সকাল দশটা দশ মিনিট
মাঝে মাঝে যখন হীনমন্যতায় ভূগি, ক্ষমতার লোভ এবং আকাঙ্ক্ষা যখন জেগে ওঠে, তখন মনে হয় সবকিছু ছেড়ে সিয়েঞ্জি ট্যাক্সির ড্রাইভার হয়ে যাই। প্রায়ই মনে হয়, ঢাকা শহরে ক্ষমতাবান একটা পেশার নাম সিয়েঞ্জির ড্রাইভার। রোদ-বৃষ্টি-মেঘলা আকাশ, শীত-গরম-বর্ষা, সকাল অফিস টাইম, দুপুরের জ্যাম, সন্ধ্যার অফিস টাইম, রাত হয়ে গেছে; সব পরিস্থিতিতে সিয়েঞ্জির ড্রাইভাররা রাজা-বাদশা। ‘যামু না’ বলার জন্য
যতোটুকু মনোযোগ দেয়া দরকার সেটুকুও দেবে না। মামা-কাকা-ভাই ডাকে লাভ নেই। বিশ টাকা বাড়িয়ে দেবো – এমন প্রস্তাবও এখন কাজ করে না। জমা নাকি ৮৫০ টাকা হয়ে গেছে, সিয়েঞ্জির দাম ডবল হয়ে গেছে, ঐদিকে জ্যাম বেশি; এসব ছুতোয় রাজারা তুচ্ছ করে দেয় যাত্রীদের। তবুও রাস্তায় দাঁড়াই, দাম হাকি। আজ ভাগ্য প্রসন্ন, বয়স্ক ড্রাইভার বিনয়ের সঙ্গে জানালেন, "শুক্রবার – ১৪ নম্বর মোড়ে চেক করে – মিটারে চলেন – বিবেকমত একটু বাড়ায়ে দিয়েন।" উঠে বসলাম, মিরপুর-বনানী।
মিরপুর তেরো নম্বর পার হতে মোবাইল ফোনে রিং। অপরিচিত নম্বর। জিজ্ঞেস করলাম – কে?
নারীকন্ঠ হ্যালো, "একটু রনিকে দেন।"
"জ্বী, কাকে চান?"
"রনিকে দেন ভাইয়া।"
"এটা রনির নম্বর না, আপনি ভুল নম্বরে কল করছেন।"
"ভুল নম্বর না, আমি আপনাকে চিনি, প্লিজ রনিকে একটু দেন।"
এবার বিরক্ত হই – "আচ্ছা আপনি কত নম্বরে ডায়াল করছেন?"
"আমি ঠিক নম্বরেই করছি, এটা আমার সীম।"
"হা হা, আপনার? শোনেন, এইটা আমার অনেক পুরানা নম্বর। আপনি নম্বর দেখে ঠিকমত ডায়াল করেন।"
"প্লিজ রনিকে দেন, নাইলে আমি গাজীপুর চলে যাবো।"
ধ্যুত বলে লাইন কেটে দিলাম।
"বিশ সেকেন্ড পরে আবার কল, প্লিজ ভাইয়া রনিকে দেন।"
"আচ্ছা, বলেন তো রনি কে, কী করে? আপনার নাম কী?"
"আমার নাম সুপ্তি।"
"সুপ্তি শোনেন, আমি ভদ্রভাবেই বলছি এটা রনির নম্বর না।"
"ও ভদ্রভাবেই তো বলবেন। ভদ্রভাবে বলার জন্যই তো গতরাতে…"
এই বাক্যে চার-পাঁচ অশ্লীল শব্দে সুপ্তি যা বললো তার মানে এই যে গতরাতে তারা ঘনিষ্ঠ সময় কাটিয়েছে, সুপ্তি তার গোপনতম ভালোবাসা প্রকাশ করেছে।
একটু ধাক্কা খেলাম, ধমক দিলাম, "শোনেন, ভুল নম্বরে ফোন করে জটিলতা বাড়াবেন না।"
সুপ্তি এবার রেগে গেল। বললো, "রনিকে বইলেন – সে কথা না বললে তার অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে, আমি গাজীপুর চলে যাবো। হু, গাজীপুর চলে যাবো।"
কন্ঠে হাল্কা কান্না ও তীব্র ক্ষোভ। নিজে থেকেই লাইন কেটে দিলো।
ভাবলাম, কে এই সুপ্তি? রনি কে? রনি ফোন ধরছে না কেন? সুপ্তি কেন বারবার ভুল নম্বরে ফোন করছে? আর সে গাজীপুর কেন যাবে? গাজীপুর গেলে রনির কী ক্ষতি হবে?
এসব যখন ভাবছিলাম, সিয়েঞ্জি কাকলী মোড়ে এসে সিগন্যালে থামে। ডানে বিজ্ঞাপনের বিলবোর্ডে তাকিয়ে থাকি। শেল্টেক বা স্টীলটেকের মডেল তরুণী, স্কার্ট পরা, হাঁটুদ্বয় দেখতে বড়ো রুক্ষ, পুরুষালী...।
সিয়েঞ্জি মিটারে বিল এসেছে চৌষট্টি টাকা, দিলাম পঁচাশি টাকা।
বিকাল চারটা চল্লিশ মিনিট
মিরপুর দশ নম্বরে কাজীপাড়া থেকে গোলচক্করের দিকে যাওয়া সব গাড়ি স্থবির হয়ে আছে। অন্য পাশে পার হতে গিয়ে দেখি অনেক নিরাপত্তা পুলিশ, পার হতে দিচ্ছে না। মাঝে রোড ডিভাইডারেও দাঁড়ানো নিষেধ। তীব্র হুইসেলে সবাইকে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে। অনুমান করলাম, ভিয়াইপি কেউ যাবে। শুনলাম প্রাইম মিনিস্টার যাবেন। আরো অপেক্ষার পরে সাঁই সাঁই করে কিছু মোটর সাইকেল এবং আরো কয়েকটা প্রাইভেট কার, জিপ, শেষে পুলিসের ভ্যান গেলে অনুমান করি তিনি চলে গেছেন। পুলিসের সংকেত পেয়ে গাড়ি চলতে শুরু করে, আমি এবং অন্যরা রাস্তা পার হয়। কেউ কেউ মাথা তুলে কাজীপাড়ার দিকে তাকিয়ে থাকে –ঐ তো একটু আগে চলে গেল!
আজ মনজুর হাসান অস্ট্রেলিয়ায় চলে যাচ্ছে। উদ্দেশ্য উচ্চশিক্ষা।
আমার কলেজ জীবনের ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদের একজন। ভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লেও, আমি মাঝে প্রবাসে কাটালেও বন্ধুত্ব অটুট আছে নিত্য যোগাযোগে, কারণ আমরা সমমনা। আজ বাসায় দেখা করতে গিয়ে, শেষে যখন বিদায় নিচ্ছিলাম, বললাম – "এ শহরের অর্ধেক খালি হয়ে গেল"। হ্যাঁ, কোনো কোনো মানুষের অনুপস্থিতি অনেক বেশি শুন্যতা সৃষ্টি করে।
সন্ধ্যা ছয়টা আটান্ন মিনিট
মতিঝিল শাপলা চত্ত্বর। শুক্রবার বলে তেমন ভীড় নেই। সোনালী ব্যাংক ভবনের সামনে সেই চেনাজানা হকারদল। অনেকদিন আগে, যখন কলেজ থেকে বাসায় ফিরতাম ১৫ নম্বর বাসে চড়ে, একটা ঘ্রাণ পেতাম নাকে, সে ঘ্রাণ আজও আছে। বাসে ওঠার আগে ভাবলাম বাদাম কিনে উঠি।
দশ টাকার বাদাম দিলো অতি সামান্য।
জিজ্ঞেস করলাম, "এত কম? ১০০ গ্রাম কত?"
বললো, "২০ টাকা।"
"এহ! এই না দু’দিন আগেও ১৪ টাকা ছিল?"
"হ, ছিল। তখন কেজি ছিল ৮০টাকা, আজ কেজি ১০৫ টাকা।"
ঠোঙা হাতে নিয়ে ডাক শুনলাম, “ঐ মিরপুর দশ, ডাইরেক্ট সিটিং, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, মিরপুর দশ চৌদ্দ, ডাইরেক্ট।“
দৌড়ে বাসে উঠলাম।
মন্তব্য
চমৎকার একখন্ড ঢাকার চিত্র। কালকে কি ঢাকামেট্রো ১৮-০২১২ আসবে?
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
আসতে পারে, আবার না-ও পারে
ভালো লাগলো। লেখার শিরোনামটা বেশ উইটি!
ধন্যবাদ!
শিরোনাম আর লেখা দুটোই
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
হ্যাঁ, কোনো কোনো মানুষের অনুপস্থিতি অনেক বেশি শুন্যতা সৃষ্টি করে ..
ভালো লাগলো দিনপঞ্জি।
ঢাকা মেট্রো এভাবেই চলে আমাদের স্থিরতায় বা ব্যস্ততায়.........
_____________________
Give Her Freedom!
আপনার এই দিনলিপি টাইপের লেখাগুলো পড়লে ক্যামন একটা ঠান্ডা অনুভূতি হয়। তীব্র গরমে ক্লাস করে ঘরে ঢুঁকেই সোঁ-সোঁ ফ্যান চালিয়ে দেবার মতন
facebook
চলুক।
সুপ্তি জানে শিমুল সচলে ল্যাখে। রনিও ল্যাখে নিশ্চয়ই। অতএব, শিমুলের মাধ্যমেই রনিকে পাকড়াও করা সম্ভব। সব বাদ দিয়ে রনিকে চিপক্কে ধরো, সুপ্তি'র গাজীপুর যাওয়ার কাহিনি বের হয়ে যাবে! সব দোষ রনি'র। আর, সুপ্তির সিম দুই বছর আগে তোমার কাছে আসলো ক্যামনে, এইটা খোলাসা করো মিয়া রনি মুখ খোলার আগেই।
পীর জঙ্গি মাজার থেকে যে রেলগাড়ির মতো লম্বা বাসগুলো গুলশানের দিকে যেতো, ঐগুলার নাম্বার জানি কতো!
শিরোনামে বাংলা বর্ণমালার একটা অক্ষর বাদ পড়ছে।
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
"পীরজঙ্গি মাজার হতে ৬ গুলশান বনানী"
লগিন করতে বাধ্য হলাম।
মতিঝিলে সোনালী ব্যাংকের হেড অফিসের সামনে বাসের অপেক্ষায় আর অনিশ্চয়তার মধ্যে কত সন্ধ্যা-রাত পেরিয়েছে সেটা স্মরণে এল। মিরপুর দশ-এগারো-বারো শোনার অপেক্ষায় সেই অধীর অপেক্ষা...
একদিন এক বিকল্প পরিবহন সহসাই এসে ডাইরেক-ডাইরেক বলে ডাকা শুরু করলে লাফিয়ে উঠে ভাবি এইতো বাসায় পৌছুতে আর কিছুক্ষণ। ফার্মগেইটের কাছে এসে তিনজন যুবক যখন সহসাই ড্রাইভারকে বলে-- এই ড্রাইভার বাসের লাইট বন্ধ কর, তখন যেন জীবনের লাইটটাই নিবু হয়ে এসেছিল। কোন এক অজানা কারণে সামনের সিগনালে যুবকেরা নেমে গেলে প্রাণটা আবার যেন ফিরে পেয়েছিলাম।
তুমি একটা লাইনেই স্মৃতির সেই দিনগুলোর কথা লিখতে বাধ্য করলে, শিমুল। এখানেই তোমার লেখার সার্থকতা।
ভালো থাকো।
মিরপুর টু মতঝিল পাক্কা দু-ঘ্নটা, কি ভয়ঙ্কর ।
এটাই ঢাকার নিত্যদিনের জীবন। ধন্যবাদ।
------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।
নিজেকেই যেন আয়নায় দেখতে পেলাম
-------------------------------------------------
ক্লাশভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেফ সমস্ত কাগজ !
আমি বাজে ছেলে, আমি লাষ্ট বেঞ্চি, আমি পারবো না !
আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
শিরোনামের আইডিয়াটা মারাত্নক লাগলো।
আর দিনলিপি সম্পর্কে কী বলবো?
(চলুক)
সুপ্তি কি আর কল করেছিল?
"কোন কোন মানুষের অনুপস্থিতি অনেক বেশি শুন্যতা সৃষ্টি করে।" - অনেক বেশি সত্যি কথা।
অনেকদিন পর সচলে ঢুকে একটা চমৎকার লেখা পড়লাম।
ধন্যবাদ।
...........................
Every Picture Tells a Story
বিডিয়ারের ডাক নাম মনে নাই তোমার? ওরে সবাই রনি বইলা ডাকে। বিডিয়ার... রনি... আইইউটি... গাজিপুর... বিষয়গুলা মিলাইতে থাকো।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
বিডিআর তাইলে সুপ্তির 'গাজীপুর যামুগা কৈলাম'- হুমকীর কারণেই সচলে ল্যাখে না!
ডালে তো কালা কিছু নাই, বরং কালার লাইগ্যা ডাইলই দেখা যায় না বাউল!
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
আপনার এই দিনপঞ্জিগুলা পড়তে সবসময়ই খুব ভালো লাগে।
বিঃদ্রঃ দুষ্টলোকদের কথায় কান্দিলাম্না!
নতুন মন্তব্য করুন