পকেট খানিকটা ভারী থাকায় আজ সন্ধ্যায় কাঁচ ঘেরা তাপ নিয়ন্ত্রিত দোকানে বসি। প্রচন্ড খিদে নিয়ে গপাগপ কামড় দিই, মুরগীর বুক - রান। গলায় আঁটকে গেলে কোমল পানীয়ে চুমুক। ঝাঁঝে হয়তো চোখে পানি এসে যায়, তারপর - আলুর ফরাসী ভাজা; মরিচ টমেটোর সচে মাখিয়ে নিই। এ সময়টায় বারবার মিরপুর এসে আমার মনে হানা দেয়। আমার প্রিয় শহর, ভালোবাসার শহর, স্মৃতির শহর। বন্ধুত্বের শহর। দশ নম্বর গোল চক্করের গ্রামীণ রেস্তঁরা, চার টাকা দামের বড় বড় সিংগাড়া। তেতুলের সচ, সাথে শষা পিঁয়াজের সালাদ। ঘন্টা ধরে আড্ডা, গুটিকয় বন্ধু, প্রেম-অপ্রেমের সংকটে কারো উদ্ভ্রান্ত মন। অথবা আরেকটু দূরে একটু ঘষামাজা করে জমিয়ে উঠা পূর্ণিমা রেস্টুরেন্ট, তেল ছাড়া পরোটা, স্পেশাল চা - চিনি কম, দুধ বেশী। মাঝে মাঝে বাজারের মাঝখানে অদ্ভুত রহস্যময় চেহারার গম্ভীর চা দোকানদার, ঘন দুধের সর উঠা গরম চা। রিকশা ভাড়া বাঁচিয়ে দুটাকার বাদাম কিনে খেয়ে খেয়ে ঘরে ফেরা। এসব স্মৃতির হানাহানিতে টের পাই না কখন পাশের টেবিলের কিশোর কিশোরীগুলো উঠে গেছে। এসে বসেছে মধ্য বয়সের এক বাবা, সাথে তার দুই ছেলে মেয়ে। নিজের প্লেট থেকে, আমি আড়চোখে দেখি, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই তুলে দিচ্ছে ছেলের প্লেটে। অর্ধেক গ্লাস স্প্রাইট মেয়ের গ্লাসে।
আমার মা সেদিন ফোনে বলছিলো - 'তোর ওখানে কি বুট-পিঁয়াজো পাওয়া যায়? বেগুনি?'
আমি হাসি। বলা হয় না - 'আমার ভীষণ হালিম খেতে ইচ্ছে করছে আজ।'
সামনের টেবিলে দু'জন এসে বসেছে তখন। বাবার বয়েসী শ্বেতাঙ্গ পুরুষ, সাথে প্রাক যৌবনা থাই কিশোরী। লোকটি বাবা নয়, কিশোরীটি মেয়ে নয়। কেউ প্রেমিক নয়, প্রেমিকা নয়। ভোক্তাপ্রধান সমাজে ওরা কেবলই ক্রেতা বিক্রেতা। এ সন্ধ্যায় ভালোবাসার নামে তারা নিরাপত্তা অথবা বিশ্বাস কেনার অভিনয় করছে। রোদে পোড়া খসখসে চামড়ার সাদা লোকটি তখন খুব কুৎসিতভাবে মেয়েটির গলায় ঘ্যাঁসঘ্য্যঁস শব্দে আদর করছে।
সিঁড়ি বেয়ে সুপার স্টোরে ঢুকি। গেটে দেখলাম - চার ভারতীয়কে আঁটকে দেয়া হয়েছে। সিক্যুরিটি এক এক করে বিল আর সওদা মেলাচ্ছে। এটা প্রায়ই চোখে পড়ে। দক্ষিণ এশীয় চেহারার প্রতি কিছু থাই হারামজাদার অহেতুক সন্দেহ আছে। তাদের কাছে ইউরোপ-অ্যামেরিকার সাদা চামড়ার লোক মানে ঈশ্বর, পকেট ভর্তি ডলার কিংবা দু'তিনটি ক্রেডিট কার্ড। দেদারসে কিনে নেয় - পন্য ও সেবা। অন্যদিকে কালো চেহারার লোকগুলো যেন শপিং সেন্টারে ঢুকে উইন্ডো শপিং কিংবা চুরির জন্য। আজ ভারতীয়গুলো খানিকটা ভড়কে গেছে। পাশ কাটিয়ে আমি ভেতরে যাই। সারি সারি দোকান। কিডস কর্নারে একটি বাচ্চা বায়না ধরেছে খেলনা গাড়ী কিনবে, মা'টি বাচ্চাকে শান্ত করতে পারছে না। আমি হাঁটতে হাঁটতে এপাশ থেকে ওপাশে যাই। আসলে কোথাও যাবার নেই, কিচ্ছু করার নেই। তাই অহেতূক চলা। আচমকা টের পাই আমি ভিক্টোরিয়া'স সিক্রেট বিভাগে! হায় হায়, এলাম কই? দড়ি ছেড়া গরুর মতো ঢু মেরে জুতার শেলভের সামনে যাই। আরেকটু পরে - এক ষাটোর্ধ প্রেমিক ঝাড়ু কিনছে, সাথে অন্তসত্বা তরুণী প্রেমিকা। ট্রলিতে ডিটারজেন্ট পাউডার, নুডুলস, চাল, সবজি, মিস্টার বীনের থাই সিডি। দুজনের মুখ হাসি খুশি। মেয়েটি ভাবছে - এ অনেক সুখের জীবন, আর্থিক নিরাপত্তার চেয়ে বড় কিছু নেই। ধুসর চোখে বৃদ্ধ ভাবছে - শুধু শুধু জীবনের আসল সময়টা বরফের দেশে কাটিয়ে দিলাম, এমন কেয়ারিং বউ ইউরোপে কোথায়! থাই প্রেমিকাটিকে আপাত: ঈভ মনে হয়, সে অ্যাডাম। নিষিদ্ধ আপেল বলে কিছু নেই। ইস, কেনো আরো আগে দেখা হলো না দু'জনার! সুখী পরিবারের দৃশ্য থেকে আমি চোখ সরাই। ওরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মিলে না।
বাইরে এসে দেখি বৃষ্টি ভেজা পথ। তখনো থামেনি, বিরক্তিকর গুড়িগুড়ি বৃষ্টি। টেম্পোর জন্য রাস্তায় দাঁড়াই। বৃষ্টি বাড়ছে। লাইনের টেম্পো আসলে আমি উঠে বসি। আরো তিনটি সীট খালি। আরো তিন জনের জন্য অপেক্ষা। পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট, পনের মিনিট। কেউ আসে না। বাকী সহযাত্রীরা চুপচাপ, কারো কোনো তাড়া নেই, অথচ আমার ভেতরে ভীষণ তাড়া। এ এক বিরক্তিকর অপেক্ষা। বৃষ্টি বেড়েই চলেছে। হঠাৎ ঝলক মেরে দুই রমণী গাড়ীতে উঠে। দু;জনই পুতিন মামার ভাগ্নী, রাসপুটিনের পাশের ফ্লাটে থাকতো একসময়। তুলনামূলক তরুণীটি আমার পাশে বসে। হাতে ম্যাপ। কী যেনো জিজ্ঞেস করলো। আইপডের প্লাগ সরিয়ে মনোযোগ দিই। রূপবতীর ডাক অগ্রাহ্য করলে রূপের অভিশাপ লাগে, কোথায় পড়েছিলাম (!), সেই অভিশাপের আগুন মারাত্মক। তাই আমি আলাপী হই। প্রশ্নের জবাবে জানাই - তরুণীর ধারণা ভুল, আমি মালয়েশিয়ান কিংবা ইন্দোনেশিয়ান নই। ম্যাপ ধরে আমি তাকে বুঝাই - এটা সুকুমভিত রোড, আমরা আছি সিটি হলের সামনে, বামে গেলে নর্থ, ডানে গেলে বীচ রোড ধরে সাউথ। বাইরে তখন ঝমঝম বৃষ্টি। আচমকা হাঁটু পানির জলদস্যুর কথা মনে পড়ে। জার্মানী থেকে কোনোভাবে এ দৃশ্য কল্পনা করলেই তার হানা দেয়ার সম্ভবনা ছিল। আমার কেন জানি মনে হয়, বৃষ্টি না থামুক, বাকীজন না আসুক, টেম্পো না চলুক। আমি ভুগোলের মাস্টার হয়ে শহরের পথ ঘাট চেনাই অনেকক্ষণ। এসময় তরুণীদ্বয় কী কী আলাপ করে নিজেদের মাঝে। চট করে বলে "আমরা সাউথে যাবো, ভুল গাড়ীতে উঠেছি" - দু;জনই নেমে পড়ে। তিন সীট খালী রেখেই টেম্পো তখন চলতে শুরু করেছে। আইপডে শ্রীকান্ত বৃষ্টি ঝরে, ঝরে মধুর দানায় - - -।
বৃষ্টি ভেজা কালো পিচের রাস্তা তখন সোডিয়াম আলোয় চিকচিক। আমার মনে হয় - ঘরে ফেরার তাড়া নেই কোনো। ইচ্ছে করে এ ঝমঝম বৃষ্টিতে হাঁটি অনেক পথ।
মন্তব্য
"
এক ফোঁটা দুই ফোঁটা জল পড়ে।
আমি একা রাস্তায় দৌড়ুই -অক্ষছেড়া নদীর তীর ঘেঁষে। একটা সম্বিতহীন মানুষ - সম্ভবত মদ্যপ। নির্বিকার আমি পাশ কাটিয়ে যাই। কানে বাজে শিমুল নামের কারও পাঠানো গান - কমলো মেঘেদের ওজন - বৃষ্টি বলে প্রয়োজন তাকে.. যে খোঁজে আমাকে..
বৃষ্টি জোড়ে নেমে আসে।
পিথিমীটা আজকাল সহজে ভিজে যায়, ভিজতেই থাকে অবিরাম, মাঝে মাঝে মনে হয় - ভেসে যাবে সব।
সব। আমার অতীত অথবা বর্তমান কিংবা আমি নিজেই। অথবা আমার শেঁকড়।
ধ্যাত্তেরিকা, কীসব আবোল তাবোল বলি। মনেই থাকে না আমার শেঁকড় নেই। শেঁকড় থাকতে হয় না এইসব জীবনে।"
পঁচা একটা লেখা।
শিমুলটাও আজকাল মন খারাপ করে দেয়।
আমি ও আমার স্বপ্নেরা লুকোচুরি খেলি
আবার লিখবো হয়তো কোন দিন
আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, কোনো মানুষ ইউনিক না। সে যা করে, যা ভাবে - তা কোথাও না কোথাও অন্য কেউ করছে, ভাবছে। একই সময়ে। দূরত্বের কারণে জানা হচ্ছে না কেবল। কোন একটা থিয়রী যেমন প্রজাপতির ডানার ঝাপটানিতে নক্ষত্রের ঝরে পড়ার কথা বলে সেরকম ব্যাপার। আমরা জানি না। তবে ঘটে।
আপনি যে মফস্বল শহরে থাকেন, ওখানে বাদাম পাওয়া যায়?
কেন যাবে না?
চলে আসুন একদিন, বাদামের নেমন্তন্ন রইলো।
আবার লিখবো হয়তো কোন দিন
আজকে এখানেও খুব বৃষ্টি হল। আমারো মনটা খারাপ হয়ে গেল কোন কারণ ছাড়াই। মনে হল, আমার বাড়ি কই? এদিকে একজনের কাছে থাকি তো ওদিকে আরো কতজন ছেড়ে আসতে হয়।
তোমার মত আমারো মাঝেমাঝে মনে হয় মানুষ ইউনিক না। একই সময়ে যেমন হয়তো অন্যখানে কেউ একই ভাবনায় মগ্ন, তেমনি মনে হয় অনেককাল আগে থেকেও এরকম ভাবনা ভেবে গেছে অনেকেই। বিশেষ করে হঠাৎ হঠাৎ যখন কোন পুরনো গান শুনি বা লেখা পড়ি আর দেখি আমার তখনকার ভাবের সাথে সেটা মিলে যায় - তখন আর এ বিষয়ে সন্দেহও থাকে না। আসলেই আমরা কেউই সেভাবে ইউনিক নই।
লেখাটা খুব সুন্দর হয়েছে। মন ছুঁয়ে গেল।
ভাল আছি, ভাল থেকো।
ভাল আছি, ভাল থেকো।
খালি দীর্ঘশ্বাস।
×××××××××××××××××××××××××××××××××××××××××××
পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?
পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?
অযুত নিযুত ধন্যবাদ, পড়ার জন্য @ রেজওয়ান ভাই।
সুকুমভিত আইলো কোথা থেকে ?আপনি না পাতায়া থাকতেন ? নাকি ব্যন্কক চলে এসেছেন ?
হা হা। এইটা আসলেই গন্ডগোলের ব্যাপার। সুকুমভিত রোডটা ১৯০ কিলোমিটারের মতো। ব্যাংককের সুকুমভিত এলাকা থেকে শুরু হয়ে পাতায়া ছুঁয়ে চুনবুরি প্রভিন্সে শেষ হয়েছে। এমন কি আমার যে ঠিকানা ওটাও ৩০১ সুকুমভিত রোড।
বুঝছি, ৫০ ময়মনসিংহ রোড মানে হইলো বাংলামোটরে ভোরের কাগজের অফিস।ময়মনসিংহের ধারে কাছেও যেটা নাই।
আবার লিখবো হয়তো কোন দিন
দিমু নাকি আপনার দিন ধরে টান?
কি মাঝি? ডরাইলা?
- মুরগীর বুক, রান কামড়ানোর অনুভূতির মতোই দোলা দিলো লেখাটা।
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
এক সন্ধ্যার প্রশ্নমালা!
এরকম সন্ধ্যায় অঞ্জন দত্ত'র গানের এই লাইনটা বড়ো বেশী বুকে বাজে- ঘর ফেরা হয়না আমার ঘর, জানা হয়না মনের মানুষটা কে?
-----------------------------------
মানুষ এখনো বালক,এখনো কেবলি সম্ভাবনা
ফুরোয়নি তার আয়ু
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
লেখা বেশ ভাল লাগলো। মিরপুরের কোথায় থাকতেন? আমি এক কালের পল্লবীবাসী।
সৌরভ : ওকে, বাদাম খাওয়ার দাওয়াত সানন্দে গ্রহণ করা হলো।
মাশীদা'পু: আমার বাড়ী কই? এটা মন খারাপে ভর করে বেশী। থ্যাংকস!
আরিফ ভাই: দূর্দান্ত উদাহরণ! জব্বর!!!
ইমরুল হাসান: আপনার ভালো লেগেছে জেনে ভালো লাগলো।
দ্রোহী: ভাবছি, চলমান গল্পের পোস্ট শুরু করবো। আপনি সাহস দিলে ভাবতে পারি। আর আপনি যদি শুরু করেন, আমি টান দেবো, কনফার্ম। অন্য এক বৈঠকে আলাপ হচ্ছিলো আপনি নাকি দোকা এখন? ক্যাম্নেকী? এক জায়গায় আপনেরে মিস করতেছি। সাথে পাইলে ভালো লাগতো।
ধুসর গোধুলি: জ্বর থেকে উঠার পরে মুখ তেতো থাকার কথা। এখন কি অবস্থা?
মোরশেদ ভাই: ঠিক। বারবার ফিরে ফিরে আসে। হয়তো, প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তর জানা নেই!
ইশতিয়াক রউফ: । স্টেডিয়ামের অপোজিটে। হয়তো দেখা হয়েছিলো কখনো!
সবাইকে ধন্যবাদ।
দেশে থেকেও বিবাগী এই আমরা। প্রেম বা দেশপ্রেম দুটোই এখন অনেক দূরে। অনুভূতি ভোতা হয়ে গেছে। লেখাটি পড়ে মনে পড়ে গেল আমার চেনাপথে অনেকদিন মাড়ানো হয় না।
আমার ভালো লাগাগুলো কেন জানি এই লেখার প্রতিটি লাইনে এসে মিলেছে।
লেখাটি খুবই ভালো হয়েছে। ধন্যবাদ।
রক্তে নেবো প্রতিশোধ...
নারে ভাই, দেশপ্রেমের পোস্ট না। এমনিতেই স্মৃতিচারণ টাইপ লেখা।
ধন্যবাদ।
ইচ্ছে করে এ ঝমঝম বৃষ্টিতে হাঁটি অনেক পথ...
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
ব্যাক্তিগত ব্লগ | আমার ছবিঘর
ইচ্ছে পূরণ হয়?
ইসস্ এই লেখাটা মিস করেছিলাম!!
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
ধন্যবাদ।
ইশ! এতো সুন্দর লেখাটা আগে কেন মিস করলাম
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
এটা খুঁজে পেলেন কীভাবে!
কৃতজ্ঞতা, প্রিয় রানা মেহের...
আনেকদিন পর লেখাটা খুজে পেলাম
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
নতুন মন্তব্য করুন