অনন্ত মহাবিশ্বের সন্ধানে

অভিজিৎ এর ছবি
লিখেছেন অভিজিৎ (তারিখ: শনি, ১২/০৪/২০০৮ - ২:৫১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

auto
আপনার উর্বর মস্তিষ্কের রঙিন কল্পণায়ও কি কখনও - একটি বারও মনে হয়েছে, এই যে আকাশের বুকে হাজারো লক্ষ কোটি গ্রহ-তারা-নিহারীকা আর গ্রহানুপুঞ্জ নিয়ে তৈরী এই যে আমাদের এত পরিচিত বিশাল মহাবিশ্ব, এর বাইরেও এমনি ধরনের অসংখ্য মহাবিশ্ব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে? এর মধ্যে কোন কোনটিতে থাকতে পারে অবিকল আমাদের এই পৃথিবীর মতই মলয়শীতলা একটি গ্রহ, এমনকি সে গ্রহে থাকতে পারে আপনার আবিকল চেহারার এক 'জমজ ভাই'? বিশ্বাস করুন, নীলক্ষেতের সোনামিয়ার গাঁজায় দম দিয়ে কিন্তু এ লেখা শুরু করিনি। দিব্যি সুস্থ্য মাথায়ই লিখছি এগুলো। ট্রিয়ন, অ্যালেন গুথ, ম্যাক্স টেগ মার্ক আর লিন্ডের গবেষণার ফলাফল যদি সত্যি হয়ে থাকে, তবে এমন জোড়ালো সম্ভাবনা কিন্তু আজ উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না মোটেই। আসলে আধুনিক পদার্থবিদের একটি অত্যন্ত বিপ্লবাত্মক মতবাদ হল মালটিভার্স বা অনন্ত মহাবিশ্বের ধারণা। এই ধারণাটি বলছে এই যে আমাদের পরিচিত মহাবিশ্ব -এটি কোন অনন্য বা ইউনিক কিছু নয়, বরং এমনি ধরনের হাজারো মহাবিশ্ব হয়ত ছড়িয়ে আছে যেগুলো সম্পর্কে আমরা হয়ত একদমই ওয়াকিবহাল নই। অনন্ত মহাবিশ্বের ধারণাটি কোন ঠাকুরমার ঝুলির রূপকথা নয়, নয় কোন স্টারট্রেক মুভি বা আসিমভের সায়েন্সফিকশন। অতি সংক্ষেপে অনন্ত মহাবিশ্বের বৈজ্ঞানিক ধারণাটি এরকম :

আমাদের মহাবিশ্ব যদি কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের মধ্য দিয়ে স্থান-কালের শূন্যতার ভিতর দিয়ে আবির্ভূত হয়ে থাকে, তবে এই পুরো প্রক্রিয়াটি কিন্তু একাধিকবার ঘটতে পারে, এবং হয়ত বাস্তবে ঘটেছেও। এই একাধিক মহাবিশ্বের অস্তিত্বের ব্যাপারটি প্রাথমিকভাবে ট্রিয়ন আর পরবর্তীতে মূলতঃ আদ্রে লিন্ডের গবেষণা থেকে বেরিয়ে এসেছে। বলা হয়ে থাকে সৃষ্টির উষালগ্নে ইনফেçশনের মাধ্যমে সম্প্রসারিত বুদ্বুদ (Expanding Bubbles) থেকে আমাদের মহাবিশ্বের মতই অসংখ্য মহাবিশ্ব তৈরী হয়েছে, যেগুলো একটা অপরটা থেকে সংস্পর্শবিহীন অবস্থায় দূরে সরে গেছে। এ ধরনের অসংখ্য মহাবিশ্বের একটিতেই হয়ত আমরা অবস্থান করছি অন্য গুলোর অস্তিত্ব সম্বন্ধে একেবারেই জ্ঞাত না হয়ে।


ছবি : লিন্ডের সাম্প্রতিক তত্ত্ব বলছে কেওটিক ইনফেçশনের ফলে সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য সম্প্রসারিত বুদ্বুদ এবং প্রতিটি সম্প্রসারিত বদ্বুদই আবার জন্ম দিয়েছে এক একটি 'বিগ-ব্যাং'-এর। আর সেই এক একটি বিগ-ব্যাং পরিশেষে জন্ম দিয়েছে এক একটি পকেট মহাবিশ্বের। আমরা এ ধরনেরই একটি পকেট মহাবিশ্বে বাস করছি।

বিজ্ঞানীরা মনে করেন মাল্টিভার্স বা অনন্ত মহাবিশ্বর ধারণাটি 'ইন্টিলিজেন্ট ডিজাইন'-এর প্রবক্তাদের একটি যোগ্য জবাব দিতে পেরেছে। ব্যাপারটি বোঝাবার আগে আই.ডিওয়ালাদের সম্পর্কে এই ফাঁকে কিছু কথা বলে নেই। পাঠকরা নিশ্চয় অবগত যে, সম্প্রতি বেশ কিছু দার্শনিকদের পক্ষ থেকে নতুন কিছু যুক্তির অবতারনা করে একটু ভিন্নভাবে মহাবিশ্বের অস্তিত্বের কারণ খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে । এঁদের যুক্তি হল, আমাদের বিশ্বব্রক্ষ্মান্ড এমন কিছু চলক বা ভ্যারিয়েবলের সূক্ষ্ন সমন্নয়ের (ফাইন টিউনিং) সাহায্যে তৈরী হয়েছে যে এর একচুল হের ফের হলে আর আমাদের এ পৃথিবীতে কখনই প্রাণ সৃষ্টি হত না। বিশেষতঃ জন ডি. ব্যরো এবং ফ্রাঙ্ক জে. টিপলার নানা ধরনের রহস্যময় মহাজাগতিক ন'যোগাযোগ' তুলে ধরে একটি বই লিখেছেন ১৯৮৬ সালে, নাম-'The Anthropic Cosmological Principle'। তাঁদের বক্তব্য হল, আমাদের মহাবিশ্বে গ্র্যাভিটেশনাল অথবা কসমলজিকাল ধ্রুবকগুলোর মান এমন কেন, কিংবা মহাবিশ্বের চেহারাটাই বা এমন কেন হয়েছে তার উত্তর পেতে হলে ব্যাখ্যা খুঁজতে হবে পৃথিবীতে প্রাণ এবং মানুষের উপস্থিতির দিকে তাকিয়ে। পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টির জন্য সর্বোপরি মানুষের আবির্ভাবের জন্য এই মৌলিক ধ্রুবক আর চলকগুলোর মান ঠিক এমনই হওয়া দরকার ছিল - সে জন্যই ওগুলো ওরকম। দৈবক্রমে ওগুলো ঘটে নি, ররং এর পেছনে হয়ত এক বুদ্ধিদীপ্ত সত্ত্বার একটি সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য রয়েছে। মানুষকে কেন্দ্রে রেখে বিশ্বব্রক্ষ্মান্ডের নিয়ম-নীতিগুলোকে ব্যাখ্যা করবার এই যুক্তিকে বলা হয় 'অ্যানথ্রোপিক আর্গুমেন্ট' বা 'নরত্ববাচক যুক্তি' (আমি আমার ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ বইটিতে এ নিয়ে বিষদভাবে লিখেছি। )।


ছবি: অনেক বিজ্ঞানী বলেন খুব সীমিত পরিসরে জীবনের বিকাশ ঘটেছে; এমন কেন হয়েছে তার উত্তর পেতে হলে ব্যাখ্যা খুঁজতে হবে পৃথিবীতে প্রাণ এবং মানুষের উপস্থিতির দিকে তাকিয়ে।

কিছুদিন আগেও বিজ্ঞানীরা অনেকটাই হতবিহবল ছিলেন এই ভেবে যে এই রহস্যময় যোগাযোগ গুলো (অ্যান্থ্রোপিক নম্বরগুলো) আমাদের অস্তিত্বের পেছনে কেন এতটাই জরুরী হয়ে উঠল। আই.ডি ওয়ালারা স্বভাবতই এর পেছনে তাদের তথাকথিত 'ইন্টেলিজেন্ট এজেন্ট' এর হাত দেখতে পেতেন, আর আই.ডি বিরোধীরা বলতেন এ নিতান্তই 'কাকতালীয়' ব্যাপার, যাকে বলে 'ঘটনাচক্রের সমাপতন' (coincidence)। অনেকে আবার এই দু'দলের মাঝামাঝি একটা অবস্থানে থেকে ভাবতেন, আমরা এখনো পরিপূর্ণ তত্ত্ব সম্পর্কে জানি না; কাজেই হলফ করে কিছুই বলা যাচ্ছে না। বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং ১৯৮৮ সালে এমনি ধরনের একটি ধারণা ব্যক্ত করে বলেন :

'বিজ্ঞানের যে সূত্রগুলো সম্বন্ধে আমরা বর্তমানে অবগত, তাতে অনেক মৌলিক সংখ্যা রয়েছে। যেমন, ইলেকট্রনে বৈদ্যুতিক চার্জের পরিমান, প্রোটন-ইলেকট্রনের মধ্যকার ভরের অনুপাত ইত্যাদি। আমরা এখনো, অন্তত এই মুহূর্তে - কোন ধরনের তত্ত্বের সাহায্যে এই সংখ্যাগুলো ব্যাখ্যা করতে পারছি না - আমরা কেবল পর্যবেক্ষণ দ্বারাই এগুলো সম্বন্ধে জানতে পেরেছি। এমন হতে পারে আমরা কোন দিন ঐক্যবদ্ধ তত্ত্ব আবিস্কার করব আর সেগুলো সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বানী করতে পারব, কিন্তু এটাও হতে পারে যে, ও সংখ্যাগুলোর সবগুলোই কিংবা অনেকগুলোই এক মহাবিশ্ব থেকে আরেক মহাবিশ্বে ভিন্ন রকম হবে, এমনকি একই মহাবিশ্বেও অন্যরকম হতে পারে। কিন্তু অত্যাশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে সংখ্যাগুলোর মান খুব সূক্ষভাবে সমন্নিত আছে যা আমাদের জীবনের বিকাশকে সম্ভব করে তুলেছে।'


ছবি : মালটিভার্স হাইপোথিসিস অ্যান্থ্রোপিক আর্গুমেন্টের একটি সহজ সমাধান দেয়।

যেহেতু বিজ্ঞানীরা এ সমস্ত রহস্যময় ঘটনার পেছনে কোন তত্ত্ব বা থিওরী খুঁজে পাচ্ছিলেন না - ওই সূক্ষ-সমন্নয় আর নরত্ববাচক যুক্তিগুলো নিয়ে বিজ্ঞানীদের অবচেতন মনে একটা খচখচানি থেকেই গিয়েছিল; মালটিভার্স তত্ত্ব কিন্তু তা থেকে অনেকটাই মুক্তি দিতে পেরেছে। সাদা মাঠা কথায় এ তত্ত্ব বলছে যে, হাজারো-লক্ষ-কোটি মহাবিশ্বের ভীরে আমাদের মহাবিশ্বও একটি। স্রেফ সম্ভাবনার নিরিখেই একটি মহাবিশ্বে চলকগুলোর মান এমনিতেই অমন সূক্ষভাবে সমন্নিত হতে পারে, অন্যগুলোতে হয়ত হয়নি। আমাদের মহাবিশ্বে চলকগুলো কোন একভাবে সমন্নিত হতে পেরেছে বলেই এতে প্রাণের উন্মেষ ঘটেছে; এতে এত আশ্চর্য হবার কিছু নেই! অধ্যাপক রীস সেটিই খুব চমৎকারভাবে একটি উপমার মাধ্যমে উল্লেখ করেছেন :

অসংখ্য মহাবিশ্বের ভীরে আমাদের মহাবিশ্বও একটি। অন্য মহাবিশ্বে বিজ্ঞানের সূত্র আর চলকগুলো হয়ত একেবারেই অন্যরকম হবে।... কাজেই ঘড়ির কারিগরের সাদৃশ্য এখানে একেবারেই অচল। তার বদলে বরং আমাদের বিশ্বব্রক্ষ্মান্ডকে অনেকটা পরিত্যক্ত সেকেন্ড হ্যান্ড কাপড়ের দোকানের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। দোকানের মজুদ যদি বিশাল হয় তবে দোকানের কোন একটি জামা আপনার গায়ে ঠিকমত লেগে গেলে আপনি নিশ্চয় তাতে বিস্মিত হবেন না! ঠিক একইভাবে আমাদের মহাবিশ্ব যদি ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য মহাবিশ্বের একটি হয়ে থাকে, দোকানের একটি জামার মতই সূক্ষ-সমন্নয় দেখে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।

কাজেই এই ধারণা অনুযায়ী আমাদের মহাবিশ্ব যাকে এতদিন প্রকৃতির পুরো অংশ বলে ভেবে নেওয়া হত, আসলে হয়ত এটি এক বিশাল কোন মহাজাগতিক দানবের খুব ক্ষুদ্র অংশবিশেষ ছাড়া আর কিছু নয়। আমাদের অবস্থাটা এতোদিন ছিল সেই বহুল প্রচলিত 'অন্ধের হস্তি দর্শন' গল্পের অন্ধ লোকটির মত - হাতীর কান ছুঁয়েই যে ভেবে নিয়েছিলো ওইটাই বুঝি হাতীর পুরো দেহটা! এখানেই কিন্তু গল্প শেষ নয়। এই মালটিভার্স থিওরীর বাই প্রোডাক্ট বা উপজাত হিসেবে আবার ইদানিং উঠে এসেছে আরো এক ডিগ্রী মজাদার তত্ত্ব - সমান্তরাল মহাবিশ্ব বা প্যারালাল ইউনিভার্স। সমান্তরাল মহাবিশ্ব নিয়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভিড ডেটচস সম্প্রতি একটি বই লিখেছেন The Fabric of Reality: The Science of Parallel Universes - And Its Implications নামে। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর পাশাপাশি সমান্তরাল মহাবিশ্বের ধারণা বৈজ্ঞানিক সাময়িকীগুলোতেও ঠাঁই করে নিয়েছে। ২০০৩ সালের মে মাসের সায়েন্টিফিক আমেরিকানের সঙ্খ্যায় ম্যাক্স টেগমার্ক Parallel Universes নামের একটি প্রবন্ধ লেখেন। লেখাটিতে টেগমার্ক তিনটি মডেলের সাহায্যে অত্যন্ত বিস্তৃত ও আকর্ষনীয় ভঙ্গিতে 'প্যারালাল ইউনিভার্স' এর ধারণাকে পাঠকদের মাঝে তুলে ধরেন । প্যারালাল ইউনিভার্সের তত্ত্ব বলছে যে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লক্ষ কোটি মহাবিশ্বের মধ্যে কোন কোনটি যে আকার, আয়তন আর বৈশিষ্ট্যে একদম ঠিক ঠিক আমাদের মহাবিশ্বের মতই হবে না, এমন তো কোন গ্যারান্টি নেই। পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলোও সেই মহাবিশ্বে একই রকমভাবে কাজ করার কথা। ম্যাক্স টেগমার্ক আমাদের জানা গনিতের সম্ভাবনার নিরিখেই হিসেব করে দেখিয়েছেন যে, এই মহাবিশ্ব থেকে পায় ১০১০ ২৮ মিটার দূরে আপনারই এক 'আইডেন্টিকাল টুইন' হয়ত

কম্পিউটারের সামনে বসে এই লেখাটি পড়ছে, তা আপনি কোন দিন জানতেও পারবেন না!

বেশ বুঝতে পারছি মাল্টিভার্সের ধারণাই হয়ত পাঠকদের অনেকে হজম করতে পারছেন না, তার উপর আবার প্যারালাল ইনিভার্স, আইডেন্টিকাল টুইন - হেন তেন চলে আসায় নিশ্চয় মাথা তালগোল পাকিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, উপরের ধারণা, কিংবা তত্ত্বগুলো যতই আজগুবি মনে হোক না কেন ওগুলো নির্মাণ করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা পদার্থবিজ্ঞানের কোন নিয়ম নীতি লংঘন করেননি।

তত্ত্ব হিসেবে মাল্টিভার্সের ধারণা যে সমালোচনার সম্মুখীন হয়নি তা নয়। যথেষ্টই হয়েছে। মাল্টিভাস নামের এই বিপ্লবাত্মক ধারণার প্রথম সমস্যা হল, এ ধারণা যে সঠিকই তা এই মুহূর্তে পরীক্ষা করে বলবার কোন উপায় নেই। কার্ল পপার 'ফলসিফায়েবিলিটি'র যে বৈশিষ্ট্য বিজ্ঞানের সংজ্ঞা হিসেবে নির্ধারিত করে রেখেছেন, তার আওতায় কিন্তু মাল্টিভার্স এখনও পড়ে না। কার্লপপারের অনুসারীরা বলেন, গাণিতিক বিমূর্ততায় ঠাসা মাল্টিভার্স বা অনন্ত মহাবিশ্বের ধারণা যতটুকু না বাস্তবতার কাছাকাছি, তার চাইতে ঢের বেশী কাছাকাছি অধিপদার্থবিদ্যার (মেটা ফিজিক্স)। কাজেই এটি বিজ্ঞান হয় কি করে? কিন্তু মাল্টিভার্সের সমর্থকদেরও যুক্তির কোন অভাব নেই। তারা বলেন- ওই অধিপদার্থবিদ্যা আর পদার্থবিদ্যার মাঝখানের সীমারেখাটা যতই দিন যাচ্ছে ততই ছোট হয়ে আসছে। অতীতে আমরা দেখেছি পর্যবেক্ষনবিরোধী বহু তত্ত্বই - যেমন গোলাকার পৃথিবীর ধারণা, অদৃশ্য বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় ক্ষেত্র, উচ্চ গতিতে ভ্রমণকালে সময় শ্লথতা, কোয়ান্টাম উপরিপাতন, স্থান-কালের বক্রতা, কৃষ্ণগহবর ইত্যাদি সবকিছুই শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞানের অংশ হয়ে গেছে। অনন্ত মহাবিশ্ব সেই তালিকায় এক নতুন সংযোজনমাত্র।

দর্শনশাস্ত্রে 'অক্কামের ক্ষুর' নামে একটি সূত্র প্রচলিত আছে। সোজা বাংলায় এই সূত্রটি বলে - অনর্থক বাহুল্য সর্বদাই বর্জনীয়। আইডির সমর্থক অধ্যাপক জর্জ এলিস অক্কামের ক্ষুরকে ব্যবহার করেছেন মাল্টিভার্সের ধারণার বিরুদ্ধে, বলেছেন এই তত্ত্ব অক্কামের ক্ষুরের সুস্পষ্ট লংঘন। তাঁর যুক্তি হল, একটা মহাবিশ্ব দিয়েই যখন সমস্যা সমাধান করা যায়, হাজার কোটি মহাবিশ্ব টেনে এনে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা আসলে বাতুলতা মাত্র, অনর্থক অপচয়। কিন্তু এ যুক্তিও ধোপে টেকেনি। যেমন, কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ভিকটর স্টেঙ্গর তার 'টাইমলেস রিয়ালিটি' এবং 'হ্যাজ সায়েন্স ফাউন্ড গড' বইয়ে এই যুক্তি খন্ডন করে বলেন, পদার্থবিজ্ঞানের সাম্প্রতিক তত্ত্বগুলোর কোনটাই অসংখ্য মহাবিশ্বের অস্তিত্বকে বাতিল করে দেয় না। বরং যেখানে লিন্ডের তত্ত্ব কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের মাধ্যমে অসংখ্য মহাবিশ্ব সৃষ্টির দিকেই ইঙ্গিত করছে, সেখানে কেউ যদি অযথা বাড়তি একটি প্রকল্প আরোপ করে বলেন আমাদের এই মহাবিশ্ব ছাড়া আর কোন মহাবিশ্ব নেই, কিংবা কখনই তৈরী হওয়া সম্ভবপর নয়, তবে সেটাই বরং হবে অক্কামের ক্ষুরের লংঘন। অধ্যাপক স্টেঙ্গরের মতে, লিন্ডের গবেষণা থেকে বেরিয়ে আসা সমাধানের ভুল ধরিয়ে দিয়ে নিজের সজ্ঞাত ধারণাটি -'একটি মহাবিশ্বই টিকে থাকতে পারবে' - প্রামাণ করার দায়িত্ব থাকছে কিন্তু ওই দাবীদারদের ঘারেই -যারা একটিমাত্র মহাবিশ্বের ধারণায় আস্থাশীল । এখন পর্যন্ত কেউই সে ধরণের কোন 'স্পেশাল নিয়ম' হাজির করতে পারেননি যার মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে কেবল একটি মহাবিশ্বই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে, অন্যগুলো বাতিল হয়ে যাবে।

সম্প্রতি কানাডার প্রিমিয়ার ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক লি স্মোলিন একটু অন্যভাবে সমস্যাটা নিয়ে ভেবেছেন। কেন আমাদের মহাবিশ্বই টিকে রইল, অন্যগুলো রইলোনা - এ প্রশ্নটির সমাধান দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন বায়োলজি বা জীববিদ্যা হয়ত এক্ষেত্রে আমাদের পথ দেখাতে পারে। জীববিজ্ঞানে এ ধরনের ঘটনার হাজারো উদাহরণ ছড়িয়ে আছে। কড মাছ মিলিয়ন মিলিয়ন ডিম পাড়ে, তার মধ্যে খুব কমই শেষ পর্যন্ত নিষিক্ত হয়, আর নিষিক্ত ডিম থেকে জন্ম নেয়া অধিকাংশ পোনাই আবার বিভিন্ন কারণে মারা যায়, কিংবা অন্য মাছদের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়, শেষ পর্যন্ত দেখা যায় খুব কম পোনাই টিকে থাকে আর তারপর পূর্ণাংগ মাছে পরিণত হতে পারে। বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখিয়েছেন যে একটা কড মাছের ডিমের নিরানব্বই শতাংশই প্রথম মাসে কোন না কোন ভাবে ধ্বংস হয়ে যায়, আর বাকি যা বেঁচে থাকে তারও নব্বই ভাগ প্রথম বছরেই ধ্বংস হয়ে যায়। মানুষ সহ প্রতিটি স্তন্যপায়ী প্রাণীরই কোটি কোটি স্পার্মের প্রয়োজন হয় কেবল এটি নিশ্চিত করতে যে এদের মধ্যে একটি মাত্র স্পার্মই বিভিন্ন চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ডিম্বানুকে নিষিক্ত করবে আর শেষপর্যন্ত পরবর্তী প্রজন্মকে টিকিয়ে রাখবে। অর্থাৎ প্রকৃতি তুলনামুলকভাবে বেশী উপযুক্ত বৈশিষ্ট্যের অধিকারীদের টিকিয়ে রাখে। এ ব্যাপারটিকেই চলতি কথায় যোগ্যতমের বিজয় বা 'সার্ভাইবাল অব ফিটেস্ট' বলা হয়। ডারউইন প্রকৃতির এই নির্বাচন প্রক্রিয়ারই নাম দেন 'প্রাকৃতিক নির্বাচন' যার মাধ্যমে তিনি জীবজগতের বিবর্তনকে সার্থকভাবে ব্যাখ্যা করতে পেরেছিলেন।

লি স্মোলিন ভাবলেন জীবজগতের বিবর্তনের নিয়মের মত 'কিছু একটা' সামগ্রিকভাবে মহাবিশ্বের বিবর্তনের জন্যও প্রযোজ্য হতে পারে কিনা। ইনফেçশনের ফলশ্রুতিতে মহাবিশ্বের ইতিহাসে যে অগুনতি সিঙ্গুলারিটি তৈরী হয়েছিলো, এমনও তো হতে পারে যে, এদের মধ্যে শেষ পর্যন্ত একটিমাত্রই টিকে রইল, যেভাবে মানবদেহে নিষেক ঘটানোর অভিপ্রায়ে মিলিয়ন শুক্রানুর মধ্যে টিকে রয় একটিমাত্র স্পার্ম বা শুক্রানু। তাহলে কি যোগ্যতম শুক্রানুর মত কোন এক যোগ্যতম সিঙ্গুলারিটি থেকেই 'প্রাকৃতিক নির্বাচনের' মাধ্যমে জন্ম নিয়েছে আমাদের এই পরিচিত মহাবিশ্ব? কে জানে, হতেও তো পারে! তাই যদি হয়, তবে 'ফাইন-টিউনিং' আর 'অ্যান্থ্রোপিক আর্গুমেন্ট'-এর জন্য অতিপ্রাকৃত স্বর্গীয় সমাধান খুঁজে আর লাভ নেই। কারণ ডারউইনীয় বিবর্তনবাদী ধারণা বলছে হয়ত এ প্রকারণগুলোই আমাদের মহাবিশ্বকে অন্যগুলো থেকে অধিকতর 'যোগ্যতম' হিসেবে আলাদা করে দিয়েছিলো! তাই এটি টিকে গেছে।

অনন্ত মহাবিশ্বের সমস্যা সমাধানে লি স্মোলিনের এই বিবর্তনবাদী দর্শন খুব আকর্ষনীয় সমাধান দিলেও এটি জ্যোতির্পদার্থবিদদের কাছ থেকে কখনই তেমন সমর্থন পায়নি। এর কারণ মুলতঃ দুটি। অধিকাংশ পদার্থবিদদের সবাই পদার্থবিদ্যার জানা নিয়ম নীতির মধ্যে থেকেই এই রহস্যের সমাধান চান- হঠাৎ করেই এক ভিন্ন ধরনের বৈজ্ঞানিক নিয়মের মাধ্যমে একধরনের 'গোঁজামিল' দেওয়া ব্যাখ্যা নয়; আর তাছাড়া লি স্মোলিন যে প্রাকৃতিক নির্বাচনের কথা বলছেন তার কোন গানিতিক মডেল উপহার দিতে পারেন নি যা পদার্থবিদদের কাছে গ্রহণযোগ্যতার এক অন্যতম পূর্বশর্ত।

যতদিন না এই শর্ত পূরণ হচ্ছে ততদিন কিন্তু থেকে যাচ্ছে আমাদের মহাবিশ্বের বাইরেও হাজার-কোটি-অনন্ত মহাবিশ্বের অস্তিত্বের এক বিশাল সম্ভাবনা আর একই সাথে থেকে যাচ্ছে এই বিশ্বব্রক্ষ্মান্ডের বুকে কোথাও না কোথাও আপনার যমজ ভাই থেকে যাবার সম্ভাবনাও, যে ভাইটির সাথে কোন দিনই হয়ত আপনার মোলাকাত হবে না!


লেখাটা দৈনিক সমকালে ১৫ জুলাই ২০০৬ এ প্রাকশিত হয়েছিল


মন্তব্য

দিগন্ত এর ছবি

লি স্মোলিনের বইটার অনেকটা পড়েছি। ওনার দাবী হল যে মহাবিশ্ব যত ভাল ব্ল্যাক হোলের জন্য সেই মহাবিশ্বই ফিটেস্ট ... ভাল বুঝতে পারিনি কি কারণ দেখাচ্ছেন উনি ...
---------------------------------
হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

অভিজিৎ এর ছবি

লি স্মোলিনের কোন বইটা? নতুন টা? দ্য ট্রাবল উইথ ফিজিক্স... নাকি রোডস টু কোয়ান্টাম গ্রাভিটি?

লি স্মোলিনের কোয়ান্টাম লুপ গ্র্যাভিটি নিয়ে করা কাজ স্ট্রিং তত্তের বিকল্প হিসেবে উঠে এসেছে...। ওটা নিয়ে পরে কিছু লিখবার আশা আছে।



পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)


পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)

হিমু এর ছবি

আপনার এ পোস্টটির বানানপ্রমাদগুলি যদি একটু সংশোধন করে দিতেন তবে বেশ হতো।


হাঁটুপানির জলদস্যু

অভিজিৎ এর ছবি

বর্নসফটে লেখা পুরানো মাল কনভার্ট করতে গিয়ে ভ্যারাচ্যারা লেগে গেছে। আর তা ছাড়া বানানে এমনিতেই আমি দুর্বল, আর সেজন্য মুখে বলি - বানান রীতি ফিতিগুলা হচ্ছে একটা মূর্তিমান কুসংস্কারের ঝাঁপি! ওগুলো চোখ বুঝে না মানলেও চলে। নাঁচতে না জানলে উঠোন বাঁকা আর কি!



পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)


পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)

হিমু এর ছবি

একটা দুরমুজ হাতে নেমে পড়ুন। পিটিয়ে উঠান সমান করে ফেলুন একদম। ভবিষ্যৎ প্রুফ রিডার যেন মনে মনে আপনাকে দুষ্টু দুষ্টু গালি দিতে না পারে ...।


হাঁটুপানির জলদস্যু

অভিজিৎ এর ছবি

হ্যা - হয় দুরমুজ না হলে তরমুজ - কোন এক উপায়ে রক্ষা পেয়েই যাব মনে হচ্ছে।



পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)


পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)

শিক্ষানবিস এর ছবি

বেশ কিছুদিন আগেই টিপলার আর ব্যারোর থিওফিজিক্স সম্বন্ধে জেনেছিলাম। টিপলার বোধহয় "ফিজিক্স অফ ক্রিশ্চিয়ানিটি" নামে একটি বই লিখেছেন। সেখানে মূল সমস্যা হল তিনি অনেকগুলো বিষয় সত্য বলে ধরে নিয়েছেন যা এখনও সত্য বলে প্রমাণিত হয়নি। কসমিক ভ্যারিয়েন্স ব্লগে শন ক্যারল বলেছেন, টিপলারের দাবী কোয়ান্টাম মহাকর্ষের পরিপূর্ণ তত্ত্ব নাকি আবিষ্কৃত হয়ে গেছে। আসলে তা হয়নি। যতদূর মনে হচ্ছে, তাদের গবেষণার ধারাটা হল: ক্রিশ্চিয়ানিটি সত্য এবং ঈশ্বর আছেন এটা তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন। তাই ফলাফল জেনে গবেষণা করছেন। মূল উদ্দেশ্য ফলাফলের সাথে গবেষণার ধারাকে মেলানো।
আমার মনে হয় সব ধর্মবিশ্বাসীরাই এভাবে চিন্ত করেন। ধর্মেও এটা বলা হয়- তোমাকে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে হবে। বিশ্বাসের পর আসবে যুক্তির স্থান। তারা ধার্মিক বলেই বোধহয় বিশ্বাসের মাধ্যমে ফলাফল নির্ণয় করেছেন, যুক্তির মাধ্যমে নয়। আর বিজ্ঞান দিয়ে সেই ফলাফলে আসার প্রাণপণ চেষ্টা করছেন।

অভিজিৎ এর ছবি

হ্যা জানি, ফ্রাঙ্ক টিপলার হচ্ছেন খ্রীষ্টান জগতের 'শমশের আলী'। পদার্থবিজ্ঞানে অবদানের জন্য যত না বিখ্যাত, তার চেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছেন খ্রীষ্টধর্মকে 'বিজ্ঞান' বানানোর জন্য। ওমেগা পয়েণ্ট নামে একটি তত্ত্ব দিয়েছেন টিপলার যা মহাসংকোচন (বিগ ক্রাঞ্চ)-এর সময় সিংগুলারিটির গানিতিক মডেলকে বর্ণনা করে। এ পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু টিপলার মনে করেন এই ওমেগা পয়েন্ট হচ্ছে গড। যীশুর অলৌকিক জন্মকে (ভার্জিন বার্থ) তিনি বৈজ্ঞানিক বৈধতা দিতে চান যীশুকে বিরল xx male বানিয়ে, যিশুর পুনুরুত্থানকে ব্যারন এনিহিলেশন প্রক্রিয়ার সাথে তুলনা করেছেন, ইনকারনেশনকে বলেছেন বিপরীতমুখি ডিম্যাটারিলিজেশন পদ্ধতি, ইত্যাদি। এ সমস্ত নিয়েই তার The Physics of Christianity!



পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)


পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)

স্নিগ্ধা এর ছবি

অভি (হে হে হে) কি বলে যে ধন্যবাদ জানাবো এমন একটা লেখার জন্য!! ইসসস, মাল্টিভার্স থাকাটা কি যে একটা ভালো ব্যাপার - এই পৃথিবীতে যাদের উপর রাগে গা জ্বলে যায় (জনৈক বিজ্ঞানমনস্ক 'বন্ধু' সহ) কিন্তু জেলে যাওয়ার ভয়ে কিছু করতে পারি না, তাদের কোন এক সমান্তরাল পৃথিবীতে ধরে ধরে আছাড় মারছি - এটা ভাবতেই ......!!!!!! হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।