সিন্ডি “গালা”-র সামনে বারে বারে কেনো “গ্র্যান্ড” বসাচ্ছিলো তা রহমান বিল্লাহ অনুষ্ঠানে এসে বুঝতে পারেন। মেয়েটির ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ফার্ম তুলকালাম কান্ড করেছে! এতো চটকদার অনুষ্ঠানে আসার সুযোগ রহমান বিল্লাহর আগে কখনো হয়নি।
শহরের অন্য প্রান্তে উপশহরের সীমানা জুড়ে প্রকান্ড দালান। রানীর সম্পত্তি ছিলো। পাউন্ডের দাম পড়ে যাবার পর রাজপরিবার অনেক প্রাসাদ বিক্রি করে দিয়েছে, কিংবা ভাড়া দিয়েছে। এই প্রাসাদটি তেমনই একটি। ষোড়শ শতাব্দীতে তৈরী। অসাধারণ স্থাপত্য। মার্বেলের মেঝে, পেতলের কারুকাজ, কাঠের নৈপুন্য, সাদা খিলান আর প্রকান্ড থাম। মাথার ওপরে পাশের দেয়ালা নাম জানা না জানা শিল্পীদের আঁকা পৌরাণিক চিত্রকল্প। ছাঁদের কোনা থেকে উঁকি মেরে থাকা গারগয়েল। সুবিশাল জানালা জুড়ে ভারী মখমলের পর্দা।
এতো সুন্দর দালানের আলাদা সজ্জার প্রয়োজন পড়ে না। বুদ্ধিমতী সিন্ডি সে চেষ্টাও করেনি। প্রাসাদের অলংকরণ যেমন ছিলো ঠিক তেমনি রেখেছে। কেবল আলোকসজ্জা আর শিফন দিয়ে পুরো বলরুমটিকে আরও মায়াময় করে তুলেছে। হঠাৎ ঢুকে ধাক্কা খেতে হয়। মনে হয় অন্য কোনো কল্পরাজ্যে ঢুকে পড়লাম বুঝি। আঁধারীতে ছিটিয়ে থাকা সাদা-কালো টক্সিডো লাল বো-টাই আর ঝলমলে নারী-পোষাক। নাচের জায়গা ঘিরে খাবারের স্তুপে প্রকান্ড টানা টানা কাঠের টেবিল। তার চার পাশজুড়ে জাদুকর, জিপসী গণক আর স্বল্পবসনা পরিবেশীকার দল। টুং-টাং শব্দে শ্যাম্পেনের গ্লাস। চাপা গলার হাসি।
রহমান বিল্লাহর হুট করে ক্ষুধা পায়। ডিনারের বেল বাজেনি, এখন চাইলেও খাওয়া যাবে না। তিনি আস্তে আস্তে খাবারের টেবিলের দিকে সরে আসেন। এখন টুক করে একটি স্প্রিংরোল তুলে নিলে কেউ কী লক্ষ্য করবে? রহমান বিল্লাহর নিজেকে কেমন অসহায় মনে হয়। বাংলাদেশের কথা মনে পড়ে। সেই ছোটবেলার কথা। তখন প্রেক্ষাপট অন্য ছিলো। স্বল্প আয়ে তার বাবা দুইবেলা পাতে খাবার তুলে দিতে পারতেন না। দুপুরে মা বেরুতেন কলমী শাকের সন্ধানে। আজ নিজেকে, এতো খাবারের সামনে, কেমন অচ্ছুত মনে হয়। মনে হয় এই ঘরে তার উপস্থিতি একটি নিছক দুর্ঘটনা মাত্র। কিংবা খুব অশ্লীল কিছু। রহমান বিল্লাহ আড়চোখে চারদিকে তাকিয়ে একটি টেবিল থেকে একটি ডাম্পলিং তুলে মুখে পুরে দেন। ভেতরে কী দেয়া? পর্ক না তো?
সবাই ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে গল্প করছে। টুক করে কোনো দলে ঢুকে গেলে কেমন হয়? বড় মানুষদের বড় আলোচনা। গলফ কিংবা নতুন কেনা কোনো কান্ট্রিহাউসের আলাপ। তেলের দর কিংবা পাউন্ডের পতন। রহমান বিল্লাহ পাকা বাঙালির মতো চারপাশে বাদামী চামড়ার মানুষের খোঁজ করেন। জাজ ফার্গুসনের নতুন সেক্রেটারি মায়া বাদে আর কাউকেই নজরে পড়ে না। মায়া জাজের সাথে একদম সেঁটে আছে। জাজ ফার্গুসনের পক্ষাঘাতগ্রস্থ বউয়ের নাম যেনো কী? নাটালি? নাকি নাটালিয়া? আচ্ছা মায়া মেয়েটির গল্প কী? কোন দেশের? ভারত? নাকি বাঙালি? কখনো জানা হয়নি।
রহমান বিল্লাহর হঠাৎ খুব বাঙলা বলতে ইচ্ছে করে। এখন যদি তিনি হেঁটে গিয়ে মায়াকে বলেন, “এক কাপ চা খাওয়াতে পারবে মায়া?” তাহলে কেমন হয়? ঠিক দেশের মতো কড়া লিকার, ঘন-দুধ আর বেশি চিনি দেয়া চা। ঠিক যেমনটি কোনো বিশেষ দিনে কালো গাইয়ের দুধ নিয়ে মা বানাতেন।
বিল্লাহ আরেকটি ডাম্পলিং তুলে মুখে দিতে দিতে ধরা পড়ে যান। ডাচেস ফ্রিডা ঠিক তার দিকেই তাকিয়ে আছেন। রহমান সাহেবের লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে হয়। ডাচেস তার পাশে দাঁড়ানো এমপি রায়ার্সনকে কী যেনো বলেন। বাদামী মানুষের হাভাতে আচরণ নিয়েই কী? রহমান বিল্লাহর জমা করে রাখা সব আত্মবিশ্বাস পেজা তুষারের মতো ঝরে ঝরে পড়ে।
এই চটকের মেলা তো তার জন্য নয়। কেনো জোর করে মানিয়ে নেবার চেষ্টা? কিসের এই দায়বদ্ধতা? একটি ছোট টিনের ঘর। বাম পাশের পুকুর ছুঁয়ে আসা ভেজা বাতাস। সামনে ধানের ক্ষেতে বয়ে যাওয়া সবুজ স্রোত। দেয়ালে চেনা টিকটিকির টিক-টিক। সামনের উঠোনে শুকাতে দেয়া ধান। আর এক পাশে তাকিয়া পেতে মুঠো ভরে মুড়ি-গুড়। হয়তোবা একগ্লাস গরম দুধ। কিংবা হয়তো ঠান্ডা খেজুরের রস।
রহমান বিল্লাহর কল্পনায় আঁধার নেমে আসে। সব আলো বিলীন হয়ে ঝলমল করে ওঠে বলরুমের মাথায় গড়া ছিমছাম পাটাতন। মাইক্রোফোন হাতে স্টেজে উঠে আসে দেশের সব চেয়ে সুন্দরী মেয়েটি। হাতের রেডওয়াইন নাচিয়ে মজা মজা স্বরে মেয়েটি বলে, “নাহ। রেকর্ড মুনাফার পার্টি এটি নয়। এটি পৃথিবীর ষষ্ঠতম ধনীর ছবি ফোর্বসে আসার আনন্দ-উৎসব…” বলরুমে হাসির রোল ওঠে। রহমান সাহেবের পাশে কে যেনো দাঁড়ায়। মায়া! বলে, “অসাধারণ পার্টি!”
রহমান বিল্লাহ কী বলবেন তা বুঝে ওঠার আগেই বলরুমে তালির ঝড় ওঠে। এতো মানুষের তালিতে কেমন যেনো বিভ্রম জন্মে। মনে হয় এ যেনো টিনের চালে হঠাৎ নামা ঝুম বৃষ্টির আওয়াজ। মায়ার বুক থেকে উঠে আসা ঘ্রানকে মনে হয় মাটির মিষ্টি সোঁদা ভাঁপ। সেই ভাঁপে তার চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে। তিনি মোহাবিষ্ঠের মতো হাঁটতে শুরু করেন।
স্টেজের সিড়ির ধাপ ভাঙতে ভাঙতে সব কেমন যেনো পরিস্কার হয়ে যায়। বৃষ্টির ছাঁট হয়ে যায় ছিটিয়ে দেয়া গোলাপের পাঁপড়ি। বৃষ্টির আওয়াজ ধনী মানুষের উচ্ছাস। আর ঠুনকো আত্মগ্লানী হয়ে ওঠে আত্মবিশ্বাসী প্রগল্ভতা। নুয়ে থাকা বাদামী মানুষটির গালে আলতো চুমু দেয় দেশের সব চেয়ে সুন্দরী মেয়েটি। আর টানটান হয়ে মাইক্রোফোন তুলে নেন রহমান বিল্লাহ। খাঁটি ব্রিটিশ উচ্চারণে সবাইকে হাসিয়ে বলেন, “আজ ডিনারের সাথে আমার ছবি সহ ফোর্বস এর নয়া সংখ্যা ফ্রি!”
© অমিত আহমেদ
দ্বিতীয় প্রকাশ: ই-গল্পগ্রন্থ, "ফেলে আসা গল্প যতো", সীমাহীন সংলাপ, ২০০৯
ব্যবহৃত ছবি: Wheat Field in Rain By Vincent van Gogh
মন্তব্য
খুব ভালো লাগলো গল্পটা। বেশি বেশি ভালো
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
হুম...... ভাল লাগল গল্পটি বিশেষ করে শেষের অংশটি ।
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
- বেশ একটা মোচর খেলাম দেখি। রহমান বিল্লাহ-কে অন্যভাবে কল্পনা করে এগুচ্ছিলাম।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
হুমম... ভালো লাগলো...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
দুর্দান্ত লাগলো ।
আত্মবিশ্বাস ?
অনুগল্প বিশাল ভালো লাগলো।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
মাইক্রোফোন হাতে সুন্দরী মেয়েটা স্টেজে উঠে ঘোষণা দেয়ামাত্রই আন্দাজ করলাম যে এন্ডিংটা এরকম হতে পারে। কিন্তু তারপরও ভাল লাগায় তা প্রভাব ফেলেনি এক বিন্দুও। অসাধারণ একটা গল্প। খুবই ভাল লাগল।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই
এন্ডিংটা ভালো লেগেছে। একটু চমক ছিল বৈকি। এমনই চমক পাঠক হিসেবে তো চাই -ই।
তারেক: অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
নিবিড়: শেষের অংশটি আমারও ভালো লাগে। ধন্যবাদ।
ধুসর গোধূলি: কিছু মানুষের অন্তর আর বাহির খাপ খায় না। বিল্লাহ মনে হয় সেরকম একজন।
নজরুল ইসলাম: হুমমম...
আলাভোলা: জ্বী "আত্মবিশ্বাস"-ই হবে। প্রমাদ ধরিয়ে দেবার জন্য আপনাকে ডাবল ধন্যবাদ।
কীর্তিনাশা: হা হা। আমিও জেনে বিশাল খুশি হইলাম।
অতন্দ্র প্রহরী: প্রহরীর মননকে তাহলে ফাঁকি দেবার উপায় নাই! ধন্যবাদ।
পান্থ রহমান রেজা: থ্যাংকস রেজা।
ওয়েবসাইট | ব্লগস্পট | ফেসবুক | ইমেইল
"মনে হয় অন্য কোনো কল্পরাজ্যে ঢুকে পড়লাম বুঝি। আঁধারীতে ছিটিয়ে থাকা সাদা-কালো টক্সিডো লাল বো-টাই আর ঝলমলে নারী-পোষাক।"
সাধারণত এ ধরনের কথায় বলা হয় "ঝলমলে পোষাক-নারী"। আপনার অন্যরকম বলা দেখে এ লাইনগুলো সবছেয়ে ভালো লাগলো
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
অনেক ধন্যবাদ রানা।
ওয়েবসাইট | ব্লগস্পট | ফেসবুক | ইমেইল
আরেকটি অমিতীয় স্পিন ।
চাঁটগাঁয়ে বৃষ্টি হচ্ছে না কেনু কেনু কেনু???
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
নতুন মন্তব্য করুন