স্কুল পর্যায়ে বাংলা ব্যাকরণ শিক্ষার বর্তমান অবস্থা: একটি পর্যবেক্ষণ

আয়েশা আখতার এর ছবি
লিখেছেন আয়েশা আখতার (তারিখ: শুক্র, ১৮/০১/২০০৮ - ৪:৪৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

(শেষ অংশ)
নবম-দশম শ্রেণীর জন্য নির্ধারিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ বইটি প্রসঙ্গে কিছু না বললে আলোচনাটি একরকম অসমাপ্ত থেকে যায়। এই ব্যাকরণ বইটি মূলত প্রথাগত ধারায় রচিত। প্রথাগত ধারার ব্যাকরণের প্রধান উদ্দেশ্য শুদ্ধ শব্দ গঠনের কৌশল শেখানো এবং কিছু কিছু বিধি নিষেধ শেখানো, যেসব ব্যবহার করলে শিক্ষার্থীরা শুদ্ধভাবে ভাষা প্রয়োগ করতে সক্ষম হবে। কিন্তু এই বইটি সেই প্রয়োজন কতটুকু মেটায় তা পাঠক মাত্রই অবগত আছেন। হ্যাঁ, এই বইটিও যে একেবারেই কিছু প্রয়োজন মেটাতে পারে না , তা নয়। কিন্তু সেই ক্ষেত্রে রয়েছে উপযুক্ত শিক্ষকের অভাব। বিভিন্ন স্কুলের বেশ কিছু শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি - ধ্বনিতত্ত্ব , প্রত্যয় ইত্যাদি ছাত্রদের কাছে বোধগম্য করে তুলতে তাদের বেশ বেগ পেতে হয়। আর ছাত্ররা আসলে বেশিরভাগই না বুঝে এইসব পরীক্ষায় পাশের জন্য মুখস্থ করে।ধ্বনিতত্ত্বে আসলে কী আছে ? বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত ধ্বনিগুলোর শ্রেণীবিভাগ, উচ্চারণ স্থান এবং কোন স্বরধ্বনি শব্দের কোথায় অবস্থান করলে কীভাবে উচ্চারিত হবে ইতাদি। এর বিজ্ঞানকে শিক্ষক সঠিকভাবে শিক্ষার্থীর কাছে তুলে ধরলে শিক্ষার্থীরা কিছুটা হলেও আনন্দ পাবে । তবে এই অংশের আলোচনায় বড় ঘাটতি হল - শব্দে অবস্থানভেদে একই ধ্বনির উচ্চারণ যে বিভিন্ন রকম হতে পারে এই বিষয়ে স্বল্প আলোচনা। এই আলোচনা যথেষ্ট উদাহরণসহ থাকা উচিত। কারণ এটি আমাদের বাংলা ভাষার শুদ্ধ উচ্চারণে সাহায্য করে। আর ণ-ত্ব ও ষ-ত্ব বিধান নিয়ে একটা প্রশ্ন প্রায়ই ওঠে- যে কারণে সংস্কৃত শব্দে ণ / ষ হয়, সেই একই কারণে অসংস্কৃত শব্দে ণ/ষ না হওয়াটা অযৌক্তিক। আর সন্ধিতে এমন সব সংস্কৃত শব্দের উদাহরণ আছে যেগুলো সাধারণ শিক্ষার্থীদের না জানলেও চলে। প্রত্যয়ের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এসব অধ্যায় সংস্কৃত শব্দের উদাহরণে ঠাসা। শিক্ষার্থীরা কথোপকথনে এবং অন্য যেসব বই সবসময় পড়ে থাকে সেখানে এসব শব্দের উল্লেখ পায় না। ফলে তাদের কাছে এসব শব্দ গুরুত্ব সহকারে বিবেচিত হয় না। এর পেছনে শিক্ষার্থীর সময় ব্যয় , সময়ের অপচয়ই বলতে হবে। সংস্কৃত শব্দ সম্পর্কে কারো আগ্রহ থাকলে সে নিজের প্রয়োজনেই এর অনুসন্ধান করবে। আর এমন কিছু বিষয় আছে যেখানে পরস্পর বিরোধী তথ্য থাকে ,একটি উদাহরণ দেই - ‘ধনাঢ্য’ শব্দটির ব্যাসবাক্য ‘ধনে আঢ্য’ হলেও তয়া তৎপুরুষ সমাস হয়, কিন্তু তৎপুরুষ সমাসের সংজ্ঞার্থ অনুযায়ী এটা ৭মী তৎপুরুষ সমাস হওয়া উচিত, আর ব্যতিক্রম হলে তারও সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকা উচিত। যেখানে সমাসের অধ্যায় কতটুকু প্রয়োজন সে বিষয়েই ভাববার ব্যাপার আছে (ভাষাবিজ্ঞানীরাই ভাববেন) , সেখানে যদি এরকম তথ্য থাকে, তাতে শিক্ষার্থীকে বিভ্রান্তিতে পড়তে হয় বৈকি।
শব্দগঠনের কৌশল জানার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল বাক্যে যথাযথভাবে শব্দের ব্যবহার জানা। কারো ভাষা ব্যবহারের দক্ষতা প্রকাশ পাবে, বাক্যে উপযুক্ত শব্দের সঠিক স্থাপনের যোগ্যতার মধ্য দিয়ে । অথচ সবচেয়ে প্রয়োজনীয় এই অধ্যায়টিই অবহেলিত। মাত্র এক পৃষ্ঠায় বাক্যে ‘পদ-সংস্থাপনার ক্রম’ বিষয়টি আলোচনা করা হয়েছে খুব দায়সারাভাবে। এই বিষয়টি পড়লেই যে বাক্য গঠনে খুব পটু হবে তা নয়। শিক্ষার্থীরা কমপক্ষে বাংলা বাক্যের শৃংখলা সম্পর্কে কিছুটা হলেও জ্ঞান লাভ করত, বিশুদ্ধ বাক্য গঠনের চেষ্টা করত। যেহেতু বইয়ে বিষয়টির বিস্তারতি আলোচনা নেই ,তাই শিক্ষকের উপরেই অনেক কিছু নির্ভর করছে।
আসলে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে এই ব্যাকরণ শিক্ষার বিষয়টিও গভীরভাবে জড়িত। তাই সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া খুব বেশি এগুনো যাবে না। তারপরও ভাষাবিজ্ঞানীরা এক্ষেত্রে কিছুটা হলেও দায়িত্ব নিতে পারেন, বাংলা একাডেমি এগিয়ে আসতে পারে। এখন থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সহ অনেকেই একটা যুগোপযোগী বাংলা ব্যাকরণের স্বপ্ন দেখেছিলেন। ড: হুমায়ুন আজাদ এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন ভাষাবিজ্ঞানীর হাতে রচিত ব্যাকরণ থেকেই রচিত হবে ছাত্রপাঠ্য বাংলা ব্যাকরণ। হাজার বছরের পুরোনো আমাদের এই প্রিয় বাংলা ভাষার বর্তমান যে রূপ, তার একটি যুগোপযোগী ব্যাকরণ রচনার স্বপ্ন আশা করি আমাদের ভাষাবিজ্ঞানীরা সফল করবেন। আর এই পথ ধরেই ছাত্রদের জন্য রচিত হবে এমন ব্যাকরণ যাতে ছাত্ররা খুঁজে পাবে তাদের পরিচিত বাংলা ভাষার শৃংখলার বর্ণনা।


মন্তব্য

মুজিব মেহদী এর ছবি

হ্যাঁ, রচিত হোক এমন কোনো ব্যাকরণ গ্রন্থ, যা ছাত্রছাত্রীদের প্রয়োজনীয় ব্যাকরণ শিখে ওঠবার ক্ষেত্রে আগ্রহী করে তুলবে।
তবে তার আগে চাই শিক্ষকদের সম্মানজনক বেতন কাঠামো ও ভালো শিক্ষক।
..................................................................................
অপরিপক্কতা সবসময় একরোখা হয়, আর পরিপক্কতা হচ্ছে সর্বগ্রাহী
-সেলিম আল দীন

... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
কচুরিপানার নিচে জেগে থাকে ক্রন্দনশীলা সব নদী

সুজন চৌধুরী এর ছবি

লেখাটা চমত্কার। এ রকম লেখা সচলায়তনকে সমৃদ্ধ করবে।
আরো লেখা চাই।
____________________________
লাল গানে নীল সুর হাসি হাসি গন্ধ......

আয়েশা আখতার এর ছবি

ধন্যবাদ।

শেখ জলিল এর ছবি

ভাল্লাগলো ব্যাকরণপর্ব।
এরপর 'আঞ্চলিক ভাষা: প্রমিত ভাষা' অথবা 'মুখের ভাষা: লেখার ভাষা'এরকম সিরিজ করলে ভালো লাগবে।

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।