সচলচিত্র : এক
ঠিক যেখানে খালটি মৃতপ্রায় নদীটির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সেই মোহনা হতে খালের অভিমুখে কিছু দূরে একটি রেলের সেতু। দৈর্ঘ্যে সেতুটি বড়জোড় ৩০-৩৫ ফুট হবে। খালের দুই পাড় বেয়ে চওড়া দুটি দেয়াল খাড়া উঠে গেছে লোকবসতির ভূমি হতে আরও কয়েক ফুট উচ্চতায়। দুই পাড়ের দেয়াল দুটির উপর ভর করেই রেললাইন চলে গেছে তার নির্দিষ্ট গন্তব্যে। সেতুটির নীচ দিয়ে আকাশমুখা তাকালে মনে হবে রেললাইন স্লিপার মিলে যে খোপের সৃষ্টি হয়েছে, একটি ফিল্ম বিছালেও একই রকম মনে হবে। এক একটি খোপ নাম ফ্রেমে দৃষ্টি দিলে ভিন্ন ভিন্ন ছবি দেখা যাবে। হয়তো কাছাকাছি কিন্তু নিশ্চিত ভাবেই একটি ফ্রেমের ছবির সঙ্গে অন্য খোপের ছবির পার্থক্য থাকবেই। সেতুটির উপর দাঁড়ালে একপাশে চোখে পড়ে দিগন্ত বিস্তৃত চওড়া মাঠ, অন্যপাশে ইটখলার চুল্লীর লৌহচোঙ। পড়ন্ত বিকেলে ঐ লৌহচোঙ এর পাশ দিয়ে সূর্য যখন ডুবতে থাকে, চোঙ এর মুখ দিয়ে নিসৃত ধোঁয়া আর লালরঙা সূর্য মিলেমিশে পশ্চিমাকাশে একচোখা দৈত্যের মত, বুঝিবা মনে হয় তাকিয়ে আছে এই বসতির দিকে। খালের পাড় বেয়ে দখখিণ দিক দিয়ে কিছুদূর গেলে একটি বাঁধানো ঘাট। পানি থেকে অনেকগুলো সিঁড়ি উপরে উঠে গেছে। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলে আপাত অর্থে যেটাকে মূলভূমি বলা যায়, সেখানে দেখা যাবে দুই পার্শ্বে দুটি বাঁধানো চত্ত্বর। চত্ত্বর দুটি আয়তাকার চারকোণায় একটি করে চারটি মোটা লোহার শিক। চত্ত্বরটির মাঝখানে খাঁজকাটা ড্রেনের মত, সেই সঙ্গে খালাভিমুখে নিম্নগামী। শ্মশান। এই শ্মশানের দোচালা ঘরের বারান্দায় একটি কাঠের খুঁটিতে হেলান দিয়ে, সদ্য জেগে ওঠা সূর্যের বিপরীতে অথচ সূর্যের দিকে বিষন্ন নয়ানে বসে আছে পড়ন্ত বয়সের এক পুরুষ। কয়লাবর্ণা গা, কাঁচাপাকা চুলদাড়ি, হাতে বিভিন্ন ধাতুর সমন্বয়ে গড়া কিছু চুড়ি, বামহাতে চিমটা লালসালু পরিহিত লিকলিকে মহাদেব। তার কপালে ঘামের চিকন রেখা। আজ ভোর থেকে সে এই দোচালা ঘরের বারান্দার খুঁটিতে হেলান দিয়ে সূর্যমুখা বসে আছে। ভোর থেকে কেননা তখনই জানতে পেরেছে, পশ্চিম পাড়ায় সনাতন ঘরের এক যুবক আত্মহত্যা করেছে। এতকাল সম্মুখ চত্ত্বরে চিতা সাজিয়ে অজস্র শবের প্রাপ্য শেষকৃত্য সম্পন্ন করেছে মহাদেব। শবের আবির্ভাব মানেই মহাদেবের অর্থসমৃদ্ধি। তবু যে শবের শেষকৃত্য আজ তার হাতে ন্যস্ত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, ঐ যুবাটির কথা ভেবে সে কিছুটা বিচলিত, ভারাক্রান্ত। ঐ যুবার সঙ্গে তার এক অপ্রচল সম্বন্ধ ছিল। কোনো কোনো পূর্ণিমায় ঐ যুবাটি চলে আসত এই শ্মশান ঘাটে। মহাদেবের চিমটা হাতে নিয়ে ঝনাত ঝনাত তাল ঠুকে গান ধরত, যে গানে প্রিয়জন চলে যাবার বেদনা কিংবা দেহের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পৃক্ততা প্রকাশ পেত। কখনও কখনও মহাদেবের হাত থেকে জ্বলন্ত কল্কে কেড়ে নিয়ে কয়েকপ্রস্থ টান দিয়ে আবার সুরের জগতে লীন হয়ে যেত। মাঝে মাঝে মহাদেব দেবস্তুতিমাখা সুরেলা শ্লোক উচ্চারণ করলে চিমটার ঝনাত ঝনাত শব্দে উতসাহ দিয়ে চলত। যুবাটি বলত,
: হেই মহাদেব, এত এত মানুষগুলারে আগুনে পোড়ায়া মিশায়া দিছ কোন অদেখা জগতে। ঐ অদেখা জগতই যদি মানুষের সত্য পরিণতি, তবে মানুষের জগতবাস কি প্রয়োজন! যদি অল্প কিছু সময়ের জন্যে আমাদের আগমণ তবে যা চাই তা পাই না ক্যান? ক্যান যারে প্রতিমা মানি সে চোখের সামনে অন্য ঘরে গিয়া ঢোকে? যে সুরের সাধনা করি তাও ক্যান আমার আঙুল ফস্কায়া অন্য কণ্ঠে বাজে? জানি সব পুরানা প্রশ্ন তবু ক্যান নয়া হয়া মান্দার গাছে গা ঘইস্যা নামে?
যুবাটির কণ্ঠ পূর্ণিমার চাঁদকে কখনও ছোঁয়নি। অনাদিকালের চিরন্তন এইসব প্রশ্ননাম কথকতা জোস্নাকে ফিকে করেনি মুহূর্তের জন্যেও। পুরানো চাঁদের নতুন জোস্নায় মানুষ চিরকাল মুগ্ধ নয়ানে ভেসেছে, বেঁচে থাকার কপালে পড়িয়েছে স্বার্থকতার টিকা। যুবাটির এতসব প্রশ্নে মহাদেব নিরুত্তর সবসময়। কল্কের টানে তার ভাবনা জগতও কিছু টলায়মান কিন্তু তীক্ষ। অজস্র শব পোড়ালেও প্রতিটি শবের সঙ্গে মহাদেব নিজেও পুড়েছে বৈকি। এতবার পুড়ে পুড়ে সুক্ষ অনুভূতির তন্ত্রীতে সহসা টঙ্কার জাগে না। তবুও কেন যেন ঐ যুবার আপাত কষ্টের বহিপ্রকাশে সে প্রতিবার কিছুটা যন্ত্রণা অনুভব করেছে, তবে তা মমতা সম্ভূত না করুণাজাত তার ধরবার মতা তার কোনোকালেই ছিলনা। ট্রেনের হুইসেলের শব্দে তার ভাবনার ঘোর কাটে। প্রতিদিনই সকাল ছ'টার ট্রেন আটটার দিকে পূর্বমুখা ছোটে। মহাদেব কখনও ঘড়ি ব্যবহার করেনি। তাঁর সময়যাপন এইসব যান্ত্রিক ঘোটক আর প্রকৃতির বদলে যাবার লীলায় নির্ধারিত হয়। তবে আজ ঐ যান্ত্রিক ঘোটক 'ট্রেন 'মনে হয় প্রকৃত সময়েই উড়াল দিয়েছে নির্দিষ্ট গন্তব্যে। ট্রেনটি যখন ফেরে তখন দুপুর সাড়ে বারো থেকে একটার মত বেজে যায়। আবার সন্ধ্যা সাড়ে ছ'টার দিকে পূর্বমুখা ছুটবে, এগারো কি বারোটার দিকে ফিরবে এই বসতির স্টেশানে। কিন্তু আজ এইসব সময়বৃত্ত পূর্ণ হবে না। শুরুর সঙ্গেইতো শেষ প্রাপ্তির ফলাফল নির্ভর করে থাকে। এইমাত্র পশ্চিমপাড়ার ঐ সনাতন বাড়ীর একলোক এসে খবর দিয়ে গেল মহাদেবকে, সন্ধ্যায় ঐ মৃত যুবার চিতা জ্বলবে।
সচলচিত্র : দুই
বেশ সকাল থেকে পশ্চিমপাড়ার এই বাড়ীতে লোকজনের সরব আনাগোনা। বাড়ী থেকে বের হলেই রেলপথ, পূর্ব-পশ্চিমে সমান দূরত্ব রেখে চলে গেছে, বুঝিবা মনে হয় অনন্তে। একজায়গায় দাঁড়িয়ে কিছু দূরে তাকালে মনে হবে রেলপথের দুটি লাইন মিশে গিয়ে একাকার। কিন্তু কেনা জানে এ এক দৃষ্টিবিভ্রম ছাড়া কিছুই নয়। জীবিত আর মৃত পাশাপাশি দুই পরিণতি, খুব নিকটবর্তী বলে মানি। কিন্তু এই বোঝার বিভ্রম কি জানে, পৃথিবীর সবকিছুতে শুধু জীবিতের অধিকার, মৃতের জন্যে শেষকৃত্য, শোকসঙ্গীত ছাড়া আর কিইবা থাকে!
ধীরে ধীরে পশ্চিমপাড়ার ঐ বাড়ীর অভিমুখে আশি বছরের বৃদ্ধ থেকে শুরু করে পাঁচ বছরের শিশু পর্যন্ত ধাবমান, যেন এক মানব স্রোতের ধারা তৈরী হয়েছে। প্রত্যেকের চোখে জল, কারো কারো কণ্ঠে শোকের মাতম।
যুবার নিঃসাড় দেহটি টিন দিয়ে তৈরী ঘরের বারান্দায় শায়িত। উপচে ওঠা ভীড়। ভীড় ঠেলে মানুষজন শেষবারের মত দেখে নিচ্ছে সম্ভাবনার অকাল প্রয়ান। কেউ কেউ অনতিদূরে স্থির দাঁড়িয়ে, হয়তো প্রথম সংবাদ শুনে অবিশ্বাস নিয়ে ঐ যুবাকেই জানাতে আসছিল তাকে নিয়ে ছড়ানো এই কাহিনীপুরাণ। কিন্তু এই সংবাদ মিথ্যে হয়নি, ঘটনার আকস্মিকতায় এ জন্যেই হয়তো এরা পাথরের মত দাঁড়িয়ে। কেউ কেউ মাতম জুড়ে দিয়েছে, ঐ মৃত যুবার সঙ্গে জীবিতকালের বিভিন্ন ঘটনার আবেগ জাগানিয়া বর্ণনায়। কেউ কেউ হয়তো আসবেই না, কেননা যে জীবন্ত স্মৃতি তাদের মানসজুড়ে জাগ্রত, তারা হয়তো তা ম্লান করতে চাইবে না। এক বৃদ্ধ কাঁদছে আর বলছে,
তোর কান্ধে চইর্যা না আমার শ্বশ্মানে যাওনের কথা আছিন,
কোন্ পরানে এই হাতে তোরে চিতায় চড়ামুরে, হায়!
এইড্যা তুই কি করলি?
বারান্দার বাম দিকে দরজা। দরজা দিয়ে ঘরের ভিতরে তাকালে অন্ধকার। ঐ ঘরের সিলিং আর কমলাবর্ণের দড়ি তার অন্তিমসঙ্গী হয়ে ওঠে। ঐ ঘরেই চলত সুরের সাধনা। প্রতি সন্ধ্যায় নীলবর্ণা আলো তার সঙ্গে সুগন্ধি ধোঁয়া। কখনও সিডি, কখনও সজীব উপস্থাপনা, কি বাউল, আধুনিক, রবীন্দ্র-নজরুল অথবা স্বরচিত। মুগ্ধ শ্রোতারা শুধু সুরের নির্যাসটুকু নিয়ে যেত নিংড়ে নিংড়ে, কিন্তু যে বাউলিয়ানা ঐ যুবার প্রতিবেশে, যে অতৃপ্তির অপার রণ তার সমস্ত সময় জুড়ে, ক’জন সেই অগম্য পথে হেঁটেছে বা হাঁটতে চেয়েছে? জানা নাই।
সন্ধ্যা হয়ে আসে। বেশ গরম আবহাওয়া। মৃত যুবার শরীর একটু ফুলে উঠেছে। এইতো শরীর গতকালও যত্নের পরশ নিয়ে টিকে ছিল, আর আজ চলনশক্তি রহিত দেহ, অযাচিত জীবানুর আক্রমণে পরাজিত প্রায়। মৃত যুবাকে চৌপায়া খাটে নিয়ে যে সমস্ত স্থানে তার শিল্পীত পদচারণা ছিল, শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যাত্রাপথে আশপাশের বাড়ী থেকে সশব্দ কান্নারা ভীড় করছে এই মৃত যুবকের লাশকে ঘিরে। এরপর চৌপায়া খাটের গন্তব্য নিশ্চিত শ্মশান।
সচলচিত্র : তিন
আম কাঠের চিতা সাজাচ্ছে মহাদেব। চারকোনায় চারটি লোহার মোটা শিক। এদের কেন্দ্র করেই এই কাঠের শয্যা। এই শয্যায় ফুলের পাপড়ি ছড়ানো নাই, নাই সুগন্ধি তরল, তবুও এ শয্যা কারো স্বপ্ন কিংবা আকাঙ্খার পরোয়া করে নাই কখনও, করবে না কোনোদিন। মহাদেব অপো করে কখন আসবে এই অগ্ন্যুতসবের প্রধান ব্যক্তি। মহাদেব চিমটা হাতে অস্থির পায়ে এদিক সেদিক হাঁটে। এক সময় মাটির কল্কে আগুন জ্বেলে তাতে দ্রুত টান দিয়ে নাক মুখ দিয়ে গলগল ধোঁয়া ছেড়ে দেয়। কিছুণের মাঝেই মহাদেবের দুচোখ টকটকে লাল হয়ে ওঠে। এমন সময় বধুয়া মেথর টলতে টলতে এসে শ্মশানে ঢোকে। বুধুয়া তার মুখ দিয়ে মদের গন্ধ ছুটিয়ে সেই সঙ্গে নিজ অদৃষ্টকে গালমন্দ করতে করতে মহাদেবের পায়ের কাছে বসে। মহাদেব নিরাসক্ত দৃষ্টিতে বুধুয়াকে দেখে আবার কল্কেতে মনোযোগী হয়। বুধুয়া খানিকণ উসখুস করে অতঃপর মহাদেবকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
: হেই মহাদেব, কি হইছেরে তোর? আইজ ক্যান তুই এমন উদাস হয়া আছস? তোর মনে তো কুনো কষ্ট থাকার কথা না। টিনের ঘরে থাকস, ঘরে কম বয়েসি বউ আছে, মাস গেলে ট্যাকা পায়া যাস, তুই ক্যান এই সব ছাই ভস্ব খাবি? এই আমার দিকে তাকায়া দ্যাখ, ছোড কাম করি, মাইনসের গু ফালাই, মদ খাই, কুনো রেইতে ঘরে ফিরি কুনো রেইতে ফিরি না। আমার লাইগ্যা কেউ নাই। এক মুনিয়া ছিল, সেও মরিয়া ভূত হয়া গেছে। মহাদেব, হেই মহাদেব।
মহাদেব নিরুত্তর। বুধুয়া আবারো চেষ্টা করে কথা জমাবার। কিন্তু মহাদেব কিছু বলে না। বুধুয়া আকাশমুখা মুখ উঁচিয়ে গান ধরে, যে গানে তার মুনিয়াকে হারানোর কথা, মুনিয়ার জন্যে তার হৃদয়ের ক্ষরণের কথা জেগে ওঠে,
ও মুনিয়া কোথায় গেলি
আমি একেলা ঘুড়িয়া বেড়াই
তুই ছাড়া এই মনেতে
আর কুনো শান্তি যে নাই
আরজনমে পাইলে তরে
দিতাম হায়রে কত আদর
কোন পরানে তুই গেলি হায়
ছাড়িয়া দিয়া এই অন্তর।
বুধুয়ার কণ্ঠ শ্মশানের নির্দিষ্ট গণ্ডী ছাড়িয়ে অনন্ত আকাশে লীন হয়ে যায়, ফিরে আসে না। গান গাইতে গাইতে বুধুয়া চিতকার করে ডুকরে কেঁদে ওঠে। বুধুয়া আকাশের কোনো এক তারার দিকে আঙ্গুল তাক করে বলে,
:হেই মহাদেব, তুই না কয়াছিলি মুনিয়া ঐ আকাশের তারা হয়া আছে, সে আমারে হগল সময় দেখতে পায়, কিন্তু আমি ক্যান তা বুঝতে পাইনা, ক্যান তারে স্বপ্নে দেইখে, ঐ দূরের তারায় বিশ্বেস কইরে শান্তি পাইনা। ক্যান ইচ্ছা করে এই বুকের মাঝে তারে পিইসে, তার গন্ধ নিয়া রক্তমাংসে পাইতে? ক্যান ইচ্ছা করে, ক্যান? ক্যান? হেই মহাদেব ক্যান তুই আমার সোনার মুনিয়ারে চিতায় চড়ায়া ঐ আসমানে পাঠায়া দিছস।
বলতে বলতে বুধুয়া মাটিতে গড়াগড়ি যায়, ফুঁপিয়ে কাঁদে। মহাদেব আস্তে করে উঠে গিয়ে বুধুয়ার মাথায় পিঠে হাত বুলোয়। মহাদেব ভাবে, বধুয়ার কত অজস্র সময়, কত অতৃপ্ত মুহূর্ত না পাওয়ার বেদনায় নিজেদের হত্যা করেছে। হয়তো প্রতিটি মানুষই এমনতরো প্রতিপরে মুখোমুখি হয়, জানে সে পরাজিত হবে তবুও কোন্ খেয়ালে, কিসের তাড়নায় সেই সব রণ জাগানিয়া চিত্রগুলোকে যুদ্ধে আহবান জানায়, এই রহস্য সে ভেদ করতে পারে না। এই চরাচরে আজ কেন যেন একটু দ্রুত রহস্যময়ী সন্ধ্যা নামে। ট্রেনের হুইসেলের শব্দে মহাদেব তার ভাবনার জগত থেকে ফিরে আসে, সাজানো চিতার সম্মুখে।
সচলচিত্র : চার
শববাহী চৌপায়া খাট সমেত একদল মানুষ মুড়ি-খৈ ছিটাতে, ছিটাতে আর 'হরি হরি বোলা' স্তোত্রে, সমস্ত প্রতিবেশ কাঁপিয়ে দিয়ে ঐ মৃত যুবার লাশ নিয়ে প্রবেশ করে এই শ্মশানে। শববাহী দলে তখনও মৃদু কান্নার রোল। ধীরে ধীরে ঐ মৃত যুবার ঘি মাখানো শরীর উপুর করে শুইয়ে দেয়া হল আম কাঠে সাজানো চিতায়। চিতায় অগ্নিসংযোগের পূর্বে আনুষঙ্গিক কৃত্যাদি সম্পন্ন করা হল। এবার মুখাগ্নি। মৃত যুবার জেষ্ঠ ভূবনভেদী চিতকারে শবের মুখে আগুনের তিলক পরিয়ে দিলেন। কয়েকজন তাঁকে সরিয়ে নিয়ে গেল শ্মশানের বারান্দায়। সেই বারান্দায় বসে জেষ্ঠ, গুঙিয়ে গুঙিয়ে কাঁদছেন। হয়তো তাঁর মনে ফেলে আসা দূরন্ত শৈশব উঁকি দিয়ে যাচ্ছিল। অনুজের নিষ্পাপ সেই মুখাবয়ব, কোলে চড়া, আবদার, অকারণ দুষ্টুমির যুগল হুেল্লাড় এতসব মনোগত দৃশ্যপাতে বুকের ভেতর আবেগের স্ফুরণ দ্রুত জেগে ওঠে, জেষ্ঠ বুক খামচে ধরে কাঁদেন। মানুষের এই অন্তিম পরিণতির মঞ্চায়ণ জীবিতদের ভেতর খানিকটা ভীতি আর অর্থহীনতার জন্ম দেয় হয়তো, নইলে সবাই নিশ্চুপ বসে থাকবে কেন! একটু পর মৃত যুবার এক বন্ধু অপ্রকৃতস্থ আচরণে বলে ওঠে 'ওকে পুড়ছো কেন!' আগুন তখন আকাশমুখা। মাঝে মাঝে ঘি আর ধূপ ছিটিয়ে আগুনকে উসকে দেয়া হচ্ছে। লম্বা বাঁশের লাঠি দিয়ে কাঠের টুকরোগুলোকে এদিক সেদিক করতে থাকা আর একজন হু হু করে কাঁদতে, কাঁদতে বলে, 'এইতো ইচ্ছা ছিল তোর, নে পুড়তে থাক।' বারান্দার একপাশে লালসালু পরিহিত নিশ্চুপ মহাদেব খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে আছে। আগুনের লাল আভা তার সমস্ত চোখেমুখে। মহাদেবকে জলন্ত কাঠকয়লার মত মনে হয়, মনে হয় সে নিজেও যেনবা পুড়ছে। একজনমে এইভাবে মহাদেব নিজে কতবার চিতায় উঠেছে তার সংখ্যা সে নিজেও জানেনা। বারান্দার মধ্যবর্তী স্থানে গানের আসর বসে। এক শুভ্র শশ্রুমণ্ডিত বৃদ্ধ গান ধরে,
হঠাত চলে গেলে
চাওয়ার কিছু নাই
শুধু তোমায় যেন আমি
চোখের সামনে পাই
কেননা ঐ স্মৃতি আমার
মৃত চোখে থাকবে লেগে
অনেক বিনিদ্র রজনী
কাটিয়েছি জেগে জেগে
আজ অনন্ত ঘুমে গেলেও
তোমায় না পাবার বেদনা
জেনে রেখো
এই চিতার সমান না।
বৃদ্ধের গানে চারপাশে জড়ো হয়ে থাকা মানুষগুলোকে আবেগাপ্লুত করে তোলে। কেউ কেউ সরবে ডুকরে ওঠে, কেই কেই নীরবে চোখ মোছে। বৃদ্ধ গায়েনের চোখেও জলের আভাস। একের পর এক গান গেয়ে চলে গায়েন। সময় গড়িয়ে চলে। মৃত যুবার শিষ্য বলে খ্যাত বালকটি অনেক অনুরোধেও কোন গান ধরে না। হয়তো এই অনাকাঙ্খিত আসরে গুরুর উদ্দেশ্যে সে কোনো সঙ্গীত ছুঁড়ে দেবে না, বড় অভিমানী সে। এক সময় শেষ হয় লাশ ঘিরে জেগে থাকা অগ্ন্যুতসব। আগুন স্তিমিত হয়ে আসে। সামনের পুকুর থেকে জল টেনে এনে ধোয়া হলো শরীর বিলীন করে দেয়া ছাই। কিছুণ আগেও যে শরীর দৃশ্যমান ছিল, এখন তা কোন্ সুদূরে, হাওয়ায় হাওয়ায় লীন। চারকোণার চার লোহার শিক হতে তখনও ধোঁয়া বের হচ্ছে। সবাই ফেরার আয়োজন করে, এমন সময় অদূরের মসজিদ থেকে দিনের প্রথম আযান ভেসে আসে।
সচলচিত্র : পাঁচ
সবাই ফিরে যাচ্ছে। সারাদিনের পরিশ্রমে কমবেশী ক্লান্ত। প্রত্যেকেই মাথা নীচু করে হাঁটছে। বড়দের কেউ কেউ সিগারেট ধরিয়েছে। ছোট যারা ধূমপায়ী একটু পেছনে একটু আড়াল রেখে তারাও সিগারেট ধরিয়েছে। কেউ কোনো কথা বলছে না। মাথার উপর শেষ রাতের মস্ত এক চাঁদ। পূর্ণিমা ছিল কিনা এ নিয়ে কারো মাথা ব্যথা নেই। চাঁদের আলোয় নিজেদের ছায়া সঙ্গে করে প্রত্যেকে ফিরে চলছে নিজ নিজ ঘরে। শুধু যে মানুষটি গতকালও ছিল সজীব, প্রাণোচ্ছল, যাকে এই কিছুণ আগে অগ্নিভেলায় ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে, তার জন্যে কোন গন্তব্য নাই, খাদ্য-বস্ত্র, জীবন নিমিত্ত উপার্জন, কাঙ্খিত নারীর হাতের পরশ, রোজ রাতে ঘরে ফেরার তাগাদা কোনো কিছুই আজ আর তার প্রয়োজন নাই, মৃতের জন্যে এসব কিছুই থাকে না, থাকবেনা কোনো কালে। মৃত যুবার শিষ্যটি হাঁটতে, হাঁটতে গুনগুন করে গান ধরে,
সোনাপাখি যায়রে উড়ে
আগুনডানায় ভেসে
একজীবনের ছোট্ট সফর
পূর্ণ হলো শেষে।
যাবার সময় রেখে গেল শুধু
হাজার স্মৃতিকথা
জীবনস্রোতে ভুলবে সবাই
এই হারনোর ব্যথা।
তবু জেনো পূর্ণিমাতে
মোদের সজল আঁখি
আকাশ পানে ডাকবে চেয়ে
সুরপাখি সুরপাখি।
গান শুনতে শুনতে সবার মনে হঠাত ভয় আর বিস্ময়ের দ্বৈত মাতম জাগে। কেননা চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখা যায়, গায়কের সঙ্গে চলমান ছায়াটি ঐ মৃতযুবার।
মন্তব্য
বর্ণ্দূত ভাল লাগল আপনার গল্প ।
নিবিড়
মার্কেজের একটা গন্ধ যেন কোথাও আছে...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
এই খুব সুন্দর গল্পটা পড়া হয়েছিল আগেই।
তুমি আমাকে জানিয়েছিলে ছাপা হওয়ার খবর, পরে আমি অফিস থেকে পত্রিকার ফটোকপি ক'রে বাসায় নিয়ে রসিয়ে রসিয়ে পড়েছিলাম। বলেছিলাম তখনও, কিন্তু লিখিত রূপে আজ আবার ব'লে গেলাম এখানে- বেশ সুন্দর এই গল্পটা।
আজকে সময়ের অনটনে আছি বড়। তাই আবার পড়া হ'লো না এটা আজ আর। তবু আগের পড়ার রেশটুকু মনে ক'রে সত্য আর সততায়ই বলছি, সুন্দর।
_ সাইফুল আকবর খান
বন্ধু,
আমাকে উতসাহ দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। ভালো থাকো।
নতুন মন্তব্য করুন