গানওয়ালা

আশরাফুল আলম রাসেল এর ছবি
লিখেছেন আশরাফুল আলম রাসেল [অতিথি] (তারিখ: রবি, ০২/০৮/২০০৯ - ১২:১৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

গুলশান থেকে ধানমন্ডি যাওয়ার পুরো রাস্তাজুড়েই জ্যাম। রোদটাও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। এইসময় বর্ষার কালো মেঘে দেখেও বৃষ্টির কথা নিশ্চিত করে বলা যায়না। আর তখন তো পুরো আকাশটাই জরোয়ার সাজে। অনেকক্ষণ ধরে একটা অটো রিকশা খুঁজছি। হুলুস্থুল গরমে কেবল অস্বস্তি বাড়ছে। কেউই যেতে রাজি হচ্ছেনা। আবার রাজি হলেও আকাশ ছোঁয়া ভাড়া হাঁকছে। বেশ কিছুদূর হাঁটার পর এবার আমাকে থামতেই হলো। অনেক হয়েছে। আর ঠিক তখনই দেখলাম একটু দূরে গাছের ছায়ায় একটা অটো দাঁড়িয়ে। ইচ্ছার বিরূদ্ধেও এগিয়ে গেলাম। ড্রাইভিং সিটে ষাটোর্ধ্ব বয়সী লোকটিকে বলতেই সে রাজি হয়ে গেলো। একটু অবাকই হলাম। আমি তখনও বুঝিনি আমার জন্য আরো অবাক হওয়ার মতো ঘটনা অপেক্ষা করছে। অটোতে ওঠার আগে লোকটি আমাকে প্রশ্ন করলো, ‘একাই যাবেন?’ একটু বিরক্তিই হলাম। তাকে এই ধরনের প্রশ্ন করার কারণ জিজ্ঞাসা করতে সে উত্তর দিলো ‘এমনি’।

আমরা চলতে শুরু করেছি। বনানী থেকে চেয়ারম্যান বাড়ি আসতেই অনেকটা সময় লাগলো। কিন্তু এখানে এসে জ্যামের আরো ভয়াবহ রূপ দেখতে হলো। খুব অস্থির লাগছিলো। কতোক্ষণ আর ধৈর্য রাখা যায়...ভাবনাটা শেষ হবার আগেই ঘটলো সেই ঘটনাটি। সূর্যের প্রখর রোদ শরীরের ঘামে পিছলে পড়লো পিচের রাস্তার। কোথা থেকে যেন এক পশলা বৃষ্টি মেঘের খামে পাঠালো বাতাস। ভেজানো শরীরে সে রাখলো কুমারী হাত। আমি চোখ বুজে ফেললাম। এইটুকু ঘটনা যদি কল্পনাতেও ঘটে থাকে তবে বাস্তবে যা ঘটেছে তার কল্পনার চেয়েও সুন্দর। ঢাকায় যারা নিয়মিত অটো রিকশায় যাতায়াত করেন তারা কেউ কি চেনেন এই অটো রিকশাওয়াকে? লম্বা জ্যাম দেখলে যে রিকশার ছাদে গুঁজে রাখা বাঁশি হাতে নিয়ে বাজায় রাখালিয়া সুর? আসলে সে বাজায় না, সুর যেনো তাকে বাজাচ্ছে। আরো অবাক করার মতো ব্যাপার আছে। সে যে সুর বাজায় তা তক্ষুনি চিন্তা করে। কিছুক্ষণ বাঁশি বাজাবার পর সে গান ধরে নাগরিক গানওয়ালা।

এতো গাড়ি ক্যান বুঝি না
শুধু জানি সারাগামা
তালে তালে তালে তালে
যাচ্ছি সবই পেছন ফেলে
যাচ্ছি কোথায় তাও জানি না
শুধু জানি সারেগামা

এবার এই গানটিরই সুর ওঠে বাঁশিতে। পাশের হোন্ডা সিআরভি- তে বসে থাকা সুন্দরী মেয়েটি একবার আলগোছে তাকায়। কাঁচের ওপাশ থেকে সে অনুমানে বুঝে নেয় ঘটনাটা। তারপরই চোখ সরিয়ে নেয়। রাস্তার কোনো দৃশ্য পয়শাওয়ালাদের বেশিক্ষণ দেখতে নেই। উৎসুক অটো রিকশাওয়ালাগুলো কিন্তু সেদিক দিয়ে একেবারে ভিন্ন। তারা ক্রমাগত গানওয়ালাকে উৎসাহ দেয়। সে সেদিকে খেয়ালও করেনা। আপন মনে বাঁশি বাজায়। মাঝে মাঝে নিজেই দেয় হাততালি। তার চোখে-মুখে কোথাও কোনো কৌতুক কাজ করে না। সে যে নিবিষ্ট মনেই গাইছে, তা বেশ বোঝা যায়। জ্যাম একটু হালকা হতেই বাঁশি আবার চলে যায় আগের জায়গায়। গান চলতে থাকে। তালে তালে দুলছে তার সমস্ত শরীর। আমি ভাবতে শুরু করি- পিকআপটাও কি বাড়ছে-কমছে তালে তালে। রাস্তায় মানুষগুলো কি তালে তালে পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে? বাসের হেল্পার দরজায় ঝুলে তালে তালেই কি বলছে ‘এই পেলাস্টিক’, রিকশাওয়ার সাথে লোকগুলো কি তালে তালে দর কষছে? কিংবা হুডতোলা রিকশায় কিশোর ছেলেটি কি তালে তালেই চুমু খাচ্ছে পাশের কিশোরিটিকে? সত্যি জানি না, কিন্তু আবার মনে হচ্ছিলো সবকিছুর একটা তাল আছে, লয় আছে। জ্যামের মাঝে থেমে থেমে চলা গাড়িরগুলোও তালে তালেই চলে। সিগন্যালও জ্বলে-নেভে নির্দিষ্ট লয়ে।

তালে তালে তালে তালে
কে আছে কোন খেয়ালে
আমি কি তার কিছু জানি
শুধু জানি মাপাধানি...
সুন্দরী তুমি না হয় হলে
তুমিও চলো তালে তালে
আমি তোমার খোঁজ রাখি না
শুধু জানি সারেগামা...

শিল্পী কখনোই অবজ্ঞা সহ্য করতে পারে না। আশ্চর্য! সে কি মেয়েটির অবজ্ঞার দৃষ্টি লক্ষ করেছে? লোকটির চেহারা আমি তখন কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না। চেহারা না দেখে তার ব্যক্তি জীবন সম্পর্কে অনুমান করা অসম্ভব। ব্যাকভিউ মিররের দিকে তাকাতেই তাকে দেখতে পেলাম। চোখ দুটো টকটকে লাল, মাথার বেশিরভাগ চুল পাকা, নীল জামার বদলে সে পরেছে ধবধবে সাদা একটা জামা। আমার চাইতে সেই বেশি ঘামছে। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য তার ভেতর কোনো অস্বস্তি কিংবা অস্থিরতা দেখিনি। অধৈর্য হতে দেখিনি একবারও। চারপাশে অনেকেই তাকে বাঁকা মন্তব্য ছুঁড়ছিলো, সে তখনও গানে মগ্ন। অনেক উৎসাহী পথচারী তাকে নানারকম প্রশ্ন করছিলো। সে তখনও একাত্ম বাঁশিতে, তার রাগরাগিনী নিয়ে। পথ ফুরিয়ে আসছিলো। জরুরি কাজ আমার ধানমন্ডিতে। কিন্তু আমি চাইছি না। পথটা আরো একটু লম্বা হোক। অটো রিকশাটি দাঁড়িয়ে গেলো। আমি নামতে পারছি না। কিন্তু আর বেশিক্ষণ এই ইন্দ্রজালের ভেতর থাকতেও আমি চাইছি না। একবার ভাবলাম, লোকটি অস্বাভাবিক কোনো ভাড়া চায়নি, বরং আমার পুরো দুপুরটাই পাল্টে দিয়েছে। তাকে কি আমার বেশি ভাড়া দেয়া উচিৎ? আবার ভাবলাম, যা আমাকে মুগ্ধ করেছে তা আমি গোঁয়ারের মতো ভাড়ার অংকে ফেলছি! ভেতরে বসে এমন অনেক কথাই ভাবছিলাম। পুরো পথটায় তার গানে আমি বাধা হয়নি, ভেবেছিলাম নেমেই জিজ্ঞেস করবো নাম, ঠিকানা। কিন্তু কি আশ্চর্য, নামার পরও আমার সেরকম কোনো ইচ্ছাই হলো না। ভাড়া দিতেই সে তা পকেটে রেখে দিলো। চলে আসার আগে সে যেভাবে আমার দিকে তাকিয়েছিলো তা ভোলা অসম্ভব। আমি বুঝে গিয়েছিলাম ভাড়ার অতিরিক্ত টাকা না দিয়ে আমি ভীষন ভালো করেছি। গানওয়ালার নাম জানা হলো না। অটো রিকশার নম্বরটাও না। পথের অবাক করা সুখ থাকুক পথেই। সেই সুর নাগরিক পকেটে পুরে সস্তা করবার মানে হয় না। চলে আসবার আগে সে শুধু আমাকে বলেছিলো এখন সোজা বাসায় যাবে। প্রচন্ড ক্ষুধার্ত সে। আমি আর দাঁড়াইনি। তার টকটকে লাল চোখেও গানের মতোই এক সম্মোহন শক্তি আছে। আমি চলে এসেছিলাম তখনই।
অনেকটা দূর হেঁটে এসেছি। এতোদূর থেকে তাকে শোনা সম্ভব না। তবু, সারাদিনই আমি শুনতে থাকলাম-

কে চলে যে কোন অজানায়
কাটে বাঁধন
ভোজন, সাধন
পাধানিসা
পাধানিসা
শুণ্যের ওপর আমার বাসা
রেসানিধা
কিসের বাঁধা
আমি কি সে সাধন জানি
শুধু গাই মাপাধানি....


মন্তব্য

সাইফুল আকবর খান এর ছবি

সুন্দর!
অভিজ্ঞতাটি তো বেশ অন্যরকম সমৃদ্ধ বলতেই হবে (যদি সত্যি হয়ে থাকে), আর তার বিবরণটিও ভালো লাগলো বেশ।
চলুক হাসি
___________
স্বাক্ষর?!
মাঝেসাঝে বুঝতে পাই- আমি
নিরক্ষর!

___________
সবকিছু নিয়ে এখন সত্যিই বেশ ত্রিধা'য় আছি

আশরাফুল আলম রাসেল এর ছবি

অভিজ্ঞতাটি ১০০ ভাগ সত্য। গতকালের ঘটনা!!অপেক্ষা করছি আবার কবে দেখা হবে লোকটার সাথে।
................
আমি অতিথি তোমার দেশে.....

আমি অতিথি তোমার দেশে.....

সাইফুল আকবর খান এর ছবি

হ্যাঁ, ইন্টারেস্টিং।
আমরা নাগরিক জ্যামে-ঘামে হঠাত্ একদিন বাঁশি শুনি,
আর দীপ্তি তার বেড়ালটাকে খুব ভালোবাসে। হাসি
___________
স্বাক্ষর?!
মাঝেসাঝে বুঝতে পাই- আমি
নিরক্ষর!

___________
সবকিছু নিয়ে এখন সত্যিই বেশ ত্রিধা'য় আছি

শাহেনশাহ সিমন [অতিথি] এর ছবি

এটা তবে একটা গল্প। একটা ফ্যান্টাসি। চলুক

আশরাফুল আলম রাসেল এর ছবি

নিজের অভিজ্ঞতা থেকে গল্প লেখার চেষ্টা বলতে পারেন।
................................
আমি অতিথি তোমার দেশে.....

আমি অতিথি তোমার দেশে.....

শাহেনশাহ সিমন এর ছবি

ট্যাগে 'গল্প' লিখে বিভ্রান্ত করার চেষ্টায় আপনাকে ১। খাইছে

_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

এইটা কি গল্প না আপনার বাস্তব অভিজ্ঞতা? আমার মনে হয় হচ্ছে, আমাদের এই নগরে এ ধরনের ঘটনা ঘটা অসম্ভব নয়! ভালো লাগলো আপনার লেখা।

আশরাফুল আলম রাসেল এর ছবি

বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং এদম টাটকা।

.......................................................
আমি অতিথি তোমার দেশে.....

আমি অতিথি তোমার দেশে.....

দুষ্ট বালিকা এর ছবি

ভাল লাগল... আরও লিখুন।

--------------------------------
কাঠবেড়ালি! তুমি মর! তুমি কচু খাও!!

**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।

মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

ভালো...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

ভুতুম এর ছবি

ভালো লাগলো। আরো লিখুন না।

-----------------------------------------------------------------------------
সোনা কাঠির পাশে রুপো কাঠি
পকেটে নিয়ে আমি পথ হাঁটি

-----------------------------------------------------------------------------
সোনা কাঠির পাশে রুপো কাঠি
পকেটে নিয়ে আমি পথ হাঁটি

কড়িকাঠুরে এর ছবি

এরপর কোন জ্যামে বসে তাঁকে খুঁজতে পারি... হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।