চিঠি

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি
লিখেছেন আনোয়ার সাদাত শিমুল (তারিখ: বিষ্যুদ, ১১/১০/২০০৭ - ৫:৫৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কলেজে পড়ার সময় ঢাকায় বিচ্ছিন্ন জীবন আমার। হঠাৎ মনে হলো - সবাইকে ছেড়ে এ কোথায় এলাম! সন্ধ্যা হলেই মন খারাপ। এক কিশোরের হু হু চাপা কান্না মুয়াজ্জিনের সান্ধ্য আজানের সাথে মিশে যায়। এভাবে দিন যায়। তারপর একদিন বাসার সবার কাছে, স্কুলের বন্ধুদের কাছে চিঠি লেখা শুরু করলাম। বিশাল বিশাল চিঠি; কোন ক্লাসে কি হলো, কোন স্যার কি রকম, বাসে কোনদিন কোন লোক কি কি ঝগড়া করলো এসব। মাস কয়েক পরে মনে হলো, এটার চেয়ে বড় কোনো থেরাপী নেই। পরীক্ষার আগের রাতে বই খোলার আগে চিঠি লিখি, মন ভালো হয়ে যায়। ভীষণ অভিমানী কিছু চিঠি লেখার পর মনে হয়েছে - পোস্ট না করি, থাক। আর পোস্ট করা হয়নি, অথচ মন খারাপটা কেটে গেছে।

ধীরে ধীরে মোবাইল এলো। কমলো চিঠি লেখা। বিশ্ব ডাক দিবসের স্লোগান হলো - 'চিঠি লিখুন, চিঠি স্থায়ী'। আমারও চিঠি লেখার অভ্যাস কমে গেলো। দু'য়েকবার যা-ও লিখতে হয়েছে ভীষণ ক্লান্তিময় চেষ্টা। দু'টাকার হলুদ খাম তখন কেবলই স্মৃতিময়তা। মিরপুর পোস্ট অফিসের বিবর্ণ দালানে যাওয়া হয় না তেমন। চাকরীর আবেদনে অনলাইন কার্যকলাপ। চিঠি লেখার দিনগুলো ক্রমান্বয়ে ধুসর হয়ে উঠে।

চিঠি লিখে উত্তর পাবো সেটা খুব বেশী হয়তো প্রত্যাশা করতাম না। তাই ফিরতি পত্র পেলে আনন্দের সীমা থাকতো না। স্কুল জীবনে টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে রেডিও অনুষ্ঠানে চিঠি লিখেছি অনেক। সম্ভবত: সবচে' বেশী চিঠি বাংলাদেশ বেতার, ১২১ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউতেই লিখেছি, এর আগে ১৫ নিউ বেইলী রোডে, তখনকার রেডিও বাংলাদেশ। প্রভাতী অনুষ্ঠান মহানগর, ম্যাগাজিন দর্পন, উত্তরণ। বিভিন্ন রকম সংগীতমালা। চিঠি পত্রের অনুষ্ঠান বিনিময়। একদিন হঠাৎ আমার ঠিকানায় এলো - বিজ্ঞাপন কন্ঠ নাজমুল হুসাইনের চিঠি। কী আনন্দের বিকেলই না ছিল সেদিন! পত্রিকায় 'শব্দজব্দ'এর ঠিকানা দেখে চিঠি লিখেছে বেশ কয়েকজন। কয়েক বালিকা প্রেম করার উদাত্ত আহ্বান নিয়েও চিঠি লিখেছিলো। বাসার সবাই হাসাহাসি। আর আমার সদ্য কৈশোরের অনভ্যস্ত লজ্জা। ডয়েচে ভেলে, ভয়েস অব অ্যামেরিকার মিতালী আর বিবিসির প্রীতিভাজনেষু-তেও চিঠি লিখতাম। সব চিঠির জবাব না পেলেও বছরের শুরুতে ক্যালেন্ডার, ভিউকার্ড, শুভেচ্ছাপত্রগুলো জমিয়ে রাখতাম যত্ন করে। এখনো দেশে গেলে ড্রয়ার খুলে পুরনো ফাইল বের করি। আলতো করে হাত বুলাই। ফিরে আসে পুরনো দিনের ঘ্রাণ।

বিদেশে আসার পর প্রথম দিকে খুব মেইল পেতাম। বন্ধু-স্বজনদের ই-পত্রে মেইল বক্স ভরপুর। তারপর ধীরে ধীরে ব্যস্ততা জীবনকে গ্রাস করে। ইনবক্সটা ফাঁপা হয়ে ওঠে। কখনো বা কর্পোরেট আদলে দুয়েকটা থ্যাংকস গিভিং মেইল, স্পেশাল ডে, জাস্ট টু কীপ ইন টাচ, পাবলিক রিলেশনের পারসোনালাইজেশন। গত বছর একদিন রুমে ঢুকেই চিঠি পেলাম, সাদা খাম - আগামী মাস থেকে বাসা ভাড়া বাড়ানো হলো। হায়রে চিঠি! আমিও মেনে নিই, বুঝি - বিষয় ও বাসনার বিষ অমৃততে

শ্রম বাজারে টিকে থাকার জন্য, কেরাণী ঘরের রাজনীতিতে নিজেকে সামনের সারিতে রাখার জন্য অফিসিয়াল লেটার লিখতে হয় নিয়মিত। অনেক সুন্দর করে গুছিয়ে ঋণাত্বক কথা বলতে হয়। লেসিকারের সবুজ কভারের বিজনেস কম্যুনিকেশন বই কিংবা লেসিকার যোগাযোগে নতুন প্রলেপ দিয়েছে। পাশের টেবিলের বাবুটির সাথে দিনে কথা হয় ৫ লাইন, ই-মেইল আদান প্রদান হয় ১৫/২০টি। মনে হয় - আশে পাশে কোথাও লেসিকার সাহেব উঁকি দিয়ে দেখছে, হাসছে আর বলছে - খেলারাম খেলে যা।

আজ শেষ বিকেলে ফোন পেলাম ফ্রন্ট ডেস্ক থেকে - 'তোমার নামে চিঠি আছে'। হাসি পায়। আমাকে আবার কে চিঠি লিখবে। যতসব হাবিজাবি কোম্পানী তাদের নিউজ লেটার পাঠায়। নিতান্তই ব্যাবসায়িক ধান্ধা অথবা স্রোতে টিকে থাকা। কোথায় সে হলুদ খামের চিঠি! কোথায় সে ঘ্রাণ! ভীষণ অনাগ্রহে কমলা রঙের খাম হাতে নিলাম। টিএনটি। প্রেরকের ঠিকানা না দেখেই খুললাম। মুহুর্তের জন্য হলেও চোখ ভিজে উঠেছে। নাজমুল আহসান খান, প্রিয় নাজমুল ভাই। কার্ডে লেখা আছে -

Eid for eternal joy,
happiness for us all
you are a part of it
let's celebrate a colorful aEid!

আবার সেই পুরনো চিঠির ঘ্রাণ পেলাম আজ অনেকদিন পর।

কাল/পরশু ঈদ।
নীল নির্বাসনের পৌণপুঁনিক জীবন খুব কালারফুল হয়ে ওঠে না।

ব্লগের সকল সুহৃদকে ঈদ ও পূজার শুভেচ্ছা।


মন্তব্য

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

ধন্যবাদ সুন্দর লেখার জন্যে। চিঠি জিনিসটা আসলেই ম্যাজিকের মতো। এইবার দেশে গিয়ে এক বাক্সের ভেতর সেই ১০-১৫ বছর আগে পাওয়া নানান প্রবাসী বন্ধুদের চিঠিগুলো খুঁজে পেলাম। তাজ্জব লাগলো সেগুলো আবার পড়ে। আর এখন আমিই তাদের মত।
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

আর এখন আমিই তাদের মত।

হা হা।
আপনাকেও ধন্যবাদ।

আরশাদ রহমান এর ছবি

পড়লাম। প্রথম যখন প্রবাসে আসি তখন ইমেল ছিলোনা। ফোন করাও অনেক খচের ব্যাপের ছিলো। তখন ডাক বাক্সে সাদা খামের চারপাশে লাল নীল দাগ দেয়া চিঠি দেখলেই মনটা ভালো হয়ে যেতো। চিঠির জন্য অপেক্ষা করতেও ভালো লাগতো।

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

সাদা খামের চারপাশে লাল-নীল দাগ। উপরে এয়ারমেইল লেখা। আসলেই, স্মৃতিজাগানিয়া!

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

লেটার হোক বা পত্র, ইমেল বা মেল - চিঠি-র মতে মিষ্টি শব্দ আর ক'টা আছে? সেই জিনিস এখন হারিয়ে বসে আছি। মন খারাপ হয় না!

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

ঠিক, জুবায়ের ভাই! চিঠি আসলেই মিষ্টি শব্দ। কেমন যেনো আকাঙ্খার ব্যাপার আছে। ধন্যবাদ।

সৌরভ এর ছবি

দেশ ছাড়ি বছর ছয়েক আগে।
দেশে মুঠোফোন এতোটা সহজলভ্য হয় নি এরকম সময়ে আমি আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুটিকে ৬ পৃষ্ঠা- ৭ পৃষ্ঠা চিঠি লিখতাম। জবাবও আসতো সেরকম।
চিঠিতে থাকতো রাজনৈতিক বিষয় - আল্লার মাল কিংবা ফালু কিংবা আশপাশের দৈনন্দিন কথন - প্রাক্তন কোন কলেজবন্ধুর ইংল্যান্ডে পাড়ি জমানোর গল্প অথবা তার নিজের প্রিয় মানুষের টুকরো কথা।

তারপর, আমাকে বেঁধে ফ্যালে ব্যস্ততা। অনেক রাতে বাড়ি ফিরি, উইকেন্ডেও ব্যস্ততার উপাসনা করি। আমার ভিতরের চিঠি লেখকটির মৃত্যু ঘটে।

বিরক্তি ধরে যায় পুরো ব্যাপারটায়, কম্পুকানা বন্ধুটিকে ফোন করতে শুরু করি। আর আমি ফোন করলে রাতবিরেতে ফোন করি। এক দু ঘন্টা কথা বলি।

তারপর বন্ধুটি একসময় বিয়ে করে। পুরোদস্তুর গেরস্থ হয়ে যায়। বন্ধুটিকে এখন কসমেটিকস এর দাম কিংবা ঈদের বাজারের আগুন নিয়ে ভাবতে হয়। তাই আমার ফোন করে অলীক স্বপ্নকুসুম বিষয়ক নিরর্থক কাব্য শোনার তার সময় নেই। না, সে কোনদিন সেটা আমাকে বুঝতে দেয়না।

কিন্তু আমি কীভাবে যেনো বুঝে যাই। এখন আর খুব একটা ফোন করি না। বন্ধুকে দেবার মতো সময় তার নেই বোধ হয় । তাই।

এইভাবে পৌনপুনিক জীবনের কাছাকাছি প্রিয়জনের সংখ্যা কমে। অথবা দূরত্ব বাড়তে থাকে।


আমি ও আমার স্বপ্নেরা লুকোচুরি খেলি


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

সৌরভ,
আপনি মনে হচ্ছে বিষন্নতার কারখানা খুলে বসেছেন! পোস্টে আত্মহনন, কমেন্টেও মন খারাপ করিয়ে দেন। আর একবার যদি এসব (নির্মম সত্য বচন, যেটা পাঠকের সাথে মিলে যায়!) লিখেন, তবে আমি নির্ঘাৎ 'সদস্যের ব্যাপারে আপত্তি' জানাবো।

আপনার জন্য অ্যাসাইনমেন্ট - নেক্সট ৫ টা পোস্ট রম্য লিখবেন।

আরিগাতো।

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

'আপনার জন্য অ্যাসাইনমেন্ট - নেক্সট ৫ টা পোস্ট রম্য লিখবেন।'

একমত! সৌরভ মিয়ার মন ভালো করা দরকার - একটা বিয়া পড়ায় দেওয়া যায়...
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

সৌরভ মিয়ার মন ভালো করা দরকার - একটা বিয়া পড়ায় দেওয়া যায়...

অতি উত্তম প্রস্তাব। হাসি

শিমুলের মাথায় পোকা কিলবিল করে এর ছবি

শিমুলের মাথায় পোকা কিলবিল করে। ম্যাঁও

বিপ্রতীপ এর ছবি

শিমুল ভাই,
শুরুতে ভেবেছিলাম আগের ব্লগটার মতো বুঝি এবারের ব্লগটাও মন খারাপ করা। পরে দেখলাম না...ভালোই লাগলো।

ইতি,
বিপ্রতীপ চোখ টিপি

বিঃদ্রঃ পরিবর্তনই পৃথিবীর নিয়ম...

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

প্রিয় বিপ্রতীপ ভাই:
সালাম ও শুভেচ্ছা। পরসংবাদ, লেখা পড়িয়া মন খারাপ করিবার শংকা হইতে মুক্তি পাইয়াছেন শুনিয়া নিশ্চিন্ত হইলাম। আপনার বিজ্ঞান বিষয়ক লেখা পড়িতে আরামপ্রদ ও সহজবোধ্য। সেই রকম লেখা আরও লিখিবার অনুরোধ করিয়া আজ এইখানে থামিতেছি।

ইতি,
শিমুল
১২ অক্টোবার, ২০০৭

হাসান মোরশেদ এর ছবি

ফিরতি শুভেচ্ছা শিমুলের জন্য ।
-----------------------------------
মানুষ এখনো বালক,এখনো কেবলি সম্ভাবনা
ফুরোয়নি তার আয়ু

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

মোরশেদ ভাইয়ের জন্য শুভেচ্ছা-প্রাপ্তি-স্বীকারপত্র।

বিপ্লব রহমান এর ছবি

খুব সুন্দর একটি বিষয় অনেক যত্ন করে গুছিয়ে লিখেছেন তো!


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

তারেক এর ছবি

প্রথম এবং একমাত্র চিঠি লিখেছিলাম আপুর কাছে। ও যখন প্রথমবার দেশের বাইরে গেল তখন। সেই চিঠি নিয়ে আপু এখনো উঠতে বসতে ক্ষ্যাপায় আমাকে। বোনের কাছে লিখেছিলাম সুকান্তের লাইন-

এখনও আমার মনে তোমার উজ্জ্বল উপস্থিতি/প্রত্যেক নিভৃত ক্ষণে মত্ততা ছড়ায় যথারীতি

বোঝেন অবস্থা! সেই থেকে আমি আর চিঠি লিখি না মন খারাপ
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

হা হা হা। দারুণ ঘটনা তো, তারেক! প্রথম চিঠি লেখার স্মৃতি আসলেই ভোলা যায় না। হাসি

বিপ্লব ভাইকেও ধন্যবাদ।

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাল লিখেছেন।

খুব একটা চিঠি লেখা হয়ে উঠেনি আমার। কিন্তু তারপরও শব্দটা কেমন যেন নাড়া দিয়ে যায়।

ফেরারী ফেরদৌস

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।