আগের পর্বের পর ...
আমরা আগের পর্বে মরণপ্রান্তিক অভিজ্ঞতার সময় কেন সুরঙ্গ দেখা যায় তা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোন থেকে দেখবার চেষ্টা করেছিলাম। বোঝা যাচ্ছে সুরঙ্গ-দর্শনের মাঝে অলৌকিক বা অপার্থিব কোন ব্যাপার নেই, নেই কোন পারলৌকিক রহস্য, যা আছে তা একেবারে নিরস, নিখাঁদ বিজ্ঞান। বলা বাহুল্য, ফেলু মিত্তরের গোয়েন্দাগল্পের মত 'সুরঙ্গ-রহস্য' শেষ পর্যন্ত সমাধান করেছে বিজ্ঞানীরাই। শুধু রহস্য সমাধান নয়, গাণিতিক মডেল টডেল করাও সারা। শুধু তাই নয়, টানেলের পাশাপাশি কেন যীশুখ্রীষ্ট কিংবা মৃত-আত্মীয় স্বজনের দেখা যাচ্ছে তারও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বলেন, ব্যাপারটা হয়ত পুরোটাই সমাজ-সাংস্কৃতিক। যীশুখ্রীষ্টের দেখা পান তারাই, যারা দীর্ঘদিন খ্রীষ্টীয় জল-হাওয়ায় বড় হয়েছেন, বাবা মা, শিক্ষক, পাড়া-পড়শীদের কাছ থেকে 'খ্রীষ্টীয় সবক' পেয়েছেন। একজন হিন্দু কখনোই মরণ-প্রান্তিক অভিজ্ঞতায় খ্রীষ্টের দেখা পান না, তিনি পান বিষ্ণু, ইন্দ্র বা লক্ষীর দেখা, আর ভাগ্য খারাপ হলে 'যমদূতের'। আবার একজন মুসলিম হয়ত সেক্ষেত্রে দর্শন লাভ করেন আজরাইল ফেরেশতার। বোঝা যাচ্ছে, ধর্মীয় 'দিব্য দর্শন' কোন 'সার্জনীন সত্য' নয়, বরং, আজন্ম লালিত ধর্মানুগত্য আর নিজ নিজ সংস্কৃতির রকমফেরে ব্যক্তিবিশেষে পরিবর্তিত হয়। কাজেই, ঈশ্বর দর্শনই বলুন আর ধর্মীয় 'দিব্য দর্শন'ই বলুন, এগুলোর উৎসও আসলে মানব মস্তিস্কই। দেখা গেছে মস্তিস্কের কোন কোন অংশকে উত্তেজিত করলে মানুষের পক্ষে ভুত, প্রেত, ড্রাকুলা থেকে শুরু করে শয়তান, ফেরেশতা কিংবা ঈশ্বর দর্শন সব কিছুই সম্ভব। এ ব্যাপারটা আরো বিষদভাবে বুঝতে হলে আমাদের মস্তিস্কের একটি বিশেষ অংশ -'টেম্পোরাল লোব' সম্বন্ধে জানতে হবে।
টেম্পোরাল লোব : মস্তিস্কের 'গড স্পট'?
বিশ্বের তাবৎ বিজ্ঞানী আর গবেষকের দল অনেকদিন ধরেই সন্দেহ করছিলেন, ঈশ্বর দর্শন, দিব্যদর্শন, কিংবা ওহিপ্রাপ্তির মত ধর্মীয় অভিজ্ঞতাগুলো আসলে স্রেফ মস্তিস্কসঞ্জাত। সেই ১৮৯২ সালের আমেরিকার পাঠ্যপুস্তকগুলোতেও এপিলেপ্সির সাথে 'ধর্মীয় আবেগের' সাযুজ্য খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছিল। ব্যাপারটা আরো ভালমত বোঝা গেল বিগত শতকের মধ্যবর্তী সময়ে। ১৯৫০ সালের দিকে উইল্ডার পেনফিল্ড নামের এক নিউরোসার্জন মস্তিস্কে অস্ত্রপ্রচার করার সময় ব্রেনের মধ্যে ইলেকট্রোড ঢুকিয়ে মস্তিস্কের বিভিন্ন অংশকে বৈদ্যুতিকভাবে উদ্দীপ্ত করে রোগীদের কাছে এর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইতেন। যখন কোন রোগীর ক্ষেত্রে 'টেম্পোরাল লোব' (ছবিতে দেখুন)-এ ইলেক্ট্রোড ঢুকিয়ে উদ্দীপ্ত করতেন, তাদের অনেকে নানা ধরণের 'গায়েবী আওয়াজ' শুনতে পেতেন, যা অনেকেটা 'দিব্য দর্শনের' অনুরূপ ৩০। এই ব্যাপারটা আরো পরিস্কার হল, ১৯৭৫ সালে যখন বস্টোন ভেটেরান্স এডমিনিস্ট্রেশন হাসপাতালের স্নায়ু-বিশেষজ্ঞ নরমান গেসচ উইন্ড-এর গবেষণায় প্রথম বারের মত এপিলেপ্সি বা মৃগীরোগের সাথে টেম্পোরাল লোবে বৈদ্যুতিক মিসফায়ারিং-এর একটা সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া গেল ৩১ । একই ক্রমধারায় ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ু বিশেষজ্ঞ ভিলায়ানুর এস রামাচান্দ্রণ তার গবেষণায় দেখালেন, টেম্পোরাল লোব এপিলেপ্সি রোগীদের ক্ষেত্রেই ঈশ্বর-দর্শন, ওহি-প্রাপ্তির মত ধর্মীয় অভিজ্ঞতার আস্বাদনের সম্ভাবনা বেশি ৩২। এগুলো থেকে হয়ত অনুমান করা যায়, কেন আমাদের পরিচিত ধর্ম প্রবর্তকদের অনেকেই 'ওহি-প্রাপ্তির' আগে ঘন্টাধ্বনি শুনতে পেতেন, গায়েবী কন্ঠস্বর শুনতে পেতেন , তাদের কেন 'কাপুনি দিয়ে জ্বর আসত' কিংবা কেন তারা 'ঘন ঘন মুর্চ্ছা যেতেন'৩৩ ।
চিত্রঃ মস্তিস্কের টেম্পোরাল লোব : অনেক বিজ্ঞানীই মনে করেন মস্তিস্কের এই অংশটিই হয়ত ধর্মীয় প্রনোদনার মূল উৎস। এই অংশটি নিয়ে গবেষণা করে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আধ্যাত্মিকতার সাথে এপিলেপ্সীর জোরালো সম্পর্কও পাওয়া গেছে।
এই ধরনের গবেষণা থেকে পাওয়া ফলাফলে উদ্বুদ্ধ হয়ে ক্যানাডার লরেন্টিয়ান ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মাইকেল পারসিঙ্গার আরো একধাপ সাহসী গবেষণায় হাত দিলেন। তিনি ভাবলেন, টেম্পোরাল লোবে বৈদ্যুতিক তারতম্য যদি ধর্মীয় প্রণোদনার উৎস হয়েই থাকে তবে, উল্টোভাবে মস্তিস্কের এই গোদা অংশটিকে উদ্দীপ্ত করেও তো কৃত্রিমভাবে ধর্মীয় প্রনোদনার আবেশ আস্বাদন করা সম্ভব, তাই না? হ্যা, অন্ততঃ তাত্ত্বিকভাবে তো তা সম্ভব। ডঃ পারসিঙ্গার ঠিক তাই করলেন। তিনি টেম্পোরাল লোবকে কৃত্রিম্ভাবে উদ্দীপ্ত করে ধর্মীয় আবেশ পাওয়ার জন্য তৈরী করলেন তার বিখ্যাত 'গড হেলমেট'। এই হেলমেট মাথায় পরে বসে থাকলে নাকি 'রিলিজিয়াস এক্সপেরিয়েন্স' আহরণ করা সম্ভব। হেলমেট বানানোর পর অফিশিয়ালি প্রায় ছ'শ জনের উপরে হেলমেট পরিয়ে পরীক্ষা চালানো হয়েছে। এদের প্রায় ৮০ শতাংশ বলেছেন, তাদের এক ধরণের অপার্থিব অনুভূতি হয়েছে ৩০ । তারা অনুভব করেছেন, কোন অশরীরী কেউ (কিংবা কোন স্পিরিট) তাদের উপর নজরদারি করেছে। অনেকের অভিজ্ঞতার লাটাই এর চেয়েও গজখানেক বেশি। যেমন, এক মহিলার হেলমেট পরার পর মনে হয়েছে তিনি তার মৃত মায়ের সাক্ষাৎ পেয়েছেন। আরেক মহিলার কাছে এই অশরীরী অস্তিত্ব এতটাই প্রবল ছিল যে, পরীক্ষার শেষে যখন অশরীরী আত্মা হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিল যে তিনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন। হেলমেট মাথায় পরার পর ব্রিটিশ সাংবাদিক আয়ান কটনের পুরো সময়টা নিজেকে তীব্বতী ভিক্ষু বলে বিভ্রম হয়েছিল। বিজ্ঞানী সুসান ব্ল্যাকমোরের অভিজ্ঞতাটাই বোধ হয় এক্ষেত্রে সবচেয়ে মজার। তিনি নিউ সায়েণ্টিস্ট পত্রিকায় নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন এভাবে ৩৪ -
“আমার হঠাৎ মনে হল কেউ আমার পা ধরে টানছে, দুমড়ে মুচড়ে নষ্ট করে দিচ্ছে।, তারপর ধাক্কা মেরে আমাকে দেওয়ালে ফেলে দিল। পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত; কিন্তু ঘটনাটা ছিল দিনের আলোর মতই পরিস্কার। আমার প্রথমে প্রচন্ড রাগ হচ্ছিল, পরে রাগের স্থান ক্রমান্বয়ে দখল করে নিল ভীতি...।”
অধ্যাপক ব্ল্যাকমোর পরে বলেছিলেন ৩৫, -
পারসিঙ্গারের ল্যাবরেটরীতে আমার সঞ্চিত অভিজ্ঞতা এক কথায় অবিস্মরনীয়। পরে যদি বেরিয়ে আসে কোন প্ল্যাসিবো এফেক্টের কারনে আমি এগুলোর মধ্য দিয়ে গেছি –আমি তাহলে অবাকই হব।
চিত্রঃ মাইকেল পারসিঙ্গার উদ্ভাবিত 'গড হেলমেট'।
তবে সবার ক্ষেত্রেই যে 'গড হেলমেট' একই রকমভাবে কাজ করেছে তা কিন্তু নয়। একবার গড হেলমেটের কার্যকারীতা দেখানোর জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল বিখ্যাত বিজ্ঞানী অধ্যাপক রিচার্ড ডকিন্সকে। ডকিন্স বিবর্তনবাদে বিষেষজ্ঞ একজন বিজ্ঞানী, পাশাপাশি সব সময়ই ধর্ম, অলৌকিকতা প্রভৃতি বিষয়ে উৎসুক। ধর্মের একজন কঠোর সমালোচক তিনি। নিজেকে কখনোই 'নাস্তিক' হিসেবে পরিচিত করতে পরোয়া করেন না। ঈশ্বরে বিশ্বাস তার কাছে বিভ্রান্তি বা 'ডিলুশন', ধর্মের ব্যাপারটা তার কাছে 'ভাইরাস'। এহেন ব্যক্তিকে হেলমেট পরিয়ে তার মনের মধ্যে কোন ধরণের 'ধর্মীয় ফিলিংস' ঢোকানো যায় কিনা, এ নিয়ে অনেকেই খুব উৎসুক ছিলেন।
রিচার্ড ডকিন্স খুব আগ্রহ ভরেই এই পরীক্ষায় 'গিনিপিগ' হতে রাজী হলেন ২০০৩ সালের । ডকিন্স পারসিঙ্গারের ল্যাবরেটরীতে এসে হেলমেট পরে চেম্বারে ঢুকলেন। যথা সময় বেরিয়েও আসলেন। এসে বিবিসির সাথে সাক্ষাৎকারে বললেন ৩৫,
'আমি খুবই হতাশ। খুব ইচ্ছে ছিল ঈশ্বর দর্শনের। কিন্তু চেম্বারে বসে মাথা ঝিম ঝিম করার ভাব ছাড়া আর তো কিছু পেলাম না বাপু!'
মনে হচ্ছে ডকিন্সের মত যুক্তিবাদী মাথা মৃগীরোগের জন্য উপযুক্ত নয়। এদের মত লোককে বোধ হয় সহজে গায়েবী আওয়াজ শোনানো, কিংবা দিব্য-দর্শন দেওয়া এত সহজ নয়। কাজেই, দুর্মুখেরা বলবেন, ডকিন্সের মত 'নিরেট-মস্তিস্ক' লোকেরা পয়গম্বর হবার উপযূক্ত নন! ধর্মবাদীরা কি আর সাধে বলে যে, নবুয়ত পেতে যোগ্যতা লাগে - হু!!
কিন্তু রিচার্ড ডকিন্সের উপর কাজ না করলেও এটাও ঠিক সুসান ব্ল্যাকমোর সহ অনেকের মধ্যেই তো করেছে, এবং করেছে খুব ভালভাবেই। তারা নিজেরাই তা স্বীকার করেছেন। আর পারসিঙ্গারের দাবী অনুযায়ী, তার উদ্ভাবিত এ প্রক্রিয়ায় যদি ৮০ শতাংশের বেশী লোকের অপার্থিব অনুভূতি হয়েই থাকে, তবে বলতেই হয় ঈশ্বরানুভূতির মত ব্যাপার স্যাপারগুলো হয়ত মস্তিস্কের বাইরে নয়। পারসিঙ্গারের ভাষায় ৩৪,
'ঈশ্বর মানুষের মস্তিস্ক তৈরি করেনি, বরং মানুষের মস্তিস্কই সৃষ্টি করেছে শক্তিমান ঈশ্বরের।'
নীচে ইউটিউবের সৌজন্যে 'গড হেলমেট' নিয়ে বিখ্যাত সংশয়বাদী লেখক মাইকেল শারমারের একটি ভিডিও পাঠকদের জন্য উপহার দেওয়া হল :
শেষ কথা
আত্মা ব্যাপারটি মানুষের আদিমতম কল্পণা । এটি সঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত নয় এবং আধুনিক বিজ্ঞানের চোখে অপার্থিব আত্মার কল্পণা ভ্রান্ত বিশ্বাস ছারা কিছু নয়। আমার এ প্রবন্ধে আমি খুব বিশদভাবে বিজ্ঞানের কষ্টিপাথরে আত্মা নামক ধারণাটিকে যাচাই করার চেষ্টা করেছি। এর থেকে যা বেরিয়ে এসেছে তা হল - আধুনিক বিজ্ঞানের তত্ত্বগুলোর সাথে আত্মা নামক ব্যাপারটি একেবারেই খাপ খায় না। সোজা সাপ্টা ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয় - আত্মার অস্তিত্বের কোন প্রমাণ বিজ্ঞান পায় নি। আর যত দিন যাচ্ছে, আত্মার অস্তিত্ব প্রমাণের আশা ক্রমশঃ রূপান্তরিত হচ্ছে দূরাশায়। বস্তুতঃ স্নায়ুবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, শরীরবিজ্ঞান, জেনেটিক্স আর বিবর্তনবিজ্ঞানের নতুন নতুন গবেষণা আত্মাকে আক্ষরিক ভাবেই রঙ্গমঞ্চ থেকে হটিয়ে দিয়েছে। আর সেজন্যই যুগল-সর্পিলের (ডিএনএ) রহস্যভেদকারী নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ক্রিক বলেন ২,
একজন আধুনিক স্নায়ু-জীববিজ্ঞানী মানুষের এবং অন্যান্য প্রানীর আচরণ ব্যাখ্যা করার জন্য আত্মা নামক ধর্মীয় ধারণার দ্বারস্থ হওয়ার প্রয়োজন বোধ করেন না।
দেহবিহীন আত্মার ধারনা আমার কাছে একেবারেই অর্থহীন এবং অন্তঃসারশূন্য।
কাজেই বিজ্ঞান মানতে হলে আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাসী হওয়ার কোন যুক্তিনিষ্ঠ কারণ নেই। প্রাচীনকালের মানুষেরা জন্ম-মৃত্যুর গূঢ় রহস্য বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোন থেকে সমাধান করতে না পেরে আশ্রয় করেছিল 'আত্মা' নামক আধ্ম্যাত্মিক ধারণার। বিজ্ঞানের আধুনিক গবেষণা সে সমস্ত পুরোণ এবং অসংজ্ঞায়িত ধ্যান ধারনাকে খন্ডন করে দিয়েছে। আত্মার অস্তিত্ব ছাড়াই বিজ্ঞানীরা আজ মানুষ সহ অন্যান্য প্রাণির আচরণ, আচার-ব্যবহার এবং নিজের 'আমিত্ব' (self) এবং সচেতনতাকে (consciousness) ব্যাখ্যা করতে পারছে। এমনকি খুঁজে পেয়েছে ধর্মীয় অপার্থিব অভিজ্ঞতার বিভিন্ন শরীরবৃত্তীয় উৎস। কাজেই ামার ব্যক্তিগত অভিমত হল- প্রাণের অস্তিত্বকে ব্যখ্যা করার জন্য আত্মা একটি অপ্রয়োজনীয় এবং পরিত্যক্ত ধারণা, যেমনি আলোর সঞ্চালনকে ব্যখ্যা করার জন্য পদার্থবিজ্ঞানীদের চোখে আজ ইথার একটি অপ্রয়োজনীয় এবং পরিত্যক্ত ধারণা। কিন্তু আত্মার সাথে ইথারের পার্থক্য হল - পদার্থবিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে ইথারকে হটানো সম্ভব হলেও আত্মাকে হটানো সম্ভব হয়নি, বরং আত্মা নামক পরিত্যক্ত ধারণাটিই আজো সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয়। অস্তিত্বহীন আত্মার শান্তির জন্য মানুষ তাই কত কিছুই না করে! আর সাধারণ অসচেতন মানুষকে সম্মোহিত রাখতে এই আগাছার চাষকে পুরোদমে জনপ্রিয় করে রেখেছে তাবৎ ধর্মীয় সংগঠনগুলো, স্বীয় ব্যবসায়িক স্বার্থেই। তবে, এমন একদিন নিশ্চয় আসবে যখন সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ জীবন-মৃত্যুকে ব্যাখ্যা করার জন্য আত্মার দারস্থ হবে না; আত্মার 'পারলৌকিক' শান্তির জন্য শ্রাদ্ধ-শান্তিতে কিংবা মিলাদ-মাহফিল বা চল্লিশায় অর্থ ব্যয় করবে না, মৃতদেহকে শ্মশান ঘাটে পুড়িয়ে বা মাটিচাপা দিয়ে মৃত দেহকে নষ্ট করবে না, বরং কর্ণিয়া, হৃৎপিন্ড, ফুসফুস, যকৃত, অগ্ন্যাশয় প্রভৃতি অংগ-প্রত্যঙ্গগুলো যেগুলো মানুষের কাজে লাগে, সেগুলো মানবসেবায় দান করে দেবে (গবেষণা থেকে জানা গেছে, মানুষের একটিমাত্র মৃতদেহের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে ২২ জন অসুস্থ মানুষ উপকৃত হতে পারে)। এ ছাড়াও মেডিকেলের ছাত্রদের জন্য মৃতদেহ উন্মুক্ত করবে ব্যবহারিকভাবে শরীরবিদ্যাশিক্ষার দুয়ার। আরজ আলী মাতুব্বর তার মৃতদেহ মেডিকেল কলজে দান করার সিদ্ধান্ত নিয়ে এক সময় অনুকরনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন ৩৬,
...আমি আমার মৃতদেহটিকে বিশ্বাসীদের অবহেলার বস্তু ও কবরে গলিত পদার্থে পরিণত না করে, তা মানব কল্যাণে সোপর্দ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি। আমার মরদেহটির সাহায্যে মেডিক্যাল কলেজের শল্যবিদ্যা শিক্ষার্থীগন শল্যবিদ্যা আয়ত্ব করবে, আবার তাদের সাহায্যে রুগ্ন মানুষ রোগমুক্ত হয়ে শান্তিলাভ করবে। আর এসব প্রত্যক্ষ অনুভূতিই আমাকে দিয়েছে মেডিকেলে শবদেহ দানের মাধ্যমে মানবকল্যাণের আনন্দলাভের প্রেরণা।
সে অনুপ্রেরনায় উজ্জীবিত হয়ে পরবর্তীতে মেডিকেলে নিজ মৃতদেহ দান করেছেন ডঃ আহমেদ শরীফ, নরেন বিশ্বাস, ওয়াহিদুল হক প্রমুখ। সদ্য প্রয়াত ইহজাগতিক গায়ক সঞ্জীব চৌধুরী আমাদের এ তালিকায় নতুন এবং গর্বিত সংযোজন। সমাজ সচেতন ইহজাগতিক এ মানুষগুলোকে জানাই আমার প্রাণের প্রণতি।
পাঠকেরা যারা এতদিন ধরে এই দীর্ঘ সিরিরিজটি আগ্রহ নিয়ে পড়েছেন , তাদের সকলকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
সমাপ্ত
মন্তব্য
কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক - বড় হয়ে শ্রীচৈতন্যদেবের জীবনী পড়তে গিয়ে আমার মনে হয়েছিল লোকটা হয় সমকামী ছিল অথবা জেন্ডার আইডেন্টিটি ডিসর্ডারে ভুগতো - প্রথম স্ত্রীর রহস্যজনক মৃত্যু, দ্বিতীয় বিবাহের পরপর গৃহত্যাগ, তার প্রধান অনুসারীদের সাথে মাখামাখি, রহস্যজনক ভাবে উধাও হয়ে যাওয়া...
হ্যা, সমকামী হওয়ার ভাল সম্ভাবনা আছে। বউরে নাকি 'মা' ডাকতেন। অবশ্য এই ধরণের পাগলামি না থাকলে ভাল ধর্ম্প্রচারক হওয়া যায় না মনে হয়।
পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)
পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)
ধন্যবাদ। একটি সারগর্ভ সিরিজ উপহার দেবার জন্য। এ সিরিজের আমি নিয়মিত পাঠক ছিলাম।
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
- হুমমম
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
দুর্দান্ত একটা সিরিজ শেষ করলেন
এবার ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব নিয়ে আরেকটি সিরিজ শুরু করেন
ওই পরিশ্রমের কাজ আপনাকেই দিয়েই হবে
অসাধারণ সিরিজ!
আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
পাঠকদের জন্য আরেকটা বোনাস ভিডিও দেওয়া হচ্ছে। সুসান ব্ল্যাকমোর কিংবা মাইকেল শারমার সহ ৮০ ভাগ লোকের ক্ষেত্রে 'গড হেলমেট' কাজ করলেও (মূল আর্টিকেলে ভিডিওটি ক্লিক করে দেখুন) রিচার্ড ডকিন্সের উপর একদমই কাজ করেনি। ডকিন্সের পুরো সময়টা একটা 'ডিজি' ভাব ছারা কিছু হয় নি। এর কারণ হিসেবে পারসিঙ্গার বলেছিলেন, এর আগে পরীক্ষা করেই তিনি বুঝেছিলেন, ডকিন্সের 'টেম্পোরাল লোব সেন্সিটিভিটি' গড় পরতা মানুষের তুলনায় অনেক কম। অর্থাৎ, তিনি (ডকিন্স) অপার্থিব অভিজ্ঞতা অর্জন করার (নবুয়ত প্রাপ্তির?) উপযুক্ত নন
আবারো ধন্যবাদ দিচ্ছি সবাইকে যারা দীর্ঘ সিরিরিজটি আগ্রহ নিয়ে পড়েছেন, রেটিং দিয়েছেন এবং মন্তব্য করেছেন।
পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)
পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)
অসাধারণ এই সিরিজটা শেষ হয়ে গেল?
আপনার নতুন কোনও সিরিজ বা লেখার জন্য থাকলাম অধীর অপেক্ষায়।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
এক বসাতেই সম্পুরন সিরিজ টা শেষ করালম।
নতুন মন্তব্য করুন