এ গ্রহের সবচেয়ে বড় কারাগারের খবর পেয়েছিলাম আগেই। কিন্তু এবার যখন 'কয়েদী' পড়া শুরু করলাম তখন ক্রমান্বয়ে তিন পাশে গজিয়ে উঠে অক্ষমতার দেয়াল আর অন্যপাশে বাধা দেয় কষ্ট ও ক্ষোভের কপাট। গৌরবময় ইতিহাসের সবুজ শ্যামল বাংলাদেশ যখন হরতাল নামক দানবের হিংস্র ছোবলের শিকার তখন নিষ্ঠুরভাবে দেশটির 14 কোটি মানুষ বন্দী হয় অদ্ভুত এক কারাগারে। এ কারাগারের পাঁচটি সেলের গল্প উঠে এসেছে আমাদের ব্লগার শুভ'র 'কয়েদী' উপন্যাসে।
প্রথম সেলে আমরা দেখি - গার্মেন্টস মালিক জামিল আহমেদ এবং তার জাপানীজ বায়ার রিউনোসুকে আকুতাগাওয়ার গল্প। টানা অসহযোগ আন্দোলনের ফাঁদে ফ্যাক্টরী বন্ধ, শ্রমিকদের জীবন অনিশ্চিত। বৈরী পরিস্থিতিতে তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে বাংলাদেশ ছাড়ে আকুতাগাওয়া। জামিল আহমেদ হারায় প্রসপেক্টিভ বিজনেস ডিল। তবে আকুতাগাওয়ার রেখে যাওয়া চিঠি ছুঁড়ে দেয় অনেকগুলো প্রশ্ন। দেশপ্রেমের অসহায় বোধ প্রকট হয়ে উঠে।
দ্্বিতীয় সেলে রয়েছে - মরণাপন্ন মায়ের মুখ শেষবারের মতো না দেখার যন্ত্রণায় সন্তানের করূণ কান্না। অসুস্থ মা'কে ঢাকা দেখতে যাওয়ার পথে সাকিবের ট্রেন আঁটকা পড়ে আখাউড়া জংশনে। বৌ-বাচ্চা নিয়ে সাতদিন বন্দী থাকে রেলের কামরায়। কয়েদী জীবনের উপায়হীন হাহাকার তখন কেবলই শুন্যে প্রকম্পিত হয়।
তবুও কয়েদী জীবন উপভোগ করে কেউ কেউ। তৃতীয় সেলে আমরা দেখি - হরতালের অখন্ড অবসরে একজন লেখক আনমনে লিখে যাচ্ছেন। দেশের ক্ষতি তাকে ভাবাচ্ছে না। 'পাঠক খাওয়ানো' রাজনৈতিক উপন্যাস লিখতে ব্যস্ত তিনি। ...এ অংশে 'কয়েদী'-র পাঠক খানিকটা খেই হারাতে পারে। তবে একটু ধৈর্য্য নিয়ে পরের সেলে তাকাতেই চোখে পড়বে - হরতাল দানবের আরেকটি কুৎসিত আঁচড়; অফিসগামী শহীদ সাহেবকে বিবস্ত্র করছে সন্তান-বয়েসী পিকেটাররা। মিরর অব দ্য সোসাইটির অভিজ্ঞ রাঁধুনির ক্যামেরা তখন ক্লিক ক্লিক ছবি তুলে যায়। এটুকু পড়ে পাঠক বিবেক কুঁকড়ে যায় অক্ষমতার যাতনায়। অনেকগুলো তীর এসে মূল্যবোধের ঘরে হানা দেয়।
উপন্যাসের শেষ অংশে আমরা দেখি - অসুস্থ দশ মাসের শিশুকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা নিয়ে যাচ্ছে শাহেদ-ফারা দম্পতি। তিন ঘন্টার রাস্তায় মোড়ে মোড়ে হাত-পা ছড়িয়ে বসে থাকে হরতাল দানব। দানবের মেদ জমা শরীরের ফাঁক-ফোকর পেরিয়ে খানিকটা এগুলেও গন্তব্যে পৌঁছা যায় না। ...পিকেটাররা উৎসব করে ভাঙছে শাহেদের গাড়ী!
'কয়েদী' পড়ে প্রথমে মনে হতে পারে ঘটনাগুলো সম্পর্কহীন-বিক্ষিপ্ত। অমনটিই স্বাভাবিক। কয়েদখানার সেলগুলোয় পাশাপাশি থেকেও কোন যোগসূত্র স্থাপিত হয় না, অথচ খুব কাছাকাছি অবস্থান সবার। ঠিক তেমনি জামিল আহমেদ, সাকিব, লেখক, শহীদ সাহেব কিংবা শাহেদ - এরা আমাদেরই আশেপাশের মানুষ। হয়তো তাদের পাশের সেলে বাস করছি আমি-আপনি এবং আমরা। হরতাল প্রেক্ষিতে আমাদের এক একটি নিজস্ব গল্প পূরণ করে দেয় 'কয়েদী' কাহিনীর শুন্যতাগুলো!
'কয়েদী' সম্ভবত: বাংলাদেশে হরতাল নিয়ে লেখা একমাত্র উপন্যাস। বিবেক নাড়া দেয়া বইটি প্রকাশ করেছে জাগৃতি প্রকাশনী, 33 আজিজ সুপার মার্কেট, ঢাকা।
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন