জীবনে কোন না কোন সময় সব মানুষই নাকি একবার হলেও কবি হয়। আমিও হয়েছিলাম। কাঁচাহাতে লেখা কৈশরের দুর্বল কবিতা, কিন্তু তাতেই আমার জীবন ঝালাপালা। নব্বুই-একানব্বুইয়ের দিককার ঘটনা। আমি সবে মাত্র মাধ্যমিকের পাট চুকিয়েছি। মফস্বল শহরে বন্ধুত্বের বৃত্তে চলছে জীবন। বন্ধুদের কেউ নব্য বিপ্লবী --- বামপন্থায় দীক্ষা নিচ্ছে। কেউ বা নব্য কবি --- কাব্য সাধনায় ব্যস্ত। এদের মাঝে বেমানান আমি ক্রীড়ামোদী তরুণ --- খেলাধুলো করে হেসে খেলে জীবন কাটানোর গোপন স্বপ্নে বিভোর। নব্য বিপ্লবী আর নব্য কবি বন্ধুরা তাদের বন্ধুচক্রে এই সৃস্টিহীন ক্রীড়াপ্রেমীর উপদ্রব মেনে নিতে নারাজ। দুই পক্ষের প্রভাবে আমি আধা-বিপ্লবী আর আধা-কবি হয়ে কোন কুক্ষনে যেন লিখে ফেললাম জীবনের প্রথম কবিতা। আর যায় কোথায়? কাঁচা হাতের লিখা এই কবিতাই আলী আবু আম্মুরীর অলক্ষুণে জুতো হয়ে দেখা দিল আমার জীবনে।
সেই সময়ই কোথা থেকে যেন একবার সঞ্জীব চৌধুরী নামে বিপ্লব আর শিল্পের যৌথসত্ত্বার এক মানুষ (তিনি তখনো দলছুটের সঞ্জীব হয়ে উঠেননি) এসে হাজির হলেন আমাদের বিপ্লবী আর কবি বন্ধুদের আড্ডায়। বন্ধুরা তাদের কৃতিত্বের গল্প শোনালোঃ আমার মতো সৃস্টিহীন মানুষও কিভাবে তাদের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে সম্প্রতি এক কবিতা ঝেড়ে ফেলেছে। কথায় কথায় সেই কবিতা পড়লো সঞ্জীব চৌধুরীর হাতে, যিনি তা পড়লেন এবং ফেরার সময় পকেটে ভরে নিয়ে চলে গেলেন ঢাকায়। সপ্তাহ খানিক পর জানা গেল ঢাকা থেকে ছাত্র ইউনিয়নেরর একুশের প্রকাশনা জয়ধ্বনিতে ছাপা হয়েছে আমার সেই অলক্ষুনে কবিতা। বন্ধুরা বললো, “ওরে, ছাড় তোর খেলাধুলা, তুই তো এখন কবি”।
বন্ধুরা হৈ হৈ করে সেই জয়ধ্বনির কপি নিয়ে গেল কলেজ সাময়িকীর দায়িত্বপ্রাপ্ত অধ্যাপকের কাছে। তিনি সেটা আবার ছাপিয়ে দিলেন কলেজ বার্ষিকীতে। সেই কলেজ বার্ষিকী গিয়ে পড়লো কলেজের এক সুদর্শনা মেধাবী তরুণীর হাতে, যে কিনা আবার সেই কবিতা নিয়ে ঊঠে গেল কলেজের সাংস্কৃতিক সপ্তাহের আবৃত্তি মঞ্চে। সেই কবিতা এরপর আর কোথাও গিয়ে পড়লো না, বরং আমিই আহ্লাদে গদ্গদ হয়ে গিয়ে পড়লাম সেই সুদর্শনা মেধাবী তরুনীর প্রেমে। প্রেমে তো পড়লাম, কিন্তু ভীরু মনে প্রেম নিবেদনের সাহস আর হয়ে উঠে না। একবার ভাবলাম কাব্যের ভাষায় বলি। কিন্তু কাব্যের কোলে আশ্রয় মিললো না - বেরুলো না একটি শব্দও। বেরুবে কিভাবে-বন্ধুদের সমতূল্য হবার তাড়া থেকেই না কোন কুক্ষনে লিখেছিলাম সেই একটা মাত্র কবিতা।
অতঃপর ভাবলাম এবার না হয় সেই সুদর্শনা মেধাবী তরুনীর সমতূল্য হবার চেষ্টা করে দেখি যদি প্রেম নিবেদনের কোন কুল-কিনারা করা যায়। ব্যস, লাটে ঊঠলো আমার খেলাধুলা, বিপ্লব, কাব্য সবকিছুই। মন ডুবালাম পড়াশোনায়। তবে প্রেমের মরা যেমন জলে ডুবে না, আমিও ডুবলাম না। বরং ভেসে ঊঠলাম উচ্চমাধ্যমিকের মেধাতালিকায়। কি প্রেমেই না পড়েছিলাম! আগডুম-বাগডুম করে গিয়ে দাঁড়ালাম সেই মেয়ের সামনে। মনে বড় আশা, এককালীন সাময়িকীতে ছাপা হওয়া আমার কাব্য প্রতিভা আর আজকের পত্রিকায় ছাপা হওয়া আমার কৃতিত্বের ছবি মিলিয়ে আমাতে মুগ্ধ হয়ে সেই মেয়ে নিশ্চয়ই আজ নিজ থেকেই ভালোবাসা-ভালোলাগার গল্পকথা কিছু বলবে। মেয়ে নিজ থেকেই বললো। ভালোবাসার গল্পই বললো। তবে সে গল্পের নায়ক অন্য কেঊ। ভালোবাসার এই গল্পে আমার অবস্থা যেন সেই মক্কাবাসীর মতো যে মক্কায় থেকেও হজ্বের আসর ধরতে পারেনি।
হতাশ হৃদয়। খেলাধুলোয় আর মন বসলো না। ফিরে গেলাম বিপ্লবী বন্ধু আর কবি বন্ধুদের মাঝে কাব্য আর বিপ্লবের সন্ধানে। বন্ধুরা বললো, “ওরে, ছাড় তোর কাব্য আর বিপ্লব, তুই তো এখন মেধাবী”। অবশেষে সেই সীল নিয়েই পড়াশোনার নিরস জগতে মুসাফিরের মতো ঘুরে বেরাতে থাকলাম। আজও সেই পথে পথে ঘোরা সেই হয়নি। বরং এই দুপুরে বেলায় কঠিন এক পরীক্ষার প্রুস্তুতি নিতে পড়ার টেবিলে বসে মনে হলো- আমার খেলাধুলার সেই আমোদিত জীবন কেড়ে নিলো এক অলক্ষুনে কবিতা। জীবনে ওই একবারই লিখেছিলাম। সেই প্রথম, সেই শেষ। এই সেই অলক্ষুনে কবিতা। শালার এই কবিতার মায়েরে বাপ!
দাবী
বায়ান্নতে
দু’টো দাবী জানালাম বিধাতার কাছে।
প্রথমটি প্রত্যাখ্যান করে বিধাতা বলেন, অপরটি বলো।
বললাম, ভাষা চাই।
বিধাতা ভাষা দিলেন।
একাত্তুরে
দু’টো দাবী জানালাম বিধাতার কাছে।
প্রথমটি প্রত্যাখ্যান করে বিধাতা বলেন, অপরটি বলো।
বললাম, স্বাধীনতা চাই।
বিধাতা স্বাধীনতা দিলেন।
নব্বুইতে
দু’টো দাবী জানালাম বিধাতার কাছে।
প্রথমটি প্রত্যাখ্যান করে বিধাতা বলেন, অপরটি বলো।
বললাম, গনতন্ত্র চাই।
বিধাতা গনতন্ত্র দিলেন।
যদিও বিধাতার মেনে নেয়া দাবীগুলোর
ঘটাতে পারিনি বিকাশ
তবুও এক গভীর রাতে
শত যুগের, শত শতাব্দীর প্রত্যাখ্যাত
সেই একটি মাত্র দাবী নিয়ে দাঁড়ালাম বিধাতার কাছে
বললাম, অন্ন চাই, অন্ন চাই, অন্ন চাই।
বিধাতা বলেন,
অন্ন নয়; অন্য কথা বলো।
মন্তব্য
আপনি ভুল করে কবিতার জোশে সেই প্রেমাষ্পদার কাছে কোনো কিছু খেতে চাননি তো আবার ?
প্রেমাস্পদের কাছে সামান্য কিছু খেতে চাওয়ার বোকামী। আমি আরো বড় জিনিস চেয়েছিলাম- গণতন্ত্র অর্থাৎ সর্বত্র সমান অধিকার।
জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী
প্রেমে ব্যর্থ হওয়ার কারণ কবিতায়ই আছে। যে ছেলে বিধাতার কাছে অন্নের জন্য হাহাকার করে, তার প্রেমে পড়ে জীবন বরবাদ করবে, মেয়েরা কি এত বোকা হয় নাকি?
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
ঠিকই ধরেছেন। তবে আমার ব্যাখ্যাটা একটু অন্যরকম। বিধাতার কাছে গিয়েও যে খাই খাই করে- নিশ্চিত ভাবে তার আছে সর্বগ্রাসী ক্ষুধা। এমন সর্বগ্রাসী ক্ষুধার্ত মানুষ নাকি নিতম্ব-প্রধান নারীকেও খাবার তালিকা থেকে বাদ দেয় না। সর্বগ্রাসী ক্ষুধা-সম্পন্ন এমন মানুষের তো বাজারে বেশ হাই ডিমান্ড থাকার কথা। সুতরাং সেই সুদর্শনা জীবন বরবাদ করার মতো বোকা ছিলনা নাকি নিতম্ব-প্রধান ছিলনা—সেটাই আসল প্রশ্ন।
জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী
রম্যরচনা ভালো লাগলো।
কবিতা অসাধারণ লাগলো! পরে কি সত্যিই আর লেখেননি?
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
ধন্যবাদ।
আসলেই লিখি নাই। প্রানে গান নাই,মিছে মূর্তি গড়ে লাভ কি?
জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী
আপনার প্রেমটা হয় নি তা কারণ হচ্ছে, আপনি বিধাতার কাছে বোধহয় সেটা চাইতে ভুলে গেছিলেন। এভাবে চাইতেন -
প্রেমে পড়ে
দু’টো দাবী জানালাম বিধাতার কাছে।
প্রথমটি প্রত্যাখ্যান করে বিধাতা বলেন, অপরটি বলো।
বললাম, সুদর্শনারে চাই।
বিধাতা সুদর্শনা দিলেন।
নিজের অস্ত্রের মাহাত্ম্য আপনি নিজেই বুঝেন নাই। তাইলে প্রেম হয় ক্যাম্নে?
লেখা ভাল্লাগছে!
ইসস-চান্স মিস হইয়া গেলো। ভালো পীর না পাইলে মুরীদের যা হয় আর কি!
বস আপনি তখন কই আছিলেন?
জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী
হে হে, আবুর জুতা এখন সচলেও চলে এসেছে।
...........................
Every Picture Tells a Story
যন্ত্রনার হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য কত জায়গাতেই না জুতা জোড়াকে আবু ছুড়ে ফেলে আসতো, কিন্তু জুতা জোড়া ঠিকই আবার আবুর বাড়ীতে এসে হাজির হতো। সুতরাং আবু’র জুতাই কিন্তু আদি ও অকৃত্রিম “সচল”। সচল তো আবুর জুতার আসল ঠিকানা।
জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী
কথাবার্তা বাদ্দিয়া কবিতায় ডাইরেক চইলা গেলাম ... খুব ভালো লাগসে ...
___________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
ধন্যবাদ।
উপরে শুরুরে আজাইরা প্যান-প্যানানী, আর নিচে সবশেষে হইলো কবিতা। আপনি বুদ্ধিমান মানুষ, তাই ঠিক কাজটি করছেন।
ডাইরেক নিচে চইলা গেলেই আসলে লাভ বেশী।
জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী
বিধাতার মনে কোন রসকষ নাই
এমন সরকারী বিধাতায় আপনি রস পাবেন কই?
ধন্যবাদ
জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী
জন্মথেকে আজতক কক্ষনো কাব্যরসের স্বাদ ঠিক গ্রহন করে উঠতে পারলুম না।
স্বাদ যে একেবারেই পাইনা তা না তবে ভুল যায়গায় পাই। তাই রবিবুড়োর শত সহস্র কবিতার ভিড়ে আমার প্রিয় কবিতা বৃক্ষ। যারেই তা শুনিয়ে উপমার মাধুর্য বুঝাতে চাই তারি কেন যেন গুরুত্বপূর্ন কাজ মনে পড়ে।
দেখলেন এক কমেন্ট করতে গিয়ে কি বিশাল প্যাচাল পাড়তেছি? আসলে যা বলতে চেয়েছিলাম তা হল চমৎকার এক কবিতা পাঠের পরও আমার কেবলি শানেনুযুলটাই টানতেছে।
উপনিষদের ভাষা নকল করে বলি, সুবর্ণপিন্ড জানলেই সব সুবর্ণময় বস্তু জানা যায়।
শানে-নুযুলটাই তো আসল সুবর্ণপিন্ড।
আপনি জায়গা মতোই টানাটানি করছেন!
ধন্যবাদ
জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী
চমৎকার...
_________________________________________
সেরিওজা
ধন্যবাদ
জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী
সাধে তো আর কবিতাকে আমি কোবতে বলিনা,এই এক ব্যাপারে এত চেষ্টাচরিত্তিরের পরেও এই শর্মা একেবারেই নাদান। যাক,সে কথা বলে এখন আর ফায়দা নেই।
লেখা সুস্বাদু,পড়লাম তারিয়ে তারিয়ে।
অদ্রোহ।
আপনি আর আমি তো দেখি একই জিনিস।
আমরা তো ভাই ভাই।
ওরে, তুই আমার “বুখে” আয়।
জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী
কবিতা পড়ে মুগ্ধ হয়ে গেলাম রে ভাই।
এখনও সময় আছে, সুদর্শনারা নাকি এখনও আবৃত্তি করে।
লিখে ফেলুন আরো কবিতা,
আলী আবু আম্মুরীর জুতো-চারণায়
মুখরিত হোক নীড়পাতা।
............................................................................................
স্বপ্ন শুধু সত্য আর সত্য কিছু নয়
............................................................................................
এক পথে যারা চলিবে তাহারা
সকলেরে নিক্ চিনে।
“কবিতা লিখার মতো কোন কাব্য তো নেই।“
নিজের ভেতর কাব্যের পুঁজি নেই, তাই আপনার কাছে থেকে ধার নিলাম।
আপনি মুগ্ধ হয়েছেন জেনে আমি বিমুগ্ধ!
জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী
আপনিতো ভাই দারুন ল্যাখেন। স্মৃতিচারন ভাল লাগছে।
লেখালেখি জারি রাখেন।
আপ্নে তো দেখি বস লুক
------------------------------------------------------
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’রা কি কখনো ফিরে আসে !
------------------------------------------------------
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’রা কি কখনো ফিরে আসে !
আপনি দারুণ লিখে চলেছেন দেখছি। চলতে থাকুক আপনার রম্যলেখনী।
ফাটাইছেন। তয় গুল্লি মিস হওয়ার পরে আর একটা "প্রোডাকশন" দিলে পারতেন।
.................................
শ্যামল
এদ্দিন পরে পড়লাম, লেখা ভালো লাগছে, কোবতেখানিও বুঝতে পারছি(=ভালো লাগছে)।
---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়
নতুন মন্তব্য করুন