আত্মা নিয়ে ইতং-বিতং ( দ্বিতীয় পর্ব)

অভিজিৎ এর ছবি
লিখেছেন অভিজিৎ (তারিখ: রবি, ০৬/০১/২০০৮ - ৮:৪৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আত্মা নিয়ে ইতং-বিতং (দ্বিতীয় পর্ব)

(উৎসর্গ: গায়ক সঞ্জীব চৌধুরী - আত্মায় অবিশ্বাসী একজন পরিপূর্ণ ইহজাগতিক মানুষ)

আগের পর্বের পর ...

আত্মার অসারতা :

জীব কী আর জড় কী? বুঝব কি করে ক্যাডা জীব আর ক্যাডা জড়? জীবিতদের কি ভাবে সনাক্ত করা যায়? একটি মৃতদেহ আর একটি জীবিত দেহের মধ্যে পার্থক্যই বা কি? এ প্রশ্নগুলো দিয়ে আগেকার দিনের মানুষের অনুসন্ধিৎসু মন সবসময়ই আন্দোলিত হয়েছে পুরোমাত্রায়। কিন্তু এই প্রশ্নগুলোর কোন সন্তোষজনক ব্যাখ্যা না পেয়ে তারা শেষপর্যন্ত কল্পনা করে নিয়েছে অদৃশ্য আত্মার ১৯। ভেবেছে আত্মাই বুঝি জীবন ও মৃত্যুর যোগসূত্র। প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের ভাববাদী ধ্যানধারণাগুলো কালের পরিক্রমায় বিভিন্ন ধর্মে জায়গা করে নেওয়ার পর জীবন-মৃত্যুর সংজ্ঞা ধর্মীয় মিথের আবরণে পাখা মেলতে শুরু করল। কল্পনার ফানুস উড়িয়ে মানুষ ভাবতে শুরু করল, ঈশ্বরের নির্দেশে আজরাইল বা যমদূত এসে প্রাণহরণ করলেই কেবল একটি মানুষ মারা যায়। আর তখন তার দেহস্থিত আত্মা পাড়ি জমায় পরলোকে। মৃত্যু নিয়ে মানুষের এ ধরনের ভাববাদী চিন্তা জন্ম দিয়েছে আধ্যাত্মবাদের। আধ্যাত্মবাদ স্বতঃপ্রমাণ হিসেবেই ধরে নেয়-'আত্মা জন্মহীন, নিত্য, অক্ষয়। শরীর হত হলেও আত্মা হত হয় না।' মজার ব্যাপার হল, একদিকে যেমন আত্মাকে অমর অক্ষয় বলা হচ্ছে, জোর গলায় প্রচার করা হচ্ছে আত্মাকে কাটা যায় না, পোড়ানো যায় না, আবার সেই আত্মাকেই পাপের শাস্তিস্বরূপ নরকে ধারলো অস্ত্র দিয়ে কাটা, গরম তেলে পোড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ সবই আধ্যাত্মবাদের স্ববিরোধিতা। ধর্মগ্রন্থগুলি ঘাটলেই এ ধরনের স্ববিরোধিতার হাজারো দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে।

স্ববিরোধিতা থাকা সত্ত্বেও আত্মার অস্তিত্ব দিয়ে জীবনকে ব্যাখ্যা করতে প্রয়াসী হয়েছে মানুষ। কারণ সে সময় বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি ছিল সীমিত। মৃত্যুর সঠিক কারণ ছিল তাদের জানার বাইরে। সেজন্য অনেক ধর্মবাদীরাই 'আত্মা' কিংবা 'মন' কে জীবনের আধাররূপী বস্তু হিসেবে কল্পনা করেছেন। যেমন, ইসলামিক মিথ্‌ বলছে, আল্লাহ মানবজাতির সকল আত্মা একটি নির্দিষ্ট দিনে তৈরী করে বেহেস্তে একটি নির্দিষ্ট স্থানে (ইল্লিন) বন্দি করে রেখে দিয়েছেন। আল্লাহর ইচ্ছাতেই নতুন নতুন প্রাণ সঞ্চারের জন্য একেকটি আত্মাকে তুলে নিয়ে মর্তে পাঠানো হয়। আবার আচার্য শঙ্কর তার ব্রক্ষ্মসূত্রভাষ্যে বলেছেন, 'মন হল আত্মার উপাধি স্বরূপ'। ওদিকে আবার সাংখ্যদর্শনের মতে - 'আত্মা চৈতন্যস্বরূপ' (সাংখ্যসুত্র ৫/৬৯)। জৈন দর্শনে বলা হয়েছে, 'চৈতন্যই জীবের লক্ষণ বা আত্মার ধর্ম।' (ষড়দর্শন সমুচ্চয়, পৃঃ ৫০) স্বামী বিবেকানন্দ পর্যন্ত ভাবতেন, 'চৈতন্য বা চেতনাই আত্মা।' (বিবেকানন্দ রচনা সমগ্র, পৃঃ ১৬২) স্বামী অভেদানন্দের মতে, 'আত্মা বা মন মস্তিস্ক বহির্ভুত পদার্থ, মস্তিষ্কজাত নয়।' (মরণের পারে, পৃঃ ৯৮)। গ্রীক দর্শনেও আমরা প্রায় একই রকম ভাববাদী দর্শনের ছায়া দেখতে পাই, যা আগের অংশে আমারা আলোচনা করেছি। অ্যারিস্টটলের পরবর্তী গ্রীক ও রোমান দার্শনিকেরা অ্যারিস্টটলীয় দর্শনকে প্রসারিত করে পরবর্তী যুগের চাহিদার উপযোগী করে তোলেন। খ্রীষ্টিয় তৃতীয় শতকে নয়া প্লেটোবাদীরা 'ঈশ্বর অজৈব বস্তুর মধ্যে জীবন সৃষ্টিকারী আত্মা প্রবেশ করিয়ে দিয়ে তাকে জীবন দান করেন' - এই মত প্রচার করতে শুরু করেন। নয়া প্লেটোবাদী প্লাটিনাসের মতে, 'জীবনদায়ী শক্তিই জীবনের মূল।' বস্তুতপক্ষে, জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে 'জীবনশক্তি' (life force) তত্ত্ব এখান থেকেই যাত্রা শুরু করে এবং জীবনের উৎপত্তি প্রসঙ্গে ভাববাদী দর্শনের ভিত্তিও জোরালো হয়। ধর্মবাদী চিন্তা, বৈজ্ঞানিক অনগ্রসরতা, কুসংস্কার, ভয় সব কিছু মিলে শিক্ষিত সমাজে এই ভাববাদী চিন্তাধারার দ্রুত প্রসার ঘটে।

বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি আর যুক্তির প্রসারের ফলে আজ কিন্তু আত্মা দিয়ে জীবন-মৃত্যুকে ব্যাখ্যা করার অন্তর্নিহিত ত্রুটিগুলো মানুষের চোখে সহজেই ধরা পড়ছে। যদি জীবনকে 'আত্মার উপস্থিতি' আর মৃত্যুকে 'আত্মার দেহত্যাগ' দিয়েই ব্যাখ্যা করা হয়, তবে তো যে কোন জীবিত সত্ত্বারই - তা সে উদ্ভিদই হোক আর প্রাণীই হোক- আত্মা থাকা উচিৎ। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে একটি দেহে কি কেবল একটিমাত্র আত্মা থাকবে নাকি একাধিক? যেমন, বেশ কিছু উদ্ভিদ - গোলাপ, কলা, ঘাসফুল এমন কি হাইড্রা, কোরালের মত প্রাণীরাও কর্তন (Cut) ও অঙ্কুরোদগোমের (Bud) মাধ্যমে বিস্তৃত হয়। তাহলে কি সাথে সাথে আত্মাও কর্তিত হয়, নাকি একাধিক আত্মা সাথে সাথেই অঙ্কুরিত হয়? আবার মাঝে মধ্যেই দেখা যায় যে, পানিতে ডুবে যাওয়া, শ্বাসরুদ্ধ, মৃত বলে মনে হওয়া/ঘোষিত হওয়া অচেতন ব্যক্তির জ্ঞান চিকিৎসার মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে এমন দৃষ্টান্ত মোটেই বিরল নয় - তখন কি দেহত্যাগী বৈরাগী আত্মাকেও সেই সাথে ডেকে ঘরে থুড়ি দেহে ফিরিয়ে আনা হয়? প্রজননকালে পিতৃদত্ত শুক্রানু আর মাতৃদত্ত ডিম্বানুর মিলনে শিশুর দেহকোষ তৈরী হয়। শুক্রানু আর ডিম্বানু জীবনের মূল, তাহলে নিশ্চয় তাদের আত্মাও আছে। এদের আত্মা কি তাদের আভিভাবকদের আত্মা থেকে আলাদা? যদি তাই হয় তবে কিভাবে দুটি পৃথক আত্মা পরষ্পর মিলিত হয়ে শিশুর দেহে একটি সম্পূর্ণ নতুন আত্মার জন্ম দিতে পারে? মানব মনের এ ধরনের অসংখ্য যৌক্তিক প্রশ্ন আত্মার অসারত্বকেই ধীরে ধীরে উন্মোচিত করেছে।

আত্মার সংজ্ঞাতেও আছে বিস্তর গোলমাল। কেউ আত্মার চেহারা বায়বীয় ভাবলেও (স্বামী অভেদানন্দের মরণের পারে দ্রঃ) কেউ আবার ভাবেন তরল (প্রশান্ত মহাসাগরের অধিবাসী); কেউ আত্মার রঙ লাল (মালয়ের অধিবাসী) ভাবলেও অন্য অনেকে ভাবেন কালো (আফ্রিকাবাসী এবং জাপানীদের অনেকের এ ধরণের বিশ্বাস রয়েছে)। বিদেহী আত্মার পুনর্জন্ম নিয়ে গোলমাল আরো বেশি। বিশ্বের প্রধান ধর্মমত হিসেবে হিন্দু, ইসলাম এবং খ্রীষ্ট ধর্মের কথা আলোচনা করা যাক। হিন্দুরা আত্মার পুনর্জন্মে বিশ্বাস করে; আবার অপরদিকে মুসলিম আর খ্রীষ্টানদের কাছে আত্মার পুনর্জন্ম বলে কিছু নেই। মজার ব্যাপার হচ্ছে, প্রত্যেকটি ধর্ম তাদের বিশ্বাসকেই অভ্রান্ত বলে মনে করে। এ প্রসঙ্গে প্রবীর ঘোষ তার 'অলৌকিক নয়, লৌকিক' গ্রন্থে বলেন ২১,

একবার ভাবুন তো, আত্মার চেহারাটা কেমন, তাই নিয়েই বিশ্বের বিভিন্ন দেশবাসীর বিভিন্ন মত। অথচ স্বামী অভেদানন্দই এক জায়গায় বলেছেন, 'আমাদের মনে রাখা উচিৎ যে, সত্য কখনো দু-রকমের বা বিচিত্র রকমের হয় না, সত্য চিরকালই এক ও অখন্ড।'

বিবর্তনতত্ত্ব মানতে গেলে তো আত্মার অস্তিত্ব এবং পুনর্জন্মকে ভালমতই প্রশ্নবিদ্ধ করতে হয়। বিজ্ঞান আজ প্রমাণ করেছে জড় থেকেই জীবের উদ্ভব ঘটেছিল পৃথিবীর বিশেষ ভৌত অবস্থায় নানারকম রাসায়নিক বিক্রিয়ার জটিল সংশ্লেষের মধ্য দিয়ে আর তারপর বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভব ঘটেছে জৈববিবর্তনের বন্ধুর পথে। এই প্রাণের উদ্ভব এবং পরে প্রজাতির উদ্ভবের পেছনে কোন মন বা আত্মার অস্তিত্ব ছিল না। প্রাণের উদ্ভবের পর কোটি কোটি বছর কেটে গেছে, আর আধুনিক মানুষ তো এল-এই সেদিন - মাত্র পচিশ থেকে ত্রিশ হাজার বছর আগে। তাহলে এখন প্রশ্ন হতে পারে ত্রিশ বছর আগে মানুষের আত্মারা কোথায় ছিল? জীবজন্তু কিংবা কীটপতঙ্গ হয়ে? কোন পাপে তাহলে আত্মারা কীটপতঙ্গ হল? পূর্বজন্মের কোন কর্মফলে এমনটি হল? পূর্বজন্ম পূর্বজন্ম করে পেছাতে থাকলে যে প্রাণীতে আত্মার প্রথম জন্মটি হয়েছিল সেটি কবে হয়েছিল? হলে নিশ্চয়ই এককোষী সরল প্রাণ হিসেবেই জন্ম নিয়েছিল। এককোষী প্রাণের জন্ম হয়েছিল কোন জন্মের কর্মফলে?

বিবর্তনের আধুনিক তত্ত্ব না জানা সত্ত্বেও প্রাচীন ভারতের যুক্তিবাদী চার্বাকেরা সেই খ্রীষ্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকে তাদের সেসময়কার অর্জিত জ্ঞানের সাহায্যে আত্মার অস্তিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেছিলেন। আত্মাকে অস্বীকার করার মধ্য দিয়েই সম্ভবতঃ চার্বাকদের লড়াইটা শুরু হয়েছিল। আত্মাই যদি না থাকবে তবে কেন অযথা স্বর্গ নরকের কেচ্ছা-কাহিনীর আমদানী। আত্মা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করতে করতে শেষ পর্যন্ত ঠোঁট কাটা চার্বাকেরা ঈশ্বর-আত্মা-পরলোক-জাতিভেদ-জন্মান্তর সব কিছুকেই তারা নাকচ করে দেন। তারাই প্রথম বলেছিলেন বেদ 'অপৌরুষেয়' নয়, এটা একদল স্বার্থান্নেষী মানুষেরই রচিত। জনমানুষের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাওয়া সেই সব স্বার্থান্নেষী ব্রাক্ষ্মণদের চার্বাকেরা ভন্ড, ধূর্ত, চোর, নিশাচর বলে অভিহিত করেছিলেন, তারা বাতিল করে দিয়েছিলেন আত্মার অস্তিত্ব, উন্মোচন করেছিলেন ধর্মের জুয়াচুরি এই বলে :

বেহেস্ত ও মোক্ষপ্রাপ্তি কি পরিত্রাণলাভ ফাঁকা অর্থহীন অসার বুলিমাত্র, উদরযন্ত্রে বিসর্পের কারণে সবেগে উৎক্ষিপ্ত দুর্গন্ধময় ঢেকুরমাত্র। এসব প্যাক প্যাক বা বাকচাতুরি নৈতিক অপরাধ, উন্মার্গ গমন, মানসিক ও দৈহিক ঔদার্যের ফলশ্রতি -পরান্নভোজী বমনপ্রবণ ব্যক্তিদের অদম্য কুৎসিৎ বমনমাত্র, পেটুকদের এবং উন্মার্গগামীদের বিলাস-কল্পণা। পরজগতে যাওয়ার জন্য কোন আত্মার অস্তিত্ব নেই। বর্ণাশ্রমের নির্দিষ্ট মেকি নিয়ম-আচার আসলে কোন ফল উৎপন্ন করে না। বর্ণাশ্রমের শেষ পরিনামের কাহিনী সাধারণ মানুষকে ঠকাবার উদ্দেশ্যে ধর্মকে গাঁজাবার খামি বিশেষ।

চার্বাকেরা বলতেন, চতুর পুরোহিতদের দাবী অনুযায়ী যদি জ্যোতিষ্টোম যজ্ঞে বলিকৃত প্রাণী সরাসরি স্বর্গলাভ করে, তাহলে তারা নিজেদের পিতাকে এভাবে বলি দেয় না কেন? কেন তারা এভাবে তাদের পিতার স্বর্গপ্রাপ্তি নিশ্চিত করে না? :

যদি জ্যোতিষ্টোম যজ্ঞে
বলি দিলে পশু যায় স্বর্গে
তবে পিতাকে পাঠতে স্বর্গে
ধরে বেঁধে বলি দাও যজ্ঞে।

চার্বাকেরা আরো বলতেন :

চৈতন্যরূপ আত্মার পাকযন্ত্র কোথা
তবে ত পিন্ডদান নেহাতই বৃথা।

কিংবা

যদি শ্রাদ্ধকর্ম হয় মৃতের তৃপ্তের কারণ
তবে নেভা প্রদীপে দিলে তেল, উচিৎ জ্বলন।

আত্মা বা চৈতন্যকে চার্বাকেরা তাদের দর্শনে আলাদা কিছু নয় বরং দেহধর্ম বলে বর্ণনা করেছিলেন। এই ব্যাপারটা এখন আধুনিক বিজ্ঞানও সমর্থন করে। পানির সিক্ততার ব্যাপারটা চিন্তা করুন। এই সিক্ততা জিনিসটা আলাদা কিছু নয় - বরং পানির অনুরই স্বভাব ধর্ম। 'সিক্তাত্মা' নামে কোন অপার্থিব সত্ত্বা কিন্তু পানির মধ্যে সেঁদিয়ে গিয়ে তাতে সিক্ততা নামক ধর্মটির জাগরণ ঘটাচ্ছে না। বরং পানির অণুর অঙ্গসজ্জার কারণেই 'সিক্ততা' নামের ব্যাপারটির অভ্যুদয় ঘটছে। চার্বাকেরা বলতেন, মানুষের চৈতন্য বা আত্মাও তাই। দেহের স্বভাব ধর্ম হিসেবেই আত্মা বা চৈতন্যের উদয় ঘটছে। কিভাবে এর অভ্যুদয় ঘটে? চার্বাকেরা একটি চমৎকার উপমা দিয়ে ব্যাপারটি বুঝিয়েছিলেন। বলেছিলেন, আঙ্গুর এবং মদ তৈরির অন্যান্য উপাদানগুলোতে আলাদা করে কোন মদশক্তি নেই। কিন্তু সেই উপকরণগুলোই এক ধরণের বিশেষ প্রক্রিয়ায়র মাধ্যমে কোন পাত্রে মিলিত করার পরে এর একটি নতুন গুণ পাওয়া যাচ্ছে, যাকে আমরা বলছি মদ। আত্মা বা চৈতন্যও তেমনি। যিশু খ্রীষ্টের জন্মের প্রায় ৬০০ বছর আগের বস্তুবাদী দার্শনিকেরা এভাবেই তাদের ভাষায় 'রাসায়নিক প্রক্রিয়ায়' প্রাণের উদ্ভবকে ব্যাখ্যা করেছিলেন, কোন রকমের আত্মার অনুকল্প ছাড়াই। তাদের এই বক্তব্যই পরবর্তীতে ভাববাদী দার্শনিকদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছিল।

আত্মা, মন এবং অমরত্ব : বিজ্ঞানের চোখে

ভাববাদীরা যাই বলুক না কেন স্কুলের পাঠ শেষ করা ছাত্রটিও আজ জানে, মন কোন 'বস্তু' নয়; বরং মানুষের মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের কাজ কর্মের ফল। চোখের কাজ যেমন দেখা, কানের কাজ যেমন শ্রবণ করা, পাকস্থলীর কাজ যেমন খাদ্য হজম করা, তেমনি মস্তিস্ক কোষের কাজ হল চিন্তা করা। তাই নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ক্রিক তাঁর 'The Astonishing Hypothesis: The Scientific Search for the Soul' গ্রন্থে পরিস্কার করেই বলেন :

'বিস্ময়কর অনুকল্পটি হল: আমার 'আমিত্ব', আমার উচ্ছ্বাস, বেদনা, স্মৃতি, আকাংখা, আমার সংবেদনশীলতা, আমার পরিচয় এবং আমার মুক্তবুদ্ধি এগুলো আসলে মস্তিস্কের স্নায়ুকোষ এবং তাদের আনুষঙ্গিক অণুগুলোর বিবিধ ব্যবহার ছাড়া আর কিছুই নয়।'
মানুষ চিন্তা করতে পারে বলেই নিজের ব্যক্তিত্বকে নিজের মত করে সাজাতে পারে, সত্য-মিথ্যের মিশেল দিয়ে কল্পণা করতে পারে তার ভিতরে 'মন' বলে সত্যই কোন পদার্থ আছে, অথবা আছে অদৃশ্য কোন আত্মার আশরীরী উপস্থিতি। মৃত্যুর পর দেহ বিলীন হয়। বিলীন হয় দেহাংশ, মস্তিস্ক স্নায়ুকোষ। আসলে মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষের মৃত্যু মানেই কিন্তু 'মন' এর মৃত্যু, সেই সাথে মৃত্যু তথাকথিত আত্মার। অনেক সময় দেখা যায় দেহের অন্যান্য অংগ প্রত্যংগ ঠিকমত কর্মক্ষম আছে, কিন্তু মস্তিষ্কের কার্যকারিতা হারিয়ে গেছে। এ ধরনের অবস্থাকে বলে কোমা। মানুষের চেতনা তখন লুপ্ত হয়। মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা হারানোর ফলে জীবিত দেহ তখন অনেকটা জড়পদার্থের মতই আচরণ করে। তাহলে জীবন ও মৃত্যুর যোগসূত্রটি রক্ষা করছে কে? এ কি অশরীরী আত্মা, নাকি মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের সঠিক কর্মক্ষমতা?

এ পর্যায়ে বিখ্যাত ক্রিকেটার রমণ লাম্বার মৃত্যুর ঘটনাটি স্মরণ করা যাক। ১৯৯৮ সালের ২০ এ ফেব্রুয়ারী ঢাকা স্টেডিয়ামে (বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম) লীগের খেলা চলাকালীন সময় মেহেরাব হোসেন অপির একটি পুল শট ফরওয়ার্ড শর্ট লেগে ফিল্ডিংরত লাম্বার মাথায় সজোরে আঘাত করে। প্রথমে মনে হয়েছিল তেমন কিছুই হয় নি। নিজেই হেঁটে প্যাভিলিয়নে ফিরলেন; কিন্তু অল্প কিছুক্ষণ পরই জ্ঞান হারালেন তিনি। চিকিৎসকেরা তাকে ক্লিনিকে ভর্তি করলেন। পরদিন ২১ এ ফেব্রুয়ারী তাকে পিজি হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগে ভর্তি করা হল। সেখানে তার অপারেশন হল, কিন্তু অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকেই যাচ্ছিল। পরদিন ২২ এ ফেব্রুয়ারী ডাক্তাররা ঘোষণা করলেন যে, মস্তিষ্ক তার কার্যকারিতা হারিয়েছে। হার্ট-লাং মেশিনের সাহায্যে কৃত্রিমভাবে হৃৎপিন্ড এবং ফুসফুসের কাজ চলছিল।

auto চিত্রঃ রমন লাম্বা - মেধাবী ক্রিকেটারের দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যু

২৩ ফেব্রুয়ারী বিকেল সাড়ে তিনটায় তার আইরিশ স্ত্রী কিমের উপস্থিতিতে হার্ট লাং মেশিন বন্ধ করে দিলেন চিকিৎসকেরা। থেমে গেল লাম্বার হৃৎস্পন্দন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে ডেথ সার্টিফিকেটে মৃত্যুর তারিখ কোনটি হওয়া উচিৎ? ২২ নাকি ২৩ ফেব্রুয়ারী? আর তার মৃত্যুক্ষণটি নির্ধারণ করলেন কারা? আজরাইল/যমদূত নাকি চিকিৎসারত ডাক্তারেরা?

এ ব্যাপারটি আরও ভালভাবে বুঝতে হলে মৃত্যু নিয়ে দু'চার কথা বলতেই হবে। জীবনের অনিবর্তনীয় পরিসমাপ্তিকে (Irreversible cessation of life) বলে মৃত্যু। কেন জীবের মৃত্যু হয়? কারণ মৃত্যুবরণের মাধ্যমে আমাদের জীবন তাপগতীয় স্থিতাবস্থা (thermodynamic equilibrium) প্রাপ্ত হয়। তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র মানতে গেলে জীবনের উদ্দেশ্য আর কিছুই নয় - নিবিষ্টচিত্তে এন্ট্রপি বাড়িয়ে চলা। আমাদের খাওয়া, দাওয়া, শয়ন, ভ্রমণ, মৈথুন, কিংবা হিমু্র 'বালিকা দংশন' কিংব সন্যাসীর 'কামরাঙ্গা কবিতা' পাঠের আনন্দ - সব কিছুর পেছনেই থাকে মোটা দাগে কেবল একটি মাত্র উদ্দেশ্য -ফেইথফুলি এনট্রপি বাড়ানো - সেটা আমরা বুঝতে পারি আর নাই পারি! জন্মের পর থেকে সারা জীবন ধরে আমরা এনট্রপি বাড়িয়ে বাড়িয়ে প্রকৃতিতে তাপগতীয় অসাম্য তৈরি করি, আর শেষ মেষ পঞ্চত্ব প্রাপ্তির মাধ্যমে অন্যান্য জড় পদার্থের মত নিজেদের দেহকে তাপগতীয় স্থিতাবস্থায় নিয়ে আসি। কিন্তু কিভাবে এই স্থিতাবস্থার নির্দেশ আমরা বংশপরম্পরায় বহন করি? জীবিবিজ্ঞানের চোখে দেখলে, আমরা (উদ্ভিদ এবং প্রাণী) উত্তরাধিকার সূত্রে বিবর্তনের মাধ্যমে আমাদের পূর্ব-পুরুষদের যারা যৌনসংযোগের মাধ্যমে বংশবিস্তার করে প্রকৃতিতে টিকে রয়েছে তাদের থেকে মরণ জিন (Death Gene) প্রাপ্ত হয়েছি এবং বহন করে চলেছি। এই ধরনের জিন (মরণ জিন) তার পূর্ব নির্ধারিত পরিকল্পিত উপায়েই মৃত্যুকে ত্বরান্নিত করে চলেছে। যৌনজননের মাধ্যমে বংশবিস্তাররের ব্যাপারটিতে আমি এখানে গুরুত্ব দিচ্ছি। কারণ, যে সমস্ত প্রজাতি যৌনজননকে বংশবিস্তারের একটি মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে, তাদের ‘মৃত্যু’ নামক ব্যাপারটিকেও তার জীবগত বৈশিষ্ট হিসেবে গ্রহণ করে নিতে হয়েছে। দেখা গেছে স্তন্যপায়ী জীবের ক্ষেত্রে সেক্স-সেল বা যৌনকোষগুলোই (জীববিজ্ঞানীরা বলেন 'জার্মপ্লাজম') হচ্ছে একমাত্র কোষ যারা সরাসরি এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে নিজেদের জিন সঞ্চারিত করে টিকে থাকে। জীবনের এই অংশটি অমর। কিন্তু সে তুলনায় সোমাটিক সেল দিয়ে তৈরী দেহকোষগুলো হয় স্বল্পায়ুর। অনেকে এই ব্যাপারটির নামকরণ করেছেন 'প্রোগ্রামড্‌ ডেথ'। এ যেন অনেকটা বেহুলা-লক্ষিন্দর কিংবা বাবর-হুমায়ূনের মত ব্যাপার-স্যাপার - জননকোষের অমরত্বকে পূর্ণতা দিতে গিয়ে দেহকোষকে বরণ করে নিতে হয়েছে মৃত্যুভাগ্য। প্রখ্যাত জীববিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স হালকাচালে তার 'সেলফিশ জিন' বইয়ে বলেছেন,

মৃত্যুও বোধহয় সিফিলিস বা গনোরিয়ার মত একধরনের 'সেক্সুয়ালি ট্রান্সমিটেড ডিজিজ' যা আমরা বংশ পরম্পরায় সৃষ্টির শুরু থেকে বহন করে চলেছি!
ভাইরাস ব্যাকটেরিয়ার মত সরল কোষী জীব যারা যৌন জনন নয়, বরং কোষ বিভাজনের মাধ্যমে প্রকৃতিতে টিকে আছে তারা কিন্তু আক্ষরিক অর্থেই অমর। এদের দেহ কোষ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে বিভাজিত হয়, তার পর বিভাজিত অংশগুলিও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে পুনরায় বিভাজিত হয়; কোন অংশই আসলে সেভাবে 'মৃত্যুবরণ' করে না।

আবার অধিকাংশ ক্যান্সার কোষই অমর, অন্ততঃ তাত্ত্বিকভাবে তো বটেই। একটি সাধারণ কোষকে জীবদ্দশায় মোটামুটি গোটা পঞ্চাশেক বার কালচার বা পুরুৎপাদন করা যায়। এই হাফ-সেঞ্চুরির সীমাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলে 'হেফ্লিক লিমিট' (Hayflick Limit)। কখনো সখনো ক্যান্সারাক্রান্ত কোন কোন কোষে সংকীর্ণ টেলোমার থাকার কারণে এটি কোষস্থিত ডিএনএ’র মরণ জিনকে স্থায়ীভাবে 'সুইচ অফ' করিয়ে দেয় । এর ফলে এই কোষ তার আভ্যন্তরীন 'হেফ্লিক' লিমিটকে অতিক্রম করে যায়। তখন আক্ষরিকভাবেই অসংখ্যবার - মানে অসীম সংখ্যকবার সেই কোষকে কালচার করা সম্ভব। এই ব্যাপারটাই তাত্ত্বিকভাবে কোষটিকে প্রদান করে অমরত্ব। হেনরিয়েটা ল্যাকস নামে এক মহিলা ১৯৫২ সালে সার্ভিকাল ক্যান্সারে মারা যাওয়ার পর ডাক্তাররা ক্যান্সারাক্রান্ত দেহকোষটিকে সরিয়ে নিয়ে ল্যাবে রেখে দিয়েছিল। এই কোষের মরণজিন স্থায়ীভাবে 'সুইচ অফ' করা এবং কোষটি এখনো ল্যাবরেটরীর জারে বহাল তবিয়তে 'জীবিত' অবস্থায় আছে। প্রতিদিনই এই সেল থেকে কয়েশ বার করে সেল-কালচার করা হচ্ছে, এই কোষকে এখন 'হেলা সেল' নামে অভিহিত করা হয়। যদি কোন দিন ভবিষ্যত- প্রযুক্তি আর জৈবমুল্যবোধ (bioethics) আমাদের সেই সুযোগ দেয়, তবে আমরা হয়ত হেলাকোষ ক্লোন করে হেনরিয়েটাকে আবার আমাদের পৃথিবীতে ফেরত আনতে পারব। হাসি

আবার ব্রাইন শ্রিম্প (brine shrimp), গোলকৃমি বা নেমাটোড, কিংবা টার্ডিগ্রেডের মত কিছু প্রাণি আছে যারা মৃত্যুকে সরাসরি লুকিয়ে রাখতে পারে, জীববিজ্ঞানের ভাষায় এ অবস্থাকে বলে 'ক্রিপ্টোবায়টিক স্টেট'। যেমন, ব্রাইন শ্রিম্পগুলো লবনাক্ত পানিতে সমানে বংশবৃদ্ধি করতে থাকে, কিন্তু পানি যখন শুকিয়ে যায়, তখন তারা ডিম্বানু উৎপাদন, এমনকি নিজেদের দেহের বৃদ্ধি কিংবা মেটাবলিজম পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়। শ্রিম্পগুলোকে দেখতে তখন মৃত মনে হলেও এরা আসলে মৃত নয় - বরং এদের এই মরণাপন্ন মধ্যেও জীবনের বীজ লুকানো থাকে। এই অবস্থাটিকেই বলে 'ক্রিপ্টোবায়টিক স্টেট'। আবার কখনো তারা পানি খুঁজে পেলে আবারো নতুন করে 'নবজীবন প্রাপ্ত' হয়। এদের অদ্ভুতুরে ব্যাপার স্যাপার অনেকটা ভাইরাসের মত। ভাইরাসের কথা আরেকবার চিন্তা করা যাক। ভাইরাস জীবণ ও জড়ের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থান করে। ভাইরাসকে কেউ জড় বলতে পারেন, আবার জীবিত বলতেও বাঁধা নেই। এমনিতে ভাইরাস 'মৃতবৎ', তবে তারা 'বেঁচে' ওঠে অন্য জীবিত কোষকে আশ্রয় করে। ভাইরাসে থাকে প্রোটিনবাহী নিউক্লিয়িক এসিড। এই নিউক্লিয়িক এসিডই ভাইরাসের যাবতীয় বৈশিষ্ট্যের আধার। উপযুক্ত পোষক দেহ পাওয়ার আগ পর্যন্ত তারা 'ক্রিপ্টোবায়টিক স্টেট'-এ জীবনকে লুকিয়ে রাখে। আর তারপর উপযুক্ত দেহ পেলে আবারো কোষ বিভাজনের মাধ্যমে অমরত্বের খেলা চালিয়ে যেতে থাকে।

কাজেই দেখা যাচ্ছে 'মৃত্যু' ব্যাপারটি সব জীবের জন্যই অত্যাবশ্যকীয় নিয়ামক নয়। ভাইরাসের আনবিক সজ্জার মধ্যেই আসলে লুকিয়ে আছে অমরত্বের বীজ। এই অঙ্গসজ্জাই আসলে ডিএনএর মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয় তারা কখন ঘাপটি মেরে 'ক্রিপ্টোবায়টিক স্টেট'-এ পড়ে থাকবে, আর কখন নবজীবনের ঝর্ণাধারায় নিজেদের আলোকিত করবে। সে হিসেবে ভাইরাসেরা আক্ষরিক অর্থেই কিন্তু অমর - এরা স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করে না। তবে মানুষের নিজের প্রয়োজনে রাসায়নিক জীবাণুনাশক ঔষধপত্রাদির উদ্ভাবন ও তার প্রয়োগে জীবাণুনাশের ব্যাপারটি এক্ষেত্রে আলাদা। ঔযধের প্রয়োগে আসলে এদের অংগসজ্জা ভেঙে দেওয়া হয়, যেন তারা আবার পুনর্জীবন প্রাপ্ত হয়ে রোগ ছড়াতে না পারে। ঠিক একই রকম ভাবে অত্যধিক বিকিরণ শক্তি প্রয়োগ করেও ভাইরাসের এই দেহগত অঙ্গসজ্জা ভেঙে দেওয়া যেতে পারে। এর ফলে এদের আনবিক গঠণ বিনষ্ট হবে এবং এদের জীবনের সুপ্ত আধার হারিয়ে যাবে। ফলে উপযুক্ত পরিবেশ পেলেও এরা আর পুনর্জীবনপ্রাপ্ত হবে না। যারা জীবন-মত্যুর ব্যাপারটিকে আরো ভালমত বিজ্ঞানের গভীরে গিয়ে বুঝতে চান তারা আনবিক জীববিজ্ঞানী উইলিয়াম সি ক্লার্কের লেখা 'Sex and the Origins of Death' বইটি পড়তে পারেন । আমার আর ফরিদের লেখা 'মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে' (অবসর প্রকাশনা, ২০০৭) বইটির প্রথম অধ্যায়েও বেশ কিছু আকর্ষনীয় উদাহরণ হাজির করে জীবন-মৃত্যুকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে। উৎসাহী পাঠিকেরা পড়ে নিতে পারেন ।

চলবে ...


মন্তব্য

সবজান্তা এর ছবি

বিপ্লব মানে একদম ভয়াবহ বিপ্লব আপনাকে !!

একদিকে যেমন আত্মাকে অমর অক্ষয় বলা হচ্ছে, জোর গলায় প্রচার করা হচ্ছে আত্মাকে কাটা যায় না, পোড়ানো যায় না, আবার সেই আত্মাকেই পাপের শাস্তিস্বরূপ নরকে ধারলো অস্ত্র দিয়ে কাটা, গরম তেলে পোড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।

দুর্দান্ত !

আমাদের খাওয়া, দাওয়া, শয়ন, ভ্রমণ, মৈথুন, কিংবা হিমু্র 'বালিকা দংশন' কিংব সন্যাসীর 'কামরাঙ্গা কবিতা' পাঠের আনন্দ - সব কিছুর পেছনেই থাকে মোটা দাগে কেবল একটি মাত্র উদ্দেশ্য -ফেইথফুলি এনট্রপি বাড়ানো - সেটা আমরা বুঝতে পারি আর নাই পারি!

আরো দুর্দান্ত !

আমি ব্যক্তিগত জীবনে একজন তড়িৎ প্রকৌশল বিদ্যার ছাত্র। মাধ্যমিক শ্রেনীতেই জীববিদ্যার সাথে শেষ দেখা, উচ্চমাধ্যমিকে সেই স্থান নিয়েছিল পরিসংখ্যান। তাই জীববিজ্ঞানের অনেক কিছুই জানতাম না। কিন্তু আপনার লেখা পড়ে অনেক দারুন ব্যাপার জানতে পারলাম ( যেমন হেফ্লিক লিমিট, ক্রিপ্টোবায়োটিক স্টেট ইত্যাদি ) ।অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।

আরো পড়ার প্রত্যাশায় থাকলাম।

-------------------------------------------------------
অলমিতি বিস্তারেণ

অভিজিৎ এর ছবি

সবজান্তা,
আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ লেখাটি আগ্রহভরে পড়বার এবং মন্তব্য করবার জন্য। বন্যার কাছে আপনার কথা শুনেছি। বুয়েটে পড়েন তা শুনেছিলাম, তড়িৎ প্রকৌশলের ব্যাপারটা জানতাম না। ভাল লাগল জেনে।

আমি পড়েছিলাম মেকানিকালে, তাও বুয়েট ছেড়েছি -প্রায় এক যুগ হতে চলল। আমারো উচ্চমাধ্যমিকে জীববিজ্ঞান ছিল না, ছিল পরিসংখ্যান।

হ্যা, হেফ্লিক লিমিট, ক্রিপ্টোবায়োটিক স্টেটের ব্যাপারগুলো আমাদের অনেকের কাছেই নতুন। জীববিজ্ঞানে জেনেটিক্স-এর গবেষণা যত এগুচ্ছে, ততই আমরা এ ধরণের নতুন নতুন অনেক কিছু জানতে পারছি। প্রতিদিনই আমরা আসলে নতুন নতুন জ্ঞানের আলোয় নিজেদের ঝালিয়ে নিচ্ছি।

আপনাকে আবারো ধন্যবাদ সঙ্গে থাকার জন্য।

=============================
পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)


পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

জটিল কোনও বিষয়ের ক্লাসে গর্দভ-টাইপ ছাত্রের মতো আমি আপনার লেখাগুলো পড়ে যাই প্রশ্ন- বা মন্তব্যহীন হাসি

তবে আজকের লেখায় যখন জানলাম. আমার ছড়াও এনট্রপি বাড়ানোর কাজে ব্যবহৃত হয় দেঁতো হাসি , দু'লাইন লেখার লোভ নিবৃত্ত করতে পারলাম না।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

অভিজিৎ এর ছবি

হাঃ হাঃ, আপনার মন্তব্যও আপনার লেখার মতই সরস।

আপনি বহাল তবিয়তে জীবিত থেকে আপনার কাব্য প্রতিভা প্রদর্শনের মাধ্যমে আরো এন্ট্রপি বাড়িয়ে যান, সেই কামনা করি
=========================
পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)


পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)

সবজান্তা এর ছবি

আপনার কথা শুনেতো আমি অন্যরকম একটা অনুপ্রেরণা পেলাম।

একজন যন্ত্রকৌশল এর মানুষ হয়ে এত চমৎকার বিবর্তন, ধর্ম এবং যুক্তি নিয়ে লেখেন ! এতদিন আমি ভাবতাম, এসব নিয়ে গভীরতম চিন্তার কাজ সমাজবিজ্ঞানী, দর্শন কিংবা তত্ত্বীয় বিজ্ঞানের ছাত্রদের। একজন প্রায়োগিক বিজ্ঞানের লোক হয়েও এত চমৎকার লিখেন আপনি , অভাবনীয় !
----------------------------------------------------
অলমিতি বিস্তারেণ

স্নিগ্ধা এর ছবি

অভি, আমার ধারণা ছিলো চার্বাক একজন ঋষির নাম, কিন্তু লেখাটা পড়ে মনে হচ্ছে এটা কোন বিশেষ মতানুসারীদের কেও বোঝাতো। এরা কি চার্বাকের শিষ্য ছিলো? চার্বাক যুক্তিসিদ্ধ ছিলো জানি, কিন্তু কৌটিল্যের মত তাঁর কি কোন একটা specific দিকে বুৎপত্তি ছিলো? থাকলে সেটা কি একটু বোলো তো সময় পেলে। (একটু অফফ দ্যা টপিক প্রশ্ন হয়ে গেল ঃ) )

অভিজিৎ এর ছবি

অভি, আমার ধারণা ছিলো চার্বাক একজন ঋষির নাম, কিন্তু লেখাটা পড়ে মনে হচ্ছে এটা কোন বিশেষ মতানুসারীদের কেও বোঝাতো। এরা কি চার্বাকের শিষ্য ছিলো?

আসলে এটির উত্তর দিতে গেলে অনেক কিছু বলতে হয়। কোত্থেকে শুরু করব বুঝতে পারছি না। 'চার্বাক' কথাটা কোত্থেকে এল - এ নিয়ে কিছু বলি। অনেক দার্শনিকের মতে 'চারু+বাক্' থেকে চার্বাক কথাটা এসেছে। মানুষের স্বাভাবিক ভোগপ্রবৃত্তির কথা মাথায় রেখে যে দর্শন 'চারু' বা 'সুন্দর' কথার জাল বুনে 'ইহজগতেই সব কিছু শেষ, মৃত্যুর পরে অন্য কোন জগৎ বলে কিছু নেই, অতএব ভোগ কর' বলে মানুষের চিত্ত আকর্ষন করেছে, সেই দর্শনই 'চারু বাক' বা চার্বাক।

অন্য আরেকটি মতে, 'চর্ব' (অর্থাৎ চর্বণ) করে যে- এই অর্থে চার্বাক্ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। এই ব্যাখ্যাকারীরাও খানা-পিনার মাধ্যমেই জীবনের পরম সার্থকতা খুঁজে পায় যে দর্শন - তাকে চার্বাক দর্শন বলে অভিহিত করতে চেয়েছেন।

এই ব্যাখ্যার মধ্যে চার্বাকদের সম্বন্ধে অন্তর্নিহিত হেয়কারী ভাবটি খুব সহজেই লক্ষ্যনীয়। প্রবীর ঘোষ তার 'অলৌকিক নয়, লৌকিক' বইয়ের প্রথম খন্ডে এই দুটো মতকেই বাতিল করেছেন। আসলে ব্যাকরণ মানতে গেলে তাই করতে হয়। চারু+ বাক্ থেকে চারুবাক্ বা চার্ বাক্ বা চার্বাক্ হতে পারে চার্বাক (হসন্ত নেই)নয়। অথচ, প্রাচীন সমস্ত লেখায় যেখানে চার্বাকদের কথা জানা যায় কোথাওই হসন্ত ব্যবহৃত হয়নি।
আবার যে চর্বন করে তাকে বলা উচিৎ চর্বক, চার্বাক নয়। ব-এর আকার হওয়ার কথা ছিল না।

পালি সাহিত্য বিষয়ে আরেক 'বিশেষজ্ঞ' রিস ডেভিন্ডস এর ধারনায় মহাভারতের এক কুচরিত্র রাক্ষস 'চার্বাক' -এর নাম হতেই চার্বাক শব্দটি এসেছে। আসলে প্রাচীন ভাববাদীরা বস্তুবাদী দর্শনটির প্রতি সাধারণ মানুষের অশ্রদ্ধা ও ঘৃণা সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই এমন এক ঘৃন্য চরিত্রের সাথে চার্বাক দরশনকে মিলিয়ে দিয়েছিলেন।

অনেকে আবার মনে করেন চার্বাক দর্শনটি দেবগুরু বৃহস্পতির প্রনীত। পুরাণে আছে, অসুরদের হাত থেকে দেবকূলকে রক্ষা করার জন্য বৃহস্পতি এক ভ্রান্ত দর্শন রচনা করেছিলেন। এই দর্শন অনুসরণ করে অসুরেরা নীতি ভ্রষ্ট হয়েছিল এবং অধঃ পাতে গিয়েছিল। এখানেও কিন্তু দেখতে পাই বস্তুবাদী দর্শনই অসুরদের ধ্বংসের কারণ হয়েছিল - এই জিনিস গেলানোর চেষ্টা করে আতংক ছড়ানো হয়েছে।

চার্বাক দর্শনের আরেক নাম লোকায়াত দর্শন। মানে সাধারণ মানুষের দর্শন। সাধরনেরা তো ব্রাহ্মনদের কাছে সব সময়ই অচ্ছুত। শঙ্করাচার্য প্রমুখ ভাববাদী দার্শনিকেরা 'লোকায়াত' নামকরণের কারণ হিসেবে জানিয়েছেন - এটি লোকায়াত - মানে ইতর লোকের দর্শন। এখানেও অশ্রদ্ধার ব্যাপারটি দেখো।

আসলে চার্বাকদের লেখা বইপত্র পরবর্তী যুগের ভাব বাদী দার্শনিকেরা সবই পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। চার্বাকদের সম্বন্ধে এখন যা কিছু জানা যায় তা অই ভাববাদী দার্শনিকদের সমালোচনা থেকে। বোঝ ঠ্যালা।

দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের একটি ভাল বই আছে - 'লোকায়াত দর্শন' নামে। পড়তে পারো সময় করে।

===============================
পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)


পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)

সৌরভ এর ছবি

যৌনকোষগুলোই (জীববিজ্ঞানীরা বলেন 'জার্মপ্লাজম') হচ্ছে একমাত্র কোষ যারা সরাসরি এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে নিজেদের জিন সঞ্চারিত করে টিকে থাকে। জীবনের এই অংশটি অমর।

এভাবে তো ভাবিনি কখনো।
সত্যিইতো তাই।
প্রাণের এই অংশটুকুর কোটি-কোটি কপিই তাহলে এখনকার পৃথিবীতে হেসেখেলে বেড়ায়।

আগের পর্বটা মিলিয়ে পড়লাম। আপনাকে স্যালুট।



আমি ও আমার স্বপ্নেরা লুকোচুরি খেলি


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।