এখনো বেশ মনে পড়ে। বাংলা বইয়ের বাম পাশের কোন এক পৃষ্ঠায় ছিল কবিতাটি। কবিতা নাকি ছড়া? জানি না। ভাবিনি কখনো। কী দরকার কবিতা নাকি ছড়া তা ভেবে সময় কাটানোর! ভীষণ আনন্দে শব্দ করে পড়ার পাশাপাশি বিষ্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম ছবিটির দিকে। কী চমৎকার ছবি। বিশাল লম্বা একটি তালগাছ। পেছনে গ্রাম। ঘরবাড়ী। তালগাছের নিচে এক পায়ে একটি সাদা বক দাড়ানো। বকটি উচ্চতায় তালগাছের প্রায় অর্ধেক! বক এতো বড় হয়? নাহ্! এসব জটিল ভাবনা আসতো না মনে। ক্লাস ওয়ানে সবাই শব্দ করে পড়তাম-"ঐ দেখা যায় তাল গাছঐ আমাদের গাঁঐখানেতে বাস করেকানা বগীর ছা।ও বগী তুই খাস কি?পানতা ভাত চাস কি?পানতা আমি খাই নাপুঁটি মাছ পাই না,একটা যদি পাই, অমনি ধরে - ঘাপুস ঘুপুস খাই।"গত কয়েক দশক ধরে কবিতাটি ক্লাস ওয়ানে পাঠ্য। আমাদের সময়ের স্যারেরা খুব জটিল মনের ছিলেন না বোধ হয়। পরীক্ষায় সহজ প্রশ্ন করতেন - 'যে কোন কবিতার প্রথম চার লাইন লিখ'। মনে মনে আবৃতি করতে করতে পরীক্ষার খাতায় লিখে দিতাম গোটা গোটা অক্ষরে। বানান ভুল না হলে দশে দশ পাওয়া যেতো।এখন সময়টা হয়তো খুব জটিল। বছর তিনেক আগে ঢাকার এক নামকরা স্কুলে ক্লাস ওয়ানের পরীক্ষায় প্রশ্ন করা হয়েছিল - "কানা বগীর ছা কোথায় বাস করে?"আহারে! ক্লাস ওয়ানের দেবশিশুরা কী কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীনই না হয়েছিল! কেউ লিখলো - কানা বগীর ছা আমাদের গাঁয়ে বাস করে। কেউ লিখলো - তাল গাছের নিচে বাস করে। কেউ লিখলো - তাল গাছের উপরে বাস করে। কেউ বা বুদ্ধি খাটিয়ে লিখলো - কানা বগীর ছা আমাদের গাঁয়ের তাল গাছের নিচে বাস করে। ক্লাসের সবচেয়ে অমনোযোগী ছাত্রটি লিখেছিল - কানা বগীর ছা ঐখানেতে বাস করে।জটিল সময়ের জটিল টিচারের জটিল প্রশ্নের জটিল উত্তর। অথবা স্মার্ট আনসার! পরীক্ষায় কোন উত্তরটিকে সঠিক ধরা হয়েছিল তা আর জানা হয়নি।প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তর জানা নেই:বলা নেই- কওয়া নেই, আমরা হঠাৎ করে প্রথম হয়ে গেলাম। পত্রিকাগুলো খুব ফলাও করে প্রকাশ করলো। তখন ছিল আমাদের 'জিম্মাদার' পরিবর্তনের সিজন । বিরাট এক ইস্যু। 'তাঁদের' চেয়ার পরিবর্তন হলো। হৈ চৈ হলো - শ্বেতপত্র বের হবে, এই হবে - ঐ হবে। ...বছর ঘুরলো। কিন্তু 'তাঁদের' লুটপাটের খেলার শিরোপাটা আমাদেরই রইলো। একবার, দুইবার, তিনবার। হ্যাট্রিক হলো। রাজপথের 'সংগ্রামী'রা আওয়াজ দিলো - দূর্নীতিবাজ সরকারে পতন চাই। চেয়ারে বসা মুরুবি্বরা ধমক দিলেন। দেশ দ্্রোহীতার মামলা হবে। হাইকোর্টও দেখানো হলো। তবুও থামাথামি নেই। পরপর পাঁচবার আমরা চ্যাম্পিয়ান। গতবার অবশ্য 'চান' মিয়া আমাদের সাথে যৌথভাবে প্রথম হয়েছিল। কিন্তু এবার আমরা থার্ড হয়ে গেলাম। 'হাতি' ফার্স্ট হলো। কেউ কেউ বলছে - আমাদের পারফরম্যান্স খারাপ না, অন্য দেশগুলো আমাদের এ পদক ছিনিয়ে নেয়ার জন্য অনেক সাধনা করেছে, শ্রম দিয়েছে। ইরাকে রিলিফ নিয়ে 'মেজবান' হয়েছে, সুদানে ডায়মন্ড পাচার হয়েছে। তাহলে আমাদের কী হবে? আমাদের কি বসে থাকা মানায়? ভাবনা নেই, আমাদের বসে থাকা লাগবে না... "তুমি ভালোবাসো কি-না তা আমি জানি না, আমার কর্ম আমি করিয়া রে যাবো..." - থিয়রী ফলো করে আমাদের কালো গাউন পরা 'বিবেক'রা গতকাল একটি আদেশ কার্যকর করিয়েছেন। তিন মাস মেয়াদী এই রক্ষণাবেক্ষণকারীর আমলে দূর্নীতি দমন কমিশনে কোন তদন্ত হবে না, অনেক কর্মকর্তাকে সাময়িক বিরতি দেয়া হয়েছে। ভোটের পর 5 বছরের জন্য দেশকে নতুনভাবে লীজ নেয়ার পর সব চালু হবে আবার। দূর্নীতি দমন কমিশন চালু হবে, ব্যবসা বাণিজ্যের কমিশনও চালু হবে। চ্যাম্পিয়ান না হলেও মেরিট লিস্টে থাকতে হবে সবসময়।'ঐখানেতে' বাস করা 'কানা বগীর ছা'-রা ঘাপুস ঘুপুস করে সব খেয়ে যাবে অবিরাম...। আর শিরোপাটা আমাদের হাতেই তুলে দিবেন 'তাঁরা'।
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন