৭ ফেব্রুয়ারী, ২০০৭
সময়: দুপুর ১:০০-১:৪৩
স্থান: পার্ক হোটেল, পার্ক স্ট্রীট, কোলকাতা
অবিরত দাগা খেতে খেতে এমন একটা সময় আসে যখন মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি গুলো ভোঁতা হয়ে যায়। প্রকৃতি এত যত্নের সাথে যে বোধ গুলো আমাদের মস্তিস্কের নিউরনে নিউরনে ছড়িয়ে দিয়েছে তা হঠাৎ করেই যেন নিরর্থক হয়ে পড়ে। আত্মকেন্দ্রীকতা টপকে মনের দখল নেয় সামগ্রীকতা। মনে হয় নিজের ক্ষুদ্র অস্তিত্বের চেয়ে নিজেদের অধিকার আর বিশ্বাস তুলে ধরাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আজ সংবাদপত্রে একটা খবর দেখে রাজীবের তাই মনে হলো। যাত্রার ক্লান্তি, রাত জাগার শ্রান্তির আর পেটে পড়া প্রভাবকের প্রভাবে আজ ওর ঘুম ভেঙেছে দুপুর সাড়ে বারটায়। সেই থেকেই মাথাটা ভার আর মুখটা বিস্বাদ হয়ে ছিল। খবরটা পড়ে সব নিমিশে দূর হয়ে যায়।
পার্ক হোটেলে কর্তৃপক্ষ দরজার নিচ দিয়ে দু’টো সংবাদপত্র দিয়ে গেছে। এসির ঠান্ডা বাতাবরণে কম্বলের আরামদায়ক ওম থেকে উঠে গিয়ে সংবাদপত্র নিতে মোটেই ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু ঘুম থেকে উঠেই সংবাদপত্র পড়ার অভ্যেসটা ওর অনেকদিনের, না পড়লে মনটা কেমন খুঁতখুঁত করে। তাই এক লাফে সংবাদপত্র দু’টো তুলে নিয়েই ও আবার কম্বলের তলায় ঢুকে পড়েছে। সংবাদপত্র দু’টো হাতিয়ে দেখে ও, ইংরেজী স্টেটসম্যান আর বাংলা আনন্দবাজার। ও বাংলাটাই আগে মেলে ধরে।
প্রথম পাতায় সাড়ে তিন কলাম জুড়ে গ্রেগ চ্যাপেলের ছবি - ডান হাতে শক্ত মুঠোয় ব্যাট ধরে বল ছুঁড়ে দিচ্ছেন ফিল্ডারদের দিকে। ক্যাপশন বলছে, “বিতর্কেও অবিচল। মঙ্গলবার শহরে এসেই প্র্যাক্টিসের নেতৃত্বে”। প্রথমপাতার অর্ধেকের বেশী জুড়েই ক্রিকেটের খবর। সৌরভকে নিয়ে এত তুলকালাম হবার পরেও কলকাতাবাসী চ্যাপেলকে ফুল দিয়ে বরণ করে নিয়েছে এতেই আনন্দবাজার মুগ্ধ। ওরা এটাকে বলছে “গাঁধীগিরি”। টার্মটা হালের জনপ্রিয় হিন্দী সিনেমা “লাগে রাহো মুন্না ভাই” থেকে তুলে নেয়া। সেখানে মুন্না ভাইয়ের বেশে সঞ্জয় দত্ত মহাত্মা গান্ধীর আদর্শে আদর্শিত হয়ে হাতেকলমে দেখিয়ে দেন সময় যতই পাল্টাক, গান্ধীর সত্যাগ্রহ, অহিংস নীতি আর সত্য, যা একসাথে অশিক্ষিত মুন্না ভাইয়ের ভাষায় হয়ে যায় “গাঁধীগিরি”, সব পন্থার সেরা পন্থা। এমনিতেই কিছুদিন আগে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট টিম কলকাতা থেকে একটা ন্যাক্কারজনক অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে গেছে। তাই চ্যাপেল আসলে কি হয় সেটা নিয়ে সবাই মনে হয় সবাই একটু ভয়েই ছিলেন। সে ভয়কে অমুলক করে দিয়ে আমজনতার চ্যাপেলকে বরণ করে নেয়া দেখে কলকাতার আনন্দবাজার এত তৃপ্ত যে সেই তৃপ্তির ঢেকুরে চাপা পড়ে গেছে সিঙ্গুর ঘটনা আর তৃণমূল আন্দোলন। তবে দিনের সেরা খবরটা ঠিকই গুরুত্ব নিয়ে ছাপিয়েছে ওরা। গ্রেগ চ্যাপেলের ছবির ঠিক উপরেই চার কলামে এক ইঞ্চির শিরোনাম, “বাস জ্বালাবেন? জ্বালিয়ে দিন, আমরা নামবো না”।
কাহিনীটা এ রকম, গতকাল রাজ্য জুড়ে দু’টো-তিনটের রাস্তা-রেল অবরোধকে স্বাগত জানিয়ে ঠিক দু’টোর সময়ই ধর্মতলামুখী কলকাতা ট্রামোয়েজ কোম্পানির বাসটি দাঁড়িয়ে পড়ে কোনা এক্সপ্রেসওয়ের উপরে বাকসাড়ার রাস্তায়। সেখানে আগে থেকেই রাস্তার দখল নিয়ে ছিলেন তৃণমূলের কর্মীরা। পুরো বাস ভর্তি গিজগিজে মানুষ, একটা আসনও খালি নেই, অনেকেই দাঁড়িয়ে। হঠাৎ করেই বাসে তৃণমূল কর্মীরা উঠে এসে যাত্রীদেরকে বলেন, “আপনারা বাস থেকে নেমে যান। এই বাসটা আমরা জ্বালাবো!” কেন? সে প্রশ্নের জবাব হলো, “সরকারী বাস। আপনারা না নামলে আপনাদেরকে সহই জ্বালিয়ে দেয়া হবে।” এ পর্যায়ে যাত্রীদের অনেকে ভয়ে নেমে গেলেও একটা বড় অংশ থেকে যান বাসেই। তাঁদের কথা হলো, “বাস জ্বালালে জ্বালান। আমাদেরকে নিয়েই জ্বালান। এত বড় আন্দোলন আপনাদের, সেজন্য না হয় প্রানই দেব!” অনেক হম্বীতম্বী করেও তাঁদেরকে বাস থেকে নামাতে না পেরে তৃণমূল কর্মীরা শেষ পর্যন্ত বাস জ্বালানোর পরিকল্পনায় ক্ষ্যামা দেন।
দুঃস্বপ্নের মত রাজীবের মনে পড়ে যায় ৪ জুন ২০০৪, ঢাকার সেই ভয়ানক ঘটনাটা! তার পরদিন ৫ তারিখে আমেরিকার তৎকালীন প্রতিরক্ষা সহকারী ডোনাল্ড রামসফেল্ডের ১৪ ঘন্টার ঝটিকা সফরে ঢাকায় আসার কথা। আসার কারনটা আগে থেকেই জানা, তিনি আনুষ্ঠানিক ভাবে বাংলাদেশ সরকারকে ইরাক আর আফগানিস্তানে সৈনিক পাঠানোর প্রস্তাব দেবেন। বাংলাদেশ যে সে আবেদনে “না” বলবে সেটাও দেশের মিডিয়া আগে থেকেই জেনে বসে আছে।
বাংলাদেশে তাঁর আগমনের প্রতিবাদ জানাতে একদিন আগে থেকেই সারাদেশে বাম আর ইসলামীক দলগুলো প্রতিবাদ কর্মসূচি রেখেছে। পরদিন সকাল-সন্ধ্যা হরতাল। সেদিন রাত্রে বিআরটিসির গুলিস্তান-মিরপুর রুটের দোতলা বাসটি হোটেল শেরাটনের সামনে সবে এসে থেমেছে, কে বা কারা যেন অতর্কিতে যাত্রীসহ বাসটিতে আগুন লাগিয়ে দেয়! ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটে যায় যে কিভাবে কাজটা করা হয়েছে সে নিয়েই দেশে তর্ক-বিতর্ক চলে অনেকদিন। তবে ঘটনাটা যে পূর্ব পরিকল্পিত ছিল সেটা নিশ্চিত ভাবেই বোঝা যায় নিমিশে সারা বাসে আগুন ছড়িয়ে পড়া দেখে। কারণ সেটা জ্বালানীর ব্যবহার ছাড়া সম্ভব নয়। দু’বছরের মেয়ে শিশুসহ সেই বাসেই জীবন্ত দগ্ধ হন নয় জন! রাজনৈতিক দলগুলো একে অন্যকে দোষারোপের খেলা খেলে সেই কেচ্ছা সেখানেই সমাপ্ত করেন। আইনের হাত গলে পালিয়ে যায় প্রকৃত দোষীরা।
রাজীব জানে কোলকাতার প্রেক্ষাপটটা আলাদা। এখানে তৃণমূলের আন্দোলনে পিকেটাররা বাসে আগুন দিলে একে অন্যকে দোষারোপের সুযোগটা থাকতো না। তীর ছুটে যেত এক তৃণমূলের দিকেই। সেটা নিশ্চই তাঁদের কর্মীদের বিবেচনায় ছিল। তবু কেন জানি ভাল লাগে ওর। মনে মনে বাসযাত্রীদের ধন্যবাদ দেয় ও। দেশের সম্পদ পুড়িয়ে যে আন্দোলন হয় না সেটা তাঁরা বুঝতে পেরেছেন, সেজন্য। সেই সাথে তৃণমূলকেও। আগ্রহের আতিশয্যে যাত্রীপূর্ণ বাস জ্বালাবার যে দাপটটা তাঁরা দেখাতে পারতেন কিন্তু দেখাননি, তার জন্য।
বড় একটা শ্বাস টেনে বিছানায় উঠে বসে রাজীব, আস্তে আস্তে ক্ষুধা চাঁড়া দিচ্ছে। এখন নিচে গিয়ে খেতে ইচ্ছে করছে না। গতকাল বিছানার পাশের দেরাজে খাবারের একটা মেনু দেখেছিল, সেই মেনু থেকে রিসিপশনে বলে দিলেই রুমে খাবার পাঠিয়ে দেবে। প্রথম ড্রয়ারটা খুলে একটা বাইবেল হাতে পড়ে ওর। এটা ও আগেও অনেক হোটেলে দেখেছে। দামী হোটেলে রুমে একটা বাইবেল থাকবেই থাকবে। ব্যাপারটা ওর ঠিক বোধগম্য হয় না। বাইবেল যদি থাকে তাহলে গীতা, তাওরাত কিংবা কুরান রাখতে সমস্যা কি? নাকি ওরা ধরে নিয়েছে এক বাইবেলই যথেষ্ঠ? সেই হিসাবটা কিভাবে করা হয়? কলকাতায় ক্রিশ্চিয়ান বেশি এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। তবে কি হোটেলে দেশি-বিদেশী যাঁরা ওঠেন তাঁদের মধ্যে খ্রীষ্টধর্ম অবলম্বনকারীর সংখ্যাই বেশী? আরবদেশ গুলোর হোটেল রুমেও কি বাইবেল রাখা হয়? নাকি কুরান? আর বাংলাদেশে?
দ্বিতীয় ড্রয়ারে মেনুটা পাওয়া যায়। ঘেটেঘুটে ফোন তুলে ইমলিদোসা, অমলেট আর কফির অর্ডার দেয় ও, দুপুরের খাবার আর প্রাতরাশ একসাথে হয়ে যাবে।
আজ বিকাল তিনটার সময় কলেজ স্ট্রীটে কফি হাউসের সামনে ঋতুর সাথে দেখা করার কথা। কথাটা ইচ্ছে করেই ভাবতে চাচ্ছিল না ও। এখন চিন্তা করে পাঁজরের ভেতরে একটা শিরশিরে অনুভূতি হয় ওর। গতকাল একদিনে এত কিছু ঘটে গেছে যে ভরদুপুরে এই অজানা শহরের একা হোটেলরুমে সে সব কে বাস্তবতার সাথে মেলাতে পারে না রাজীব। ওর মনে হয় যেন গল্পরাজ্যের কল্পনায়কের মত ওর দিনটি লিখে গেছে কোনো আনাড়ি লেখক। সেই গল্পরাজ্যের সাথে বাস্তবতা মেলাতে গিয়ে ভ্রু কুঁকড়ে চোয়াল শক্ত হয়ে আসে ওর, মধ্যমা আর বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে চেপে ধরে কপালের দু’পাশের দপদপে রগ। সেই হাতের ফাঁক দিয়ে নজর পরে যায় বিছানার পাশে মা’র গুছিয়ে দেয়া আধখোলা স্যুটকেসটার উপর। নিজের অজান্তেই প্রার্থনা করে ও, হে খোদা কয়েকটা ভাল জামাকাপড় যেন থাকে ওটার ভেতর। নিজের অধীরতা টের পেয়ে পরমুহুর্তেই লজ্জ্বা লাগে ওর। একটা মেয়ের সাথে দেখা করবে, তাই বলে এত চিন্তা! এত মেয়েলী কবে থেকে হলো ও?
অপারেটর বলেছে খাবার আসতে পনের মিনিট লাগবে। এ সময়টার মধ্যে নির্দ্বিধায় গোসল করে ফেলা যায়। লজ্জ্বা ঢাকতে শাওয়ারের হীমঠান্ডা পানির নিচে দাঁড়িয়ে পড়ে রাজীব।
সময়: দুপুর ২:০০-২:৩০
স্থান: প্রেসিডেন্সী কলেজ, কলেজ স্ট্রীট, কোলকাতা
স্যার ফটোডায়ড নিয়ে কি সব যেন আবোলতাবোল বকছেন আর বোর্ডে আঁকিবুঁকি কাঁটছেন তার কিচ্ছু মাথায় ঢুকছে না ঋতুর। আড়চোখে ঘড়ি দেখে ও - এখনো একঘন্টা বাকি! কাল সারারাত ঘুম হয়নি, তবু কি আশ্চর্য! রাত জাগার বিন্দুমাত্র ক্লান্তি অনুভব তো করছেই না বরং অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে কখন তিনটে বাজবে।
গতকাল হঠাৎ ফোন পেয়ে চমকে উঠেছিল ও। কি বলতে কি বলবে কিচ্ছু মাথায় আসছিল না। আর ছেলেটাও যেন কিভাবে বুঝে গেল ও কাঁদছিল! ও অবশ্য স্বীকার যায়নি। তবে ঋতু জানে রাজীব ওর কথা বিশ্বাস করেনি।
কাঁদলে ওর গলা ভারী হয়ে যায়, এক শব্দের সাথে আরেক শব্দ আটকে যায়। তাই কাঁদার পর, কথা বলার আগে একটু সময় নিয়ে নিজেকে সামলে নেয় ও। রাজীব ওর মিথ্যা ধরে ফেলবে সে ভয়ে প্রথম পাঁচটা মিনিট কোনো কথাই বলেনি ও। এ সময়টা রাজীবও ওকে চাপাচাপি করেনি। বরং ধৈর্য নিয়ে ওপাশে ফোন ধরে রেখেছে। নিজে নিজেই বলেছে, “ঋতু আমি হোটেল বার থেকে কথা বলছি। মিথ্যা বলবো না, তোমার নাম্বার টেপার সাহস আনতে পেটে ইতিমধ্যে কয়েক গ্লাস ঢুকে গেছে! তাই আমার কথা অসংলগ্ন হলে তুমি আমাকে নির্দ্বিধায় একটা গালি দিয়ে লাইনটা কেটে দিতে পার। আমি কিচ্ছু মনে করবো না। তবে সম্ভাবনা আছে এর পরেও আমি তোমাকে আবার কল করবো...!” এমন কথা শুনে চোখে জল নিয়েই হেসে ফেলেছে ঋতু।
রাজীব যে ড্রিংক করেছে এটা ও না বললেও ঠিক বুঝতে পারতো ঋতু। ওর বাবা প্রতি শনিবার রাতে বন্ধুদের সাথে ল্যিটন হোটেলে ড্রিংক করে বাসায় আসেন। সে সময় তাঁর কথায় একটা অহেতুক উল্লাস চলে আসে, সেটা গতকাল রাজীবের গলাতেও ছিল। তবে এটা একদিক থেকে ভালই হয়েছে। ঋতুর মনে হয় রাজীব ড্রিংক করেছিল বলেই গতকাল ওদের দু’জনের মধ্যে কোনো আড়ষ্ঠতা ছিল না। পানীয়ের প্রভাবে তৈরী ধোঁয়াশা দু’জনের মাঝে একটা পর্দার মত কাজ করেছে, যে পর্দার আড়াল নিয়ে রাজীব-ঋতু মন খুলে দু’জনের সাথে কথা বলেতে পেরেছে।
আগে কখনো কারো সাথে এতক্ষণ ফোনে কথা বলেনি ঋতু। এক দীপকের সাথেই সবচেয়ে বেশী কথা বলা হয়েছে। তাও সেটা ঘন্টা দু’য়েকের বেশী নয়। গতকালের আগে পর্যন্ত ওর ধারণা ছিল কারণটা অর্থনৈতিক। দীপক কিংবা ঋতু কেউই ধনী পরিবারের সন্তান নয়। একনাগাড়ে মোবাইলে কথা বলাটা তাই ওদের জন্য এক রকম অসুস্থ বিলাসীতা। দীপকের মোবাইলের বিল দেন ওর দিদি সুভদ্রা, আর ওরটা আসে ট্যুইশনির টাকা থেকে। খুব প্রয়োজন ছাড়া তাই দু’জনের কারুরই মোবাইল তেমন ব্যবহার করা হয় না।
কিন্তু গতকাল কি থেকে কি-যে হয়ে গেল! “মোবাইলের বিল উঠছে” কিংবা “সকালে ক্লাস আছে” এসব জাগতিক বোধ সব নিমিষে বায়বীয় হয়ে গেল! যদি সম্ভব হতো তাহলে ছেলেটার সাথে অনন্তকাল কথা বলতে পারতো ঋতু। এটাও এমন একটা আশ্চর্য অনুভূতি! আগে কখনো এমন মনে হয়নি ওর। ওর জানা ছিল ওর জীবনটা ডাল-ভাতের মতই পানসে যেখানে উত্তেজক, অন্যরকম, বলার মত কিছু ঘটে না। জীবনটা ওর বাঁধা ক্লাস-বাসা-ট্যুইশনির বৃত্তে। কিন্তু ওরো যে বলার মত এত কথা জমে ছিল, এত কথা ভাগাভাগি করার ছিল তা আগে কখনো অনুভব করেনি ও। নিজেকে ওর মনে হয় ঠাকুরমার ঝুলির বোতলে আটকা পড়া কোনো দৈত্য। যে বোতলের সংকীর্ণ আবরনে এতদিন আটকা ছিল ওর সব অনুভূতি, সব চাওয়া পাওয়া। ছেলেটা যেন সেই বোতলের ছিপি নেহয়ায়তই অবহেলায় খুলে দিয়েছে। সেই হঠাৎ স্বাধীনতার স্বাদ অবগাহনে খুলে গিয়েছিল ওর সব না বলা কথার কল, ভেসে গিয়েছিল সব অজানা অনুভূতির বাঁধ।
এখন ক্লাসে বসে নিজের বাচালতার কথা মনে করে মুখে রক্ত জমে ঋতুর। না জানি ছেলেটা কি ভেবেছে! ওর জন্য রাজীবের কোন কথাই জানা হয়নি, অথচ রাজীব ঋতুর জন্মাবধী সব কাহিনী জেনে বসে আছে! লজ্জ্বার সাথে কোনো আফসোস অবশ্য আসে না ঋতুর। বরং মনে হয় যদি ভোরে মা’র পূজো দেয়ার অভ্যেসটা না থাকতো তবে সে আরো কয়েকটা ঘন্টা ছেলেটার সাথে বেশী কথা বলতে পারতো। মা যদি দেখতেন ও ভোররাত পর্যন্ত মোবাইল কানে নিয়ে বসে আছে তাহলে বাসায় লঙ্কাকান্ড বেঁধে যেত, তাই বাধ্য হয়েই ফোনটা রেখে দিতে হলো।
আড়চোখে আবার ঘড়ি দেখে ঋতু। ছেলেটার খুব শখ মান্না দে’র কফি হাউসে এক কাপ কফি খাবে! সেখানে এক কাপ কফি খেয়ে তবেই অন্য কোথাও। স্বাভাবিক সময়ে সহপাঠী কিংবা দীপক ছাড়া অন্য কোনো ছেলের সাথে কফি হাউসে দেখা করার কথা চিন্তাও করতো না ঋতু। সেখানে ওর কিংবা দীপকের বন্ধু-বান্ধব, এমনকি স্ময়ং দীপকের সাথে দেখা হয়ে যাবার সমূহ সম্ভাবনা। দীপক আর ওর ব্যাপারটা কলেজে এতজন জানে যে অচেনা কারো সাথে দেখলেই সে নিয়ে গুজব ছড়িয়ে যাবে। সেসব গুজব জেনে কিংবা না জেনে কেউ দীপককে লাগাবে। কি দরকার ঝামেলার! তবে ঋতু এখন এসবের পরোয়াটাও করে না। নতুন এই অনুভূতিটা এত প্রবল যে ও অন্য কাউকে, অন্য কিছুকে পাত্তা দিয়ে চলায় প্রয়োজন ওর কাছে এ মূহুর্তে বাহুল্য মনে হয়। হ্যাঁ, ও রাজীবের সাথে সবার সামনেই কফি হাউসে দেখা কববে... কে কি করবে করুক!
গতকাল দীপক বলেছিল আজ কলেজে আসবে। সে কথা মাথায় রেখে ঋতু রাজীবকে তিনটের সময় আসতে বলেছে। দীপক জানে আজ ওর ক্লাস শেষ আড়াইটায়, কাজেই ও আসলে আড়াইটের সময়ই আসবে। গতকাল দিনটি যে অন্য সব দিনের মত ছিল না সেটা নির্ঘাত দীপক ঠিক ঠিক বুঝে নিয়েছে। আর যদি রাতে কল করে থাকে তবে ঋতুর নাম্বার ব্যস্ত পেয়েও ওর একটা কিছু অনুমান করে নেয়ার কথা। তাই হয়তো সে রাগ দেখিয়ে আজ আসবেই না। তবে যদি আসে ঋতু ওকে সরাসরি যা সত্যি তাই বলবে। বলবে ওর আরো সময় চাই। এতদিন যে সম্পর্ককে ও ভালবাসা ভেবে এসেছে সেটা কি আসলেই ভালবাসা সে নিয়ে ওর মনে সন্দেহ জেগেছে। সেই সন্দেহ দূর হবার আগে ও দীপকের সাথে কোনো যোগাযোগ রাখতে চায় না।
দীপকের সাথে শুরুটাই ছিল একটা বাজে ঘটনা দিয়ে। এর আগে করেকবার ওর সাথে কফি হাউসে গিয়েছে। একই কলেজের সিনিয়র তাই দীপকের মধ্যে একটা দাদাসূলভ ভাব ছিল। কিন্তু দু’তিন বারের কফিকেই এত বড় ঘটনা বানিয়ে দীপক যে সবাইকে মনগড়া এতসব কিছু বলে বেড়াবে সেটা ঋতুর কল্পনাতেও আসেনি। সেদিন মিষ্টির কাছে প্রথম শুনে ওর কান ঝাঁ ঝাঁ করছিল! দীপকেরও ভাগ্য খারাপ, সেদিনই কফি হাউসে গিয়ে ওকে পেয়ে গেল ঋতু। রাগে হিতাহিত জ্ঞান ছিল না ওর, সবার সামনেই দীপককে অনেক যা-তা শুনিয়েছে। সেদিন রাত্রেই ফোনে প্রথম প্রেমের কথা বলে দীপক। “না” বলতে এক মূহুর্তও দেরি হয়নি ঋতুর। কিন্তু সেই “না”-ই দীপকের ক্রমাগত চাপাচাপি, প্রতিদিন একটা করে কাব্যময় ইমেইল, বন্ধুদের মাধ্যমের কাকুতি, এমনকি দিদি সুভদ্রার মাধ্যমে মিনতির মিলেমিশে কিভাবে জানি একসময় “হ্যাঁ” হয়ে গেল। কাজটা কি ঝোঁকের মাথায় করা হয়ে গিয়েছিল? ভাবে ঋতু। নাকি এখন যা হচ্ছে তাই ঝোঁকের মাথায়?
সময়: দুপুর ২:০০-২:১৭
স্থান: পার্ক হোটেল, পার্ক স্ট্রীট, কোলকাতা
নাস্তা শেষে একটা সিগারেট ধরায় রাজীব।
রুমে কি সিগারেট খাওয়া যায়েজ? একটা ক্রিস্টালের অ্যাশট্রে অবশ্য সাজানো আছে রুমে। কিন্তু রুমের গড়নটার মধ্যেই কেমন যেন একটা “নন স্মোকিং” ভাব। ওর বিছানার বাম পাশে জানালা ঘেঁষে একটা কফি টেবল আর দুটো কাজ করা চেয়ার রাখা। সেখান থেকে একটা চেয়ার টেনে জানালার সামনে নিয়ে জানালাটা খুলে দেয় ও। গুমোট ঘরে সিগারেট খেলে এমনিতেই ওর মাথা ধরে।
টেবিলে এখনো এঁটো কাপ-প্লেট পড়ে আছে। ও যাবার আগেই রুম সার্ভিসে কল করতে হবে এগুলো নিয়ে যাবার জন্য। ভাইয়া বলে দিয়েছিলেন ও যেন হোটেলে চেক ইন করার সময় অবশ্যই ফর্মে “নো সার্ভিস” টিক দেয়। বাধ্য ছেলের মত ও তাই করেছে। নিয়মানুযায়ী হোটেলে কর্তৃপক্ষের প্রতিদিন রুমটা আদ্যোপান্ত পরিস্কার করে দেবার কথা। এ কাজটা সাধারণত করা হয় যখন অতিথী রুমে থাকেন না তখন। তবে যাঁরা নিজেদের গোপনীয়তা নিয়ে সন্দীহান তাঁরা আগে থেকেই বলে দিতে পারেন তাঁরা কোনো অনাকাঙ্খিত সার্ভিস চান না। সেক্ষেত্রে কেবলমাত্র অতিথী ডাকলেই হোটেলের কর্মচারী রুমে আসেন। এখন সে যদি রুমটা পরিস্কার করে দিতে না বলে তাহলে সাদাদিন রুমটা এমনি পড়ে থাকবে।
সিগারেটটা শেষ করে রিসিপশনে ডায়াল করে রাজীব।
“হ্যালো! পার্ক হোটেল কলকাতা রিসিপশন।”
“হ্যালো! ক্যান ইউ সেন্ড সামওয়ান ওভার টু ক্লিন আপ মাই রুম, প্লিজ!”
“অ্যাবসলুটলি স্যার! সামওয়ান উইল বি দেয়ার ইন ফাইভ মিনিটস।”
“পারফেক্ট! অ্যান্ড ক্যান ইউ প্লিজ গেট মি অ্যা ক্যাব টু কলেজ স্ট্রিট... অ্যাট অ্যারাউন্ড টু থার্টি?”
“সিওর স্যার! মে আই রেকমেন্ড আওয়ার লিমো সার্ভিস?”
“রেগুলার ইয়েলো ক্যাব উড বি ফাইন।”
“এক্সেলেন্ট স্যার।”
দুই মিনিটের মধ্যেই নক পড়ে দরজায়। ট্রলি ঠেলে রুমে ঢোকে ধোপদুরস্ত তরুনী হোটেল কর্মচারী। ম্যাজিকের মত ট্রলির প্রথম তাকে উধাও হয়ে যায় টেবিলের এঁটো কাপ-প্লেট। ট্রলির অন্য তাক থেকে অভ্যস্ত হাতে দ্রুত পাল্টে যায় বিছানার ছাদর, তোয়ালে, সাবান, স্যাম্পু, টুথপেস্ট। মেয়েটার সাবলিল কাজ দেখতে দেখতে একবার আয়নার দিকে তাকায় রাজীব, কাল যে জিন্সটা পরেছিল আজও সেটাই পরেছে, সাথে একটা হালকা সবুজ টার্টলনেক। ওর হঠাৎ করেই মনে হয় এখন ভাইয়া সাথে থাকলে খুব ভাল হতো!
সময়: দুপুর ২:১৮-২:৩৬
স্থান: প্রেসিডেন্সী কলেজ, কলেজ স্ট্রীট, কোলকাতা
রাস্তা ভর্তি গাড়িঘোড়া, গাড়ি এগুচ্ছে না মোটেই তাই ট্যাক্সি থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে নেমে যায় রাজীব। ভাড়া চুকিয়ে ফুটপাথে উঠে আসে। কলেজ স্ট্রীটের নাম কলকাতার গল্প উপন্যাসে পড়েছে ও। জায়গাটাকে বলা যায় কলকাতার ইন্টেলেকচুয়াল হাব। পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব বিখ্যাত কলেজ-ইউনিভার্সিটি এখানেই। বাংলার সাহিত্যিক-রাজনীতিবীদ-শিল্পী-বিজ্ঞানীর একটা বড় অংশ এই কলেজ স্ট্রীটের অলিগলিতে হেঁটেই নিজেদের গড়ে নিয়েছেন। এখন সেই কলেজ স্ট্রীটে দাঁড়িয়ে শরীরে কেমন একটা শীহরণ অনুভব করে রাজীব।
জায়গাটায় কেমন যেন একটা চেনা চেনা গন্ধ। একটু হাঁটতেই বোঝে রাজীব কেন এত চেনা মনে হচ্ছে। কলেজ স্ট্রীটের সাথে ঢাকার নীলক্ষেত বাকুশাহ মার্কেটের একটা অবিশ্বাস্য মিল! সেই একই রকম ঘুপচি মার্কা বইয়ের দোকান। সেই একই রকম উপচে পড়া বইয়ের স্তুপ, ফুটপাথ দখল করে পেপারব্যাক আর পুরানো বইয়ের ক্যানভাস, দোকানীর সাথে ক্রেতার উগ্র দামাদামী, পথচারীকে দোকানীর সেই একই রকম আহবান “আইনের বই খুঁজচেন দাদা? আইনের বই?” ফুটপাথ দিয়ে দুদ্দাড় ছুটে চলা ছাত্র-ছাত্রীও যেন টিএসসি’র প্রতিচ্ছবি। সেই একই রকম অহেতুক আড্ডা-তর্ক, প্রেমিকের পাশে প্রেমিকার নতমাথায় লাজুক পদচারণ, চত্ত্বরে গীটার বাজিয়ে গান আর চায়ের স্টলে ভাঁড়ের পর ভাঁড় চা’র শ্রাদ্ধ।
ভিক্টোরিয়া পার্কের সেই অনুভবটা আবার ফিরে আসে রাজীবের মধ্যে। বাংলার মধ্যিখানে একটা সীমানা দিয়ে হয়তো বাংলাকে দুই ভাগ করা গেছে, বাঙালিকে নয়!
এক দোকানীকে জিজ্ঞেস করে প্রেসিডেন্সী আর কফি হাউসটা কোথায় জেনে নেয় রাজীব। ঠিক জায়গাতেই নেমেছে। দুটো গেট পরেই প্রেসিডেন্সী। তার উল্টো পাশেই কফি হাউস। ঋতু বলেছিল কফি হাউসের সামনে থাকতে। রাজীব তাই রাস্তা পেরিয়ে উল্টো পাশে চলে যায়। একটা গলি দিয়ে ঢুকে হাতে বাম পাশে কফি হাউসের গেট। গেটটা দেখে একটু হতাশই হয় রাজীব। ও আরো চমকদার কিছু আশা করেছিল। নেহায়তই সাধারন সিমেন্টের সিড়ি, নিচে মুদির দোকান, ফোন-ফ্যাক্সের স্টল। কেমন যেন গাউছিয়া গাউছিয়া ভাব।
একটা সিগারেট ধরিয়ে প্রধান রাস্তার সামনে দাঁড়াতেই ঋতুকে দেখতে পায় রাজীব। কাঁধে একটা ঝোলানো ব্যাগ নিয়ে ওপাশ থেকে রাস্তা পেরুচ্ছে। সিগারেটটা ফেলে দিয়ে মেয়েটাকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখে রাজীব। নীল রঙের সাদা কাজ করা সাধারণ একটা সালোয়ার-কামিজ পরেছে, অথচ মনে হচ্ছে অন্য কোনো জামায় ওকে এর চেয়ে বেশী মানাতো না। গতকালের মতই কোনো প্রসাধণ নেই। বোঝাই যাচ্ছে মেয়েটা ওর সাথে দেখা হবে বলে বাড়তি কিছু করেনি, আর ও তিন তিনবার পোষাক বদলেছে!
মেয়েটার মনে হয় রাস্তা পেরুতে ভয়। ভয়ার্ত চোখে দুইদিক দেখে বাচ্চার মত ছোট ছোট পা ফেলে রাস্তা পেরুচ্ছে। এত মনোযোগ যে রাজীব যে এদিকে দাঁড়িয়ে আছে সেটাও খেয়াল করেনি। বাচ্চাদের বড়মানুষী দেখে বড়রা যেভাবে প্রশ্রয় মেশানো মমতা নিয়ে হাসে, ঋতুর দিকে তাকিয়ে সেভাবেই মিটিমিটি হাসে রাজীব।
কেমন যেন একটা দুষ্টুমি মাখা হাসি নিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করে রাজীব, “কেমন আছো ঋতু?”
দুপুরের এই সময়টা কফি হাউস ভর্তি থাকে মানুষে। খালি জায়গা পাওয়াটা খুব দুষ্কর। এমনিতে একটা চেয়ার ফাঁকা থাকলেও ঋতু নির্দ্বিধায় সেখানে গিয়ে বসে পড়তে পারে। কিন্তু রাজীবকে নিয়ে এক দঙ্গল মানুষের মাঝে গিয়ে বসার ইচ্ছে নেই ওর। খানিক্ষণ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে দু’জনে, এরপর একটা টেবিল খালি পেয়ে চট করে সেখানে বসে পড়ে।
টেবিলে বসে রাজীব একটা চাপা আগ্রহ নিয়ে চারপাশে তাকায়। হাউসের তেমন একটা যত্ন মনে হয় নেয়া হয় না। দেয়ালের পলেস্তারা খসে খসে পড়ছে। তবে ভেতরে জায়গাটা বেশ ছড়ানো। ছোট্ট চৌকনা টেবিলগুলো ঘিরে চারটে করে প্লাস্টিক বোনা কাঠের চেয়ার। কফি হাউসটাকে বলা যায় আর্ধেক দোতলা। আর্ধেক, কারন সিড়ি বেয়ে উপরে ওঠা যায় কিন্তু উপরটা পুরো ঢালাই করা নয়, ব্যালকনির মত স্থাপত্য কফি হাউসের চারদিক থেকে ঠেলে ভেতরের দিকে ছড়িয়ে এসেছে। তাই উপরে তাকালে ছাঁদ থেকে নেমে আসা মান্ধাত্তা আমলের ফ্যানের সাথে সাথে চারদিক থেকে বেরিয়ে আসা সিমেন্টের পাটাতনও চোখে পড়ে। তবে উপরতলা মনে হয় কোনো কারণে বন্ধ, সিড়িতে দড়ি দিয়ে ব্যারিকেড লাগানো।
যাঁরা কাজ করছে তারা বেশ চটপটে ধোপদুরস্ত। ইংরেজ শাসনামলে বেয়ারাদের জন্য যে লাল-সাদা লেবাস নির্ধারিত ছিল সেই পরে ঘুরে ঘুরে অর্ডার নিচ্ছেন। দু’জনের জন্য দু’কাপ কফি বলে ঋতু। মেয়েটা প্রথম ওকে দেখে চমকে গিয়েছিল, এখন বেশ সামলে নিয়েছে। জিজ্ঞেস করে, “রাজীব তুমি আর কিছু নেবে? অমলেট? ওদের অমলেটটা ভাল হয়।”
“আর কিছু নেব না। হোটেল থেকে খেয়েই বেরিয়েছি। তুমি লাঞ্চ করেছ?”
“করেছি। মা টিফিন বক্সে করে দুপুরের খাবার দিয়ে দেন। আমি সাড়ে বারোটা-একটার দিকেই খেয়ে নেই।”
“আমাদের দেশে এভাবে রেস্তোরায় কেউ অমলেট খায় না, জান?”
বিস্ময়ে বড় বড় চোখে তাকায় ঋতু, “তোমরা অমলেট খাও না?”
“খাই! বাংলাদেশে এটা অলিখিত ভাবে সকালের নাস্তা হিসেবে গন্য। সকালে রুটি দিয়ে ডিমভাজি। শুধু শুধু কেউ কপকপিয়ে অমলেট খায় না!”
মুখে হাত চেপে হাসে ঋতু, “এমন আড্ডার রেস্তোরায় কি খাও তোমরা?”
“ডালপুরি, সিঙ্গারা, সামোসা, চটপটি-ফুচকা... ডালপুরিকে মনে হয় কচুরী বলো তোমরা।”
“ফুচকা?”
“হুম... তোমাদের ফুচকার সাথে আমাদেরটার তুলনাই হয় না। তোমাকে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে আমি এই জিনিসটাই প্রথম খাওয়াবো। আমি যে ইউনিভার্সিটিতে পড়ি সেখানে বাংলাদেশের সেরা ফুচকা পাওয়া যায়!”
সাধারণ একটা কথা। তবু খুউব ভাল লাগে ঋতুর। ছেলেটা দেশে নিয়ে যাবে এ কথাটা এত দৃপ্ত ভাবে বলে যেন ঋতু ওর সাথে বাংলাদেশ যাবেই যাবে, সেটা সব ঠিকঠাক!
“এখানে তুমি নিয়মিত আস ঋতু?”
“নাহ! আগে নিয়মিত আসা পড়তো। এখন কমে গেছে।”
“আমারা তোমাদের কোলকাতা সম্পর্কে যতটা জানি তোমরা কিন্তু ঢাকা সম্পর্কে তেমন জান না!”
“তোমরা আমাদের বই অনেক পড় তাই তো?”
“অনেক! মজা হচ্ছে দুই বাংলার লেখা কিন্তু দুই রকম! তোমাদের কবিতাগুলো একটু বেশী কাব্যময়, প্রেমভাব-কল্পনাটা বেশি। আমাদের কবিতায় সেসবের সাথে থাকে একটা চাপা ক্রোধভাব। অনেকটা আগ্নেয়গিরীর মত, এই বুঝি জ্বলে উঠলো। আবার গদ্যের কথা যদি বলো, তাহলে আমার মনে হয় তোমাদের গদ্য আমাদের চেয়ে অনেক বেশি পরিনত।”
“সত্যি কথা বলি, “দেশ”-এর পূজোসংখ্যায় হুমায়ুন আহমেদের একটা উপন্যাস ছাড়া আমি তোমাদের আর কোনো গদ্য পড়িনি!”
“মেকস সেন্স! এখন বাংলা বইয়ের বাজার মানেই বাংলাদেশ। এখানে প্রকাশিত বই সেই বাংলাদেশেই যায়, বাংলাদেশে থেকে এখানে আসে কম। “দেশ” যে শারদীয় সংখ্যায় হুমায়ুনের উপন্যাস ছাপাচ্ছে সেটাও হয়তো বাংলাদেশের বাজারে টিকে থাকার জন্য। এখন বাংলাদেশে দুই ঈদে অনেক পত্রিকা বিশেষ সংখ্যা বের করে। তাই পাঠকের অপশন বেড়েছে, প্রতিযোগীতাও বেড়েছে। সেই প্রতিযোগীতায় টিকে থাকতে হলে বাংলাদেশের সবচে’ জনপ্রিয় উপন্যাসিক একটা বুদ্ধিমান অবলম্বন।”
হঠাৎ মনে পড়ে রাজীবের, “আচ্ছা ঋতু, তোমাদের বইমেলা কি শুরু হয়ে গেছে?”
“না এখনো হয়নি, ন’ তারিখে হবার কথা। যাবে? থাকবে ততদিন?”
“থাকবো। কিন্তু এখানে বইমেলা এক তারিখে শুরু হয় না?”
“এমনিতে পয়লা ফেব্রুয়ারীতেই হয়। কিন্তু এবার ঝামেলা হয়েছে।”
“কেমন ঝামেলা?”
“বইমেলা সবসময় ময়দানে হয়। চেন ময়দান? ভিক্টোরিয়ার পাশে। সেটা আসলে সেনাবাহিনীর সম্পত্তি। এবার সেখানে স্টল বানানো শুরু করে দিয়েছিল গিল্ড...”
“গিল্ড?”
“পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ড। ওরাই বইমেলার আয়োজোন করেন। এর মাঝে পরিবেশবীদরা মামলা করে দিলেন। বইমেলায় নাকি দূর্দান্ত রকমের পরিবেশ দূষণ হয়। সেই মামলায় জিতে গেছেন তাঁরা। তাই হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছে মেলা সরিয়ে নিতে। এখন সেই মেলা হবে যুব ভারতীর মাঠে, সল্টলেকে। ময়দানের সব স্টল ভেঙে ফেলা হচ্ছে।”
“আচ্ছা কান্ড! কদ্দিন চলে এই বইমেলা?”
“২১ তারিখ পর্যন্ত।”
কথার ফাঁকেই বেয়ারা এসে দুই কাপ কফি রেখে যায় টেবিলে। একটা কাপ তুলে চুমুক দেয় রাজীব। কেমন যেন একটা খড়িমাটি স্বাদ, ধোঁয়াটে গন্ধ। খুব ভাল লাগে রাজীবের। ওদের গ্রামে খড়িমাটির চুলোয় খাঁটি গরুর দুধ জ্বাল দিয়ে বানানো চায়ে এমন একটা গন্ধ থাকে। কফি হাউসের চুলো কি কাঠ কয়লায় জ্বলে?
“তোমাদের নিয়ে আমাদের আমাদের দিকে কি কথা চালু আছে জানো?” মিটিমিটি হাসে রাজীব।
“কি কথা?”
“যে তোমরা প্রচন্ড কৃপন! অতিথি আসলে বলো, দাদা কি খেয়ে এসেছেন না গিয়ে খাবেন!”
“যাহ! এটা এক্ষুনি বানিয়ে বললে তুমি!”
হাঃ হাঃ করে হাসে রাজীব, “সত্যি! আরো কি বলে জানো? তোমরা নাকি একটা রসগোল্লা দিয়ে বলো, রসগোল্লাটার পুরোটাই খেতে হবে কিন্তু!”
মুখটা লাল হয়ে যায় ঋতুর, “ছিছি! দিব্যি? এমন কথা বলো তোমরা?”
“হুম, বলি তো!” ঋতু যে রেগে গেছে সেটা বোঝাই যাচ্ছে। মুখটা কেমন লাল হয়ে গেছে। সেই মুখে এসে পড়েছে ওর খোলা চুল। অবোধ্য মায়াটা আবার ফিরে আসে রাজীবের, ইচ্ছে করে আলতো হাতে মুখ থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে আরো ভালমত দেখে মেয়েটাকে।
“কেন? তোমরা বুঝি আমাদের নিয়ে কিছু বলো না?”
“না তো! তবে সবাই বলে তোমরা নাকি পেটুক প্রকৃতির। হাসিমুখে জমি-জিরাত বেচে দাও দু’টো ভাল খাবারের জন্য।”
উদ্দাম গলায় আবার হাসে রাজীব, “এটা একটা সত্যি কথা! রসনাই আমাদের প্রধান কনসার্ন! দেখ তোমাদের নিয়ে যে দু’টো কথা বললাম সেখানেও ঘুরে ফিরে খাবার উঠে এসেছে। আমরা বাঙালরা চিন্তিত এই বুঝি আমাদের ঘটি বন্ধুটি আমাকে না খাইয়ে বিদেয় করে দিলো... যদিও বা খেতে দিল, তাও হয়তো সর্বসাকুল্যে একটা মিষ্টি মাত্র!”
রাজীবের বলার ভঙ্গিতে হেসে ফেলে ঋতু।
ছেলেটার সাথে আজ দেখা হবে সেই মোহে ও অনেক কিছুই ভুলে বসে আছে। প্রথমত, কফি হাউস থেকে ওরা যাবে কোথায়? সেটা তো ঠিক করা হয়নি! ছেলেটা বিদেশী, যা করার তা তো ওকেই করতে হবে। যাতায়াতের ব্যবস্থাটাই বা কি হবে? ঋতু নিজে ট্রাম-বাস কিংবা শেয়ারে চালিয়ে দেয়। কিন্তু এ ছেলেটা কি ট্রামে বাসে চড়বে? এটুকু সময়ে অন্তত্য এটা বোঝা গেছে ছেলেটা পাবলিক ট্রাসপোর্টেশনে অভ্যস্থ নয়। থাক ওকে ও ট্রাম-বাসে চড়াবে না, ট্যাক্সিতে করেই ঘোরাবে। তবে ছেলেটা যে গোঁয়ার, হয়তো ওকে ভাড়াই দিতে দেবে না! সেটা একটা লজ্বার ব্যাপার হবে। ঋতু ব্যাগে ওর জমানো স-ব টাকা ভরে এনেছে। টাকাগুলো ও হঠাৎ করে কোনো কারণ ছাড়াই জমাতে শুরু করেছিল। এখন মনে মনে সবকিছুতে একটা যোগসূত্র খুঁজে পায় ঋতু, ওর মনে হয় এসব কিছুই ভগবানের ইশারাতেই যেন হচ্ছে।
ছেলেটা খুব মনোযোগ দিয়ে কফি খাচ্ছে। মাঝে আবার একবার শুকেও দেখলো যেন। একদম একটা বাচ্চা ছেলের মত। হাসি পায় ঋতুর। ওর মনে হয় খেতে গিয়ে একটু পরপর মুখ মোছা অভ্যেস। কয়েকবার আশে পাশে ন্যাপকিন খুঁজে না পেয়ে হাত দিয়েই ঠোঁট মোছে রাজীব। ঋতুর ব্যাগে রুমাল আছে, ওর ইচ্ছে করে সেটা বের করে মুছিয়ে দেবার অজুহাতে একবার ছুঁয়ে দেয় ছেলেটাকে। ছেলেটার বাম হাত পড়ে আছে টেবিলের উপরে। গতকাল অবচেতন ভাবে যে হাত ও ধরেছিল আজ চেতন ভাবে সেই হাত ধরতে গিয়ে ওর উপর পৃথিবীর সব লজ্জ্বা এসে ভর করে, বাঁধা দেয়। মনে মনে প্রার্থনা করে ঋতু, “ভগবান, ছেলেটাকে আজ একবার, মাত্র একবার ছুঁতে দাও!”
ঋতু খেয়াল করে না, অবশ্য খেয়াল করার মত অবস্থাতেও ও ছিল না, যে দীপক কফি হাউসে ঢুকে ওদের দিকে খানিক্ষণ অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আস্তে মাথা নিচু করে বেরিয়ে যায়।
[চলবে...] © অমিত আহমেদ
মন্তব্য
তোমার বইয়ের লিস্টিটা সর্ট করতে হবে। প্রিন্ট প্রিভিউ তে সব বেরাছেরা।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
হ! সব গুলো ড্রাফটে নিয়ে ট্রাই করেছিলাম আপনার পরামর্শ অনুযায়ী। কাজ হয়নি।
এমনি থাক নাকি? পরে ঠিক করতে গিয়ে হারিয়ে গেলে? গন্দম পুরা আমার সন্তানের মত। ঝামেলা হলে মারকাট হয়ে যাবে
ব্লগস্পট | ফেসবুক | ইমেইল
ঝামেলা হবে না আশা করি। আসলে সচলায়তনের কোড নিয়ে ঘাটতে চাই না। একবার নেশা উঠে গেলে আমার বাকি সব কাজ বাদ পড়ে যায়।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
কোলকাতা এ ফুচকা কে লোকে পানিপুরী বলে না, ফুচকাই বলে। কোনো কোনো বিহারী স্টলে গেলে অথবা মেটিয়াবুরজের দিকে গেলে হয়ত আপনি পানিপুরী শব্দটা শুনতে পাবেন। সাধারণ বাঙালী ফুচকা শব্দের সাথেই পরিচিত। আমি নিজে পানিপুরী শব্দটা শিখেছি হায়দ্রাবাদে এসে।
আর ডালপুরী-কচুরী ঠিকঠাক কিন্তু আমার ধারণা দুটোর উপাদানে কিছু পার্থক্য আছে। সঠিক জেনে জানাব।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
একটা ব্যাপারে আপনার সাথে কথা বলে নিশ্চিত হয়ে নেয়ার ইচ্ছে ছিল। পরে ইমেইল করতে পারি? যদি অনুমতি থাকে তবে আমাকে একটা প্রাইভেট মেসেজ করে ব্যক্তিগত ইমেইল আইডিটা দিতে পারেন।
লেখাটা আপনার তথ্যানুযায়ী ঠিক করে নিচ্ছি। আপনি যে আমার কত বড় উপকার করছেন সেটা বোঝানো সাধ্যাতীত!
ধন্যবাদ।
ব্লগস্পট | ফেসবুক | ইমেইল
লেখাটা প্রথমবারে ঠিকঠাক এলনা কেন জানিনা। এখন ঠিকঠাক।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
রাজিব/ অমিতের এই উপলব্ধী আমারও।
গন্দম পড়ছি। এই সব জীবনের সত্যি গল্প নয়, এমনটা ভাবতে ইচ্ছে করে না।...
আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
ঋতুকে এত আপন লাগে কেন?
গন্দম আমার ভাললাগে খুব।খুব বেশি।
::একাকিত্বের বিলাস আমার অনেকদিনের সাধ::
::একাকিত্বের বিলাস আমার অনেকদিনের সাধ::
নতুন মন্তব্য করুন