গ্রীষ্মকালীন পাঠ কোনকালেই আমার ঠিক মনমত হয়ে ওঠে না। কানাডাতে গ্রীষ্ম মানে মোটে চারটে মাস, তারপর তাপমাত্রা আবার সেই ঋণাত্বকে গিয়ে নামে। এই চারটে মাস যুক্তি যতই বই-খাতা নিয়ে বসতে বলুক, মন মানে না। গত হপ্তায় আমার দ্রোণাচার্যের (পিএইচডি সুপারভাইসর) সাথে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা হয়েছে। আলোচনার বিষয়বস্তু পরবর্তি শিক্ষাতীর্থে (সেমিনার) আমার আলোচনীয় গবেষণার ফল (পেপার)। ভদ্রলোকের সামনে কোন এক অজানা কারনে আমার উৎসাহ চরমে গিয়ে ঠেকে। আমি ঝোঁকের মাথায় অনেক কিছুই বলে ফেলি। তেমনি বলে ফেললাম সমীক্ষার একটা ছোট্ট খসড়া আমি এ সপ্তাহেই দাখিল করবো। পরে বাসায় এসে বসে থাকলাম গুম হয়ে কম্পিউটারের সামনে। এই প্রতিজ্ঞার মানে এই পুরো হপ্তাটা মাটি।
বাসায় মন ব্যকুল করার মত উপাদ্যের অভাব নেই। জাল (ইন্টারনেট) থেকে ৭০/৮০ টার মত বাংলা বই নামিয়েছি, পুনজন্ম আর কোয়ান্টাম ফিজিক্সের মত উত্তেজক কিছু বইও ইন্ডিগো থেকে কেনা আছে। আর আছে গোদের উপর বিষফোঁড়ার মত অসংখ্য সিনেমার ডিভিডি আর টিভি। তাই ঠিক করি আজ বিকালে সব পেপার নিয়ে বাইরে গাছতলে গিয়ে আসন গাড়ব। প্রকৃতির সানিধ্যে ধুম পড়া হবে।
গ্রীষ্মে সূর্য অস্ত যেতে যেতে রাত নয়টা বেজে যায়। তাই সন্ধ্যা ছ'টাতেও প্রখর সূর্যের তাপ। আমি সাইকেলটা নিয়ে, পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে পাশবর্তী পার্কের দিকে রওনা দেই। পার্কের বেঞ্চ আমার পছন্দের জায়গা গুলির অন্যতম। সুন্দর ঝিরঝিরে বাতাস ভেসে আসে। গাছের মর্মর ধ্বনি, পাখির কিচিমিচির সাথে সুন্দরী ললনাদের মুখ সুখদর্শণ করা যায়। তেমনি একটা বেঞ্চ বেছে আমি গ্যাঁট হয়ে বসে পড়ি। ব্যাগ থেকে খাতাপত্র বের করেছি কি করিনি কোত্থেকে যেন এক দঙ্গল আন্ডাবাচ্চা এসে হানা দেয়। বাচ্চাদেরকে নিয়ে আমার একটা দর্ষণ আছে। সেটি হলো, "যতক্ষণ পর্যন্ত ওরা দৃষ্টি সীমানার মাঝে, স্পর্শ্ব সীমানার বাইরে আছে ততক্ষণ পর্যন্ত ওরা দেবশিশু, কিন্তু স্পর্শ্ব সীমানার মাঝে চলে আসলে সাক্ষাত ইবলিশ সন্তান"।
দর্শণের স্বার্থকতা প্রমান করে ওরা আমার সুন্দর পরিকল্পনাটা নিমিষে ছাই করে দিল। একজন এসে সাইকেল ধরে টানাটানি করে তো আরেকজন ক্যালকুলটর নিয়ে ছুট লাগায়। একজন গায়ে বল ছুড়ে মারে তো আরেকজন কারন ছাড়াই ভ্যাঁ করে ওঠে। দঙ্গলের মা-রা সবাই দূরে চাটাই মত বিছিয়ে চা-বিস্কুট নিয়ে বসেছে, এদিকে মোটেই লক্ষ্য নেই। আমি বিস্ময় নিয়ে দঙ্গলের মুন্সিয়ানা দেখতে থাকি। কানাডা যে কতটা মাল্টিকালচারাল তা পুরোদমেই দেখা যাচ্ছে। দঙ্গলে সাদা, এশীয়, ভারতীয়, ল্যাটিনো সব ধরনেরই দু'একটা স্যাম্পল আছে। আমার দুরাবস্থায় সমব্যথী দেখা গেল এক কোরীয়ান চেহারার বাচ্চার, ৪/৫ বছর বয়স হবে, খুব শান্তভাবেই গোলগাল মুখে কৌতুহল ফুটিয়ে আমার পাশে এসে বসেছে। আমি গলায় মধু ঢেলে জিজ্ঞাস করলাম, "কিহে নাম কি?"
ছেলেটা মনে হয় এর অপেক্ষাতেই ছিল, সেকেন্ডে একটা পাশবিক শব্দ করে পিঠের পেছন থেকে 'ওয়াটার গান' বের করে আমার দিকে তাক করে ঘোড়া টিপে দেয়। শয়তানটা মনে হয় পানি ভরার আগে পানিতে রং মিশিয়ে নিয়েছিল, আমার নতুন কেনা সাদা হলিস্টারের টিশার্টে লাল বিমুর্তমূর্তি জেগে ওঠে। আমি খাতাপত্র সামলে সাইকেল নিয়ে ছুট লাগাই।
পার্ক থেকে একটু দুরেই একটা পুকুর। এই জায়গাটাও আমার ভাল্লাগে। তবে তেমন আসা হয় না, কারন এখানে ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের তেমন কোন তদারকি নেই। পুকুর ঘেড়া বড় বড় বুনো ঘাস, তার মাঝে বুনো মেটে হাঁসের বাসা, ডিম, বাচ্চা। ঘাস ডিঙিয়ে বড় বড় উইলো গাছ। এখানে মানুষের আনাগোনা নেই বল্লেই চলে। আমি একটা গাছের তলে বসে পড়ি। একটা ঘন্টা বেহুদা চলে গেল, আমি ব্যস্ত ভাবে ব্যাগ হাতড়াই। এমন সময় পিলে চমকানো আওয়াজ আসে সামনে থেকে। দেখি ২৫/৩০ টা বুলো হাস রদ্দুর পোহাচ্ছে। গ্রীষ্মে এদের আনাগোনা বাড়ে, শীতকালে এরাই বাংলাদেশের দিকে উড়াল দেয়। আমার মনে একটা শীত শীত ভাব জেগে ওঠে। এই হাঁস গুলোর গত শীতকালটা হয়তো কেটেছে আমার বাংলাদেশেই! পশু-পাখিদের সাথে আলাপ চালানোর একটা পাগলামী আমার আছে, তাই একটু আবেগ নিয়েই জিজ্ঞেস করি, "কিরে ব্যাটা, সব ভালো?"
এতক্ষণ সবাই আমার উপস্থিতি নিয়ে সবাই নির্লিপ্তই ছিল, কিন্তু প্রশ্নটা হয়তও একটু জোরেই করে ফেলেছিলাম সবার মনে হয় আমি লোক ভাল না। সব পাখি তারস্বরে বিখাউজ শব্দে চিৎকার করে ওঠে। আমি সতর্ক হয়ে যাই। কথাবার্তা চালানোর মুডে কেউ আছে বলে মনে হয় না। একটু পরে সবাই থামলে আমার মনে হয়, যে যায়গাটায় বসেছি সেটা ঠিক নিরাপদ নয়। আমার ধারনা সত্য প্রমানিত করতেই যেন পশ্চাৎদেশে তীব্র জ্বালা অনুভুত হয়। খেয়াল করে দেখি গাছের গুঁড়ি ভর্তি লাল লাল দশাশই কাঠ পিপড়ে। ইতিমধ্যেই তাদের কয়েকটা আমার জাঙ্গিয়া ভেদ করে ঢুকে গেছে। খানিক উদ্দামতার পরে আবার সাইকেন নিয়ে ছুট লাগাতে হয়।
এবার চলে আসি বিশ্ববিদ্যালয়ের মানমন্দিরের কাছে। এখানেও কিছু বুনো গাছের বহর, সুন্দর লাল, সবুজ ফল ফলে আছে (জাঝা হতে পারে)। ঠিক করি এখানে যাই হোকনা কেন, যা পড়ার পড়বই পড়বো। কিন্তু বিধাতার মনে তখন অন্যকিছু। সিমেন্ট স্ল্যাবে বসতে না বসতেই দেখি হাতি সদৃশ একটা রেকুন সামনের গাছে ঝুলে আছে। যাদের এই আবর্জনাখেকো প্রানীটির সাথে পরিচয় নেই তাদের বলি, এদের কাছ থেকে যতটা দূরে থাকা যায় ততটাই ভালো। হুটহাট আক্রমন করে বাসার বদভ্যাস এদের আছে।
আমি দির্ঘ্বশ্বাস ফেলে আবার সাইকেলে আসিন হই। মোবাইলটা বেজে ওঠে, আমার সর্বঘনিষ্ট পারস্যদেশের বান্ধবিটি বলে, "কি, পড়ালেখা কেমন চলে?"
আমি উত্তর দেবার ঝামেলায় যাই না, বলি, "১৫ মিনিটে টিম হর্টনসে আস। রক্তে ক্যাফেইনের অভাব অনুভূত হচ্ছে, আই নিড অ্যা ব্রেক!"
(ডিজিটাল ক্যামেরায় তোলা কিছু ছবিও আপলোড করে দিলাম, আপনাদের মনরঞ্জনে)
ওয়েব থেকে নেয়া:
© অমিত আহমেদ
মন্তব্য
টীম হরটনসের ফ্রেঞ্চ ভেনিলাটা আমার প্রিয় ছিল এক সময়
____________________________
লাল গানে নীল সুর হাসি হাসি গন্ধ......
লাল গানে নীল সুর, হাসি হাসি গন্ধ
আপনি কি কানাডাতে??
************************
আমার বেলা যে যায় সাঁঝ-বেলাতে
তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে
আরে না কি কস, সুমন ভাই জার্মানিতে।
বস আরামেই আছ?
আমার প্রোপোজাল সেপ্টেম্বরে
সুমন ভাইকে আবার পাইলেন কই?
************************
আমার বেলা যে যায় সাঁঝ-বেলাতে
তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে
আরে কেমিকাল আলী!
স্বাগতম! শুভ হোক লেখালেখি
-------------------------------------
রামছাগলের সামনে, খচ্চরের পেছনে আর নিবোর্ধের ধারেকাছে না থাকাই শ্রেয়!
কঠ্ঠিন!
-------------------------------------
রামছাগলের সামনে, খচ্চরের পেছনে আর নিবোর্ধের ধারেকাছে না থাকাই শ্রেয়!
ধন্যবাদ অরুপ। সাব্বির, অরুপ কিন্তু নাফিসের ক্লাসমেট।
আরে চোখে ভুল দেখছি, সুজন কে সুমন মনে হ[/i]ইছে
সাব্বিরটা কে?
-------------------------------------
রামছাগলের সামনে, খচ্চরের পেছনে আর নিবোর্ধের ধারেকাছে না থাকাই শ্রেয়!
জী ভানকুভারে । আগে ছিলাম টরেন্টোতে, তখনই ওই বাতিক হইছিল।
আপনি আছেন কোথায়?
____________________________
লাল গানে নীল সুর হাসি হাসি গন্ধ......
লাল গানে নীল সুর, হাসি হাসি গন্ধ
টরান্টোতে আছি। পড়াশোনা করছেন?
************************
আমার বেলা যে যায় সাঁঝ-বেলাতে
তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে
জী না কার্টুন করি ।
___________________________
লাল গানে নীল সুর হাসি হাসি গন্ধ......
লাল গানে নীল সুর, হাসি হাসি গন্ধ
আরে জটিল!
************************
আমার বেলা যে যায় সাঁঝ-বেলাতে
তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে
এই জন্যই কয়,পড়াশুনা বাসায় বইসাই করা মঙ্গল।
-----------------------------------
কিস্তিমাতের যুদ্ধ শেষে,সাদাকালো ঘুটিগুলো এক বাক্সেই ফেরত যাবে...
সেটাই হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি!
************************
আমার বেলা যে যায় সাঁঝ-বেলাতে
তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে
দুর্দান্ত ব্লগিং।
অমিতের (বা সাব্বিরের) লেখার প্রশংসা পড়েছি সামহোয়ারে আজ লেখাটা পড়ে বুঝলাম সেসব প্রশংসার মাজেজা। পড়ালেখা বাদ দিয়ে অমিত যদি শুধু লেখালেখি করেন তবে বিপুল জনপ্রিয় লেখক হবেন তা নিশ্চিত করে বলা যায়।
-----------------------------------------------
গাধারে সাবান দিয়া গোসল দেয়ানোটা গাধাপ্রীতির উজ্জ্বল নমুনা হতে পারে; তবে ফলাফল পূর্বেই অনুমান করা সম্ভব, গাধার চামড়ার ক্ষতি আর সাবানের অপচয়।
-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না
ভালো লাগলো পড়ে। সামনে এমন আরো ভেস্তে যাওয়া লেখাপড়ার সফল বর্ণনার অপেক্ষায় থাকলাম আমরা :)।
হাঁটুপানির জলদস্যু
এর লেখা খারাপ লাগেনা কোন সময়। সবসময় তাজা, তয় একটু দিরং করে। সহজে সিরিজ শেষ করেনা। একেক সময় মনডায় কয়...
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
- আমি খালি কানেকশন খুঁজি। আপনে কি কোন ভাবে হযু মুন্সীর সাথে সম্পৃক্ত?
_________________________________
<স্বাক্ষর দিমুনা, পরে জমিজমা সব লেইখা লইলে!>
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
শোহেইল মতাহির চৌধুরী: বলছেন? আফসোস, এই কথাটাই আমার বাপ-মায় বুঝলো না!
---
হিমু: আমার প্রতিটি পড়ার উদ্যোগই ভেস্তে যাওয়া, তাই আরও পাবার সম্ভাবনা প্রবল
---
নজমুল আলবাব: ঈমানে কইলাম, আপনার লগে দেখা করনের আগে তিনবার কুলহুআল্লাহু পইড়া বুকে ফুঁ দিয়া তবেই যামু!
---
ধুসর গোধূলি: নারে ভাই! হযু মুন্সীটা কে?
************************
আমার বেলা যে যায় সাঁঝ-বেলাতে
তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
নতুন মন্তব্য করুন