পদার্থবিদ্যার রহস্য রত্নঃ সময়-স্ফটিকের খোঁজে

বাহাউদ্দীন এর ছবি
লিখেছেন বাহাউদ্দীন [অতিথি] (তারিখ: শুক্র, ১৫/১২/২০১৭ - ১:০৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বিখ্যাত বিজ্ঞানী এবং বিজ্ঞানবক্তা মিচিও কাকুর একটি বই আছে, নামঃ “ফিজিক্স অব দ্যা ইম্পসিবল”। এই বইয়ে কাকু তিনটি ভাগে “বর্তমান বিজ্ঞানে অসম্ভব” বস্তুর পদার্থবিজ্ঞান ভবিষ্যতে কেমন হতে পারে বা গবেষণা কোন পর্যায়ে আছে তা নিয়ে কথা বলেছেন। এরকম “অসম্ভবের” প্রথমটি হল – ক্লাস ওয়ান ইম্পসিবিলিটিঃ এখানে আছে স্টার-ট্রেকের মতো শিল্ড বা ফোর্স ফিল্ড, স্টার-ওয়ার্সের মতো বিশাল স্পেসশীপ, কোন কিছুকে অদৃশ্য করে দেয়ার ক্ষমতা, টেলিপোর্টেশন, ভিন্ন গ্রহের বুদ্ধিমান প্রাণের সাথে যোগাযোগ ইত্যাদি। দ্বিতীয়টি হল – ক্লাস টু ইম্পসিবিলিটিঃ আলোর থেকে দ্রুত পরিভ্রমণ করা, সময় পরিভ্রমণ এবং প্যারালাল ইউনিভার্সে যোগাযোগ। শেষটি হল – ক্লাস থ্রি ইম্পসিবিলিটিঃ পার্পেচুয়াল মেশিন এবং ভবিষ্যৎ দেখতে পারা।

এদের মধ্যে পার্পেচুয়াল মেশিন হল এমন একটি যন্ত্র বা সিস্টেম যেটা থেকে বাইরের সাহায্য ছাড়াই অবিরাম শক্তি তৈরি করতে পারে। যদিও আমাদের দেশে কিছু দিন পর পর পার্পেচুয়াল মেশিন (জ্বালানি ছাড়াই বিদ্যুৎ) আবিষ্কারের ঘোষণা শোনা যায়, কিন্তু পশ্চিমা বিজ্ঞানীরা মেনে নিয়েছেন এমন কোন বস্তু থাকা সম্ভব নয় (বোধ হয় পশ্চিমা বিজ্ঞানীরা এদিক থেকে আমাদের দেশ থেকে অনেক পিছিয়ে আছেন!), কারণ এটি সরাসরি শক্তির সংরক্ষণশীলতার নীতি এবং তাপ-গতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রকে অস্বীকার করে। তাপ-গতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র নিয়ে আইন্সটাইনের সহকর্মী বিজ্ঞানী স্যার আর্থার এডিংটনের মজার একটা উক্তি আছে, “মহাবিশ্ব নিয়ে তোমার তৈরি কোন সূত্র পূর্বের যে কোন প্রতিষ্ঠিত সূত্রের সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারে, সেক্ষেত্রে তুমি ভাবতেই পারো হয়ত আগের সূত্রে কোন ভুল ছিল, বা তোমার পরীক্ষায় কোন ত্রুটি ছিল। কিন্তু এটি যদি তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রের সাথে সাংঘর্ষিক হয়, তাহলে আমি তোমাকে বলতে পারি, তোমার সূত্র নিঃসন্দেহে ভুল।” (If someone points out to you that your pet theory of the universe is in disagreement with Maxwell's equations — then so much the worse for Maxwell's equations. If it is found to be contradicted by observation — well, these experimentalists do bungle things sometimes. But if your theory is found to be against the second law of thermodynamics I can give you no hope; there is nothing for it but to collapse in deepest humiliation.)

পার্পেচুয়াল মেশিন অসম্ভব হওয়ার সবচেয়ে সোজাসাপ্টা কারণ হল, এমন কোন সিস্টেম থাকা সম্ভব না, যেটা কোন শক্তি না দিলে নিজে নিজে শক্তি উৎপাদন করে। তদুপরি সিস্টেমের কলকব্জা নড়ানোর জন্য হলেও কিছু শক্তি খরচ করতে হবে। সুতরাং সিস্টেমে যেই শক্তি দেয়া হবে, তার থেকে কিছু কম শক্তি কাজ করার জন্য পাওয়া যাবে। তাহলে প্রশ্ন জাগে, এমন কোন সিস্টেম কি তৈরি করা সম্ভব যার ভেতরে কিছু শক্তি দিয়ে দেয়া থাকবে, যেটা সে কোথাও খরচ করতে পারবে না এবং তার কাছ থেকে কেউ নিবেও না, যার ফলে সেই শক্তি দিয়ে সে আজীবন তার কলকব্জা নাড়াতে থাকবে? এমন একটা সিস্টেম আসলে দেখতে কেমন হবে? এটা যেন একটা ইঞ্জিন, সবসময় চলছে, কিন্তু এই ইঞ্জিন দিয়ে কোন চাকা ঘুরানো যায় না। শুধু ভেতরে কলকব্জা চালু রাখা যায়! পদার্থের এরকম এক অদ্ভুত অবস্থার নাম “সময়-স্ফটিক”।

দশা এবং সাম্যাবস্থা
সময়-স্ফটিক নিয়ে কথা বলার জন্য সবার আগে সাম্যাবস্থা ব্যাপারটা নিয়ে একটু কথা বলে নেয়া উচিৎ। পদার্থবিজ্ঞানে সাম্যাবস্থা মানে হল এমন একটা অবস্থা যেখানে বস্তুর উপর কোন “মোট” বল (ফোর্স) কাজ করছে না। এখানে “মোট” বলার কারণ হল, বস্তুর উপর একাধিক বল কাজ করতে পারে, কিন্তু সব বলগুলো যখন হিসাবে নেয়া হবে তখন “মোট” বা “লব্ধি” শুন্য হয়ে যাবে। এতে করে বস্তু স্থিতিশীলতা (স্ট্যাবিলিটি) অর্জন করবে। সাধারণত মহাবিশ্বের সকল বস্তু এই স্থিতিশীলতা পেতে চায়, যেকোনোভাবেই হউক পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র মেনে তাই বস্তু চেষ্টা করে সাম্যাবস্থা অর্জন করার। একবার যখন কোন বস্তু সাম্যাবস্থা পেয়ে যায়, তখন আবার সে সহজে সেখান থেকে চ্যুত হতে চায় না। তখন বাইরে থেকে কোন লব্ধি বল কাজ করলেও সে চেষ্টা করে ওই বল গ্রহণ না করতে বা অন্য কোনভাবে ক্ষয় করে দিতে, যাতে তার সাম্যাবস্থা নষ্ট না হয় (এই ধর্মটাকে বলে “রিজিডিটি”)।

এখন সাম্যাবস্থার সাথে পদার্থের “দশা” বা “অবস্থা”র খুব বড় একটা সম্পর্ক আছে। পদার্থ যখন কোন একটা দশায় পৌঁছায় তখন আমরা বুঝে নেই যে সে ওই দশার জন্য সাম্যাবস্থা অর্জন করেছে। তাহলে প্রশ্ন আসে, দশা কি? বা আরও গভীরে গেলে, দশা ধারণ করার দরকারটা কি? যেমন খুশি তেমনভাবে থাকা আর একটা দশার মধ্যে থেকে স্থিতাবস্থা অর্জন করা বা ছুটোছুটি করার মধ্যে পার্থক্য কি? উত্তর হল, যেমন খুশি তেমনভাবে থাকা যায়, কিন্তু এতে করে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সিস্টেমের শক্তি অনেক উদ্বৃত্ত থেকে যায়, ফলাফল হল বিশৃঙ্খলা, যেটা মহাবিশ্বে কেউই চায় না। সবাই চায় সর্বনিম্ন শক্তিস্তরে গিয়ে উদ্বৃত্ত শক্তি বাইরে ছেড়ে দিতে। এবং এটা তখনই পাওয়া যায় যখন পদার্থের অভ্যন্তরে কোন প্রতিসাম্য বা সিমেট্রি অর্জন করা যায়। গাণিতিকভাবে দেখানো যায় যে, প্রতিসাম্য অর্জন মানে হল একটা শৃঙ্খলা যেখানে সর্বনিম্ন শক্তিতে সিস্টেম অবস্থান করতে পারে। তার মানে দাঁড়ালো, পদার্থ সবসময় চেষ্টা করে কোন একটা প্রতিসাম্য অর্জন করে উদ্বৃত্ত শক্তি ছেঁড়ে দিতে এবং সেটার ফলাফল আমরা দেখতে পাই যে সে একটা দশায় এসে স্থিতিশীল হয়েছে (স্ট্যাবিলিটি অর্জন করেছে)।

দশা এবং সাম্যাবস্থার মধ্যে সম্পর্ক একটা উদাহরণ দিয়ে বললে মনে হয় আরও ভালো বুঝা যায়ঃ ধরা যাক পানি কঠিন অবস্থা প্রাপ্ত হল, মানে বরফ হয়ে গেলো। এটা পানির কঠিন দশা। এখন বরফ কেন বরফ? কেন সে পানির মতো তরল না? তার কারণ হল, বরফের অণু-পরমাণুরা একটা সাম্যাবস্থা অর্জন করেছে যেখানে তারা নিজেদের জন্য একটা স্থায়ী ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে (বিজ্ঞানের ভাষায়, ক্রিস্টালের ল্যাটিস)। এখন তারা চায় না যে, এই ঠিকানা ছেড়ে, বসত-ভিটা ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে। যদি বাইরে থেকে বল (ফোর্স) আসেও, তারা সম্মিলিতভাবে আন্দোলিত হয়ে সে বলকে শব্দ শক্তি হিসেবে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিবে, কিংবা দরকার হলে বড় বড় টুকরায় ভেঙ্গে যাবে, কিন্তু নিজেদের আণবিক অবস্থান বিসর্জন দিবে না। বিসর্জন দিতে বাধ্য হবে তখনই যদি যথেষ্ট বল (এইক্ষেত্রে তাপশক্তি হিসেবে) বাইরে থেকে দেয়া হয়। যেটা আমরা দেখি, বরফকে গরম করলে প্রথমে তাপমাত্রা বাড়ে এবং এক সময় আর তাপমাত্রা বাড়াতে না পারলে বরফ গলে পানি হয়ে যায়। কিন্তু আবারও একই কথা, অতিরিক্ত বলের জন্য হয়ত দশা পরিবর্তন করবে, কিন্তু করে ঠিকই এমন একটা দশায় যাবে যেখানে আবার সে একটা নতুন সাম্যাবস্থা অর্জন করতে পারে (এই ক্ষেত্রে, পানি)। পানির ক্ষেত্রে এটা হল অণু-পরমাণুর অস্থায়ী ঠিকানার সাম্যাবস্থা। এই সাম্যাবস্থায় আয়তন আছে, কিন্তু স্থায়ী ঠিকানার অভাবে বরফের মতো কোন আকার বা আকৃতি নেই।

সময় এবং স্থানের প্রতিসাম্য
এতক্ষণ দশা এবং প্রতিসাম্য নিয়ে যা কিছু বললাম খেয়াল করলে দেখা যায় সব কিছুর সাথে স্থান সম্পর্কিত। মানে আমরা যখন বলছি প্রতিসাম্য, তখন বুঝাচ্ছি স্থানের প্রতিসাম্য। একটা উদাহরণ দেই, মনে করুন পানি তরল দশায় আছে। এখন আপনি যদি পানির অণু-পরমাণুর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জগতে গিয়ে চারদিকে তাকান, দেখবেন অসংখ্য পানির অণু যে যেভাবে পারে ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে। আপনি ওই জগতে যেভাবেই দাঁড়ান, ১০ পা সামনে এগিয়ে, বা আধা চক্কর ঘুরে, বা কোণাকুণি ঘাড় বাঁকিয়ে, সবসময় সবদিকে একই অবস্থা দেখতে পাবেন। এই ঘটনার তাৎপর্য হলঃ তরল অবস্থায় পানির অণুদের বিন্যাসে ট্রান্সলেশন(আগে-পিছে) এবং রোটেশনাল(ঘুরিয়ে-বাঁকিয়ে) সিমেট্রি বা প্রতিসাম্য আছে। এবং এই প্রতিসাম্যটি হল স্থানের সাপেক্ষে “কন্টিনিউয়াস” বা “নিরবিচ্ছিন্ন”। এবার চলুন বরফের জগতে যাইঃ এই জগতে সব অণু যার যার অবস্থানে স্থির এবং সবাই একই ভাবে সজ্জিত। যেন একটার পর একটা ঘর এবং সেই ঘরের বিভিন্ন জায়গায় অণুগুলো একটা নির্দিষ্ট জায়গায় পেরেক দিয়ে বসানো, এবং প্রত্যেকটা নতুন ঘরে গেলে দেখা যায় ঘরের ঠিক একই জায়গায় একই ভাবে অণুরা বসে আছে। এক ঘরের মাঝখান থেকে আরেকঘরের মাঝখানে গেলে মনে হয় যেন আগের ঘরটাতেই আছি। এটা হল ক্রিস্টাল সিমেট্রি বা স্ফটিক প্রতিসাম্য। এই প্রতিসাম্যে স্থানের নির্দিষ্ট একটা দূরত্ব পার হলেই শুধু সব আগের মত দেখায় (এক ঘরের কেন্দ্র থেকে আরেক ঘরের কেন্দ্র)। ধরা যাক, এক ঘরের কেন্দ্র থেকে আরেক ঘরের কেন্দ্রের দূরত্ব ২০ পা, আপনি যদি ১০ পা যান, অথবা ২৫ পা যান, আপনি কিন্তু একই রকম দেখবেন না। আপনাকে সবকিছু আগের মত পেতে হলে ঠিক ২০ পা করেই এগুতে হবে (ছবিতে)। এজন্য এটাকে বলে ডিসক্রিট (টুকরো-টুকরো) ট্রান্সলেশন সিমেট্রি। ডিসক্রিট বলা হচ্ছে, কারণ সিমেট্রি পেতে হলে আপনাকে ২০ পা, অথবা ২x২০ = ৪০ পা, অথবা ৩x২০ = ৬০ পা করে আগাতে হবে। এর মাঝে কিছু হলে আপনি সিমেট্রি পাবেন না। সুতরাং পানি থেকে বরফ দশায় যাওয়ার মানে হল, “নিরবিচ্ছিন্ন প্রতিসাম্য” ভেঙ্গে “বিচ্ছিন্ন প্রতিসাম্য” অর্জন করা।

এত কিছু বলার কারণ হল, আমরা যখন প্রতিসাম্য বলি তখন বুঝি যে স্থানের সাথে কোন কিছুর পুনরাবৃত্তি হচ্ছে, যখন “বিচ্ছিন্ন প্রতিসাম্য” বলি তখন বুঝি যে এই বিচ্ছিন্নতা স্থানের সাথে সাথে। কিন্তু সময়ের সাথে ব্যাপারটা কেমন? সময়ের সাথে সব পদার্থই “নিরবিচ্ছিন্ন প্রতিসাম্য” প্রদর্শন করে, মানে সময়ের সাথে অতীতে বা ভবিষ্যতে যে দিকেই যাওয়া হউক বাইরে থেকে কিছু না করা হলে সাম্যাবস্থায় সবকিছু আগের মতই থাকে, আলাদা করে কোন প্রতিসম আকার দেখা যায় না। অন্তত পদার্থবিজ্ঞানীরা ২০১২ সালের আগ পর্যন্ত এভাবেই চিন্তা করতেন। কিন্তু ২০১২ সালে নোবেলবিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী ফ্র্যাঙ্ক উইলযেক বললেন, স্থানের সাথে পুনরাবৃত্তির জন্য যে বিচ্ছিন্ন প্রতিসাম্য হয় তা থেকে যদি পদার্থের বিভিন্ন দশা থাকতে পারে, তাহলে সেটা সময়ের জন্য নয় কেন? আইন্সটাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুযায়ী স্থান এবং সময় আসলে আলাদা কিছু নয়, দুইটা মিলে বরং একবারে বলা উচিৎ স্থান-কাল। তাহলে আমাদের চতুর্মাত্রিক মহাবিশ্বে সময়ের সাথে পুনরাবৃত্তির জন্যও কি কোন প্রতিসাম্য হতে পারে, যেখানে “সময়-নিরবিচ্ছিন্ন প্রতিসাম্য” ভেঙ্গে তার থেকে “সময়-বিচ্ছিন্ন প্রতিসাম্য” পাওয়া যাবে? ফলে আমরা পদার্থের নতুন দশা পাব? উইলযেক এমন দশাসম্পন্ন পদার্থের নাম দিলেন সময়-স্ফটিক বা টাইম ক্রিস্টাল। সাধারণ ক্রিস্টাল বা স্ফটিকে অণু-পরমাণুগুলো স্থানের সাথে বিন্যস্ত হয়ে টুকরো-টুকরো বা বিচ্ছিন্ন প্রতিসাম্য (ডিসক্রিট সিমেট্রি) অর্জন করে, আর এই ক্ষেত্রে তারা হবে সময়ের সাথে। উপরের সাধারণ স্ফটিকের উদাহরণে যেমন দেখি, প্রতি ২০ পা পর পর অণু-পরমাণুগুলোর বিন্যাস একই রকম, এইবেলায় আমরা দেখব, প্রতি ২০ সেকেন্ড পর পর অণু-পরমাণুগুলো একই বিন্যাস অর্জন করছে (ছবিতে লক্ষ্য করুন, এবার আর স্থানের সাথে কোন প্রতিসাম্য নেই, কিন্তু সময়ের সাথে আছে!)।

উইলযেকের মতে, এমন কোন পদার্থ থাকা উচিৎ, যার সর্বনিম্ন শক্তিস্তরে সাম্যাবস্থা আছে এবং সাম্যাবস্থায় থাকাকালেই তার ভিতরে অণু-পরমাণুগুলো উপরের ছবির মতো একটি প্রতিসাম্য মেনে নড়াচড়া করতে পারে। যেন এমন একটা ঘড়ি যার সর্বনিম্ন শক্তিস্তরের শক্তি দিয়ে সে আজীবন তার কলকব্জা নাড়িয়ে টিক টিক করে যাচ্ছে! (পার্পেচুয়াল মেশিনের মতো, তবে পার্পেচুয়াল মেশিন না, কারণ এখানে সিস্টেমের বাইরে কোন শক্তি যাওয়ার সুযোগ নেই যেটা থেকে কোন কাজ বের করা সম্ভব)। অন্যভাবে বললে, পদার্থটি সময়ের সাথে সাথে একটা ডিসক্রিট বা বিচ্ছিন্ন প্রতিসাম্য দেখাচ্ছে, যেটা পদার্থের একটা নতুন দশা হিসেবে আমাদের সামনে আবির্ভূত হবে। উপরন্তু “দশা” বলে, সিস্টেমটিকে বাইরে থেকে অল্প পরিমাণ বল (বা ফোর্স) প্রয়োগ করলেও তার এই প্রতিসাম্য ভেঙ্গে পড়বে না, সে দশাকে ধরে রাখবে অর্থাৎ “রিজিডিটি” ধর্ম প্রদর্শন করবে। উইলযেকের তত্ত্বটি অসাধারণ হলেও কিছুদিনের মধ্যে অ্যামেরিকা, ফ্রান্স এবং জাপানের বড় বড় তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী এবং গণিতবিদরা হিসেব করে দেখিয়ে দিলেন যে, পার্পেচুয়াল মেশিন না হলেও কিছু আসে যায় না, সাম্যাবস্থায় এমন পদার্থ থাকা সম্ভব নয় যে সর্বনিম্ন শক্তিস্তরে থেকে এভাবে নিজে নিজে বাইরের কোন সাহায্য ছাড়া টিক টিক করতে পারবে, বা বিজ্ঞানের ভাষায়, “সময়-নিরবিচ্ছিন্ন প্রতিসাম্য” ভেঙ্গে “সময়-বিচ্ছিন্ন (ডিসক্রিট) প্রতিসাম্য” অর্জন করতে পারবে।

কিন্তু কিছু বিজ্ঞানী বললেন, সাম্যাবস্থা থাকতেই হবে এমন তো কোন কথা নেই, প্রকৃতিতে এমন দশাও সম্ভব যেখানে সাম্যাবস্থা (ইকুইলিব্রিয়াম) নেই। বরং সেখানে অণু-পরমাণুরা এরকম দশায় থাকে যাতে তাদের উপর সবসময়ই কমবেশি একটা লব্ধি বল (ফোর্স) কাজ করতে থাকে এবং এতে করে তারা সারাক্ষণই ছুটোছুটির মধ্যে থাকে। তাত্ত্বিকভাবে এরকম অ-সাম্যাবস্থায় (নন-ইকুইলিব্রিয়াম) থাকা অবস্থায়ও পদার্থ “দশা” ধারণ করতে পারে। প্রশ্ন হল, অ-সাম্যাবস্থার দশা কি? এটা হল এমন একটা দশা যে দশায় পদার্থের পক্ষে সব শক্তি ছেড়ে দিয়ে পরিপূর্ণ স্থিতিশীলতা অর্জন করা সম্ভব হয়নি, কিছু শক্তি রয়ে গেছে যেটা পদার্থের অভ্যন্তরস্থ কণাদেরকে ছুটোছুটির মধ্যে রেখেছে, কিন্তু এই ছুটোছুটির মধ্যেও একটা প্রতিসাম্যতা বা সিমেট্রি পদার্থ অর্জন করেছে। ফলে এটা হল এমন একটা অবস্থা যেটাকে বলা যায় গতিশীল দশা (যে দশায় গতিশক্তি রয়ে গেছে)। ২০১৫ সালের দিকে এসে বিজ্ঞানীরা নিজেদের প্রশ্ন করতে শুরু করলেন, “অ-সাম্যাবস্থায় কি তাহলে সময়-স্ফটিক পাওয়া সম্ভব?”

সময়-স্ফটিকের খোঁজে
প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞানী শিভাজি সন্ধির গ্রুপ বিশেষ একধরনের অণু-পরমাণুর স্যুপ নিয়ে কাজ করছিলেন। তাঁরা স্যুপটিকে একটু পর পর লেজার রশ্মি দিয়ে উত্তপ্ত করছিলেন এবং দেখছিলেন কিভাবে স্যুপটি গরম হয়। সাধারণত এরকম ক্ষেত্রে স্যুপটি উত্তপ্ত থেকে উত্তপ্ততর হওয়ার কথা, সেই সাথে অণু-পরমাণুগুলোর ভেতরে ছুটোছুটি এবং বিশৃঙ্খলা বেড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তাঁরা দেখলেন, একটা বিশেষ ক্ষেত্রে স্যুপটি আর বিশৃঙ্খল বা গরম হয় না, সে একটা “অ-সাম্যাবস্থার দশা” লাভ করে, যেখানে সে লেজার রশ্মি থেকে প্রাপ্ত উদ্বৃত্ত শক্তি বাইরে ছেড়ে দেয়। শিভাজি সন্ধির এই গবেষণা চোখে পড়ে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া সান্টা বারবারা’র আরেক পদার্থবিজ্ঞানী চেতন নায়েকের। ইনি ছিলেন উইলযেকের ছাত্র এবং তাঁর কাজের জন্য তিনি মাইক্রোসফটের স্টেশন Q-তে কোয়ান্টাম পদার্থ নিয়ে কাজ করছিলেন। তিনি ভাবলেন, শিভাজির অণু-পরমাণুর স্যুপ থেকে কি সময়-স্ফটিক বানানো সম্ভব? তাঁরা হিসাবে কষে দেখলেন যে, সম্ভব হতে পারে কিন্তু একটা বাধা থেকে যায়। সেটা হল, স্যুপটি সময়ের সাথে সাথে ঠান্ডা হয়ে আসে এবং “অ-সাম্যাবস্থার দশা” থেকে “সাম্যাবস্থার দশা”য় এসে পড়ে। সুতরাং তাঁরা বললেন যে, যদি অণু-পরমাণুর স্যুপটিকে আমরা “অ-সাম্যাবস্থার দশা”য় ধরে রাখতে পারি, তাহলেই সেখান থেকে সময়-স্ফটিক তৈরি করা সম্ভব।

একই সময়ে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্ক্লে’র বিজ্ঞানী নরম্যান ইয়াও একই জিনিস নিয়ে কাজ করছিলেন। তিনি কল্পনার জগতে নায়েকের অণু-পরমাণুর স্যুপের পরিবর্তে পর পর বসানো কতোগুলো পারমাণবিক কণা দিয়ে তৈরি শিকল নিয়ে কাজ করছিলেন। তিনি দেখলেন, যদি এই শিকলটিকে একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর কোন নির্দিষ্ট কম্পাংকের শক্তি দিয়ে বাইরে থেকে আন্দোলিত করা হয় (অ-সাম্যাবস্থায় নেয়া হয়), তবে শিকলটি সেই কম্পাংকে আন্দোলিত হতে থাকে (যেমনঃ আমি যদি হাত দিয়ে দড়ি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দড়িলাফ দেই, তাহলে প্রতি সেকেন্ডে একবার ঘোরানোর জন্য দড়িটিও সেকেন্ডে একবার আমার চারদিকে ঘুরে আসবে)। এখন এমন যদি হয় যে, আমরা এই শিকল বা দড়িটির বিভিন্ন অংশকে ইচ্ছা করে একটা বিশৃঙ্খলার মধ্যে ফেললাম এবং একই সাথে এমন ব্যবস্থা করে দিলাম যে দড়ির বিভিন্ন অংশ নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলে নিজেদের সুবিধামত সাজে সজ্জিত হতে পারে, তাহলে একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে। তখন দেখা যায় প্রতি সেকেন্ডে একবার দড়ি ঘুরানো হচ্ছে, কিন্তু দড়ি ঘুরে আসছে দুই সেকেন্ডে একবার, বা তিন সেকেন্ডে একবার বা অন্য কোন পূর্ণ সংখ্যার গুণিতক। সোজা ভাষায় বললে, দড়ি ঘুরানো হচ্ছে এক গতিতে, কিন্তু দড়ি আন্দোলিত হচ্ছে সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছা মতো, একটা আলাদা গতিতে। আরও দেখা যায়, আমাদের বাহ্যিক আন্দোলনের গতি কিছু বাড়িয়ে বা কমিয়ে দিলেও, দড়ির নিজস্ব আন্দোলনের গতির কোন পরিবর্তন হয় না (রিজিডিটি), যেন দড়িটা একটা “দশা” পেয়ে গেছে, সে সব সময় এভাবেই থাকবে, যতক্ষণ না বাইরে থেকে অনেক বেশি শক্তি দিয়ে দশা ভেঙ্গে দেয়া না হচ্ছে।

চেতন নায়েক এবং নরম্যান ইয়াওয়ের গবেষণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ২০১৬ সালে এগিয়ে আসলেন ইউনিভার্সিটি অব ম্যারিল্যান্ডের ক্রিস মনরো এবং হার্ভার্ডের মিখাইল লুকিন। ক্রিস মনরোর ভাষায়, আমাদের হাতে অণু-পরমাণুর স্যুপ তৈরি ছিল, এখন শুধু রেসিপি খুঁজে বের করতে হবে, যার মাধ্যমে স্যুপ থেকে আমরা সময়-স্ফটিক বের করে আনতে পারি। মনরোর গ্রুপ হিসাব কষে দেখলেন, রেসিপিতে মাত্র তিনটা মসলা দরকারঃ ১। এমন একটা কিছু যে অণু-পরমাণুর স্যুপটিকে বারবার ধাক্কা দিয়ে “অ-সাম্যাবস্থার দশা” ধরে রাখতে পারবে, ২। এমন কোন ব্যবস্থা যাতে অণু-পরমাণুরা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলে একটা “বিচ্ছিন্ন প্রতিসাম্য” খুঁজে নিতে পারে এবং ৩। একটা এলোপাথারি বিশৃঙ্খলা, যেটার কাজ হল, বিভিন্ন ধাক্কা থেকে যে উদ্বৃত্ত শক্তি থাকবে সেটা স্যুপটিকে শোষণ করতে না দিয়ে বের করে দেয়ার ব্যবস্থা করে দেয়া।

পরিকল্পনামত ক্রিস মনরোর গ্রুপ চরম-শীতল তাপমাত্রায় দশটি ইটার্বিয়াম পরমাণু পর পর সাজিয়ে এক জায়গায় আটকে রাখলেন। এবার রেসিপির এক নম্বর শর্ত অনুযায়ী একটু পর পর পরমাণুগুলোকে একটি নির্দিষ্ট কম্পাংকের লেজার রশ্মি দিয়ে ধাক্কা দিতে শুরু করলেন। দেখা গেলো, ইটার্বিয়াম পরমাণুগুলোও লেজার রশ্মির সাথে সাথে একই তালে আন্দোলিত হতে শুরু করেছে। একই সময়ে রেসিপির দ্বিতীয় এবং তৃতীয় শর্ত অনুযায়ী তাঁরা আরেকটা ভিন্ন কম্পাংকের লেজার রশ্মি দিয়ে ইটার্বিয়াম পরমাণুগুলোকে নির্দিষ্ট সময় পর পর আঘাত করতে থাকলেন, যাতে পরমাণুগুলোর গতি এলোপাথাড়ি হয় কিন্তু তারা একে অপরের সাথে ইন্টারঅ্যাক্ট করতে পারে। তাঁরা দেখতে পেলেন, পরমাণুগুলো একদম শুরুতে এলোপাথাড়ি ছুটোছুটি করছিলো, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা ছুটোছুটি বন্ধ করে একটা নির্দিষ্ট কম্পাংকে আন্দোলিত হতে শুরু করল। এবং তাদের আন্দোলনের যেই কম্পাংক সেটা দুইটি লেজার রশ্মির কোনটিরই কম্পাংকের সাথে মিলে না, যেন পরমাণুগুলো সম্পূর্ণ নতুন একটা কম্পাংক নিজে নিজে খুঁজে নিয়ে সময়ের সাথে সাথে আন্দোলিত হচ্ছে। আরও দারুণ ব্যাপার হল, একবার এই “অবস্থা” বা “দশা” প্রাপ্ত হওয়ার পর লেজার রশ্মিগুলোর কম্পাংক এদিক-সেদিক করলেও পরমাণুগুলো নিজস্ব আন্দোলনের কম্পাংকের কোন পরিবর্তন হয় না। অর্থাৎ পরমাণুটির চেইনটি “রিজিডিটি” ধর্ম প্রকাশ করে। সুতরাং এই দশটি ইটার্বিয়াম পরমাণু একসাথে একটি টাইম-ক্রিস্টাল বা সময়-স্ফটিক তৈরি করে (ছবি)।

হার্ভার্ডের লুকিন গ্রুপও প্রায় একই পরীক্ষা করলেন, তবে তাঁরা ইটার্বিয়াম পরমাণুর বদলে নিয়েছিলেন হীরার স্ফটিকের মাঝে বসানো নাইট্রোজেন পরমাণু, লেজার রশ্মির বদলে ব্যবহার করেছিলেন মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গ এবং পুরো পরীক্ষাটি করেছিলেন কক্ষ তাপমাত্রায় (২৫°সেঃ)। সম্পূর্ণ ভিন্ন তাপমাত্রায় নতুন পদার্থ এবং ভিন্ন মাত্রার তরঙ্গ দিয়ে ধাক্কা দিয়েও তাঁরা ঠিকই দেখলেন যে, নাইট্রোজেন পরমাণুগুলো ইটার্বিয়াম পরমাণুর মতই সম্পূর্ণ নতুন একটা কম্পাংক নিজে নিজে খুঁজে নিয়ে সময়ের সাথে সাথে আন্দোলিত হচ্ছে। এবং তারাও আগেরটির মতো “রিজিডিটি” প্রদর্শন করছে অর্থাৎ মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গের কম্পাংক এদিক-সেদিক করলেও পরমাণুগুলোর নিজস্ব আন্দোলনের কম্পাংকের কোন পরিবর্তন হচ্ছে না। এতে করে নিশ্চিতভাবে প্রমাণ পাওয়া গেলো যে, প্রকৃতিতে সময়-স্ফটিকের অস্তিত্ব রয়েছে।

সময়-স্ফটিকের ভবিষ্যৎ
পদার্থবিজ্ঞানীদের চোখে সময়-স্ফটিকের সবচেয়ে অসাধারণ ব্যাপারটা হল অ-সাম্যাবস্থায় যে পদার্থের প্রতিসাম্য এবং দশা থাকতে পারে সেটা সরাসরি প্রমাণ করা। আমরা এতদিন যা কিছু নিয়ে কাজ করেছি, সব পদার্থই ছিল মূলত সাম্যাবস্থার, অ-সাম্যাবস্থায় আসলে কখন, কি, কিভাবে হতে পারে সেই গল্প আমাদের প্রায় অজানা। সময়-স্ফটিক আবিষ্কারে এখন সেই রূপকথার দেশ নিয়ে গবেষণার সুযোগ তৈরি হয়ে গেলো।

ইঞ্জিনিয়ারিং দিক থেকে সময়-স্ফটিকের এখনই খুব একটা ব্যবহার নেই, কারণ পদার্থটা যে থাকতে পারে এটাই আমরা জানলাম মাত্র দুই বছর আগে। কিন্তু একটা জিনিস এখনই আমরা বুঝতে পারছি যে, সময়-স্ফটিক যেহেতু কক্ষ তাপমাত্রায় পাওয়া গেছে, তাই এটিকে ব্যবহারিক জীবনে কাজে লাগানো অনেক সহজ হবে। বিশেষ করে কোয়ান্টাম পদার্থগুলো নিয়ে আমরা যখন কাজ করি, এঁরা সবক্ষেত্রেই অস্তিত্বশীল হয় মিলি-কেলভিন বা ন্যানো-কেলভিন তাপমাত্রায় (শূন্যেরও ২৭২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে), যে কারণে এদের সাধারণ কোন টেকনোলজিতে সরাসরি ব্যবহার করা যায় না। একই সমস্যা কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরিতেও, বেশিরভাগ কিউবিট (কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের অংক কষার একক) আমরা তৈরি করতে পেরেছি এরকম আল্ট্রা-কোল্ড বা চরম-শীতল তাপমাত্রায়, যেটা দৈনন্দিন কম্পিউটার তৈরির জন্য এখনও উপযোগী না। কিন্তু সময়-স্ফটিক যেহেতু কক্ষ তাপমাত্রায় পাওয়া কোয়ান্টাম পদার্থ (যে সরাসরি কোয়ান্টাম জগতের ধর্ম প্রকাশ করে), সুতরাং একে ভবিষ্যতে কিউবিট তৈরিতে ব্যবহার করতে কোন বাঁধা নেই।

কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের কথাই যখন উঠল, তখন সময়-স্ফটিক আরেকটি সমস্যা সমাধানেও আমাদের সাহায্য করতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন। কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের একটি বড় চ্যালেঞ্জ হল, কিউবিট যখন কোন একটা অংক কষে উত্তর বের করে রাখল, তখন সেই উত্তরকে কিউবিটে ধরে রাখা এবং উদ্ধার করা। কিউবিটের কোয়ান্টাম স্টেট অসম্ভব সংবেদনশীল এবং ক্ষণস্থায়ী বলে এখান থেকে সবসময় সঠিক তথ্য উদ্ধার করা খুবই কঠিন একটা কাজ। এখানে সময়-স্ফটিক আমাদের ত্রাণকর্তা হয়ে আসতে পারে, কারণ উপরে যেমন বললাম, সময়-স্ফটিক যখন একটা দশায় যায় সে তখন রিজিডিটি ধর্ম প্রদর্শন করে, মানে হল বাইরে থেকে হালকা-পাতলা ধাক্কাধাক্কি করলেও সে তার নিজের অবস্থা থেকে নড়াচড়া করে না। সুতরাং সময়-স্ফটিক দিয়ে তৈরি কিউবিটও অন্যান্য কিউবিট থেকে অনেক স্থিতিশীল এবং দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার কথা। শুধু কিউবিট না, অন্যান্য যে কোন ব্যবহারিক প্রযুক্তিতে যেখানে চরম সংবেদনশীল এবং ক্ষণস্থায়ী কোয়ান্টাম পদার্থ নিয়ে কাজ করা হয় (যেমনঃ super-precise sensors), এমন সব জায়গাতেই সময়-স্ফটিকের ব্যবহার প্রযুক্তির চেহারা বদলে দিতে পারে।

অনেক বকবক করলাম, আজকের মতো বিদায় নেই। বিদায় বেলায় সময়-স্ফটিকের গল্প শেষ করব ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইন্সটিটিউটের বিজ্ঞানী রডেরিক মজেনার এর কথা দিয়ে, “বিজ্ঞানের সবচেয়ে দারুণ ব্যাপার মনে হয় এটাই, যখনই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের এক একজন অনুসন্ধানী মানুষ একে অপরের চিন্তা আর কল্পনার সুতো জোড়া দিতে থাকেন, তখনই আমরা দেখি প্রকৃতিতে একটা একটা করে নতুন পদার্থ, নতুন সূত্রে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। সময়-স্ফটিকের অস্তিত্ব আবারও সেটাই প্রমাণ করলো।”

- বাহাউদ্দীন (১৪ ডিসেম্বর, ২০১৭)
(উৎসর্গঃ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সকল বুদ্ধিজীবী এবং তাঁদের পরিবার)

পরিশিষ্টঃ

১। এখানে ব্যবহৃত প্রত্যেকটি ছবি আমার নিজের বানানো, যে কেউ অন্য কাউকে বুঝানোর কাজে ব্যবহার করতে পারেন। অনুমতির দরকার নেই।

২। বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও এরকম লেখাই ইচ্ছা করেই কিছু অতি-সরলীকরণ করা হয়েছে। বিচক্ষণ পাঠক ভুল-ত্রুটি পেলে অবশ্যই ধরিয়ে দিবেন।

৩। সময়-স্ফটিক নিয়ে আরও ভালোমতো জানার লিংকঃ
https://physics.aps.org/articles/v10/5
https://www.nature.com/news/the-quest-to-crystallize-time-1.21595
F. Wilczek, “Quantum Time Crystals,” Phys. Rev. Lett. 109, 160401 (2012).
S. Choi et al., “Observation of Discrete Time-Crystalline Order in a Disordered Dipolar Many-Body System,” arXiv:1610.08057.
J. Smith, A. Lee, P. Richerme, B. Neyenhuis, P. W. Hess, P. Hauke, M. Heyl, D. A. Huse, and C. Monroe, “Many-body Localization in a Quantum Simulator with Programmable Random Disorder,” Nature Phys. 12, 907 (2016).


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

চরম!!!!! সময়-স্ফটিকের কম্পাংক, সেটা কি ‌রেন্ডমলি যেকোন একটা হয়, নাকি হিসাব করে বের করা যায়? আর সময় স্ফটিকতৈরী হওয়ার পর বললেন যে ২টা লেজারের কম্পাংক চেন্জ করে দিলেও স্ফটিকের কম্পাংকের চেন্জ হয়না, তার মানে কি কোনো কম্পাংক না দিলেও সময়-স্ফটিক চালু থাকছে?

----কৌতুহলী

বাহাউদ্দীন এর ছবি

প্রশ্নের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।

১ম লেজার রশ্মির কম্পাংক যদি হয় f, তাহলে সময়-স্ফটিকের কম্পাংক হবে f/n, উল্টো করে বললে, ১ম লেজার রশ্মি যদি T সময়ে একবার আন্দোলিত করতে চায়, তবে দেখা যায় সময়-স্ফটিক আন্দোলিত হচ্ছে nT সময়ে, যেখানে n = পূর্ণ সংখ্যা। n এর মান কত হবে সেটা নির্ভর করে এক্সপেরিমেন্টের অন্যান্য বিষয়াদির উপর। এটার উপর নরম্যান ইয়াও এর থিওরি পেপার আছে যেখানে তার গ্রুপ সূত্র বের করে দেখিয়েছেন কোন ক্ষেত্রে কত কম্পাংক হবে, কত বেশি কম্পাংক এদিক সেদিক করলে একসময় সময়-স্ফটিকের দশা ভেঙ্গে পড়বে ইত্যাদি।

সময়-স্ফটিক তৈরী হওয়ার পর একটা নির্দিষ্ট মাত্রার মধ্যে কম্পাংক পরিবর্তন করলেও স্ফটিকের কম্পাংক একই থাকে। কিন্তু পরিবর্তন খুব বেশি হয়ে গেলে তখন আর থাকবে না (খুব বেশি বলতে একবারে কমিয়ে আনলে (বা থামিয়ে দিলে), বা অনেক বাড়িয়ে দিলে)।

সত্যপীর এর ছবি

দারুণ।

নিকট অতীতে পদার্থবিদ্যার জটিল কিমোনো খুলে আপনি এবং জনৈক সাক্ষী সত্যানন্দ চমৎকার বুঝিয়ে চলেছেন। সত্যানন্দ অবশ্য এখন অত্যাধিক বিজি, এসো কোয়ান্টামের রাজ্যে টাইপ সিরিজ আবার কবে আসবে আল্লাই মালুম। যাক সে আসতে থাকুক, ইতোমধ্যে আপনি সময় করে লিখে চলুন।

আর দুইটা লেখা দেন এরপর আপনার সচলত্বের সুপারিশে হরতাল ডেকে দেশ অচল করে দিব। (হরতালের দিনক্ষণ ঈদের পরে জানানো হবে)

..................................................................
#Banshibir.

বাহাউদ্দীন এর ছবি

মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। হাসি

হ্যাঁ, সাক্ষীর লেখার হাত দারুণ। আমি নিজেও পড়ে অনেক উপকৃত হয়েছি। আমার পক্ষ থেকে চেষ্টা থাকবে আরও কিছু বিষয় নিয়ে লেখার।

লিখতে আসলে অনেক ভালো লাগে, কিন্তু আলসেমির জন্যই হউক বা অন্য কোন কারণেই হউক, সময় করে লেখা দেয়া হয় না, মাথায় থাকতে থাকতেই একসময় হজম হয়ে যায়। হরতালে সংহতি জানালাম দেঁতো হাসি

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

হাচলত্বের শুভেচ্ছা + বিজয় দিবসের আগাম শুভেচ্ছা। লিখুন হাত খুলে। হাসি

অটঃ পড়ে নিই, পোস্ট নিয়ে পরে মন্তব্য করব!

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

বাহাউদ্দীন এর ছবি

অবশ্যই, পড়ে জানাবেন কেমন লাগলো। আপনাকেও বিজয় দিবসের আগাম শুভেচ্ছা হাসি আপনার কোয়ান্টাম মেকানিক্স নিয়ে লেখাগুলো পড়লাম, এক কথায় দারুণ! অনেক কিছু আরও সহজ করে চিন্তা করতে সাহায্য করেছে।

কর্ণজয় এর ছবি

গভীর মনোযোগ এবং গভীর আনন্দ নিয়ে পড়লাম। জটিল বিষয়গুলোকে সহজ সাবলীল ভাষায় ছবির মতো প্রকাশ করার অসাধারণ ক্ষমতা আপনার।
লেখাটি আমি শেয়ার করেছি। ফেসবুকে। শেয়ার করার সময় নিজে কিছু কথা লিখেছি।
আপনার জন্য, সেটি একটু জানিয়ে রাখার জন্য তুলে দিলাম
---------------------------------------
আমরা নিজেদের পদার্থরূপেই প্রমাণ করিতে চাই। নিজের মত, নিজের জাতি, দেশ, ধর্মই একমাত্র পদার্থ হিসেবে স্বীকার করিয়া অন্য, ভিন্ন সবকিছুকে অপদার্থ প্রমাণ করিতে উদগ্রীব হইয়া উঠি।
পদার্থ হিসেবে আমরা কী করিতে পারি, আর অপদার্থ হইয়া তোমরা কী করিতে পারো না তাহার বিবরণ সাত সমুদ্র তের নদী পার হইয়া মহাবিশ্বের পানে ছুটিয়া বেড়ায়। আকাশের গ্রহরাশি, নক্ষত্ররাজি, ধূমকেতু আমরা যে মহাপদার্থ তাহার ঘোষণা হইয়া জ্বলজ্বল করিতে থাকে।
যে পদার্থ  অপদার্থ লইয়া আমাদিগদের যে আস্ফালন সেই পদার্থ অপদার্থ বিজ্ঞানের বিষয় আশয় লইয়া আমাদের জ্ঞান নিতান্তই গ্যাসীয় পর্যায়ে বিরাজমান।
এই উদাহরণটিও একটু গ্যাসীয় হইয়া উঠিল। কঠিণ হইলেই পদার্থ হইবে, তরল হইলেই তা অপদার্থ হইয়া উঠিবে আর গ্যাসীয় বা বায়বীয় হইয়া উঠিলেই তা ভূতলোকের হইয়া উঠিবে এমনতর ভাবনা আমাদের মনে দিনে সূর্যের মতোন, রাত্রিরে চন্দ্রালোকের মতো উজ্বল হইয়া পথ দেখাইয়া নিয়া যায়। সেই পথে যে বায়ু প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় বায়ু পদার্থ হইয়া আমাদের পদার্থ বানাইয়া দিতে ঘনাইয়া আসিতে পারে তাহা ভুলিয়া যাই।
আমরা ভুলিয়া না গেলে স্মরণ করিতে পারি, ১৯৭০ সালের সেই বায়ু পদার্থের কথা- যাহার স্পর্শে লক্ষ লক্ষ বাঙালী প্রাণ দিয়া চোখে আঙুল দিয়া বুঝাইয়া দিয়াছিল- পাকিস্তানের সরকার আমাদের অপদার্থ ভাবে। নিজেদের পদার্থ প্রমাণ করিতে আরো ৩০ লক্ষ মানুষের জীবন দিতে হইয়াছিল। আমরা স্বাধীন হইয়াছিলাম।
কিন্তু আজো কি আমরা নিজেদের পদার্থ প্রমাণ করিতে পারিয়াছি? দেশের ও নিজেদের দিকে তাকাইলে সহসা তা প্রমাণ হয় না।  অবশ্য কি সে এটা প্রমাণ হইবে আর কিসে যে উহা অপ্রমাণিত হইবে তা বলা দুষ্কর। এই দুষ্কর কাজটি করিতে গেলে আমাদের পদার্থবিদ্যা সম্পর্কে খানিকটা জ্ঞান অর্জন করিতে হইবে। কিন্তু পদার্থ বিজ্ঞানের সুকঠিন আস্তর খসাইয়া এর ভেতরে প্রবেশ করিতে হিম্মত থাকা চাই।
বাহাউদ্দীন সাহেবের বইখানি খানিকটা হিম্মত জোগাইবে। বড় স্বাদু ভাষায় তিনি পদার্থ বিদ্যার সুকঠিন আস্তর খসাইয়া আমাদের মধ্যে এক রকমের আস্থা জন্মাইয়া দিয়াছেন, পদার্থ অপদার্থ লইয়া আরও শক্তি আর উন্মাদনার সহিত ঝাঁপাইয়া পড়া যাইবে।
জয়তু পদার্থবিজ্ঞান 

বাহাউদ্দীন এর ছবি

মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ! কঠিন জিনিস লিখতে গিয়ে আসলে নিজেও অনেক কিছু শেখার সুযোগ পেয়েছি হাসি

আপনার নিজের কথাগুলো পড়ে অসম্ভব ভালো লাগলো। অনেক অনুপ্রাণিত হলাম। সামনে আরও লেখার চেষ্টা করবো।

হিমু এর ছবি

চমৎকার!

সময়-স্ফটিকের জন্যে কি কোনো বহিরান্দোলক বা "বিদেশি শক্তি"কে (উদাহরণের লেজার রশ্মি বা মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গ) সবসময় ফুঁ দিয়ে যেতে হবে? নাকি একটা পর্যায়ে গিয়ে ওটা সরিয়ে নিলেও ঐ কালিক-প্রতিসাম্য একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত জারি থাকবে (আমি সরল দোলকের প্রতিকল্প দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছি)?

অর্ধপ্রাসঙ্গিক নোট: শব্দদুটো কনটিনিউয়াস অর্থে নিরবচ্ছিন্ন (নয় অবচ্ছিন্ন) আর ডিসক্রিট অর্থে বিচ্ছিন্ন হবে সম্ভবত। "নিরবিচ্ছিন্ন" শব্দটা অভিধানে নেই, নিরবচ্ছিন্নের ভুল প্রয়োগ হিসেবে এখানে-ওখানে আছে (অনেকটা জনসমক্ষে যেভাবে পাল্টে জনসম্মুখে হয়ে গেছে)।

বাহাউদ্দীন এর ছবি

মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।

বিদেশি শক্তিকে সবসময় ফুঁ দিয়ে যেতে হবে, না হলে অ-সাম্যাবস্থা ধরে রাখা যাবে না (যেটা সময়-স্ফটিকের পাওয়ার শর্ত)। এইটা অনেকটা চুলোয় রাখা গরম পানির মতো, সারাক্ষণ ফুটছে, এবং এই রকম ফুটন্ত অবস্থায় একটা নতুন দশা বের হয়ে আসছে যেটা আসলে বাষ্পও না, পানিও না, অন্য কিছু। চুলো বন্ধ করে দিলে দেখা যাবে জিনিসটা আর নেই, তখন হয় পানি, না হয় বাষ্প পাওয়া যাবে, কিন্তু ওই "অন্য কিছু"টা আর পাওয়া যাবে না! এইটা আসলে আমাদের চেনা-জানা জিনিস দিয়ে বোঝা যাবে না, কারণ এরকম জিনিস আমাদের আশেপাশে নেই। এই লেখার উদ্দেশ্যই হল এমনতর অদ্ভুতুড়ে জিনিস যে থাকতে পারে সেটা জানানো!

বানান ভুলের জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত। অনেক অনেক ধন্যবাদ সংশোধন জানানোর জন্য। আমি ঠিক করে নিচ্ছি।

হাসিব এর ছবি

চমৎকার পোস্ট। আরো লিখুন।

বাহাউদ্দীন এর ছবি

অসংখ্য ধন্যবাদ! হাসি অনুপ্রাণিত হলাম হাসি

রাহামাং  এর ছবি

অসাধারণ লিখা ভাইয়া। এত সুন্দর করে কিভাবে লিখিস!? হাসি
*হ্যাটস অফ*

বাহাউদ্দীন এর ছবি

থেনক্যু থেনক্যু লইজ্জা লাগে

Ashik Irfan এর ছবি

বাংলাদেশে এর মতো দেশে যেখানে অধিকাংশ মানুষ বিজ্ঞান-বিমূখ, সেখানে এই টাইপের লিখা অতি কাঙ্ক্ষিত।

বাহাউদ্দীন এর ছবি

মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ, বন্ধু হাসি

সুজন চৌধুরী এর ছবি

খুব ভাল লাগলো পড়ে। মনে হলো আমিই বুঝতে পারছি ! এরকম আরো লেখা পেলে অন্তত আমার অনেক উপকার হয়,একেবারে অজানা বিষয়ে কিছুটা ধারণা তৈরী হয়। অনুগ্রহ করে আরো লিখবেন এরকম।

বাহাউদ্দীন এর ছবি

অসংখ্য ধন্যবাদ, পাঠক সহজ বাংলায় বুঝতে পারলেই এই লেখা সার্থক! হাসি অনুপ্রাণিত হলাম!

Apon Jon এর ছবি

মিশা লুকিন লোকটা মানুষ না মেশিন আমি মাঝে মাঝে ভাবি

বাহাউদ্দীন এর ছবি

ফাটাফাটি স্মার্ট একজন ফিজিসিস্ট গুরু গুরু

এক লহমা এর ছবি

সবটা আমার বুঝ-এর মধ্যে আসার নয়। যতটুকু বুঝতে পেরেছহি, খুব ভাল লেগেছে।
সাক্ষীর সুরে সুর মিলিয়ে বলি - হাচলত্বের শুভেচ্ছা + বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা। লিখুন হাত খুলে।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

বাহাউদ্দীন এর ছবি

মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ। যেটুকু বুঝতে পেরেছেন সেটুকু আপনার কৃতিত্ব, যেটুকু বুঝেন নি সেটা আমার বুঝানোর ঘাটতি (এইটা বিজ্ঞানী ফেইন্ম্যান সাহেবের কথা, আমি খুব চেষ্টা করি এটা অনুসরণ করতে)।

আর সব কিছু বাদ দিয়ে শুধু এভাবে ভাবুনঃ মনে করুন, আপনি একবার চুলা বন্ধ করছেন, আবার ছাড়ছেন, আবার চুলা বন্ধ করছেন, আবার ছাড়ছেন, এভাবে পানি গরম করছেন। এভাবে এক সময় পানি অনেক গরম হয়ে গেলো, যেন বলগ উঠছে। এমন সময় আপনি পানি নাড়াতে শুরু করলেন, হঠাত দেখলেন, পানি আর পানি নেই, অন্য কিছু হয়ে গেছে, মানে পানির হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেন ঠিকই আছে, কিন্তু হাইড্রোজেন-অক্সিজেন মিলে যে পানি তৈরি করতো, সেই স্ট্রাকচারটা আর নেই। এমন কি নতুন স্ট্রাকচারটা বাষ্পও না বা বরফও না। সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু। সেই স্ট্রাকচারটা আবার সময়ের সাথে সাথে হৃৎপিণ্ডের মতো স্পন্দন করে। এই জিনিসটাই হল টাইম ক্রিস্টাল।

এখন আপনি যদি চুলার তাপ আগে যেভাবে কম বেশি করছিলেন, এখন তার থেকে একটু অন্যভাবেও করেন, বা পানি যেভাবে ঘুটা দিচ্ছিলেন, সেটা যদি আগের থেকে একটু জোরে বা আস্তেও ঘুটান, দেখবেন, টাইম-ক্রিস্টাল ঠিকই আছে, ওইটার কিছু হয় নি (রিজিডিটি ধর্ম)। কিন্তু আপনি যদি একবারে ঘুটা দেয়া বন্ধ করে দেন, বা খুব খুব বেশি জোরে ঘুটা শুরু করেন, দেখবেন, টাইম-ক্রিস্টাল নষ্ট হয়ে গেছে। একইভাবে যদি চুলা পুরোপুরি বন্ধ করে দেন, কিম্বা তাপ খুব বেশি বাড়িয়ে দেন তাহলেও দেখবেন টাইম-ক্রিস্টাল নষ্ট হয়ে গেছে (পানি যেভাবে বেশি তাপে বাষ্প হয়ে যায় বা তাপের অভাবে বরফ হয়ে যায়)।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

প্রথমে হাচলাভিনন্দন! অনেক দিন পরে লিখলেন। লেখা মাথায় হজম হবার আগেই প্লেটে ঢেলে ফেলুন, তাতে পাঠককুল উপকৃত হয়।

আমার একেবারে তীরে এসে তরী ডুবলো! মানে, ক্রিস মনরো গ্রুপ আর লুকিন গ্রুপের পরীক্ষণে এসে গোলমাল লেগে গেলো!

পরীক্ষণটিতে অতিশীতল তাপমাত্রায় পরমাণুশৃঙ্খলকে (নাকি অণুশৃঙ্খল?) একটি নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কের (f1) লেজার রশ্মি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে সমকম্পাঙ্কে আন্দোলিত করা হলো। এখন সবিরাম দ্বিতীয় ধাক্কাটি (f2) যখন আসলো তখন প্রথম ধাক্কা + পরমাণুগুচ্ছ’র সমআন্দোলন বাধাগ্রস্থ হয়ে একটা সাময়িক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলো। এরপর পরমাণুগুচ্ছ যে তৃতীয় কম্পাঙ্কে (f3) আন্দোলিত হয় সেটি কি নিউটনীয় বলবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রের বয়ানের লদ্ধি বল ও তার অভিমুখের ধারণার সাথে মিলে যায় না? যদিও পদার্থের এই পর্যায়ে নিউটনীয় বলবিদ্যা কাজে আসার কথা না।

প্রশ্ন হচ্ছে, দ্বিতীয় ধাক্কাটিও কি বিরামসহ অবিরত?

আমি যা বুঝতে পারছি তাতে দুটো ধাক্কাকেই চালিয়ে যেতে হবে – প্রথমটা নিরবচ্ছিন্নভাবে, দ্বিতীয়টা বিরতিসহ। প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে এমন ধাক্কার যোগানসহ ব্যবস্থাটির কি প্রকৃতিতে স্বাধীন অস্তিত্ত্ব থাকা সম্ভব? হলে তা কীভাবে?

আরও প্রশ্ন হচ্ছে, পরীক্ষণে —

১. একটি বিশেষ মৌলের পরমাণুগুচ্ছ প্রথম দুটি ধাক্কার কম্পাঙ্ক ও তরঙ্গদৈর্ঘ্য নির্বিশেষে কি সবসময়ে অভিন্ন (বা তার গুণিতক) লদ্ধি কম্পাঙ্কে আন্দোলিত হয়?
২. লদ্ধি কম্পাঙ্ক কি এক মৌল থেকে আরেক মৌলে পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়?
৩. সুনির্দিষ্ট মৌলের পরমাণুর বদলে বিভিন্ন মৌলের পরমাণু অথবা যৌগের অণু নিলেও কি পরীক্ষণটি একই প্রকারের ফল দেবে?
৪. সাধারণ দৃশ্যমান জগতের বস্তু দিয়ে কি এমন পরীক্ষণ সম্ভব?


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

বাহাউদ্দীন এর ছবি

অসাধারণ, বিজ্ঞানে প্রশ্নোত্তর থেকে দারুণ আর কিছু নেই। অনেক অনেক ধন্যবাদ প্রশ্ন করার জন্য।

আমি পরীক্ষার অংশটা অতি সরলীকরণ করতে গিয়ে মনে হয় গুলিয়ে ফেলেছি। আমি বিশুদ্ধ বৈজ্ঞানিক ভাষায় পুরো বাপারটা বলি, আশা করি আপনার সব প্রশ্নের উত্তর পাবেন।

> এখানে যে লেজার রশ্মি ব্যবহার করা হয় সেটা হল পালসড লেজার বীম। মানে বিচ্ছিন্ন (বা বিরতি) লেজার রশ্মি।

> আসলে অণু-পরমাণু মুখ্য কিছু না, যেই জিনিসটাকে লেজার রশ্মি দিয়ে স্পন্দন করানো হয় সেটা হল অণু বা পরমাণুর স্পিন। এই স্প্লিনের সাধারণত দুইটা স্টেট থাকেঃ স্পিন আপ এবং স্পিন ডাউন। এখন সঠিক কম্পাংকের লেজার রশ্মি দিয়ে আঘাত করলে স্পিন আপ থেকে স্পিন ডাউন হয়ে যায় (ডাউন থেকে আপ হয়ে যায়)।

> প্রথম লেজার রশ্মিটা এরকম সঠিক কম্পাংকে টিউন করা। সেটা পালসড বলে, এটা একবার পরমাণুগুলোর স্পিনকে আপ করে, আবার পরের বার ডাউন করে, এভাবেই চলতে থাকে। এবং স্পিনগুলোও যখন পালস আসে কেবল তখনই স্টেট পরিবর্তন করে।

> দ্বিতীয় লেজার রশ্মিটাও পালসড কিন্তু টিউন করা না। ফলে এই লেজারের সাথে কোন স্পিন কিভাবে বদলাবে সেটা বলা যায় না। বিশেষ করে হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার সূত্র অনুযায়ী স্পিনরা কিভাবে আচরণ করবে সেটা অনেকটাই কয়েন ফ্লিপ করার মত, প্রবাবলিটি দিয়ে ধারণা করা যায়, কিন্তু কোনটা কোন এক সময় ঠিক কি করবে সেটা কোন ভাবেই বলা সম্ভব না। এই লেজার রশ্মিটাই সিস্টেমে দরকারি বিশৃঙ্খলা আনে। এবং বিশৃঙ্খলা আসলেই তখন স্পিনরা নিজে নিজে কথাবার্তা শুরু করেঃ এটাকে বলে ম্যানি বডি এফেক্ট (বহু সত্ত্বার সম্মিলিত প্রভাব)। এভাবে সিস্টেম একটা প্রতিসাম্য খুঁজে দশায় পৌঁছানোর চেষ্টা করে। এই ক্ষেত্রে যেটা হয়, সেটা হল স্পিন গুলো আপ-ডাউনের মধ্যে স্পন্দিত হতে থাকে, কিন্তু এই স্পন্দনের কম্পাংক প্রথম বা দ্বিতীয় লেজার কোনটারই সাথে মিলে না, এমনকি এদের লব্ধি যোগফল বা বিয়োগফলের সাথেও না।

এবার আপনার প্রশ্নের উত্তরঃ

- প্রথম এবং দ্বিতীয় দুইটি ধাক্কাই বিরামসহ অবিরত (কন্টিনিউয়াস পালসড লেজার)।
- এমন ধাক্কা প্রকৃতিতে সহজে পাওয়া যায় না, কিন্তু প্রকৃতি বড় অদ্ভুত। খুবই অর্ডারড সিস্টেমের মধ্যে ন্যাচারালি এটা তৈরি হতেও পারে (যেমন নিউট্রন স্টার)। এক্সপেরিমেন্টে লেজার রশ্মি ব্যবহার করা হয়েছে বাহ্যিক সব ঝামেলা থেকে দূরে থাকার জন্য, কিন্তু সত্যি বলতে যে কোন টিউনড শক্তির উৎসই এই জিনিস তৈরি করতে সক্ষম।

আরও প্রশ্নের আরও উত্তরঃ
১। না, প্রথম ধাক্কাটি এমন হতে হবে যেন স্পিন স্পন্দনের সাথে টিউনড হয়। দ্বিতীয়টি এমন হতে হবে যেন টিউনড না হয়। এই শর্ত পূরণ হলে তখন একটি বিশেষ মৌলের পরমাণুগুচ্ছ সবসময় একই কম্পাঙ্কে (বা তার গুনিতক) আন্দোলিত হবে।
২। হ্যাঁ, মৌল পরিবর্তন হলে যদি সেই অনুযায়ী স্পিন বদলানোর শর্তগুলো বদলে যায়, তখন এক মৌল থেকে আরেক মৌলে পরিবর্তনের সাথে সাথে সময় স্ফটিকের কম্পাংক পরিবর্তিত হবে।
৩। হ্যাঁ, টাইম ক্রিস্টাল তৈরি হবে। তবে তৈরির কম্পাংক (লেজার রশ্মি দুটোর) এবং সময়-স্ফটিকের নিজস্ব কম্পাঙ্ক হয়ত ভিন্ন হবে।
৪। এটা আসলে একটা কোয়ান্টাম এফেক্ট। কোয়ান্টাম এফেক্ট মূলত পাওয়া যায় মাইক্রো-ন্যানো-পরমাণুর জগতে। সাধারণ দৃশ্যমান জগত হল ম্যাক্রো ওয়ার্ল্ড। এখানে কোয়ান্টাম এফেক্ট সরাসরি পাওয়া যায় না। এজন্যই হয়ত এতদিন আমরা সাধারণ দৃশ্যমান জগতে সময় স্ফটিকের মতো কিছু দেখিনি। কিন্তু এক্সট্রিম কোন জায়গায় (নক্ষত্রের অভ্যন্তরে) বা অন্য কোন বিশেষ সিস্টেমে সাইড এফেক্ট হিসেবে সময় স্ফটিক তৈরির শর্ত পূরণ হতে পারে, যেখানে ন্যাচারালি হয়ত সময়-স্ফটিক পাওয়া যাবে।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। এবার বিষয়টা আমার কাছে আসলেই ক্রিস্টাল-ক্লিয়ার হলো। অনেক দিন ধরে লেখাপড়া থেকে বাইরে থাকার কুফল হলো সরল বাংলায় লেখা পদার্থবিজ্ঞান বুঝতে গিয়ে এক পর্যায়ে গোলমাল করে ফেলা। দোষ অতি অবশ্যই আমার। রূপের অসীম ভাণ্ডার পদার্থবিজ্ঞান থেকে দূরে থাকাটাই বোকামি।

অটঃ আচ্ছা প্ল্যাংকের ধ্রুবকের মান বাড়ানোর কি কোন কায়দা আছে? এখনো হয়নি কিন্তু ভবিষ্যতে হতে পারে এমন কোন কায়দা হলেও চলবে। আমার ধারণা প্ল্যাংকের ধ্রুবকের মান এই ধরুন ১ বা ২-এর মতো বিশা-আ-আ-ল সংখ্যা হলে দৃশ্যমান, স্পর্শযোগ্য প্রতিদিনকার দুনিয়ার জিনিসপত্র দিয়ে সময়-স্ফটিক বানানো সম্ভব হবে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

বাহাউদ্দীন এর ছবি

প্ল্যাংকের ধ্রুবকের মান মনে হয় না বাড়াইলেই ভালো হয়। ১,২ লাগবে না, এখন যা আছে (6.2618 x 10^-34 Joule-seconds) তার থেকে একটু বাড়ালেই (ধরা যাক 6.2618 x 10^-20 Joule-seconds (J*s)) সব পরমাণু থেকে ইলেক্ট্রন মুক্ত হয়ে যাবে, আবার একটা হাইড্রোজেন পরমাণুর সাইজ হবে আমাদের সৌরজগতের কয়েকগুণ বড়!

তবে বিজ্ঞানীরা এখন অনেক কাজ করছেন যে প্ল্যাংকের ধ্রুবক পুরো মহাবিশ্ব জুড়ে সব সময় একই কি না। দেখা যাক কি পাওয়া যায়। একই না হলে আজব আজব সব জিনিস বের হয়ে আসবে সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই!

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

এ রকম একটি লেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করি। চলুক

বাহাউদ্দীন এর ছবি

এরকম মন্তব্যের জন্য মনে হয় বার বার লেখার সাহস পাই হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।