সারা আকাশ ঝাট দিয়ে ঘামাচি পরিমাণ মেঘও পাওয়া যাবে না। গত তিন মাসে ঝিনুক পরিমাণ বৃষ্টিও হয়নি। বৈশাখের এই নরক কুণ্ডের মধ্যে বাবু পদ্মার ভেড়ি বাঁধে এসে বাই সাইকেল থেকে নেমে ঠেলা শুরু করল। বন বিভাগের ভূতরে হাতের কসরতে বাঁধের দু’ধারের গাছ হাওয়া হয়ে বাঁধের ধুলা রোদে তেতে মুড়ি ভাজার উপযোগী হয়ে উঠেছে। উত্তাপের ঝলকায় গভীর ধুলার বুক চিরে সাইকেল ঠেলে নেতে গুন টানার মত কষ্ট হচ্ছে। চরের উপর দিয়ে বয়ে আসা দমকা বাতাস যখন বাবুর গায়ে লাগছে তখন মনে হচ্ছে দোজখের এগজষ্ট পাইপ দিয়ে এ বাতাস আসছে। ধুলা উড়ায়ে একটা কুকুর কখনো আগে কখনো পিছে গিয়ে বাবুকে সঙ্গ দিতে দিতে যাচ্ছে। আধ হাত জিব বের করে কুকুরটি খাবি খাচ্ছে।
তপ্ত হাওয়া তপ্ত ধুলার সাথে পিপাসা যোগ দিয়ে বাবুকে কাহিল করে ফেল্ল। বাবুর জিব কুকুরটার মত বের হয়ে আসেনি তবে শুকায়ে তালুতে লেগে গেছে। বাঁধের কোলে ফাঁকে ফাঁকে গড়ে উঠেছে ভূমিহীনদের ঝুপরি। পথ প্রায় নির্জন। বাঁধের বাসিন্দাদের আনা গোনা বুদবুদের আয়ুর মত চোখে পড়ে। আর দূরে তাকালে চোখে পড়ে কোমর দোলায়ে নৃত্যরত ধু ধু বাষ্পের নরকারহণের দৃশ্য। বাবু মুখের ভেতর জিব নাড়ায়ে বার বার ঢোক গিলছে। পিপাসার কাছে পরাস্থ হয়ে বাবু এক বাড়ির পাশে সাইকেল থামাল। একে বাড়ি না বলে ঘর বলাই ভাল। একটি খরের চালার ছাউনি ঘিরে চার দিকে চার খান বনের বেড়া আটা। ঘরের বেড়া ছাড়া আর কোথাও কোন আড়াল নেই। তাই এ বাড়ির ভেতর আঙ্গীনা বাহির আঙ্গিনা দিগন্তে গিয়ে ঠেকেছে।
সাইকেলের বেল বাজানর শব্দে ঘরের ঝাপ সরায়ে লাঠি ভর দিয়ে চোখের উপর একটা হাত রেখে রোদ আড়াল করে ঠক ঠক করতে করতে এক লোল চর্ম বৃদ্ধা এগিয়ে এল। এসে বলল, কিডা বাবা তুমি? কি চাও?
- ইকটু পানি হোবি, তিষেয় বুকটা ফাটি যাতেছে। জিবেয় এক ফুটা কষও নেই।
- আহারে! তুমার বাড়ি কোন গাঁয়?
- নয়নামতি।
- ইকটু খাড়াও।
বৃদ্ধা ঘরে গিয়ে এক হাতে একটি কাসার থালা অন্য হাতে পিতলের ঘটি নিয়ে বের হয়ে আসল। থালার এক কোনে একটু গুড়, আর এক কোনে মুঠ খানিক মুড়ি। থালাটি বাবুর দিকে আগায়ে দিয়ে বলল, লে বাপ এই টুক মুকে দিয়ি তার পর পানি খা।
- না না এসব কিছু লাগবি নানে। আমাক খালি পানিই দেন।
- না বাপ, দুইপর বেলায় অতিত (অতিথী) মানষেক খালি পানি দিতি নেই। গিরেস্তের দুন্নাম হয়।
- আপনের বাড়িত আর কিডা কিডা আছে?
- তিনডে মিয়ে ছিলে ভিন গাঁয় বি (বিয়ে) দিছি। একেনে আমার বুড়ের (বুড়ার) সাতে থাকি। তারও শইল (শরীর) চলে না। কিন্তুক প্যাট তো মানে না বাবা; তাই সুয়ামি আমার এককিন নিড়িন হাতে লিয়ে সেই আল্লার ফজরে কামলা খাটার লেগেন বার হয়ছে। বুড়েডা আমার রোদের ভিদেন (ভেতর) কোনে যে কি করতেছে?
- আপনেরই তো দিন চলে না, আমাক আবার মেমানদারি করার লেগেন হুটেপাটা লাগাইছেন।
বৃদ্ধা কিছুক্ষণ বাবুর দিকে তাকায়ে থেকে লাঠিতে ভর দিয়ে বসে পড়ল।
-বাবা হেন থেন মাইল দুই ফাঁকে রাক্কোসের ল্যাহান (মত) চিত হোয়ে যে পদ্মা শুয়ি রয়চে, ঐ গাং-এর বুকিই এক দিন ছিলে আমার সুনার সংসার। ভিটেত ভিটেত টিনের ঘর, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগী, বিরাট বিরাট খেরের পালা। সব সুময় অতিত-কুটুমে বাড়ি গমগম করতে। আমার মনে পড়ে না ছওয়াল করে আমার বাড়িত থেন খালি হাতে খালি প্যাটে কেউ গেছে। আমার জমি-জমা সম্পত্তি ঐ গাং-এ খায়ছে, তয় মনডা আর গাং-এ লিবের পারে নেই। হাজার অভাবের ঠেলা খায়েও সিডা আমার তাজা আছে। রোদি তাতে মুখখিন তোর বেগুন পুড়া হয়ে গেছে। মুখির দিক আর তাহানে যাচ্ছে না। আমার বাড়ির রেওয়াজ ভাংগিসনে; লে বাপ, গুড়-মুড়ি মুখি ফ্যালায়ে পানিডা খায়ে লে; প্যাটটা ইকটু দল হোক। পরাণডা জুড়েক।
বৃদ্ধার কথায় মুগ্ধ হয়ে বাবু থালে হাত বাড়াল। কুকুরটি দূরে দাঁড়ায়ে লেজ নাড়তে লাগল।
মন্তব্য
বড় অসময় এসে পড়লাম। তাই ভাবোদ্ধার করা হলে না। এমন কিছু লেখাই আশা ছিল। ধন্যবাদ।
মরণ রে তুহু মম শ্যাম সমান.....
অভি আপনি কি রিলে রেসের জন্য তৈরী ছিলেন। তা না হলে ভোর ৫.৩০ টায় পোষ্ট দেয়ার সাথে সাথেই দেখি একজন পাঠক হাজির। আমার লেখার দ্রুততম পাঠক খেতাবটা আপনারই প্রাপ্য।
আপনি তো ভালো রূপকের ব্যবহার জানেন দেখছি!
ধন্যবাদ প্রপ্রে।
উপমা-উৎপেক্ষা-রূপক – কী বলে এসবকে, জানি না, তবে খুবই মনে ধরলো।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
সন্নাসীর যখন ভাল লেঘেছে তা হলে ত আমি আনেন্দ বাংগী ফাটা।
নতুন মন্তব্য করুন