আমার লেখার হাত কখনই ভাল নয়। তার উপর আবার আমি শব্দ দিয়ে আমার মনের ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে একেবারেই অপদার্থ। প্রবাস জীবনে ছোট ছোট ঘটনাও যে কিভাবে মাঝে মাঝে আবেগপ্রবণ করে তোলে তারই একটি ছোট্ট গল্প আমার এই লেখা। যদি কারও ভাল না লাগে, তবে নিজগুণে ক্ষমা করে দিবেন।
দুই নয়ন অশ্রুসিক্ত না হলেই মনটা ছিল ভেজা। নাহ্, কোন চরম দুঃখ নয়, হঠাৎ অনুভূত হওয়া স্নেহ ও মমতার স্পর্শই আমার এই অবস্থার জন্য দায়ী। অযথা কথা না বাড়িয়ে মূল বক্তব্যে চলে যাওয়াটাই মনে হয় ভাল হবে। তাহলে বলে ফেলি কিভাবে একটি ছোট্ট ঘটনা আমার মনকে নাড়া দিয়ে গিয়েছে।
সেদিন ছিল শুক্রবার। আমাদের এলাকার বেশ কিছু প্রবাসী বাঙ্গালি মিলে আয়োজন করল ফুটবল খেলার। সবাই মিলে হৈ চৈ করতে করতে চলে গেলাম মাঠে। মাঠে গিয়ে যথারীতি দুটি দলে বিভক্ত হয়ে খেলা শুরু হয়ে গেল। খেলা কিছু সময় চলার পর আবার নতুন করে দল গঠন করা হয়। কারণ, শুরুতে দল বিভাগের সময় ভাল-খারাপ খেলোয়াড়ের ঠিক সুষম বন্টন হয়নি। তারপর নতুন দল নিয়ে নবোদ্যমে আবার খেলা শুরু হল। এক সময় খেলা শেষও হয়ে গেল। খেলা শেষে দেখা গেল প্রতিটি খেলোয়ারই যথেষ্ট পরিমাণ ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, এবং আহতও বটে। সেই অবস্থাতেই আমরা বাসায় ফিরে এলাম।
আমাদের বাসায় একসাথে আমরা চারজন বসবাস করি। একত্রে দীর্ঘদিন যাবৎ বসবাসের কারণে আমাদের মাঝে এক ধরনের ভ্রাতৃসুলভ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। আমাদের এই ভ্রাতৃবন্ধনের আরেক সদস্য, কিংবা বলা যেতে পারে পঞ্চপাণ্ডবের আরেক পাণ্ডব আমাদের বাসাতেই সেই সময় বসা। যদিও সে অন্য এক বাসায় অন্য বাঙ্গালিদের সাথে থাকে, কিন্তু আমাদের সাথেই তার উঠা-বসা বেশি। আমাদের এই পঞ্চপাণ্ডবের প্রত্যেকেই তখন অত্যন্ত ক্ষুধার্ত থাকলেও এত অধিক মাত্রায় ক্লান্ত ও আহত যে, আমাদের কারও পক্ষেই কিছু রান্না করে খাওয়ার আয়োজন করার মত বিন্দুমাত্র শক্তি নেই। স্বভাবতই আমরা এর কি সমাধান করা যায় তাই নিয়ে চিন্তা করা শুরু করলাম। তখনই বাকিরা এক বৌদির নাম বলে উঠল। সবাই মিলে বলতে লাগল যে, যদি আমরা তাঁকে অনুরোধ করি, তবে নিশ্চয় এই হতভাগাগুলোকে কষ্ট করে এসে একটু কিছু রেঁধে দিয়ে যাবে। অবশ্য দাদাও আমাদের সাথে খেলেছেন। আর খেলার পর তাঁরা গিয়েছেন বাজারে। তাই তাঁদের ফোন করা ঠিক হবে কি হবে না এই নিয়ে কথা বলতে বলতে শেষ পর্যন্ত আমরা ফোন করেই ফেললাম। আর তিনিও রাজি হয়ে গেলেন।
তারপরের ঘটনা নিশ্চয় অনুমান করা যাচ্ছে। জ্বি, ঠিকই অনুমান করেছেন, বাজার শেষে দিদি এবং দাদা দুজনেই এলেন আমাদের বাসায়। শুরু করলেন বাধাকপির ভাজি, মুরগির ঝোল, আর ভাত রান্না। রান্না শেষ হতে হতে রাত্রি প্রায় ১২ টা বেজে গেল। নিশ্চয় ভাবছেন এত দেরি হল কেন। এপ্রিল মাস কিনা, তাই যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়াতে সূর্যও যেমন দেরি করে ডোবে, তেমনি আমাদের খেলাও চলে অনেক সময় ধরে। তাই আমাদের খেলা শেষে বাসায় আসতেই বেজে গিয়েছিল ৮টার একটু বেশি। আর তারপর সিদ্ধান্ত গ্রহণ, ফোন করা, দিদিদের বাজার – সব মিলিয়ে একটু সময়তো লাগবেই।
আমাদের দিদি আবার চমৎকার গান করেন। রান্নার ফাঁকে ফাঁকে যখন গান গেয়ে উঠছিলেন শুনতে ভালই লাগছিল। পাশাপাশি আমাদের আড্ডাও চলছিল যথারীতি। আর হ্যাঁ, দিদি কিন্তু যে সে গায়িকা নন, তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনে গাইতেন, আর তাঁর যদি যুক্তরাষ্ট্রে আসা না হত, তবে হয়তো তাঁকে আপনারা দেখতে পেতেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার পাশে বসে রবীন্দ্র সংগীত করতে। আর এ যে আমার বৃথা প্রশংসা নয়, যারা তার গান শুনেছে, শুনছে, এবং শুনবে, তারা সকলে স্বীকার করবে। তার উপর আবার সামনের অগাস্ট থেকে তিনি পি.এইচ.ডি শুরু করবেন। আর সেই তিনি কিনা এতটুকু আপত্তি না করে আমাদের এসে রেঁধে দিচ্ছেন।
আমার গল্পের কিন্তু এখানেই শেষ। নিশ্চয় ভাবছেন, এখানে দুঃখের কি আছে, কিংবা হঠাৎ আবেগপ্রবণ হবারই বা কি আছে। তাহলে আমিই বলি কেন আমার এরকম মনে হয়েছিল। যখন আমাদের মাঝে এতটুকু শক্তি ছিলনা রান্না করার, তখন আমার বারবার মনে পড়ছিল দেশের কথা। যদি দেশে থাকতাম, তবে মা আমার কি সুন্দর করে রান্না করে দিত। হয়তোবা মুখে তুলে খাইয়েও দিত। কিন্তু সে উপায়তো এখানে নেই। এমনি সময় যখন দিদিকে ফোন করলাম, তিনি রাজি হয়ে গেলেন আমাদের বাসায় এসে রান্না করে দিয়ে যাবার জন্য। এমন গুণের অধিকারীণি একজন মানুষ, তাঁরতো কোনই প্রয়োজন নেই আমাদের মত কতগুলা ছেলের অনুরোধে এরকম করে মাঝ রাতে এসে রেঁধে দেবার। এতো আমাদের প্রতি তাঁর স্নেহ, ভালোবাসা আর মায়া-মমতারই বহিঃপ্রকাশ। আমার মনে হচ্ছিল, যেন আমার মা হঠাৎ এসে দাঁড়িয়েছেন পাশে। পুরাটা সময় সে হাসি মুখে ছিল, মুখমণ্ডলে ছিলনা এতটুকু বিরক্তির ছাপ। যদিও নয় একই মায়ের পেটের বোন, তবু যেন মনে হচ্ছিল তার চেয়েও বেশি। দিদিকে আমার শত সহস্র সালাম। পৃথিবীর মানুষগুলো খুবই আজব, কেউ আপন হয়েও আপন হয় না, আবার কেউ দূর থেকে এসে হঠাৎ করে কি চমৎকারভাবে আপন হয়ে যায়।
হয়তো বিদেশে বসবাস করি বলেই, হঠাৎ অনুভূত হওয়া এই স্নেহ-মমতার স্পর্শ আমাকে আবেগপ্রবণ করে তুলেছিল। তাও আমি বলব আমার পুরা মনের ভাব আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারিনি। হয়তো এই ঘটনাটি পড়ে ভাবতে পারেন অযথাই একটা বাজে লেখার পিছনে সময় নষ্ট করলেন, তবে তার জন্য আমি দুঃখিত। আমি আমার মনের কথা অনেক সময় বলতে লজ্জা পাই বলে দিদিকে সামনে দাঁড়িয়ে একথাগুলো বলতে পারিনি। তাই লিখে একটু শান্তি পেলাম।
আমার এই লেখা যদি আপনাদের আমার মনের ভাব বোঝাতে সক্ষম হয়ে থাকে, তবে তার জন্য বিদিষাদির (বিদিষা দেওয়ানজি – যার কথা বললাম এতক্ষণ) সকল প্রশংসা প্রাপ্য। আর যদি বোঝাতে ব্যর্থ হয়ে থাকি, তবে তা আমার লেখনির দোষ।
মন্তব্য
ধন্যবাদ রইলো পঞ্চম পান্ডবের পক্ষ থেকেও। কী পরিমাণ বিধ্বস্ত ছিলাম, তা বলে বোঝাবার না। এই ক'দিন আগেই ধুম করে ফোন করে চলে গিয়েছিলাম বৌদির বাড়ি। মন সেদিন খুব খারাপ ছিল ব্যাক্তিগত অনেক রকম কারণে। ক্ষুধা আর বেদনা, দু'টারই যে-পরিচর্যা পেয়েছিলাম, তা ভাষায় প্রকাশের না। আমারও চাপা একটা কৃতজ্ঞতা ছিল, রেখে গেলাম এখানে।
বৌদির কাছে সবচেয়ে বড় কৃতজ্ঞতা আমাদের এখানে সবার মধ্যেই এক রকম সংস্কৃতি-সচেতনা গড়ে তোলার জন্য।
ঠিকই বলেছ ... আমিও একমত
আজমীর
Smile costs nothing but gives much, so keep smiling.
Kids are always cute.
আজমীর
Smile costs nothing but gives much, so keep smiling.
Kids are always cute.
মন ছুঁয়ে যায় এমন ঘটনা, লেখা...
মানুষ তো এমনই ভাই... কে যে আপন হয়ে ওঠে, তার কোনো নিশানা আগে থেকে পাওয়া যায় না। অথচ কাছের অনেক মানুষও হয়ে যায় পর... ভালো থাকুন।
---------------------------------------------
বুদ্ধিমানেরা তর্ক করে, প্রতিভাবানেরা এগিয়ে যায়...
--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'
ভাল লাগলো আজমীর।
ধন্যবাদ
আজমীর
Smile costs nothing but gives much, so keep smiling.
Kids are always cute.
আজমীর
Smile costs nothing but gives much, so keep smiling.
Kids are always cute.
আপনার লেখায় কিন্তু কোনো জড়তা নেই। কেননা ওই মূহুর্ত ও তাকে জড়িয়ে থাকা আবেগ খুব সহজেই মন ছুঁয়ে গিয়েছে। এই মণিমুক্তার মত সময়গুলি একদিন পেছনে ফেলে আমরা যতই আরো বহমান সময়ের স্রোতে বয়ে যাই না কেন, হৃদয়ের গভীরে এরা উজ্জ্বল হয়ে থাকে। আপনার লেখার প্রসঙ্গে এমনই এক বৌদির কথা ভেসে উঠলো আমারও মনে। ১৯৮৩ সালে প্রথম চাকরীসূত্রে বাড়ির বাইরে গিয়ে একেবারে সংলগ্ন প্রতিবেশী এক বৌদি প্রায় মায়ের মত স্নেহে আগলে রেখেছিলেন সেকথা মনে পড়ে আজও আপনার মতই আবেগিত হয়ে থাকি।
-
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
আহা রে!
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
পৃথিবীর মানুষগুলো খুবই আজব, কেউ আপন হয়েও আপন হয় না, আবার কেউ দূর থেকে এসে হঠাৎ করে কি চমৎকারভাবে আপন হয়ে যায়।
ঠিকই বলেছেন, আজমীর।
আর আপনার লেখা চমৎকার লাগলো, স্যার।
বরাবরই লাগে।
...........................
সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
ধন্যবাদ
আজমীর
Smile costs nothing but gives much, so keep smiling.
Kids are always cute.
আজমীর
Smile costs nothing but gives much, so keep smiling.
Kids are always cute.
নিজের বক্তব্য নিয়ে আপনি যতোটা আরষ্ট ছিলেন আপনার বিষয়বস্তু কিন্তু ততোটা সাধারন মোটেই নয়।
এমন সুন্দর একটা অনুভূতি শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ
___________________________
বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ
বিদিশা তুমি এতো পঁচা তাতো জানতাম না । ঐ পঞ্চপান্ডবের পাঁচটাইতো বদের হাড্ডি । এক কাপ
চা খাওয়াবে বলে কতদিন ঝুলিয়ে রেখেছে । কিন্তু তুমিতো একটা ফোন করে বলতে পারতে দাদা এসে
ভাত খেয়ে যাও ''''''''''''''
বিদিশা সত্যিই খুব ভালো । ওর মনটা ওর গানের মতই সুন্দর । আজমীর খুব ভাল লিখেছো । ভালো মানুষের ভালোটা যে প্রকাশ করতে পারে সে নিজেও কিছুটা ভাল । সুন্দর থাকো সবাই ।
ধন্যবাদ
আজমীর
Smile costs nothing but gives much, so keep smiling.
Kids are always cute.
আজমীর
Smile costs nothing but gives much, so keep smiling.
Kids are always cute.
আবেগাক্রান্ত হলাম। একই ধরনের একাধিক কাহিনী আছে আমার প্রবাস জীবনেও।
জানি না, তবে আপনার টাইপ করার কিবোর্ডটি কিন্তু বেশ
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
ধন্যবাদ। ভাল বলেছেন। লিখে ফেলুন না আপনার ঘটনাগুলোও। অপেক্ষায় থাকব।
আজমীর
Smile costs nothing but gives much, so keep smiling.
Kids are always cute.
আজমীর
Smile costs nothing but gives much, so keep smiling.
Kids are always cute.
ইস! আচ্ছা বিদিশা দেওয়ানজী কি ভিকারুননিসা স্কুল বা হলিক্রসে পড়তেন? কোন্ ব্যাচ?
আদৌ কি পরিপাটি হয় কোনো ক্লেদ?ঋণ শুধু শরীরেরই, মন ঋণহীন??
জ্বী, হলিক্রসের সম্ভবত। খুব সম্ভব '৯৬-র ব্যাচ বা কাছাকাছি।
নতুন মন্তব্য করুন