এক গ্রুপে এতো বেশি ছাত্র যে সবার সাথে পরিচিত হওয়া অসম্ভব। তবে দু'দিনেই আমার সিটকে বিন্দু আর চারপাশের পাঁচটা সিটকে একটা ব্যাসার্ধ ধরে সেই বৃত্তের সবার সাথে পরিচয় হয়ে গেল। যা বুঝলাম ধানমন্ডি গভঃ বয়েজ স্কুলের একটা সুনাম সবার ভালোই জানা আছে। স্কুলের নাম শুনেই সবাই ভয় আর সমীহ নিয়ে তাকায়, যে কোন বিষয়ে আমার মতামতটা ওদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। আমি আমোদ নিয়ে সেটা উপভোগ করতে থাকি।
আমার দু'পাশের দু'জনের কথা তো বলেইছি, চৌধুরী আর ইজু। জানা গেল ইজু মনিপুরে পড়েছে, মিরপুরের ছেলে। ও একদিনেই আমার বাম হাত মত হয়ে গেল। দশাশই লম্বা, ছ'ফুট তো হবেই - একটা বডিগার্ড বডিগার্ড ভাব। সামনে বনি, পাশা আর তুহিন। বনি আর তুহিনও মিরপুরের ছেলে, তবে মিরপুরের গৌরব তাদের রক্তে নেই। দু'জনেই সাধাসিধা ভাল ছেলে টাইপ। বনির যে কিনা পরে আমার জিগরী দোস্ত হয়ে ওঠে, ওর সাথে আমার প্রথম কথা হলো এরকম,
বনি: "ফোনকার্ড আছে?" (যাদের মনে নেই তাদের বলি, ওই সময়টা এখানে সেখানে টিঅ্যান্ডটির ফোনবুথ গজিয়ে উঠেছিল। ওখানে কার্ড দিয়ে ফোন করা যেত)
আমি: "কেন?"
বনি: "কার্ডে টাকা না থাকলে আমাকে দিবি।"
আমি:"কেন?"
বনি: "কার্ড কেটে গিটারের পিক বানাবো।"
আমি মনে মনে বললাম, জর্জ হ্যারিসনের ছানা এসেছেন, গিটারের পিক বানাবেন। আবাল কোথাকার।
পাশা ছেলেটা কারো সাথেই তেমন কথা বলে না। সারাক্ষণ নোট নেয়া আর অবসরে সেই নোট পড়াই তার কাজ।
পেছনে ছিল সবুজ, তানভীর আর অনি। সবুজও কাকতালীয় ভাবে মিরপুরেই থাকে। সে আবার মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের একনিষ্ঠ সমর্থক। ঢাকা আর মিরপুর স্টেডিয়ামের বেশ কিছু গেটম্যানের সাথে তার চরম বোঝাপোড়া, সে সুযোগ কাজে লাগিয়ে সে সময়টাতে বিনা টিকেটে আমরা দু'জন অনেক ফুটবল ম্যাচ দেখেছি। তানভীর ছেলেটা সহজ সরল, অন্যদের অনুকরন করতে করতেই তার সময় যায়। আমি হয়তো স্যার চলে যাবার পর ক্লাসের মাইক্রোফনটা নিয়ে কেরামতি করছি, পরের ক্লাস শেষে দেখা যাবে সেও তাই করার চেষ্টা করছে।
অনি ইংরেজীতে যাকে বলে "মামা'স বয়"। তুমি তুমি করে কথা বলবে, সব কিছুতেই মাকে টেনে আনবে। একটা উদাহরণ দেই।
আমি: "অনি, চল আজকে টিফিনে প্যাটিস মারি।"
অনি: "আম্মা বলছে ওই প্যাটিস গুলা ভালো না। আমাকে আম্মা রুটি-ডিম দিছে টিফিনবক্সে ভরে।"
অবিসশ্বাস্য ভাবেই ওর মুখটা আবার অসম্ভব খারাপ। সম্ভবত সে কথাটা বলেছিল এভাবে,
"আম্মা বলছে ওই প্যাটিস ভালো না। খানকীর পোলারা কি না কি সব দিয়া বানায়। চুতমারানী তুমি ওইটাই খাইবা না? হাউয়ার নাতি, বাসা থেইকা টিফিন আনতে পারো না? আম্মা আমাকে রুটি-ডিম দিছে টিফিনবক্সে ভরে।"
আরও এখানে সেখানে পরিচয় হয়ে গেল পরাগ, হাসান, আরেফিন, মিশু, জয়ন্ত সহ আরও অনেকের সাথেই। পরে হয়তো আসবে ওদের কথা।
আমাদের ক্লাসটিচার ছিলেন এসি দাস স্যার। কেমিস্ট্রির শিক্ষক। উনাকে নিয়ে দু'টো কথা প্রচলিত ছিল, একটা হলো তিনি ক্লাসে ঢোকার আগে নাকি দু'পেগ মেরে ঢোকেন। কথাটা অবিশ্বাস করার কারন আমরা দেখিনি, কারন উনার চালচলন, কথা বলার ধরন সবই মাতালসদৃশ। আরেকটা হলো, উনার নাকি আমাদের বয়সী রূপবতী এক কন্যা আছে। এ কথাটিও সত্য, চাক্ষুস করেছিলাম পরে।
তিনি একদিন ক্লাসে ঢুকে বললেন, "আজ ক্লাস ক্যাপ্টেন ঠিক করা হবে। তিন জন দরকার, কে কে হতে চাও হাত তোল।"
আমি মনে মনে হাসলাম, সেধে কে ক্যাপ্টেন হতে চায়। স্কুলে সারাটা জীবন ক্যাপ্টেন ছিলাম (বাধ্য হয়ে, নিয়ম ছিল রোল নাম্বার অনুযায়ী ক্লাস ক্যাপ্টেন নির্বাচিত হবে), ন্যাড়া বেল তলায় বার বার যায় না।
দেখা গেল কেবল একজন ছেলে হাত তুলেছে। আমি ভালমত দেখে রাখলাম ছেলেটাকে। এসি দাস স্যার সময় নষ্ট করলেন না, বললেন, "তুমি ফার্ট ক্যাপ্টেন। আরো দু'জন লাগবে।"
সেই দুজন আর পাওয়া যায় না। স্যার ক্যাপ্টেনের সম্মান নিয়ে অনেক লেকচার দিয়েও যখন কাউকে পেলেন না তখন লটারী করে দু'জনকে দ্বিতীয় আর তৃতীয় ক্যাপ্টেন বানিয়ে ফেললেন।
ক্যাপ্টেনের কাজ জানা গেল প্রতিদিন প্রতি পিরিয়ডে উপস্থিতি নেয়া আর নানান খবর টিকটিকির মত স্যারের কাছে পাচার করা। ক্যাপ্টেনের কোন কেরামতি ধরা পড়লে নাকি সরাসরি টিসি দেয়া হবে।
ক্লাস শেষে আমি ইজুকে পাঠাই ক্যাপ্টেনকে তলব করতে। ক্যাপ্টেন ভীত মুখে কাছে আসে। আমি বলি,
"শুন, বেশী ক্যাপ্টেনগিরী যেন না ফলানো হয় ঠিকাছে? এখনই ঠিক কর ফেল তুই আমাদের দলে নাকি স্যারের দলে।"
ক্যাপ্টেন বেশ আত্মবিশ্বাসী গলায় বলে, "একটা কথা কইলি! অবশ্যই তোর লগে আছি! তোরা যা কইবি, তাই করুম।"
"অন্য ক্যাপ্টেন সমস্যা দিবো নাতো?"
"ওদের আমি সিস্টেম দিমুনে, কুনো সমস্যা নাই!"
ছেলেটাকে আমার খুব পছন্দ হয়ে গেল। এর পর থেকে আমার সব কাজের প্রধান সহকারী হয়ে ওঠে তানজিন - গ্রুপ থ্রীর ফার্স্ট ক্যাপ্টেন।
কটা দিন পরে আমাদের ৫/৭ জনের একটা গ্রুপ হয়ে গেল। আমরা ঠিক করে দেই গ্রুপে কখন কি হবে, কে কার প্রাকটিকাল পার্টনার হবে আর কে কবে আমাদের গল্পের বই সাপ্লাই দেবে। তানজিন থাকায় আমাদের দলের শক্তি সীমাহীণ। আমি-ইজু তো আছিই, তার সাথে ক্যাপ্টেনের জোরে তানজিন সুন্দর একে তাকে ঝাড়ি দিয়ে দিতে পারে।
এর ফাঁকে ক্লাস পালানোর একটা সিস্টেম আমি আবিষ্কার করে ফেললাম। প্রথমে ক্লাসে ঢুকেই এসি দাস স্যার নিজে উপস্থিতি নিয়ে নেন। সেটা করতে পাঁচ থেকে দশ মিনিট লেগে যায়। এর মাঝে প্রতিদিনই আরও
ছয় থেকে দশ জন ছাত্র চলে আসে। স্যার ক্লাসে ঢোকার এক সেকেন্ড পরে ঢুকলেও সেটা লেট অ্যাটেনডেন্স। তাই ওদেরকে স্যারের উপস্থিতি টোকা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। এরপর ওরা সবাই একযোগে স্যারের টেবিলের সামনে গিয়ে জড়ো হয়। এ সময়টা ওদের জন্য স্যার ক্লাসে কি হচ্ছে দেখতে পারেন না। সে সময়ে এক ছুটে বেরিয়ে গেলেই কেল্লা ফতে।
তবে হিসাব রাখতে হয় যেন বেশী ছেলে বের হয়ে না যায়। আমাদের দলটা ছাড়া কারও এমনটা করার সাহস নেই, আর আমরা সবাই এক সারীতে বসি। তাই একসাথে ৩ জনের বেশী বেরুনো যায় না। কে কবে বেরুবে সেটা আমি আর তানজিন ঠিক করে দেই।
পরের ক্লাস গুলোতে পালানো আরও সোজা কারন সেগুলোতে তানজিন উপস্থিতি চেক করে। তাই ক্লাসে না আসলেই হয়, আমাদের দলের কাউকেই ও অনুপস্থিত ধরে না। তবে এখানেও কে কোন ক্লাস পালাবে সেটা আমি আর তানজিন মিলে ঠিক করি। একসাথে ৩/৪ জনের বেশী কখনই কাউকে পালাতে দেয়া হয় না। আর আমাদের দলের বাইরে কেউ পালাতে চাইলে আমাদের কাছ থেকে আগে অনুমতি নিতে হয়। আমরা রাজী হলে তবেই এ সুবিধা পাওয়া যায়।
পালিয়ে যে আমরা যে খুব হাতি-ঘোড়া মারতাম তা নয়। ক্লাসের সময়টা কাটতো রফিক মামুর দোকানে আড্ডা মেরে। রফিক মামুর দোকান দ্বিতীয় বর্ষ ছাত্রদের আড্ডাখানা হলেও ক্লাসের সময় কেউ থাকতোনা ওখানে। আমরাই বেশ বড় বড় ভাব করে চা-সিগারেটের চালাতাম।
মাস ঘুরতে এভাবেই আমরা গ্রুপ থ্রীর হর্তাকর্তা হয়ে বসি। যতই দিন যায় আমাদের নাম ফাটতে থাকে। শোনা যায় আমাদের মত অন্য কিছু গ্রুপেও নাকি একই কাঠামোতে দল গড়া হয়েছে। সে মূহুর্তে আমাদের মনে হয় দলটার পরিকাঠামো দেয়া দরকার। আমি আর তানজিন মিলে আমাদের গোপন গ্রুপটির নীতিমালা নির্ধারণ করি। ক্লাবের মুলনীতি ঠিক করা হয়, "অপরাধ ধরা পরার আগে অপরাধ নয়। অন্যের ক্ষতি সাধন না করে, নটরডেমের কটু নিয়ম গুলো বরবাদ করাই আমাদের সাধ্য" আর স্লোগান ঠিক হয় ইংরাজীতে, "মেক নয়েজ!" আরও কিছু নীতিমালা ভরসা করে, গোপনীয়তার শপথ নিয়ে ৫ জন সদস্য (ইজু, সবুজ, বনি, অনি, চৌধুরী) আর আমাকে-তানজিনকে ডিরেক্টর করে জন্ম নেয় "দ্য ক্রাইম ক্লাব!"
***
ক্রাইম ক্লাবের কথা গোপন রাখার পরও কিভাবে যেন কানে কানে ঠিকই ছড়িয়ে পড়লো। আমাদের ঠাঁটবাট ছিল। সবার ল্যামিনেটেড আইডি কার্ড, নামের জায়গায় কোডনেম। সে এক এলাহী করবার। আইডি কার্ড বালানোর আগে আমাদের কোডনেম নিয়ে পুরো একটা দিন কেটে গেল। নাম ঠিক হলো নিন্মরূপ:
১) আমি (ডিরেক্টর) । কোডনেম: মফিজ (কারন সবার ধারনা মফিজ পাগলার সাথে আমার চরিত্রে বিশেষ মিল)
২) তানজিন (ডিরেক্টর) । কোডনেম: চুদ্দুস (কারন চো* ছাড়া তার মাথায় অন্য চিন্তা কমই আসে)
৩) সবুজ । কোডনেম: জগলু (কারন ওকে দেখলেই মনে হয় ওর জন্মই হয়েছে এই নামের জন্য)
৪)বনি । কোডনেম: কোন কোড নেম নাই (কোন কারনও নাই)
৫) ইজু । কোডনেম: হারকিউলিস (ওর দশাশই দেহ ও আসুরিক শক্তির জন্য)
৬) অনি । কোডনেম: ঝইন্টা (লুৎফর রহমান রিটনের একটা টিভি সিরিজ দেখতাম ছোট বেলায়, "ঝন্টু-পন্টু", সে থেকে নামটা এসেছে)
৭) চৌধুরী । কোডনেম: চৌধুরীর পো! (কারন সহজেই অনুমেয়)
ক্রাইম ক্লাব এত জনপ্রিয় হয়ে গেল যে আমাদের দু'জনের কাছে প্রতিদিনই দুই তিন জন ছেলে এসে চাপা গলায় জিজ্ঞাস করতো,
"এই শুন, ক্রাইম ক্লাবের মেম্বার হতে কি করতে হবে!"
অধিকাংশ সময়ই আমাদের জবাব থাকতো,
"ক্রাইম ক্লাব কি?"
এতে লাভের লাভ যা হলো সবার আমাদের ক্লাব নিয়ে আগ্রহ চরমে উঠলো। সবাই সদস্য হতে চায়। টাকা দিয়ে হলেও!
আমরা তাই আস্তে আস্তে সদস্য বাড়াতে লাগলাম। নিয়ম ছিল প্রথমে আবেদনকরীর সাক্ষাতকার নেয়া হবে। তাতে সফল হলে পরে তাকে কোন একটা অপরাধ করতে হবে। সেটা হতে পারে ক্লাস পালানো, কিংবা কুইজে এক জনের পরীক্ষা আরেকজন দেয়া। এতে সফল হলে তবেই পূর্ণ সদস্য পদ আর আইডি কার্ড।
আমরা ক্রাইম ক্লাবে কিছু মার্কা মারা ভালো ছাত্রকে নিঃশর্ত সদস্য পদ দিয়ে দিলাম, তাদের কাজ ছিল আমাদের প্র্যাকলিকালে সাহায্য করা আর ক্লাস নোট সাপ্লাই দেয়া। ওদের কোন আপত্তি ছিল না। ক্রাইম ক্লাবের ল্যামিনেটেড আইডি কার্ড গর্ব ভরে অন্যদেরকে দেখানোতেই ওদের সর্বসুখ নিহীত ছিল।
আমাদের ক্লাবের আরও কথা বলবো পরে। বিশেষ করে কিভাবে ক্লাবটার কথা টিচার্স রুমে ছড়িয়ে পড়লো আর কিভাবে স্যার-ম্যাডামও ক্লাবের ফ্যান হয়ে গেলেন সেটা একটা বলার মতই ঘটনা।
© অমিত আহমেদ
(আর লিখতে ইচ্ছে করছে না।)
মন্তব্য
একদম রাজার হালে ছিলেন দেখি!
আপনার এই সিরিজটা মুগ্ধ হয়ে পড়ছি। দুর্দান্ত লেখনী, আর অসম্ভব মজার!
চালিয়ে খেলুন।
-যা দেখি তা-ই বলি...
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
তুমরাই তাইলে এ-টিম এখন?(পাইছি)
আচ্ছা,শিমুলের সাথে পরিচয় কেমনে?
-----------------------------------
কিস্তিমাতের যুদ্ধ শেষে,সাদাকালো ঘুটিগুলো এক বাক্সেই ফেরত যাবে...
মজা পাইতাছি
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
কনফুসিয়াস: ধন্যবাদরে ভাই।
--
অলৌকিক হাসান: আপনি মিয়া সিরিজ শুরু করে শেষ করেন না। এইটা নিয়া পেরেশানীতে আছি।
--
আরিফ জেবতিক: শিমুলের সাথে পরিচয় পরাগের মাধ্যমে। পরাগের সাথে আমার পরিচয় প্রথম বর্ষের মাঝামাঝি আর ঘনিষ্টতা দ্বিতীয় বর্ষে শুরুতে। তখনই শিমুলের সাথে পরিচয়।
--
নজমুল আলবাব: হেঃ হেঃ
************************
আমার বেলা যে যায় সাঁঝ-বেলাতে
তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে
বাকিটা নামান তাড়াতাড়ি।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
নতুন মন্তব্য করুন