৬ ফেব্রুয়ারী, ২০০৭
সময়: বিকাল ৩:১২-৩:৪৫
স্থান: ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, কোলকাতা
বিকৃত মানুষের বিকৃত ছোঁয়া এর আগেও পেয়েছে ঋতু। এমন হয়েছে পূজোর ভিড়ে চৌরঙ্গীতে কেউ ওর বুকে হাত ছুঁয়ে চলে গেছে। কিন্তু সেখানে ঘটনার দ্রুততা আর অসম্ভবতা ওকে বিহ্বল করলেও কাতর করে তোলেনি। কিন্তু সবার সামনে এভাবে সময় নিয়ে নষ্টামী কেউ কক্ষনও ওর সাথে করেনি।
নুড়ি বেছানো গাড়ি রাস্তা পেরিয়ে ডান দিকের চৌবাচ্চার সামনে এসে দাঁড়িয়ে হাপড়ের মত হাঁপাতে লাগলো ও। এত গুলো মানুষ ওখানে, কেউ কিচ্ছু বলল না! ছিঃ! ঋতুর মনে হলো এক্ষুণি এই মুহূর্তে যদি ওর মৃত্যু হতো, তবেই কেবল এ অদমনীয় লজ্জ্বা থেকে মুক্তি পাওয়া যেত!
"ইয়ে... এক্সকিউজ মি!" পাশ থেকে আমতা আমতা করে বলল কেউ। তাকিয়ে একটা ছেলেকে দেখলো ও - লম্বায় প্রায় পাঁচ-নয়, আরেকটু ফর্সা হলে নির্দ্বিধায় বিদেশী বলে চালিয়ে দেয়া যেত। চেহারা দেখে বয়স অনুমান করাটা কঠিন, বাইশও হতে পারে আবার সাঁতাশও হতে পারে। তাকিয়ে কেবল ছেলেটার কাচুমাচু হওয়া চেহারাটাই লক্ষ্য করলো ঋতু, অন্য কিছু মাথায়ই আসলো না। কি! চায় কি ছেলেটা?
"আপনি কিন্তু আমার হাতটা এখনও ধরে আছেন।"
চমকে উঠে হাতটা ছেড়ে দিল ঋতু। ছেলেটার হাত ও কখন, কেন ধরেছে তা কিছুতেই মনে করতে পারলো না। ভগবান আর কত লজ্জ্বা দেবেন আজ ওকে!
রাজীব স্পষ্ট বুঝতে পারছে মেয়েটার কিছু একটা হয়েছে। এমন কিছু যা ওকে বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে ছিটকে নিয়ে ফেলেছে। এখন ভ্যাবাচাকা খেয়ে ওর হাত ছেড়ে দিয়ে এমন ভাবে বড় বড় কাজল দেয়া চোখে তাকিয়ে আছে যে রাজীবের একবার দেখেই মেয়েটার উপর মায়া পড়ে গেল। আহারে বেচারী!
"আমার নাম রাজীব।" হ্যান্ডসেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল ও, কোন ভাবান্তর না দেখে হাতটা আবার ফিরিয়েও নিতে হলো, "আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। আপনি নিশ্চই স্থানীয়?"
এবারও কোন উত্তর এলো না। হাল না ছেড়ে চেষ্টা করে গেল ও। একমাত্র কথা বলেই পরিবেশটা হালকা করা সম্ভব!
ছেলেটা কি রকম একা একাই কথা বলে যাচ্ছে! প্রথমে কিচ্ছু শোনেনি ঋতু, পরে বাংলাদেশ বেতারে কান দিতেই হলো। ঋতু শুনলো ছেলেটা জিজ্ঞাস করছে, "কফি হাউস যেতে কতক্ষণ লাগে জানেন আপনি?"
কফি হাউসের কথা কোথা থেকে এলো বুঝে পেল না ঋতু, বলল, "না!" বলেই চমকে গেল। কফি হাউস কলকাতায় অনেক আছে, কিন্তু শুধু কফি হাউস বললে সবাই মান্নাদের কফি হাউসই বোঝে। সেই কফি হাউস ওর কলেজের ঠিক সামনে। প্রায় প্রতিদিনই সেখানে বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে আড্ডা জমাতে যাওয়া পড়ে।
"শুনুন, আপনি পানি খাবেন?" জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা ছোট্ট পানির বোতল বের করে দিল ছেলেটা। বোতলটা নিয়ে এক চুমুকে খালি করে দিল ও। এত তৃষ্ণা পেয়েছিল জল দেখার আগে অনুভব করেনি ঋতু।
"আমার নামটা মনে আছে আপনার? রাজীব! আপনার নামটা কিন্তু এখনও জানা হলো না!"
"ঋতু..."
পাশের সিমেন্টের বেঞ্চটা দেখালো রাজীব নামের ছেলেটা, "ঋতু আপনি দয়া করে এখানে একটু বসুন..." রাজীবের গলায় এমন এক ধরনের মমতা ঝরে পড়লো যে ঋতু না বলতে পারলো না।
বেঞ্চে বসে একা একাই বকবক করতে থাকলো রাজীব। ভারতীয় বাংলা লেখকদের বই পড়ে বাংলাদেশীরা কলকাতা সম্পর্কে কতটা জানে তাই জাহীর করছে। এই অবস্থাতেও হাসি পেল ঋতুর, ছেলেটা এমন ভাবে হাত মাথা নেড়ে বর্ননা করছে যেন দুনিয়া উদ্ধার করা হয়েছে। হঠাৎ ঋতুর মনে হলো একটু আগে যা ঘটেছে তা এই ছেলেটাকে বলা যায়... বলা দরকার!
রাজীব বুঝতে পারছে ঋতু আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে আসছে। এখন ওর প্রতিটা কথাই শুনছে, মাথা নেড়ে সায়ও দিচ্ছে। ও জানে কি হয়েছে তা একটা ওকে সময়ে বলবে ঋতু, কিন্তু সে সময়টা আসার আগে পর্যন্ত মেয়েটাকে বোঝাতে হবে যে ওর কাছে নির্ভয়ে সব বলা যায়। সে বোধটা ঋতুর কখন হবে তা ভাবার মুহূর্তেই ফুঁপিয়ে উঠলো মেয়েটা, বলল, "আমাকে অসম্ভব অপমান করেছে... কয়েকটা আঠারো-উনিশ বছরের ছেলে আমাকে সবার সামনে..." গলা দিয়ে উঠে আসা প্রশ্বাসে কথা শেষ করতে পারলো না ঋতু, চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে থাকলো।
রাজীব সন্দেহ করেছিল এমনই কিছু হয়েছে, ও ঠান্ডা গলায় কেবল জিজ্ঞাস করলো, "কয়জন ছিল?"
কথাটা বলার পর যেমন প্রতিক্রিয়া আশা করেছিল ঋতু তার ধারে কাছ দিয়েও গেল না রাজীব। কোন কৌতুহল নয়, কোন প্রতিবাদ নয়, সে ফিরে গেল তার সাহিত্য আলোচনায়। ওর জায়গায় দীপক হলে কি করতো? প্রথমেই কাহিনীর খুঁটিনাটি জানতে চাইতো, তারপর ছুটতো মারামারি করতে!
ঢাকার ছেলেদেরকে নিয়ে অনেক কথা চালু আছে কলকাতায়। তার মধ্যে একটা হলো বাঙালরা হুট করে রেগে যায়, ওদের সব কাজই আবেগ নির্ভর... রাগ আর আবেগ মিশে ওদের একটা দূর্দম ছবি ঋতুর মনে আঁকা ছিল, সেটা যে কতটা ভুল এই ছেলেকে দেখেই বুঝতে পারছে। কোন অজানা কারনেও ও আশা করেছিল অচেনা এই ছেলেটা ওর ব্যাথায় সমব্যাথী হবে, দীপকের মতই দুড়দাড় করে ছুটে যাবে মারামারি করতে। সেটা মিললনা দেখে রাগ উঠলো ঋতুর, প্রচন্ড রাগ। পরমুহূর্তেই মনে হলো এ বিদেশী ছেলেটার তো ওর জন্য কিছু করার আবেগী বাধ্যকতা নেই - ঋতুর রাগটা পরিনত হলো অভিমানে!
ঠিক এসময়েই বেজে উঠলো মোবাইল ফোনটা। হাতড়ে খুঁজে ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে কে কল করেছে দেখলো ঋতু। দীপক! ঢাকার ছেলেটার উপর জমা অভিমান দীপকের উপর ঢেলে মোবাইলটা বন্ধ করে দিল ঋতু - উচ্ছন্নে যাক সব!
ও ইচ্ছে করেই এমন জায়গায় বসেছে যেখান থেকে বেরুবার গেট দেখা যায়। বের হবার গেট ওই একটাই, তাই কে যাচ্ছে আসছে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। ও কিন্তু ঠিকই খেয়াল রেখেছে চারটে আঠারো-উনিশের ছেলে বেরুচ্ছে কিনা।
"ওরাই সেই চার জন তাই না?" কঠিন গলায় জানতে চাইলো রাজীব। হঠাৎ কন্ঠের পরিবর্তনে মুখ তুলে তাকালো ঋতু, চারটে ছেলে হাসতে হাসতে গেটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দু'জনে তুমুল গালি চলছে, বাকি দু'জন চেষ্টা করছে একজন আরেকজনকে ল্যাং মারতে।
ওর দৃষ্টি দেখেই যা বোঝার বুঝে গেল রাজীব।
একটু আগেও যে ছেলে হাবিজাবি কথা বলছিল তার চোখের আগুনে দৃষ্টি দেখে ভয় পেয়ে গেল ঋতু। ওর চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে... শক্ত মুঠোয় টানটান হয়ে উঠে দাঁড়ালো রাজীব। ওর অভিব্যক্তিতে এমন এক অদম্য হিংসা ফুটে বেরুচ্ছে যে ঋতু অনুভব করলো ওর ভয়টা এখন ছেলেটাকে নিয়েই। আরও বুঝলো ও কখনই চায়নি রাজীব ওদের সাথে লড়ুক, ও শুধু দেখতে চেয়েছে ওর এই অদম্য ভাবটাই।
এক পা ফেলতেই রাজীবের হাতটা আজ দ্বিতীয়বারের মত শক্ত করে ধরে ফেলল ঋতু, ওর দেহে শেষ বিন্দু শক্তি থাকা পর্যন্ত ও রাজীবকে যেতে দিতে পারে না...
ঋতু ব্যকুল গলায় বলল, "না... প্লিজ না... ওদের সাথে ছুরি-চাকু থাকে!"
সময়: বিকাল ৩:০০-৩:২০
স্থান: এসপ্লানেড ও সর্দার রোড, কোলকাতা
ড্রাইভারকে একটা বিশ রুপীর নোট ধরিয়ে দিয়ে ট্যাক্সি থেকে নেমে গেল দীপক। এই হাঙ্গামা সহজে থামার নয়, সামনের সর্দার রোডে ঢুকে রিক্সা-টেম্পু কিছু একটা নিতে হবে। ঋতুকে একটা ফোন করা উচিত হবে নাকি সেটা নিয়ে একটা দ্বিধায় আছে ও। এখন ফোন করলেই মেয়েটা অবুঝের মত অনুযোগ শুরু করবে, রাগারাগি করবে। সত্যি কথা বলতে কি, ঋতুরই এতক্ষণে ওকে কল দেয়ার কথা ছিল। কেন দেয়নি সেটা ভেবে চিন্তা হলো দীপকের... মোবাইলে চার্জ নেই? নাকি সাথে আনতে ভুলে গেছে? আবার কোন সমস্যা হলো নাতো? এমনও হতে পারে এত বেশী রাগ হয়েছে যে ফোন করারো প্রয়োজন বোধ করছে না!
সর্দার রোডে খানিক্ষণ হেঁটে একটা গলিতে ঢুকে রিক্সা নিয়ে নিল ও... এই গলি সোজা গিয়ে মোহাম্মদ ইসহাক রোডে ঠেকবে। সেখান থেকে বাস বা ট্যাক্সি নিয়ে একটানা মেমোরিয়াল। তবে সমস্যা হচ্ছে মেইন রোডে জ্যাম দেখে সবাই গলিতেই ঢুকেছে। সামনে রিক্সা-মানুষের লাইন পড়ে গেছে।
এক হাতে দিদির লেহেঙ্গা সামলে পকেট থেকে মোবাইল বের করে ঋতুর নাম্বার ডায়াল করলো দীপক, কখন মেমোরিয়াল পৌঁছাতে পারবে সেটা ভেবে এখন আসলেই দুঃশিন্তা হচ্ছে। তিনবার রিং হবার পর লাইনটা কেটে গেল। নাকি কেটে দিল ঋতু? আবার কল করে অপারেটরের গলা শুনে অবিশ্বাস নিয়ে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে থাকলো দীপক - ঋতু ফোন বন্ধ করে দিয়েছে! রগচটা দীপক বুঝতে পারলো ওর মথায় রক্ত উঠে যাচ্ছে। রক্তলাল চোখে মোবাইলের দিকে তাকিয়েই থাকলো ও - এত রাগ তোমার মেয়ে? এত রাগ?
সময়: বিকাল ৩:৪৫-৪:১০
স্থান: ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, কোলকাতা
রাজীব হঠাৎ আহাওয়ার পরিবর্তনটা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছে। একটু আগে পর্যন্ত ও একাই মেট্রো ট্রেনের মতো কথা বলে যাচ্ছিল, এখন ঋতুই যা বলার বলছে। বাংলাদেশ বেতার রূপান্তরীত হয়েছে কলকাতা রেডিওতে।
ইতিমধ্যে ওর জানা হয়ে গেছে ঋতু প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থ বিঞানে পড়ছে, দ্বিতীয় বর্ষ। কলকাতার নিউ জেনারেশন স্রোতের বিপরীতে গিয়ে ও বাংলা বই পড়ে, গান শোনে। ওর বন্ধু-বান্ধবীরা কেউই পদার্থ বিজ্ঞানের নয়, কারন ক্রমাগত ভালো ফলাফলের কারনে ওর বিভাগের ছেলে-মেয়েরা ওকে একটু ঈর্ষার চোখেই দেখে। আরও জেনেছে ওর কোন ভাই-বোন নেই, বাবা এলাহাবাদ ব্যাঙ্কে ছোট চাকরি করেন আর মা এসবিএস স্কুলে পড়ান। তবে সচেতন বা অবচেতন ভাবেই হোক, ঋতু এখনও বলেনি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে ও কার সাথে দেখা করতে এসেছিল। একটা মেয়ে একা একা মেমোরিয়ালে ঘুরতে আসবে এটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারও ব্যক্তিগত বিষয় ঘাঁটাঘাঁটি করতে বাঁধে বলে রাজীবও কিছু জিজ্ঞাস করেনি। বলতে চাইলে ঋতু নিজে থেকেই বলবে।
রাজীব সম্পর্কে যে কাউকে জিজ্ঞাস করলে সে বলবে, শান্ত ছেলে, কিন্তু সময়ে সময়ে বড় ঘাড় ত্যাড়া! একবার রেগে গেলে ওর হিতাহিত জ্ঞান লোপ পায়। ওর তখন ইচ্ছে হচ্ছিল ওই পুঁচকে ছেলে চারটিকে পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে দিতে। কিন্তু ঋতু মেয়েটা হাত ধরে ফেলল, এমন ভাবে "না" বলল যে আর কিছু করা গেল না।
সমারসেট মমই না বলেছিলেন, "...too young to say NO to a young woman?"
মেয়েটার হাত নেড়ে কথা বলার ভঙ্গিটাও মজার। যা বলে তারই বাকিটা শুনতে ইচ্ছা করে, নিজের কিছু বলতে ইচ্ছা করে না। রাজীব বুঝতে পারছে কোনো এক বিচিত্র কারনে মেয়েটা ওকে অসম্ভব পছন্দ করেছে। এখন পছন্দটা কোন ধরনের সেটাই দেখার বিষয়।
মেয়েঘেঁষা হিসেবে একটা বদনাম ওর আছে। এই করতে গিয়ে বিবিএ পড়ার প্রায় বারোটা বাজিয়েছিল ও, কোন মতে টেনেটুনে পার হয়েছে। কিন্তু রাজীবের পছন্দের মেয়েদের একটা ধরন আছে। তার বাইরে সে কখনই তাকায় না। সেই দৃষ্টিতে দেখলে ঋতু মেয়েটার প্রতি ওর বিন্দুমাত্র আকর্ষণ জন্মানোর কথা না। আকাশী-সাদা সালোয়ার-কামিজ পড়া ছিপছিপে দেহ, গলা পর্যন্ত চুল। লম্বায় হয়তো সাড়ে পাঁচ। কোন গহনা নেই। ভালো ছাত্রী টাইপ মায়া কাড়া মুখ। মেয়েটার ঘরোয়া চেহারা একটা আপন ভাব নিয়ে আসে, যেটা স্বগত ভাবেই রাজীবের মধ্যেও এনেছে, এর বাহুল্য কিছু নয়। স্পষ্ট বলে দেয়া যায় এই মেয়ে কখনও টাকিলা গ্লাসে চো চুমুক দিয়ে লবন খুঁজবে না, প্রেমিক সিগারেট ধরালেই মুখ ভার করে থাকবে, পার্টি বললে বুঝবে বন্ধু-বান্ধবদের দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানো, রাজীব উত্তর মেরু বললে সে বুঝবে দক্ষিণ!
ঋতু বুঝতে পারছেনা ওর মধ্যে কি হচ্ছে। এই একটা বিদেশী ছেলে... যাকে আগে কখনও দেখেনি যার সম্পর্কে ও কিচ্ছু জানেনা, ওর মুখে "ঋতু" ডাক শুনে কেন মন এমন করছে! এমন কোন অনুভূতি যে থাকে, থাকতে পারে সেটাই ওর ধারনায় ছিল না। ওর মনে হচ্ছে রাজীব নামের ছেলেটা একবার ওর চোখের দিকে তাকালেই সব খোলা বইয়ের মত পড়ে ফেলবে। সে ভয়ে ও মুখ তুলেই তাকাতে পারছে না। হঠাৎ চোখে চোখ পড়লেই লজ্জ্বায় মুখ লাল হয়ে যাচ্ছে ওর, সেই লজ্জ্বা ঢাকতে আবার আবোল-তাবোল বকতে হচ্ছে। ঋতুর মনেপ্রানে চাইছে ছেলেটা যেন হুট করে জানতে না চায় ও মেমোরিয়ালে কেন এসেছে! কেন জানেনা, কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তরটা ও সরাসরি রাজীবকে দিতে পারবে না।
নিজের উপর ঘেন্না হয় ওর, "এত খারাপ মেয়ে আমি!" নিজেকে নিজেই জিজ্ঞেস করে, "তুই না দীপকের সাথে দেখা করতে এসেছিস?" সেই প্রশ্ন নিজের মধ্যেই ঘুরপাক খেতে খেতেই অভুক্ত হয়ে মারা পড়ে, ঋতু অবাক হয়ে দেখে ও প্রার্থনা করছে, "ভগবান, আজ যেন দীপক না আসে!"
সময়: বিকাল ৪:০৫-৪:১৫
স্থান: ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, কোলকাতা
মেমোরিয়ালে ট্যাক্সি থেকে নেমেই দৌড়ে একটা টিকেট নিয়ে নিল দীপক। সারাটা রাস্তা ঠিক করতে করতে এসেছে ঋতুকে কি বলা হবে। এত্তো বড় সাহস মেয়ের, ফোন বন্ধ করে দেয়!
তবে ঋতু এখনও পার্কে আছে নাকি সেটাই দেখার বিষয়, হয়তো বাড়ি চলে গেছে। সেক্ষেত্রে কাল সরাসরি প্রেসিডেন্সি যেতে হবে। আজ আর ওকে ফোন করা হবে না, ঋতু ফোন করলেও ধরবে না। কিছু কথা আছে যা সামনা সামনি বলতে হয়। ঋতুকে কাঁদবে ও, ঋতু কাঁদবে আর ও মুখ শক্ত করে দেখবে, সেটাই হবে উপযুক্ত শাস্তি! ঋতুর রাগটাও হ্য়তো পরে ওরই ভাঙাতে হবে, তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু ঋতুকে বোঝানো হবে যে কাজটা ও ঠিক করেনি। টেকেট দেখিয়ে পার্কে ঢুকেই জোর কদমে বামের সরোবরের দিকে ছুটলো ও - ঋতু সবসময় ওই দিকেই অপেক্ষা করে।
ঠিক সে সময় বেঞ্চে বসে দীপককে গেট দিয়ে ঢুকতে দেখে রক্ত ঠান্ডা হয়ে গেল ঋতুর। এখন কী হবে! ও স্বস্তি নিয়ে দেখলো দীপক কোন দিকে না তাকিয়ে উদ্ধশ্বাসে সরোবরের দিকে ছুটলো। মাথায় একগাদা চিন্তা এসে ভর করলো ঋতুর। কিভাবে কি হবে এখন! কথার মাঝ খানে উঠে পড়া যাবে না, কোন একটা কারন দেখিয়ে উঠে পড়তে হবে। কিন্তু এভাবে হুট করে উঠে পড়লে রাজীবের সাথে কি আর কখনও দেখা হবে? বাংলাদেশে কবে ফেরত যাবে তাও কিচ্ছু বলেনি ছেলেটা। এমনকি এখন পর্যন্ত ঋতুর সাথে যোগাযোগ রাখতে চাবার কোন তাগিদও দেখায়নি। ও কি নির্লজ্জ্বের মত নিজে থেকেই ওর ফোন নাম্বার দিয়ে দেবে? ঋতু বলল, "আমার এক্ষুনি যেতে হচ্ছে, আমার ফোন নাম্বারটা রাখুন..." লজ্জ্বা বলে আসলেই যদি কিছু থেকে থাকে, তবে এ মুহূর্তে তার বিন্দু মাত্র আর ওর মাঝে অবশিষ্ট নেই!
ফেরার পথে বেঞ্চ গুলোর দিকে তাকিয়েই ঋতুকে দেখতে পেল ও। একটা লম্বা মত ছেলের সাথে বসে আছে। ওর কলেজের কেউ মনে হয়। ভালই হয়েছে, মেয়েটার একা বসে থাকতে হয়নি, পরিচিত কাউকে পেয়ে গেছে। এখানেও ঋতুর ভাগ্যি, অন্য কারো সামনে বকা-ঝকা করা যাবে না।
গম্ভীর মুখে ওদের দিকে হেঁটে যাবার সময় মুখ ফিরিয়েই ওকে দেখে ফেলল ঋতু। ওর দৃষ্টি দেখে হতভম্ব হয়ে গেল দীপক - এত দিনের পরিচয়ে ঋতুকে খোলা বইয়ের মত পড়ে ফেলতে পারে ও। মেয়েটা চমকে গেছে, ওর সারা চোখে মুখে ধরা পড়ে যাবার ভয়! বিস্ময় নিয়ে ছেলেটার দিকে আবার ভালো মত তাকালো ও। কাছে যাবার আগেই ঋতু সোজা হেঁটে এসে ওর হাতটা ধরে ফেলল... বলল, "এখানে আর এক মুহূর্ত নয়!"
মেয়েদের এই ক্ষমতাটা থাকে - ওরা যে কোন মুহূর্তে শেষ কথাটা বলে দিতে পারে - সেই কথার পরে ছেলেদের আর কিচ্ছু বলার থাকে না, মেনে নিতে হয়। দীপক বুঝলো বকা দেয়ার জন্য খুঁজে বের করা শক্ত কথা গুলো সব বিফলে গেল, আজ আর কিছু বলা হবে না। বাধ্য ছেলের মত গেটের দিকে হাঁটতে হাঁটতে ছেলেটার দিকে আবার তাকালো ও - অবাক কান্ড ছেলেটা ওর দিকেই তাকিয়ে অদ্ভুত ভাবে হাসছে!
ঋতু ছেলেটার হাত ধরতেই একটা অদ্ভুত অনুভূতি হলো রাজীবের। ও এই অনুভূতির সাথে অচেনা বলেই বুঝতে পারলো না, কিন্তু আমরা জানি একে বলে "ঈর্ষা"! ঋতুকে বেরিয়ে যেতে দেখে ওর মনে হলো ঋতুর নাম্বারটা মনে রাখা জরুরী, খুবই জরুরী। অচেনা ছেলেটা ওর দিকে তাকিয়ে আছে দেখে রাজীবও তাকালো, কিন্তু ওর দৃষ্টি তখন সবকিছু দেখার ক্ষমতা হারিয়েছে - ওর মাথার ভেতর কেবল ঘুরপাক খাচ্ছে - শেষ দু'টো নাম্বার কি বলল মেয়েটা? ৫৮? ৬৭? নাকি অন্য কিছু?
[চলবে...] © অমিত আহমেদ
মন্তব্য
চলার অপেক্ষা করছে পাঠক।
হাঁটুপানির জলদস্যু
নেক্সট
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
জলদি ছাড়েন নইলে কলাম
-------------------------------------------------
যত বড়ো হোক ইন্দ্রধনু সে সুদূর আকাশে আঁকা,
আমি ভালোবাসি মোর ধরণীর প্রজাপতিটির পাখা॥
-----------------------------------
যা দেখি তা-ই বলি...
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
নতুন মন্তব্য করুন