গ্রেহাউন্ডের আন্তঃশহর বাসটা থেকে নেমেই নান্টুর মনে হলো বিশাল একটা ভুল হয়ে গেছে! ভুলের মাত্রাটা এত বেশী যে নান্টুর মাথাটা দপ্ করে ধরে উঠলো, মনে হলো ফুসফুসে মোটেই অক্সিজেন যাচ্ছে না। অ্যাড্রিনালীনের অতিরিক্ত ক্ষরণে এমনটাই হয় ওর - হঠাৎ চোখে অন্ধকার দেখে, মাথার ভেতরে চিন্তা গুলো এলোমেলো হয়ে যায়। সিগারেটের নিকোটিন আর কফির ক্যাফেইনই এ সময়ের একমাত্র মহৌষধ।
বাসের সামনে থেকে সরে অন্যদের নামার জায়গা করে দিয়ে পকেট হাতরিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে একটা সিগারেট ধরালো ও। এখন দরকার সাথে এক কাপ কড়া কফি। আশেপাশে তাকিয়ে দু'টো হটডগ স্ট্যান্ড ছাড়া কিছুই চোখে পড়লো না। বাসস্টপের থার্মোমিটার বলছে তাপমাত্রা মাইনাসের উপরে উঠে গেছে। এটা বোঝার জন্য অবশ্য থার্মোমিটার লাগে না, বরফ গলার হার দেখেই অনুমান করা যায়। এক লাফে রাস্তায় জমে থাকা বরফ গলা পানির ছোট্ট ডোবাটা পেরিয়ে ডানডাস স্ট্রিটের দিকে হাঁটা শুরু করলো নান্টু। ডানডাসে পৌঁছে ভিক্টোরিয়া স্ট্রিটে উঠলেই রায়ার্সন বিশ্ববিদ্যালয়... সেখানে একটা টিম হর্টনস্ থাকার কথা। কানাডা, শুধু কানাডা কেন, পুরো উত্তর আমেরিকা কিভাবে মানুষকে ব্রান্ডনির্ভর করে তোলে সেটা একটা আঁৎকে ওঠার মত বিষয়। বাসস্টপের বে স্ট্রিট থেকে টিম হর্টনস্ এর ভিক্টোরিয়া স্ট্রিট প্রায় পনেরো-বিশ মিনিটের হাঁটা পথ। এর মাঝে বেশ কয়েকটা ছোট-বড় কফি হাউস আছে, অথচ সে এই দীর্ঘ পথটা হেঁটে সেই টিম হর্টনসেই যাবে বলে ঠিক করে ফেলেছে!
সিগারেটে একটা দমকা টান দিয়ে চিন্তাটা লাইনে আনার চেষ্টা করলো নান্টু। এত বড় ভুলটা কিভাবে হলো, আর এখন কি করনীয় সেটাই হিসাব করা যাক। এই সেমিস্টারে ট্রেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিবেশ বিদ্যায় স্নাতক ড্রিগ্রী পেল ও। সমাবর্তনের আগেই এখানে চাকরীর খোঁজ করাটা রেয়াজ, নান্টুও তাই করেছিলো। ভাগ্য ভালো বলতে হবে আবেদনের সাথে সাথে ফোন আসে বড় একটা বহুজাতিক কোম্পানি থেকে। টেলিফোনে ইন্টারভিউটা চমৎকার হলো। কম্পানি জানিয়ে দিল, "চাকরী তোমার এক রকম হয়েই গেছে, এখন বাকি কেবল কিছু আনুষ্ঠানিকতা। আগামী সোমবারে তোমার কাগজ-পত্র নিয়ে চলে আস। ছোট্ট একটা মুখোমুখী ইন্টারভিউ হবে। আমরা আমাদের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করবো, তুমিও তোমার কন্ট্রাকটা সাইন করার আগে একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নেবে!"
এ ধরনের ইন্টারভিউয়ে দু'তিন জনকে সব সময় রিসার্ভে রাখা হয় জানা আছে নান্টুর। অনেক সময় অনেকে নানা কারনে ইন্টারভিউতে আসতে পারেন না, আবার অনেক সময় দেখা যায় আবেদনকারী আবেদন পত্রে যা দাবী করেছিলেন তা কাগজ-পত্রে দেখাতে পারছেন না। এই সব ক্ষেত্রে সেই রিসার্ভ থেকে টান পড়ে।
আজ সেই ইন্টারভিউয়ের সোমবার, অফিসে কাগজ নিয়ে দেখা করার কথা। বাস থেকে নেমেই ওর মনে পড়েছে, কাগজ-পত্রের লাল ফাইলটা ওর আনা হয় নি!
দোষ যদি কাউকে দিতেই হয় তবে সেটা নাজমুল ভাইকে দিতে হবে। অক্লান্ত পরিশ্রম শেষে তিনি অবশেষে এই বার তাঁর ৪ বছরের ডিগ্রী ৭ বছরে শেষ করেছেন। আর তাই তাঁর আনন্দটাও অন্যদের তুলনায় বেশী। গতকাল রাতে তিনি সব বাঙালীদের জন্য পার্টি রেখেছিলেন। সেখানে অফুরন্ত ভোজ্যের সাথে কিছু পানীয়েরও ব্যবস্থা ছিল। নান্টু অনেক মিনতি করেও তাঁর পানের অনুরোধ ফেরাতে পারেনি! নাজমুল ভাই যখন তাঁর গাড়িতে করে বাসায় নামিয়ে দেন তখন প্রায় ভোর তিনটা। বাসায় এসে সব সময় আগামী দিনের জন্য ব্যাগ গুছিয়ে রাখাটা ওর অভ্যেস। কিন্তু গতকাল ক্লান্তি আর নেশার ঘোরে মনে হয়না সেটা করা হয়েছিলো। আজ সকালে অভ্যাস বসে সে ব্যাগটা কাঁধে নিয়েই বেরিয়ে পড়েছে, বেরুবার আগে একবার ব্যাগটা খুলে দেখারও প্রয়োজন বোধ করে নি!
টিম হর্টনসে ঢুকে একটা বড় কালো কফি নিয়ে বাইরের সিমেন্ট স্ল্যাব গুলোর উপরে এসে বসলো নান্টু। এখন বাজে এগারটা, সাড়ে এগারোটার সময় অ্যাপন্টমেন্ট। ও থাকে পিটারব্রোতে, টরান্টো থেকে প্রায় দেড় ঘন্টা লাগে বাসে। এর মাঝে ফিরে গিয়ে কাগজ নিয়ে আসার প্রশ্নই আসে না।
বাসের কথা মনে হতেই মনটা বিষীয়ে উঠলো ওর, চাকরীটা হাতছাড়া তো হলোই মধ্যিখান থেকে বাস ভাড়ার ত্রিশটা ডলারও গচ্চা গেল। এই ত্রিশ ডলার দিয়ে চমৎকার তিন দিন লাঞ্চ করা যেত!
এখন ও যদি অফিসে গিয়ে বলে এমন একটা ঘটনা ঘটে গেছে তাহলে কি হবে? সম্ভবত ওরা ভাববে এই অপগন্ডকে চাকরীটা না দেয়াই উত্তম! আরেকটা কাজ অবশ্যি করা যায়, যদিও সেটা কিছুটা অনৈতিক হয়ে যাবে। বাসায় গিয়ে ফোন করে বলা যায়, "ড্রাইভ করে টরান্টো যাবার পথে ওর গাড়িটা স্কিড করে পাশের নালায় পড়ে গেছে!"
বরফ গলার এই সময়টাতে এটা কানাডাতে স্বাভাবিক ঘটনা, আর ওর যে গাড়ি নেই সেটাও ওদের জানা নেই। কানাডার মানুষ আভহাওয়া সংক্রান্ত সমস্যা সব সময় বিশেষ বিবেচনা করে, ফলে মিথ্যাটা কাজে লাগলেও লাগতে পারে! সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল নান্টু এটাই করবে।
আর এই হতচ্ছাড়া চাকরীটা না পেলেই বা কী? এক বার ইন্টারভিউ দিয়ে যখন ডাক পেয়েছে তখন অন্য জায়গা থেকেও নিশ্চই পাবে! ক্যাফেইন-নিকোটিনের কেরামতিতে আত্মবিশ্বাস ফিরে আসছে বুঝতে পেরে সিগারেটে আরেকটা দমকা টান দিলো নান্টু।
"খুচরা পয়সা হবে কিছু? ভাংতি পয়সা?" ভাঙা শ্লেমা জড়ানো গলায় ঘোর ভাংলো নান্টুর। ওর পাশে কখন যেন একটা ভবঘুরে ভিখীরি এসে বসেছে খেয়ালই করেনি ও। বুড়ো, মুখে না কাটা ময়লা দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল, গায়ে তেল চিটচিটে একটা লম্বা ওভারকোট, পায়ে বিচিত্র এক লাল রং এর জুতো। নান্টু তাকাতেই হাতে ধরে রাখা কাগজের কাপটা ঝাঁকালো লোকটা। ঝুনঝুন শব্দে বোঝা গেল বেশ কয়েকটা পয়সা ইতিমধ্যেই তার উপার্জন হয়েছে।
অনেকের ধারনা কানাডাতে বুঝি ভিখীরি নেই। খুবই ভুল ধারনা। এটা সত্যি বাংলাদেশের, এমনকি আমেরিকার চেয়েও কানাডাতে ভিখীরি কম, কিন্তু আছে ঠিকই। কানাডার সরকার কানাডার নাগরিকদেরকে নানান পদক্ষেপে এত সুবিধা দেয় যে একদম হতভাগ্য মানুষ ছাড়া কপর্দকশূন্য হওয়াটা প্রায় অসম্ভব। অনেকে অবশ্য ইচ্ছে করেই সব ছেড়ে-ছুড়ে রাস্তায় নেমে আসে। ওরা বলে এটা তাদের ঘূণ ধরা নিয়মে বাঁধা সমাজের বিরুদ্ধে একটা নিরব প্রতিবাদ! পকেট হাতড়ে কয়েকটা কোয়ার্টার বের করে লোকটার কাপে ফেলে দিল নান্টু। দাড়ি-গোঁফের ফাঁকে লাল দাঁত বের হাসলো বুড়ো।
নিজের চিন্তায় ফিরলো নান্টু, আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে কাল রাতে নেশার ঘোড়ে লাল ফাইলটা সে ঠিকই ব্যাগে ঢুকিয়েছে পরে মনে নেই? এমনটা হতে পারে না? নিশ্চই পারে, তবে সেটা অবশ্য ব্যাগটা খুলে দেখলেই বোঝা যাবে।
"নেই!"
চমকে পাশে তাকালো নান্টু, বুড়ো এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে!
"কি বললেন?"
"যা খুঁজছো, তা পাবে না!"
বোকা বনে গেল নান্টু, "কি পাবো না?"
উত্তর না দিয়ে চোখ টিপলো বুড়ো
"অদৃষ্ট বলে একটা জিনিস আছে জান তো? আমাদের নিয়ে খেলা করাতেই সে হতভাগার আমোদ! তার হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার কোন উপায় নেই, জন্ম থেকেই তার থিকথিকে জালে আমরা আটকে গেছি। এই যে এখন তুমি আর আমি মিলে একসাথে গল্প করছি, এটা কি হবার কথা ছিল বলো? কোথায় থাকার কথা ছিল এখন তোমার?" এমন ভাবে রহস্য মাখা গলায় কথা গুলো বললো বুড়ো যেন সব আগে থেকেই জেনে বসে আছে।
"আমি আগে কি করতাম জান?"
উত্তর না দিয়ে ফাঁকা চোখে তাকিয়ে থাকে নান্টু। উত্তরের অবশ্য আশাও করে না বুড়ো, বলে চলে,
"ঐ যে অফিসটা, ঐ খানে প্রতিদিন সকালে স্যুট পরে হাজিরা দিতাম! বিশ্বাস হয়?"
হাত তুলে যেদিকে দেখাল পাগলা বুড়ো সেদিকে প্রায় কয়েকশো টা অফিস আছে,
"...কিন্তু শেষমেষ লাভটা কি হলো শুনি? অদৃষ্ট আমাকে টেনে এই রাস্তায় তো ঠিকই নামিয়েছে, নাকি?"
ঘ্যাশ ঘ্যাশ করে নোংরা দাড়ি চুলকে নান্টুর কাঁধে হাত রাখে বুড়ো,
"অন্ধের মত দৌড়ানো বন্ধ করো ছোকড়া। বাসায় যাও, গিয়ে নিজেকে নিজে জিজ্ঞেস করো কোন পথে নিচ্ছে তোমাকে তোমার অদৃষ্ট... যদি সেটা বুঝে ফেলতে পার, সে মত চলতে পার তবেই সাফল্য, এছাড়া সবই লবডঙ্কা!"
নান্টু বুঝতে পারলো কোন এক বিচিত্র কারনে বুড়োর কথা ওর মাথায় পাকা ভাবে ঢুকে যাচ্ছে,
"সেটা বুঝবো কিভাবে?"
প্রশ্রয়ের হাসি হাসলো বুড়ো, "সবই ইশারায় হয় বুঝলে হে ছোকড়া, সেই ইশারার মানে বুঝতে হয়।" হুট করে উঠে দাঁড়ালো বুড়ো, নান্টুর হাতে এক টুকরো মোড়ানো কাগজ দিয়ে বলল, "বাসায় গিয়ে তবেই খুলবে, দেখবে ইশারা বোঝাটা কত সহজ হয়ে গেছে তোমার জন্য!" দাঁতের ফাঁক দিয়ে পিচিক্ করে থুতু ফেলে ভিড়ে মিলিয়ে গেল ভবঘুড়ে।
***
বাসায় এসেই কাগজের টুকরোটা খুলল নান্টু, চার-পাঁচটা হিজিবিজি সংখ্যা সাজানো। সংখ্যা গুলো সম্পূর্ণ ভাবেই অবিন্যস্ত মনে হচ্ছে। এগুলো কিভাবে অদৃষ্টের ইশারা বুঝতে সাহায্য করবে কিছুতেই বুঝে পেল না নান্টু। মনে মনে সংখ্যা গুলো আওড়াতে আওড়াতে অজান্তে ব্যাগটা খুলতেই শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল নান্টুর,
ব্যাগে টুকিটাকি অনেক জিনিসে ফাঁকে শুয়ে আছে নিরিহ দর্শণ একটা লাল ফাইল!
© অমিত আহমেদ
প্রথম প্রকাশ: সামহোয়্যার ইন, ১ মার্চ ২০০৭
পরিমার্জিত দ্বিতীয় প্রকাশ: গল্পগ্রন্থ, "ফেলে আসা গল্প যতো", সীমাহীন সংলাপ, ২০০৯
মন্তব্য
ছবি ঠিক কইরা দিমু?
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
দেন!
আমার বেলা যে যায় সাঁঝ-বেলাতে
তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে
চলবে?
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
জটিল
আমার বেলা যে যায় সাঁঝ-বেলাতে
তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে
যথারীতি সাবলীল গদ্য।
চুলকে দিলাম তব পিঠখানি...
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
এরই অপেক্ষায় ছিলাম অহো দিবানিশি
আমার বেলা যে যায় সাঁঝ-বেলাতে
তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে
পড়লাম। ভালো লাগলো।
আগে পড়ি নাই। পড়ে দারুন লাগল। কি লেখা। যেন ভেসে বেড়ান পানসি।
সর্বোচ্চ রেটিং দিলাম।
আরো খিখুন। আপনাদের জন্যই সচলায়তন নতুন গ্র বাজারে ছাড়তে চলেছে।থামবেন না। লিখতে থাকুন।
----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।
----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।
অনেক বছর আগে এই গল্পটা প্রথম পড়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম সব ছেড়েছুড়ে সিনেমা বানানো শিখতে চলে যাব।
হায় সেই আমি এখনও আশায় আছি।
নতুন মন্তব্য করুন