অনেক দিন ধরে পথ চলতে গিয়ে সুমনকে খুঁজছি।
২০০৯ সালে যখন প্রথম দেখা হয়, তার বয়স ৬ বছর। বাচ্চা বয়সে একটা ছেলে রিকশা চালাচ্ছে –এ বাস্তবতায় বিমর্ষ হয়েছিলাম। জিজ্ঞেস করেছলাম, “তুমি ছোটো মানুষ, তুমি টানতে পারবা?”
"চলেন, নিয়া যামু।"
পনেরো মিনিট হাঁটার পথ সেদিন সুমনের রিকশায় চড়েছিলাম। দু’পায়ে প্যাডেল নাগাল পায় না, এক পা দিয়ে চাপ মেরে শরীর অন্য পাশে হেলিয়ে অন্য পাশে প্যাডেলে ভার রাখে। বাচ্চা শরীরের পেশী ফুলে ফেঁপে উঠছে, ঘাঁড়ে ঘামাচি এবং ঘাম। পথে আলাপ করি, জিজ্ঞেস করি – কেন এত অল্প বয়সে সে রিকশা চালায়। বলে, তার ঘরে অসুস্থ বাবা, বস্তিতে থাকে, মা এক বাসায় কাজ করে। আমার দিয়ে মুখ ফিরিয়ে বলে, ‘পেটের দায়’।
আবেগপ্রবণ হয়েছিলাম। তাই জিজ্ঞেস করেছি কোথায় থাকে, ঠিকানা কী। যাত্রাস্থলে পৌঁছে বাড়তি টাকা দিয়েছিলাম। সুমন বলেছিল, ‘পারলে একটা চাকরি দিয়েন।’
বলেছিলাম, ‘চেষ্টা করে দেখবো।’
যোগাযোগের ফোন নম্বর হিসেবে তার গ্যারেজের মালিক বারেক মিস্ত্রীর ফোন নম্বর দিয়েছিল।
এখানেই প্রথম পর্ব শেষ। নিজস্ব ঝুট ঝামেলা, স্বার্থ, বেঁচে থাকার জীবনে সুমনের কথা ভুলে যাই। মোবাইলে সেভ করা ছিল ‘Suman rick barek mist’। S অদ্যাক্ষরের কাউকে ডায়াল করতে গেলেই সুমনের কথা মনে পড়তো।
কিন্তু, তার জন্য চাকরি খোঁজার সময় হয়নি।
বুড়িগঙ্গা নদীতে স্রোত বয় কিনা জানি না, তবে সময় যায়, নতুন নতুন ভবনে আমার অফিসের পাশের আকাশ ঢেকে যায়। সুমনের রিকশা চড়ে ক্যান্সার আক্রান্ত যে খালুকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলাম, বছর পেরিয়ে সেই খালুও প্রয়াত হন।
তারপর আবার একদিন ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে সুমনের সঙ্গে দেখা হয়। সন্ধ্যায় রাস্তায় আর কোনো রিকশা ছিল না। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় খেয়াল করিনি রিকশা চালক কে বা কেমন। ততদিনে বাচ্চা শরীরটা একটু বড় হয়েছে। হালকা শীত ছিল বলে তার গায়ে ঢোলা জামা ছিল। জিজ্ঞেস করি, ‘তোমার নাম সুমন?’ জানায় সে-ই সুমন। জানতে চাই, সে এখনো বারেক মিস্ত্রীর গ্যারেজের রিকশা চালায় কিনা, তার বাবা কেমন আছে। সে অবাক হয়, আমি এতসব কীভাবে জানি!
স্মরণ করিয়ে দিই, একদিন তার রিকশায় চড়েছিলাম। কিন্তু তার কিছু মনে পড়ে না। বুঝতে পারি সে খুশি হয়, তাই ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য করে, আমাকে রাস্তায় অন্য পাশে নামাতে তৎপর হয়। আমি নিষেধ করি, কিন্তু সে শোনে না। বলে - ট্রাফিক পুলিস তাকে চেনে, কিছু করবে না।
এবারও বাড়তি কিছু টাকা দিই, যদিও খুব অল্প। নিজের ভেতর একটা ভালো লাগা জেগে ওঠে এই ভেবে যে সুমন আমাকে ভুলে গেছে, আমি তাকে চাকরি দেবো – এমন কোনো আশা নিয়ে সে বসে থাকেনি। তবে, কেন জানি মনে হয়, আবার তার সঙ্গে দেখা হবে।
নাহ্! আর দেখা হয়নি গত তিন বছরে। এ শহরে মানুষ বেড়েছে, কোলাহল বেড়েছে। বাড়ছে দিনদিন। পাল্টাচ্ছে কতো কিছু। আমার হাতের পালটে যাওয়া মোবাইলে, ‘Suman rick barek mist’ নম্বরটি আর নেই।
-০২-
কয়েক বছর পরপর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট টুর্ণামেন্ট আয়োজন করে বাংলাদেশ, আর সাজগোজে সুন্দর হয়ে ওঠে মিরপুর। ভালোই লাগে। কিন্তু, খানিক বিড়ম্বনায় পড়তে হয় এলাকাবাসীদের। বিভিন্ন দিকের রাস্তা নিরপত্তার খাতিরে বন্ধ করে রাখা হয়। দুই মিনিটের পথ তখন বিশ মিনিট ঘুরে আসতে হয়। তার ওপর নিজের দল খারাপ খেললে মেজাজ চড়ে থাকে। আরো চড়ে যায় যখন দেখি গালে পাকি পতাকা মেখে অসভ্যের দল বুক উঁচু করে স্টেডিয়ামের পথে কাফেলা ধরেছে।
বাংলাদেশের বোলিং উপদেষ্টা হচ্ছে ওয়াসিম আকরাম, এমন খবর এসেছে পত্রিকায়। টিভি চ্যানেলেও দেখেছি এক বেঞ্চে উদীয়মান তাসকিনের পাশাপাশি বসে ওয়াসিম উর্দুতে শেখাচ্ছে কী করে বল গ্রিপে আনতে হয়। দেশের ক্রিকেট থেকে তাহলে পাকি-ভূত যাবে না! বাংলাদেশ ক্রিকেটে পাকি অনুপ্রবেশ মূলতঃ ক্রিকেটকে ধ্বংসই করবে, সেটা খেলার সঙ্গে রাজনীতি না মিশিয়েই বলা যায়।
-০৩-
ওয়াসিম আকরামের কথায় মনে পড়লো, এ সপ্তাহে চালু হয়েছে যমুনা টিভি। শুরুর রাতে ওয়াসিম আকরাম আর আমাদের আকরাম খান লাইভ ছিল। উপস্থাপক মানজারুল চরম ভুল এবং দূর্বল ইংরেজীতে ওয়াসিম ভাই-ভাই বলে মুখে ফেনা তুলছিল।
এখনো যেটা বুঝিনি তা হচ্ছে, এটা কি শুধু নিউজ চ্যানেল নাকি বিনোদন- নাচ গানও থাকবে? সমস্যা হচ্ছে, বেশিরভাগ চ্যানেলগুলো্র নিজস্ব কোনো বিশেষত্ব থাকছে না। অনুষ্ঠান চলা কালে চ্যানেল লোগো পালটে দিলে বোঝার উপায় নেই, কোনটা কোন চ্যানেল।
অন্য এলাকার কথা জানি না, গত মাসে মিরপুরের একাংশে স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলগুলো ওলট পালট হয়ে গেছে। বাংলাদেশের গাজী টিভি আর চ্যানেল সিক্সটিন হারিয়ে গেছে। নতুনভাবে যোগ হয়েছে কয়েকটা ARY এবং এরকম কিছু পাকি চ্যানেল।
সম্প্রতি তারেক জিয়ার ইতিহাস বিনির্মাণ বিষয়ে টক শো’র যুক্তিবাদীগোষ্ঠীদের অনেককে খুঁজে পাচ্ছি না। এ বিষয়ে আসিফ নজরুল, পিয়াস করিম, ফরহাদ মজহার, দিলারা বেগম, নুরুল কবীর কিংবা কে কী বললেন (যদি বলে থাকেন) – তার রেকর্ড রাখা দরকার। অহেতুক জিইয়ে রাখা স্বাধীনতার ঘোষক বিতর্ক, মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা ইত্যাদি নিয়ে বিষবৃক্ষ চাষ যখন ব্যর্থ হয়েছে, তখন নতুন নতুন কুতর্ক তৈরী হচ্ছে। এসবের তীব্র প্রতিবাদ দরকার। টিভি চ্যানেলগুলো এসব বিষয়ে এখনি ধরে ধরে ‘ওপিনিয়ন লিডার’দের সাক্ষাৎকার নিয়ে রাখা দরকার। নিত্য রঙ আর ভোল পালটানো মানুষদের কথার রেকর্ড রাখা দরকার। প্রশ্ন-উত্তরবিহীন প্রিন্ট মিডিয়াকে গত আধা যুগে বাংলা ব্লগ যেমন ধাক্কা দিয়েছে, তেমনি ধাক্কা দরকার ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়। নয়তো, অপপ্রচারটাই সত্য হয়ে যাবে।
সেদিন যেমন আলাপে আলাপে একজন বলছিলেন, জাতীয় সংগীত গাওয়ার পেছনে ১০০ কোটি টাকার বাজেটের ব্যাপারটি ভুল ব্যাখ্যা হয়েছে। তিনি বললেন, ৯০ কোটি টাকা মূলতঃ টি টোয়েন্টি টুর্ণামেন্টের উদ্বোধন (সেলিব্রেশন কনসার্ট), সড়ক উন্নয়ন, আর জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া; এই তিনের পেছনে খরচ করা হয়েছে। এটা যদি সত্য হয়ে থাকে, তবে সরকারের উচিত জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার পেছনে আসলেই কতো খরচ হয়েছে তা জনসমক্ষে প্রকাশ করা। নয়তো, সংখ্যাটা ১০০ কোটি টাকাই থেকে যাবে।
গতকালের আগের চারদিন ফেসবুকে, হাবিজাবি২৪ অনলাইন মিডিয়ায় যেমন ছড়ানো হচ্ছিল, ওয়ার্ল্ড রেকর্ড হয়নি, সব বৃথা। গতকালের অফিসিয়াল কানফার্মেশনের পরে তারা চুপ মেরে গেছে। কোনো ক্ষমা বা সংশোধনের বিন্দুমাত্রও দেখিনি। আসলে, উদ্দেশ্য যখন ‘অপপ্রচার’ থাকে তখন সংশোধনের আশাটাই ভুল। কারণ, এগুলো সবই ইচ্ছাকৃত। আর আমাদের ব্লগ দিয়ে ইন্টারনেট চালানো ফেসবুকাররা যা পাচ্ছে তা-ই শেয়ার দিচ্ছে, হায় হায় করছে। মিথ্যেটাই সত্য হয়ে যাচ্ছে এ জোকসের মতো, আজ শুনলাম, “এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে বলছে, শুনেছিস? রাগিনী টু এমএমএসের নায়িকার নাকি ইয়ে ভিডিও বের হয়েছে?”
-০৪-
ভালো একটি খবর হচ্ছে বিআরটিসির বাসে ওয়াই-ফাই ইন্টারনেট পাওয়া যাবে। বাসে ওঠার আগে বার কোড স্ক্যান করে নিলে ইন্টারনেট সচল হবে। কেবল ব্রাউজ করা নয়, অন্য বিআরটিসি বাসগুলো কোথায় আছে তার অবস্থান জানা যাবে। বাসের অপেক্ষায় লাইনে দাঁড়িয়ে যদি দেখতে পাই, পরের বাস কোথায় আছে, কত গতিতে এগুচ্ছে, দারুণ হবে ব্যাপারটি।
তবে যারা বাসে উঠে ইন্টারনেট ব্যবহার করবেন, জানালার পাশে বসলে সতর্ক থাকবেন। সিগন্যালে দাঁড়ানো বাসের জানালায় ছোঁ মেরে মোবাইল ছিনতাই করা এ শহরের প্রতিদিনকার ঘটনা।
মন্তব্য
বহুদিন পর ঢাকামেট্রোর দেখা মিলল...
ওয়াসিমাক্রামের খবরটা জানতাম না ভয়াবহ সংবাদ, আমার দেখামতে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সবচাইতে খারাপ সময় মহসীন কামালের কোচিং এর সময়টুকু... হুমায়ূন আজাদ কেন গোলাপ হাতে আনা পাকিদেরও বিশ্বাসের বাইরে রাখেন তা বেশ বুঝেছিলাম... বিসিবির বর্তমান চেয়ারম্যানের উপর এখন পর্যন্ত আমার আস্থা আছে, কেবল বার্তাটা সে পর্যন্ত পৌঁছলে হয়
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
-----------------------------------------------------------
আঁখি মেলে তোমার আলো, প্রথম আমার চোখ জুড়ালো
ঐ আলোতে নয়ন রেখে মুদবো নয়ন শেষে
-----------------------------------------------------------
শুধু সিগন্যালে দাঁড়ানো বাসের জানালায়?
জ্যামে আটকে থাকা গাড়ির কাচের ভেতর হাত ঢুকিয়ে মোবাইল ছিনতাই করার কাহিনি শুনলাম কাল।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
Suman rick barek mist এর কাছাকাছি একটা গল্প আমারও আছে।
একদিন সন্ধ্যায়, প্রতিদিনকার নিয়মানুযায়ীই শাহবাগে আড্ডা মারছি। আড্ডা দিতে রওনা হয়েছে আমার তৎকালীন প্রেমিকা, এবং বর্তমান স্ত্রী। হঠাৎ ওর ফোন- আমাকে বললো অবশ্যই যেন শাহবাগে যেখানে থাকার কথা, সেখানেই থাকি। গলার স্বরে মনে হলো সিরিয়াস কিছু, বার বার জিজ্ঞেস করার পরও বললো যে কোনো সমস্যা নেই। কিছুক্ষণ পর যখন আসলো, তখন দেখি রিকশাওয়ালা বেশ ছোটো একটা ছেলে। নামটা এখন আর মনে নেই, তবে এটুকু মনে আছে, উত্তরবঙ্গের মানুষ। বাবা অসুস্থ, তাই ঢাকায় রিকশা চালাতে আসা। রিকশার মালিকের নাম চান মিয়া, রায়ের বাজারে গ্যারেজ। সেই চান মিয়ার নাম্বার আমাকে সেভ করে রাখতে হলো, এবং আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হলো ছেলেটার জন্য একটা স্কুলিং এর ব্যবস্থা ঠিক করে এই চানমিয়াকে রাজি করানো। আমিও এমন অদ্ভুতসব শব্দ লিখে নাম্বারটা আমার তখনকার সেলফোনে সেইভ করেছিলাম। এরপর আরো বাকি দশটা গুরুত্বহীন কাজের মতো, এই কাজটাও আর করা হয়ে উঠেনি। মাঝে মধ্যেই ফোনবুক হাতরাতে যেয়ে যখনই নম্বরটা দেখতাম, এক ধরনের অস্বস্তি বোধ হতো। কেন হতো জানি না- ভেবে দেখি নি কখনো।
অলমিতি বিস্তারেণ
এরকম গল্প দেখি অনেকেরই আছে!
পড়ার জন্য ও মন্তব্যের জন্য সবাইকে ধন্যবাদ
ভালোই চলছে ঢাকা মেট্রো
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
কোনো এক বৃষ্টিভেজা দিনে এক একপেয়ে রিকশাচালকের রিকশায় উঠেছিলাম। খুব মন খারাপ হয়েছিল তখন।
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
কিচু ভুলে যাওয়া কথা মনে করিয়ে দিলেন ভাই। এমন একজন রিকশাচালকের কথা মনে পড়ছে। জীবন এমনই, নির্বিকার, নির্লিপ্ত, যদিও নিরুপদ্রব নয়।
ভালো লাগলো আপনার এই টুকরো টুকরো কথামালা।
ব্লগবাড়ি । ফেসবুক
অনেক দিন পরে ঢাকা মেট্রো - শিরোনাম দেখেই লাফ দিয়ে এলাম। এবার মন খারাপের উপসর্গ বেশী, কিন্তু সবই তো নির্মম বাস্তবতা!!
ঢাকা মেট্রোকে নিয়মিত রাস্তায় দেখতে চাই।
____________________________
নতুন মন্তব্য করুন