বড় মামা এসে হুটহাট করে সব আয়োজন করলেন। বাবা-মা রাজী। ছেলে নৌ-বাহিনীর অফিসার, ফ্যামিলিও ভালো। বিয়ের পর বৌসহ গভর্মেন্ট কোয়ার্টারে থাকবে। বড় মামার পকেট থেকে সুদর্শনের ছবি বাবা-মা'র হাত ঘুরে নীলুর কাছে আসে। এক পলকের ঝলকানি!মাঝে মাঝে বুঝি স্বপ্নেরা এমন করে ধরা দেয়। কৈশোরের এলোমেলো ভাবনার গোপন আকাঙ্ক্ষাগুলো সত্যি হয়ে যায়।
তখন নীলুর কেবল নিজেকে নিজের মাঝে লুকাতে ইচ্ছে করে আর কলেজ পেরুনো মনে উথাল পাথাল শিহরণ জাগে। ... সে-ই যে কবে বাসায় পুরনো ম্যাগাজিনের পেছনে নেভী সিগারেটের বিজ্ঞাপন দেখে মোহ লেগে যায়। কল্পনায় স্বপ্নের বুননগুলো রঙিন হয়ে উঠে। জাহাজের ডেকে দাড়ানো লম্বা সুদর্শন - সাদা পোশাক - মাথায় হ্যাট। পাশে আকাশী শাড়ী পরে নীলু দাড়ানো। শিরশির বাতাসে শাড়ীর আঁচল উড়ে যায়। তারপর...। নীলু জানে না - তারপর কি! দৃশ্যটা কেন জানি এখানেই থেমে যেতো, আবার শুরু হতো প্রথম থেকে - পড়ন্ত বিকেলে জাহাজের ডেক, পাশাপাশি দু'জন, বাতাসের শব্দে ভালোলাগার নীরবতা...।
বিয়ের পর মোহিত বেশ ক'বার নীলুকে নিয়ে সমুদ্্রে গিয়েছে। স্পীড বোটের তুমুল গতিতে সাদা সাদা ফেনারাশিতে অদ্ভুত ভালো লাগা। মলির জন্মের পর আর সমুদ্্র বিহারে যাওয়া হয়নি। প্রমোশন পেয়ে মোহিতেরও দায়িত্ব অনেক বেড়ে গিয়েছিল। দিন-সপ্তাহ পেরিয়ে মাসের পর মাস সমুদ্্রে। ল্যান্ডে ফিরে এলে শুধুই বিরহ যাতনার অবিরাম ফিসফাস...।
...তারপর আচমকা 29 এপ্রিল, 1991। প্রকৃতির বৈরিতার সাথে তিনদিন লড়াই করে মলিকে কোলে নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়। মোহিতের খবর কেউ জানে না, জানা যায়নি আরো অনেকের খবর। অনেকেই আর ফিরেনি, মোহিতও ফিরেনি!এতদিন পর মাঝে মাঝে নীলুর মনে হয় - কৈশোরের ভাবনাটা হয়তো এই নিষ্ঠুর পরিণামের জন্যই একটা জায়গায় এসে আঁটকে যেতো...। ঈশ্বর কেন এমন খেলা খেলে! খবরটা গতকাল টিভি নিউজে একটু করে শুনেছে নীলু। আজ সকাল থেকে পত্রিকার একটা পাতা চোখের সামনে নিয়ে বসে আছে। বারবার পড়ছে আর চোখগুলো ঝাপসা হয়ে আসছে - "আকস্মিক ঝড়ে উপকূল লন্ডভন্ড: পাঁচ হাজার জেলেসহ তিনশ' ট্রলার নিখোঁজ, 27 লাশ উদ্ধার, ফ্রিগেট নিমজ্জিত, ক্যাপ্টেন ফিরোজ কবীরের খোঁজ মেলেনি"।
নীলু টের পায় না কখন মলি কলেজ থেকে ফিরে তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। এক ঝাপটায় মায়ের হাত থেকে পেপারটা নিয়ে দূরে ছুড়ে দেয় - 'এইসব মন খারাপের খবর না পড়লে তোমার দিন কাটে না, চলো - খেতে চলো'।
নীলু ভেজা চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে।...আরো একজন মোহিত ফিরলো না!
মন্তব্য
বাস্তবতার দংশন সর্বত্র।
"মাটি খুব শান্ত, খনির ভেতর দাবদাহ"
'
=========================================
নিজেকেই নিজে চিনি না, পরকে চেনার মিছে বাহানা
দারুন লেখা।
গল্পটাকি পারিপার্শিক সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা ?
ফ্রিগেট নিমজ্জিত বা কোনো ক্যাপ্টেনের মৃত্যু , এসব তো ঘটেনি ৯১ এ
গত জানুয়ারী/ফেব্রুয়ারীতে আকষ্মিক ঝড়ে নৌবাহিনীর ফ্রিগেট ডুবে গিয়েছিল। নিখোঁজ ক্যাপ্টেন ফিরোজ কবীরকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। সে সময়ে গল্পটা লিখেছিলাম সামহয়্যারে। @ অতিথি। (অতিথির কমেন্ট কেনো জানি অন্যরকম ভালো লাগে )
পুরনো লেখা পড়ার জন্য মৃন্ময় আহমেদকে ধন্যবাদ।
ডাংকে
ঘটনাটা পড়েছি। অনেক দূঃখজনক ও কষ্টের। ওই সময় অনেক জেলে নৌকাও কিন্তু ডুবে গিয়েছিলো এবং অসংখ্য জেলে সমুদ্রে হারিয়ে গিয়েছিলো যদিও তাদের জন্য কোনো রেসকিউ মিশন বের হয়নি। নিজের দেশেই তার হরিজন বলে কথা।
যাই হোক, ওই ভদ্রলোক একজন লেফট্যান্ট কমান্ডার ছিলেন , ক্যাপ্টেন না এবং জাহাজটা ফ্রিগেট ছিলো না, ছিলো কোস্টাল পেট্রোল বোট।
গল্পে বস্তবতার সমন্বয় ঘটানোই কৃতিত্ব ।
মোহিতকে ঘিরে যারা বেঁচে থাকে, তাদের জন্য খুব খারাপ লাগে।
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
ব্লগস্পট ব্লগ...ফেসবুক
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
তারা দিলাম বটে কিন্তু মনটা খারাপ হয়ে গেলো। আমি আসলে কেমন যেনো পরাজিত টাইপের মানুষ। কঠিন সত্যের মুখোমুখী হতে ভয় পাই। অথচ এইই আমাদের বাস্তবতা।
তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে
*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়
Nice story based on very hard truth. Keep it up.
পড়ে খারাপ লাগলো।
-------------------------------------
হাত বাঁধা, কিন্তু দড়ি মুক্ত - হায় পৃথিবী!
-------------------------------------
হাত বাঁধা, কিন্তু দড়ি মুক্ত - হায় পৃথিবী!
এই লেখাটাও মিস করছিলাম দেখি!
_________________________________________
ৎ
_________________________________________
ওরে! কত কথা বলে রে!
আপনার গদ্য পড়তে অন্যরকম ভাল লাগে
ভালো লাগলো।
------------------------------------------------------------
কবিকণ্ঠ্যহার বিদ্যাপতি
মন খারাপ করা লেখা। কত রকমের যে কষ্ট থাকে তার কোনো হিসেব নেই।
নতুন মন্তব্য করুন