আজ অনেকদিন পরে ভিক্টোরিয়া পার্কে গেলাম - টরান্টোতে বাংলাদেশীদের নিজেদের এলাকা। কানাডার বাংলাদেশী কমিউনিটির সাথে আমি কোনো এক অজানা কারনে কখনই একাত্ম হয়ে যেতে পারিনি, আর কানাডিয়ান বাংলাদেশীদের সাথে আমার যোগাযোগের এই অপূর্ণতার কারনে বাঙালি পাড়াতেও তেমন একটা যাওয়া হয়ে ওঠে না।
আজ যাবার কারন কোন ব্যক্তি নয় বরং নেহায়তই তুচ্ছ মীন - ইলিশ। গত এক মাস থেকে প্রথম আলো থেকে শুরু করে আনন্দবাজার সবটাই ইলিশে ইলিশময়। কবে ইলিশের দাম বাড়লো-কমলো, কবে বাংলাদেশ রপ্তানী বন্ধ করলো আর কবে কোলকাতার কোন ব্যবসায়ী বাংলাদেশী বলে মিথ্যা ইলিশ চালিয়ে দিল তার কোন খবরই বাদ পড়ছে না।
অদ্ভুদ কারনে এই মাছটির প্রতি আমার কোনো কালেই কোনো টান ছিল না। আমি আক্ষরিক অর্থেই সর্বভূক। খাদ্য, সে খাদ্যছকের যে খোপেই থাকুকনা কেন, আমার পাতে স্বাগত জানাতে আমার দ্বিধা থাকে না। সে হিসেবে দেশে থাকতে ইলিশও খেয়েছি অফুরন্ত, কিন্তু বাঙালির ইলিশ-প্রীতিটা আমার অজানাই ছিলো। পরবাসী হবার পরও কখনও কোনো টান অনুভব করিনি। আর রান্নায় অরূচি বিধায় এটা সেটা রান্না করার কৌতুহলটাও আমার নেই। কিন্তু গত ক'দিন থেকে কল্পনায় আমি কেবল ইলিশ দেখছি। শেষ ইলিশ খেয়েছি কবে মনেও নেই, কিন্তু মস্তিষ্ক একটা আজিব জিনিস! কবে খেয়েছি সেটা মনে না করতে পারলেও স্বাদটা ঠিকই হুট করে রসনায় নাড়া দিয়ে যায়। কিন্তু উপায় ছিলনা, রিসার্চের কাজে ব্যস্ত আমাকে সময়ের অভাবে শুকনো রুটি চিবুতে হয়, হয়তো উপরে এক প্রলেপ পিনাটবাটার পড়ে। সে ব্যস্ততার ফাঁকেও আমি মাকে ফোন ঘুরাই ইলিশের রেসিপিটা জেনে নিতে।
গতকাল রিসার্চ রিপোর্টের একটা আংশিক খসড়া জমা দেবার পরে আজ আমার ছুটি। তাই নিজেকে পুরস্কার দিতেই হয়তো... দেড় ঘন্টার বাস-ট্রেনের ধকল সামলে চলে যাই ভিক্টোরিয়া পার্ক। জায়গাটা আমার তেমন ভাল লাগে না (কেন লাগেনা সেটা অন্য লেখার বিষয়বস্তু) তাই ইলিশ কিনেই ফিরতি পথে হাঁটা দেই। ডেন্টোনিয়া পার্কের কাছে এসে সিগারেটও জ্বালানো হয়।
ঠিক সে মুহুর্তে আমার নজর পড়ে এক পৌড়া মহিলার দিকে। মাঝারী উচ্চতার, একটু মোটাসোটা, শ্যামলা, শক্ত করে বাঁধা চুল, পায়ে ফ্ল্যাট স্যান্ডাল আর এক হাতে ভারী বাজারের ব্যাগ। মহিলা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশী। কি করে নিঃশ্চিত হলাম? কারনটা ধরে নিতে পারেন বাঙালি এলাকায় উনার হালকা হলুদ রঙের লম্বা ঝুলের সালোয়ার কামিজ, যেমনটা আমাদের মা খালারা পড়ে থাকেন। কিন্তু আমাকে জিজ্ঞেস করলে বলবো, "কারন, আমি জানি"! কারও কারও মাঝে বাংলাদেশীত্ব এত মমতা নিয়ে ফুটে ওঠে যে উপরের আবরণ যাই থাকুক না কেন, একবার দেখেই দৃপ্তভাবে বলে দেয়া যায় - "বাংলাদেশী!"
উনি তাকিয়ে দেখলেন আমি সিগারেট ধরাচ্ছি, বাংলাদেশী গুরুজনদের মতই উনার ভ্রু সামান্য কুঁচকে গেল। অস্বীকার করবো না কানাডা আমার মাঝে অনেক পরিবর্তন এনেছে, হুটহাট এর তার সামনে আমি সিগারেটে ঠিকই টান দিতে পারি, কিন্তু ভদ্রমহিলার দৃষ্টির সামনে আমি বিব্রত হয়ে যাই।
উনি যাচ্ছিলেন উল্টো পথে, তাই এই দেখা কয়েক সেকেন্ডের বেশী স্থায়ী ছিলনা। ভদ্রমহিলা ব্যাগের ওজনে একপাশে ঝুঁকে, পা ঘষে চলে যান। কিন্তু এটুকে সময়ই আমাকে কাঁপিয়ে দেয়। আমি ব্যাখ্যাতীত এক গাড় মমতা অনুভব করি আমার মা কিংবা খালার মত মহিলাটির জন্যে। আমার মনে হয় যেন উনি আমার অতিপরম আত্মীয় কোন। সেই মমতাটা বিষাদ, আবার হঠাৎই বিষাদ থেকে দুঃখে রূপান্তরীত হয়ে যায়!
আমার হয় এমন।
হঠাৎ কোন কারনে মনটা হুট করে খারাপ হয়ে যায়। মনে হয় দুঃখী সবার মাথায় হাত রেখে বলি, "ভাইরে, বোনটি আমার, বাবা, মাগো... সব ঠিক হয়ে যাবে, আছিতো আমি সাথে! আছি!"
বিধাতা পুরুষ করে বানিয়েছেন, চোখ দিয়ে পানি পড়ে না, বাষ্প হয়ে উড়ে যায়। কিন্তু সেই বাষ্প আবেগেই আমার গলা বুঁজে আসে, আমি কথা-চিন্তার খেই হারিয়ে ফেলি।
***
অনেক সমস্যা আমার দেশটাতে।
কিন্তু আমার এই দেশটাতে যে আপনার পেটে চাকু মারবে, সেই তারই আরেক রূপ সারারাত হাসপাতালে জেগে হাউমাউ করে কাঁদবে আপনার জন্য। যে রাস্তায় আপনি ভিক্ষা করে পথচারীর লাথি খান, সে পথচারীরই আরেক রূপ মোড়ের মুড়িওয়ালা হয়ে আপনাকে প্রতিদিন দিয়ে যাবে এক ঠোঙা মাখানো মুড়ি। যে দুঃখে আপনি কাঁদেন, সেই দুঃখেই আপনার বন্ধুটি কাঁদবে আপনার সাথেই।
রোমান্টিক শোনাবে হয়তো, কিন্তু বিদেশের মাটিতে মৃত্যু হতে পারে এ ভাবনাটাই আমাকে কাতর করে। আমার ইচ্ছে করে আমার মৃত্যুর সময় দু'একটা বাংলা কথা শুনি। আমার জানাজায় আসুক মহসিন, যার চা'র দাম হয়তো এখনো বাকি পড়ে আছে। পাড়ার চেনা রিক্সাওয়ালাটা একটিবার হলেও বাসার সামনে দিয়ে যাবার সময় ভাবুক, "ভাইয়া লোকটা খারাপ আছিলো না..."
খুবই সংকীর্ণ এসব চিন্তা, বিশ্বনাগরিকের মত নয় মোটেই। কিন্তু সব টানতে গেলে যে টানা হয়না কিছুই!
***
আমার মনে হয় এইযে ভদ্রমহিলা একা এত ভারী বোঝা টেনে নিয়ে যাচ্ছেন, কেন? এটা দেশে থাকলে কি তাঁর করতে হতো? এখানে কিসের মোহে পড়ে আছেন তিনি?
ছেলে নিয়ে এসেছে নাতীর দেখাশোনা করতে? বউমা অফিসে যায় বাসা খালি রেখে? রান্না-বাজারটা হয়তো তাঁরই করতে হয়। দেশেও একই অবস্থা হতো, হয়তোবা একটু বেশিই খারাপ হতো, কিন্তু সে দুঃখের আলাপতো তিনি করতে পারতেন কলেজের সেই বান্ধবিটির সাথে... রাস্তায় হাঁটার সময় একটা বখা ছেলেও তো অন্তত্য সালাম দিত, লুকানোর চেষ্টা করতো সিগারেটটা... মোড়ের মুদি দোকানদারটা হয়তো বলতো, "খালাম্মা, ব্যাগটা ভারী... ওই পিচ্চি, ব্যাগটা আগায় দিয়া আয়।"
ওই যে বললাম রোমান্টিক!আর শুনুন বলি, রোমান্টিকতার কোন যুক্তি থাকে না।
হাঁটার গতি শ্লথ হয়ে আমি একটা দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়ি... মাটিতে অঙ্গুল ছুঁয়ে কেবল বলি, "আহারে!"
© অমিত আহমেদ
[যৌথভাবে সচলায়তন ও আমার ব্লগস্পটে প্রকাশিত]
মন্তব্য
এইটা বেহুদা পোস্ট ক্যান!?
স্বপ্নের মতোন মিলেছি সংশয়ে...সংশয় কাটলেই যেনো মৃত্যু আলিঙ্গন...
স্বপ্নের মতোন মিলেছি সংশয়ে...সংশয় কাটলেই যেনো মৃত্যু আলিঙ্গন...
যেসব পোস্টের কোন মা-বাপ নাই ("মাথায় হুট চিন্তা - ব্লগে হুট লেখা" টাইপ) সেগুলোকে বেহুদা পোস্ট হিসেবে চিহ্নিত করছি। এই সিরিজের এটা আমার ৩য় লেখা।
আমার বেলা যে যায় সাঁঝ-বেলাতে
তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে
খারাপ লাগল।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
অসাধারণ!
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
দারুণ!
কারও মাঝে বাংলাদেশীত্ব এত মমতা নিয়ে ফুটে ওঠে
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
লেখার নামকরণ গৌন হয়ে গেছে সবার আবেগে। আপনাদের ভালবাসায় লেখাটা আর বেহুদা থাকলো কই!
তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে
বে-হুদার বে-কেটে ইহাকে হুদাসর্বস্ব করা হোক!
সুন্দর লিখেছেন। মনের কথা।
-যা দেখি তা-ই বলি...
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
বিশ্বনাগরিক আর হলাম কই?
অমিত, অনেক বেশী ছুঁয়ে গেলো এই লেখা ।
-----------------------------------
'পড়ে রইলাম বিধির বামে,ভুল হলো মোর মুল সাধনে'
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
অসাধারন! একই সাথে মন ভালো এবং খারাপ করা লেখা।
সেন্টু খাইলাম।
আমিও দেশে গিয়া মরতে চাই...
( মাঝে মধ্যেই ভাবনাটা আসে মনে)
---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)
------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...
ভাবনার সাথে লেখা এভাবে সহসা সরে না। ধন্যবাদ।
পুরা রেটিং রইল।
----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।
----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।
বাহ্!
আসলেই মন ভাল আর খারাপ করা পোস্ট।
আমার মেজমামাটা মারা গেল ৯ তারিখে আমেরিকায়। ছোটকালের খুব কাছের এই মামার সাথে আমার সাথে শেষ দেখা ছিল প্রায় এক দশক আগে। তারপর কে কই ছিটকে পড়লাম! খুব চেয়েছিল দেশে ফিরতে। কিন্তু শেষদিকে এত কষ্ট পেল যে সেটা আর হল না। আমি এখনো ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না পুরো ব্যাপারটা। হঠাৎ হঠাৎ মনে হচ্ছে, আর বুকটা ফেটে যাচ্ছে। মনটা খারাপ এমনিতেই ছিল, আরো হল।
তবে লেখার অনেক কিছু মিলে গেল। সিঙ্গাপুরের বাঙালিপাড়ায় আমিও না পারতে যেতাম না, এই মালয়েশিয়াতেও যখন দেখি আমাকে হুট করে দেখলে মালে'ই মনে হয়, বাঙালি ভাইয়েরা ঠিক ধরতে পারে না আমি আসলে 'দেশী' - তখন বেশির ভাগ সময় স্বস্তিই পাই। কিন্তু সেটা আসলেই অন্য কোন লেখার বিষয়বস্তু।
ভাল আছি, ভাল থেকো।
ভাল আছি, ভাল থেকো।
হমম
লেখাটা পড়ে মন খারাপ হলো কিছুটা, নানা কারণে। বেহুদা সিরিজে আরো লেখা আসলে হয়তো মনটা ভালো হয়ে যাবে।
হাঁটুপানির জলদস্যু
আজ পর্যন্ত আমরা প্রবাসীরা দেশের জন্য যা কান্নাকাটি করলাম, সেটা দিয়েই বাংলাদেশকে ডুবায় দেওয়া যাবে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং লাগবে না।
________________________________
suspended animation...
সবাইকে অসংখ্য, অসংখ্য ধন্যবাদ! আমার একন্তই ব্যক্তিগত আবেগ আপনাদের মাঝে এভাবে সংক্রামিত হয়ে যাবে আমি ভাবিবি!
তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে
এই কারণেই আর দশজন প্রবাসী থেকে সাব্বির তুই আলাদা।
আর দশ জন চায় এই কানাডার মাটি কামড়ে পরে থাকতে আর তুই?
মনিটর ঘোলা হয়ে আসছে। বাস্পই মনে হয়।
বার্লিনের রাস্তায় এশিয়ান খুঁজে মেলা ভার। উপমহাদেশের কারও কদাচীৎ দেখা পেলে বেহায়ার মত তাকিয়ে থাকা হয় উভয়েরই। তার মধ্যেও বুঝতে পারি কোনটা দেশী ভাই, কোনটা শ্রীলন্কান, কোনটা পাকিস্তানী। এ কোন মাটির টান!
************************************
পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?
পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?
কষ্ট গলার কাছে দলা বেধে আছে। এমন করে লিখেন কীভাবে?
----------------------------------------------
আমাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে একটা নদী-
সাথে নিয়ে একটা পাহাড় আর একটা নিঃসঙ্গ মেঘ।
ভাল।
নতুন মন্তব্য করুন