দৃশ্যমাধ্যমে সহিংসতা

বর্ণদূত এর ছবি
লিখেছেন বর্ণদূত [অতিথি] (তারিখ: শনি, ২২/১১/২০০৮ - ১২:১৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আদিমকালে পশু শিকার শেষে ফিরে আসা শিকারীরা, ডেরায় থাকা কিংবা শিকারে ব্যর্থ অন্যান্যদের কাছে অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে যে ঘটনার জন্ম দেয় তা থেকেই নাট্যের উদ্ভব বলে ধারণা করা হয়। শিকার করা পশুর রক্তাক্ত চামড়া গায়ে জড়িয়ে একজন পশুর রূপ ধারণ করেছে এবং সঙ্গীয় অন্য শিকারীরা সেই পশুকে শিকারের অভিনয় করছে। তারা বিভিন্ন অবস্থান থেকে উঠে এসে কল্পিত পশুটিকে ঘিরে ধরে বৃত্তাকারে। অতঃপর হাতের অস্ত্র নিয়ে শিকারের ওপর আক্রমণ চালানোর ভান। আদিম মানুষেরা যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে অনুকরণ প্রক্রিয়ায় এভাবেই অভিনয় এবং নাট্যের উদ্ভব ঘটায়। তারা ল্য করে, বিষয়টি থেকে এক ধরনের আনন্দ লাভ করা যায়। শিকারের সেই উপস্থাপনা নিশ্চিতভাবেই সহিংসতার ইঙ্গিতবাহী। পরবর্তী সময়ে আমরা জানতে পারি, প্রাচীন মিশরের অ্যাবিডাস প্যাশান প্লের কথা। সেই প্লেতে দেবতা অসিরিসের পুনর্জন্ম এবং কবরে ফিরে যাওয়ার বিষয়টি উপস্থাপিত হতো। পুনর্জন্ম ও পুনর্মৃত্যুর সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১৮ দিন ব্যাপী চলত উতসব। অ্যাবিডাসের রাজ প্রাসাদ থেকে বের হত শোভাযাত্রা। সেই শোভাযাত্রায় পুরোহিত, রাজন্যবর্গ, অভিনেতা, জনসাধারণ, কৃষক সকলেই থাকত। শোভাযাত্রার মাঝখানে থাকত অসিরিসের পুণ্য তরণী। যে তরণীতে করে তিনি শত্রু বিজয়ে বের হয়েছিলেন। এই তরণী বা নৌকাকে ঘিরে অসিরিসের অনুচরেরা চলত। শোভাযাত্রা খানিকটা এগিয়ে যাওয়ার পর শত্রুরা অসিরিসের নৌকা আক্রমণ করত নাটকীয় কায়দায়। নৌকা থেকেও প্রতিরোধ আসত। এইভাবে শোভাযাত্রা এগিয়ে যেত মন্দির পর্যন্ত। দ্বিতীয় পর্যায়ে অসিরিস মন্দির থেকে পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠতেন এবং তারপরই আবার কবরে ফিরে যেতেন। তখন সমবেত জনতার বিলাপ ও ক্রন্দনে মুখরিত হয়ে উঠত আকাশ। শোভাযাত্রা আবার রওয়ানা হত এবং পথে দুপক্ষের পরে মধ্যে যুদ্ধ বাধত। যুদ্ধে অনেক অভিনেতাই মারাত্মক আহত হতেন। এই অনুষ্ঠানে হত্যা করা হত প্রকৃত যুদ্ধবন্দীদের। প্রতি বছর নির্দিষ্ট সময়ে প্রাচীন মিশরে ধর্মীয় বাতাবরণে উপস্থাপণ করা হত এ নাট্যমূলক ক্রিয়া। আপামর জনগণ এ উতসবে যোগ দিত, তারা তা উপভোগ করত।

প্রাচীন রোমেও গ্লাডিয়েটর যোদ্ধারা একে অপরকে হত্যা করতো। যুদ্ধবন্দীদের বাধ্য করা হত এ ধরনের রক্তয়ী খেলায়। তাদের বাঘ কিংবা সিংহের সাথে লড়াই করতে হতো। আর রোমান রাজন্যবর্গ এবং সাধারণ মানুষ উপভোগ করতো সেই মরণপণ লড়াই। মানুষ হত্যা, রক্তপাত আর সহিংস লড়াই ছিল তখন বিনোদনের অন্যতম উপাদান। সহিংসতা বরাবরই বিনোদনের একটি বড় অংশ দখল করে ছিল। অর্থাত দৃশ্যমাধ্যমের উদ্ভবের সময় থেকেই সহিংসতা জড়িয়ে ছিল। আদিমকালের পশুশিকার দৃশ্য, মিশরের অসিরিস প্যাশন প্লে এবং পরবর্তী সময়ে রোমের গ্ল্যাডিয়েটরের লড়াই এসবকিছুতেই প্রত্য কিংবা পরোভাবে জড়িয়ে ছিল সহিংসতা কিংবা রক্তপাত। কিন্তু সেই সময় থেকে বর্তমান বিশ্ব অনেকদূর এগিয়েছে। মানুষ এখন নিজেকে অনেক বেশি সভ্য দাবি করছে। বিনোদনের খোড়াক হিসেবে সহিংসতার সেই সত্যযুগ হয়তো এখন আর নেই। কিন্তু তা থেকে কী খুব দূরে আমাদের বর্তমান বিনোদন মাধ্যমগুলো? আমাদের চলচ্চিত্র, কম্পিউটার গেমস কিংবা টিভিতে দেখানো রেসলিং'র কথা বিবেচনা করলে এ ব্যাপারে নতুন করে ভাবতে বাধ্য হতে হয়। সত্য নয় কিন্তু সত্যের আদলেই সহিংসতাকে ব্যবসার উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আর তার বেশি ব্যবহার ঘটছে আমাদের জনপ্রিয় বিনোদনমাধ্যমগুলোতে। ফলে দৃশ্যমাধ্যমে যেমন সহিংসতার ব্যবহার ঘটছে, দৃশ্যমাধ্যমও সহিংস হয়ে উঠছে।

বর্তমান বিশ্বে চলচ্চিত্র বা মুভি একটি বড় ব্যবসা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এবং স্বীকৃত। জনপ্রিয় সংস্কৃতিকে এখন পণ্য হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, আর তা থেকে অর্জিত হচ্ছে বিপুল মুনাফা। বিশ্বের অনেক দেশের রপ্তানি খাতে চলচ্চিত্র বা মুভি বড় অংশ দখল করে আছে। ২০০১ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় শুধুমাত্র চলচ্চিত্র বা মুভির পেছনে বিশ্বের মানুষ ১ হাজার ৪শ' কোটি আমেরিকান ডলার ব্যয় করেছে। তার মধ্যে খোদ আমেরিকাই অর্জন করেছে ৯শ' কোটি ডলার যা ১৯৯১ সাল থেকে বৃদ্ধি পেয়ে উন্নীত হয়েছে ৭৫ শতাংশে ।

আমেরিকার মিডিয়া কর্পোরেশনগুলো তাদের লভ্যাংশের অর্ধেকই অর্জন করে তাদের পণ্য বিদেশে বিক্রি বা রপ্তানির মাধ্যমে। বিশ্বের মানুষের জীবনযাপন উন্নত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সম্প্রসারিত হচ্ছে বিনোদনের বাজার। তাদের প্রয়োজন হচ্ছে টিভি, স্টেরিও, ভিডিও প্লেয়ার, ডিশ অ্যান্টেনা প্রভৃতি। ফলে রমরমা হচ্ছে বিনোদনের বাজার। বর্তমানে আমেরিকান চলচ্চিত্র বা মুভি বিশ্বের ১৫০ টিরও বেশি দেশের প্রোগৃহে প্রদর্শিত হয়। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিগুলো তাদের আগের মুভির সিডি ও ডিভিডি বিক্রি করছে বিশ্বব্যাপী। আমেরিকান টেলিভিশন প্রোগ্রামগুলো বিশ্বের প্রায় ১২৫ টি দেশে সম্প্রচারিত হয়। আর এইসব প্রোগ্রামগুলো এতই জনপ্রিয় হয় যে, মানুষ ভাবে আমেরিকায় কী চমতকার প্রোগ্রাম কিংবা মুভি তৈরি হয়!
কিছুদিন আগ পর্যন্ত জেনারেল (জি) এবং প্যারেন্টাল গাইডেন্স (পিজি) এই দুই ক্যাটাগরির চলচ্চিত্র থেকে বেশি আয় হলেও সাম্প্রতিক সময়ে এ অবস্থার অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে। ২০০১ সালে হলিউড থেকে যতগুলো চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছে তার দু'তৃতীয়াংশই রেস্টিকটেড (আর) ক্যাটাগরির। অর্থাত মোট মুভির তিন ভাগের দুইভাগ মুভি সবার জন্য উন্মুক্ত নয়। অর্থাত সেখানে সহিংসতার দৃশ্যায়ন অনেক বেশি। সহিংসতা নির্ভর অ্যাকশন মুভিতে কোনো জটিল কাহিনী কিংবা চরিত্র থাকে না। মারামারি, যুদ্ধ, হত্যা, বিস্ফোরণ এবং স্পেশাল ইফেক্টই সেখানে মুখ্য। অপরদিকে কমেডি এবং ড্রামাধর্মী মুভিগুলো ভালো কাহিনী, রসবোধ এবং সুসংহত চরিত্রের ওপর নির্ভর করে নির্মিত হয়। সহিংসতা নির্ভর মুভিগুলো কদাচিৎ ভালো কাহিনী ও চরিত্র নির্ভর আর এতোটাই সহজবোধ্য বিশ্বব্যাপী কোনো দর্শকের বোঝার কোনো সমস্যা তৈরি হয় না। ফলে মুনাফার ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পারে অর্থলগ্নীকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান। তবে এর উল্টো চিত্রও যে নেই তা নয়। জেমস ক্যামেরুনের 'টাইটানিক' ব্যবসার দিক দিয়ে সর্বকালের সব রেকর্ড ভেঙ্গে দিয়েছে। মুভিটি বিশ্বব্যাপী ২০০ কোটি ডলার আয় করেছে। ব্রিটিশ মুভি 'দ্য ফুল মন্টি' আন্তর্জাতিক ভাবে ব্যবসাসফল। ২০০২ সালে 'মাই বিগ ফ্যাট গ্রিক ওয়েডিং' ব্যবসা সফলের সব ধরনের ফর্মুলাই ভ্রান্ত প্রমাণ করেছে। কিন্তু এগুলো হচ্ছে ব্যতিক্রম। সহিংসতা নির্ভর ফিকশন মুভি যেমন, 'ডাই হার্ড' কিংবা 'টারমিনেটর' তৈরি করে অর্থ লগ্নীকারীরা অনেক বেশি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন। ফলে মূল মুভির পর ওগুলোর সিকোয়াল তৈরির প্রবণতাও দেখা যায়। হলিউডের অধিকাংশ চলচ্চিত্র বা মুভি নির্মাণে বর্তমানে গড়ে ব্যয় হয় ৮ থেকে ১০ কোটি মার্কিন ডলার। সেখানে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিগুলো ব্যবসায়ী সাফল্যের জন্যে সুযোগ বা সম্ভাবনার ওপর নির্ভর করতে চায় না। এরফলে বেড়ে যাচ্ছে ফিকশন ও ভায়োলেন্স'র মিশেলে নির্মিত চলচ্চিত্রের সংখ্যা। ম্যাট্রিক্স সিরিজ, মিশন ইমপসিবল সিরিজ, বন্ড সিরিজ, ব্লেড সিরিজ, এক্সম্যান সিরিজ, ডেসপারেডো সিরিজ, র‌্যাম্বো সিরিজ, স্পাইডারম্যান সিরিজ প্রভৃতি অজস্র চলচ্চিত্র বা মুভির নাম দেয়া সম্ভব। এ ধরনের প্রতিটি চলচ্চিত্রেই একটি ছোট্ট মানবিক গল্প থাকে কিন্তু সেই গল্পের পরতে পরতে থাকে ভায়োলেন্স বা সহিংসতা। সহিংসতার পাশাপাশি রয়েছে যৌনতা। প্রয়োজনের চেয়ে অপ্রয়োজনীয় ভাবেই নারীদের বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে। তাদের দেহ বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে উপস্থাপণ করা হচ্ছে। মজার বিষয় সেখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যৌনতার স্বাভাবিক প্রকাশ ঘটছে না। যৌনতাকেও সহিংসতার সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে। উন্নত বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে যৌনতা নির্ভর চলচ্চিত্র তৈরি করা হয়। এসব চলচ্চিত্রকে বলা হয় পর্ণো চলচ্চিত্র। এ খাতে তাদের বিনিয়োগ আকাশচুম্বী। পর্ণো চলচ্চিত্র যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অন্য অনেক দেশ রফতানি করে প্রচুর মুনাফা অর্জন করে। এ ধরনের চলচ্চিত্রগুলোর আবার রয়েছে বেশ কয়েকটি ক্যাটাগরি। সাধারণ ভাবে পর্ণো চলচ্চিত্র বলা হলেও প্রধানত সফট পর্ণো ও হার্ডকোর পর্ণো হিসেবে এ ধরনের চলচ্চিত্রগুলোকে শনাক্ত করা হয়। পর্ণো চলচ্চিত্র সাধারণত পুরুষ দর্শকের চাহিদার কথা বিবেচনা করেই নির্মিত হয়। ফলে নারীকে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে ক্যামেরার মাধ্যমে উপস্থাপণ করা হয়। তাদের সেক্স অর্গানগুলোকে আকর্ষণীয় করে দেখানো হয়। যাতে করে পুরুষ উত্তেজনা বোধ করে এবং আনন্দ লাভ করে। সফট পর্ণোতে নর-নারীর প্রায় স্বাভাবিক যৌন সম্পর্কই ক্যামেরায় ধারণ করা হয়। তাতে কেউ শিামূলক কিছু খুঁজে পেতেও পারেন। কিন্তু হার্ডকোর পর্ণোতে যৌনতার সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয় সহিংসতা। সেখানে নর-নারীর যৌন সম্ভোগটাই শুধুমাত্র স্বাভাবিক কিন্তু কর্মকাণ্ড মোটেও স্বাভাবিক নয়। চিরন্তন এই বিষয়টিকে অনেক বেশিমাত্রায় ভায়োলেট করে উপস্থাপণ করা হয়। এ ধরনের চলচ্চিত্রেরও প্রধান উৎপাদক ও রফতানিকারক আমেরিকা। পর্ণো চলচ্চিত্র নির্মাণ খুবই সহজ। কিছু টেকনিক্যাল সাপোর্ট আর কয়েকজন পাত্রপাত্রী। ব্যাস। বাজেট কম কিন্তু মুনাফা বেশি। বিনিয়োগ নিরাপদ। কিন্তু এরফলশ্র“তিতে আমেরিকাসহ বিশ্বের প্রধান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিগুলো এক ধরনের বন্যতা নির্ভরতায় পর্যবসিত হচ্ছে। যার প্রভাব ছড়িয়ে পড়ছে সারা পৃথিবীতে। বাংলাদেশের মুভিগুলোতেও দেখা যায় ভায়োলেন্স বা সহিংসতার ছড়াছড়ি। উদ্ভট ইঙ্গিতপূর্ণ নাম, খুনী-মাস্তানের গেটাপে অস্ত্র হাতে নায়ক আর স্থূলদেহের নন্দনভাবনাহীন পোশাকের নায়িকাদের ছবি সম্বলিত পোস্টার থেকেই এ বিষয়ে ধারণা পাওয়া যায়। মূলত নব্বই দশকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে সহিংসতার ব্যবহার লাগাম ছাড়া হয়ে ওঠে। এ সময়েই নায়ক ও প্রতিনায়কের মধ্যে আর বেশি ব্যবধান থাকেনি। একটি ম্যাগাজিনকে দেয়া সাক্ষাতকারে চলচ্চিত্রাভিনেতা জসীম বলেন, 'আজকের দর্শক অ্যাকশন ও ভায়োলেন্সকেই বেশি দেখতে চায়। এখন থেকে নিজেকে অভিনেতা ও রাগী নায়ক দু’ভাবেই প্রমাণ করবো।' এ সময়েই চলচ্চিত্র পরিচালক কাজী হায়াত সহিংসতানির্ভর চলচ্চিত্র দাঙ্গা (১৯৯২) ও ত্রাস (১৯৯২) নির্মাণ করেন। দর্শক নায়ক মান্না অভিনীত এ ছবিদুটি গ্রহণ করে। ফলে অন্যান্য পরিচালকও এ ধরনের সহিংসতানির্ভর চলচ্চিত্র নির্মাণে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এ দশকের শেষের দিকে নায়ক মান্নার সঙ্গে ভিলেন হিসেবে যোগ দেন ডিপজল। তাঁর আবির্ভাবে চলচ্চিত্রে সহিংসতার মাত্রা আরও বেড়ে যায়। পরবর্তী সময়ে নতুন শতাব্দীর প্রথম দশক অর্থাত চলমান দশকে সহিংসতার পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে যৌনতার অযাচিত ব্যবহার। তবে এর ব্যবহার পূর্ববর্তী দশকের শেষ দিক থেকেই শুরু হয়েছিল। ফলে চলচ্চিত্র হয়ে উঠছিল 'অশ্লীলতা' দোষে দুষ্ট। মূল চলচ্চিত্রের উদ্ভট পোষকে নাচ-গানের পাশাপাশি 'কাটপিস' অভিধাযুক্ত কিছু দৃশ্য সংযোজন করে দেয়া হতো। যেগুলো প্রকৃতঅর্থে পর্নোগ্রাফি ছাড়া আর কিছু নয়। ফলে এর বিরুদ্ধে সরকারকে অভিযানে নামতে হয়েছে। এই অভিযানের ফলে বর্তমানে চলচ্চিত্রে পর্নোগ্রাফির ব্যবহার বন্ধ হয়েছে। কিন্তু সহিংসতার ব্যবহার কী বন্ধ হয়েছে?

দর্শকদের চাহিদা যথাযোগ্যভাবে পূরণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় এ দেশের চলচ্চিত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল মানুষ। পাশাপাশি স্যাটেলাইট চ্যানেল, ডিভিডি-ভিসিডি প্রভৃতি সহজলভ্য প্রযুক্তি মানুষের হাতের নাগালে চলে আসায় ঘরে বসেই চলচ্চিত্রের স্বাদ নেয়া সম্ভব হচ্ছে। ফলে সিনেমাহলে বসে সিনেমা দেখার সংস্কৃতিতে ভাটা পড়তে শুরু করে আর এর স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় চলচ্চিত্র ব্যবসায় খড়া নেমে আসে। উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী হলে গিয়ে সিনেমা দেখা বন্ধ করে দেয় প্রায়। এরপর অবশিষ্ট থাকে নিম্নবিত্ত ও গ্রামাঞ্চলের মানুষ। বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে তাদের কাছে সিনেমাহল ছাড়া আর কোনও পথ খোলা নেই। ফলে তারা সিনেমা হলে যাওয়া অব্যাহত রাখে। এই অপ্রতুল দর্শককে হাতে রাখতে কিংবা তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পাশাপাশি বিনিয়োগকৃত পুঁজি নিরাপদে সহজে তুলে আনতে সহজ কৌশল হিসেবে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে যৌনতা ও সহিংসতার ব্যবহারের মাত্রা বাড়িয়ে দেন পরিচালক-প্রযোজকেরা। এর সঙ্গে রয়েছে মুনাফালোভী ভুঁইফোড় কালোটাকার যোগানদার। জনগণকে বিনোদন দেয়ার অজুহাতে কালোটাকা বৈধকরণের কৌশলটি এখানে যথেষ্ট সহজ বলেই নিম্নরুচির ও মানের নামে চলচ্চিত্র উৎপাদন সম্ভবপর। সম্ভবপর এসব চলচ্চিত্র উতপাদনের দায় 'জনরুচি'র ওপর চাপানো। অর্থাত 'জনগণ এরকম চলচ্চিত্রই চায়'- এই সম্পূর্ণ মিথ্যার আবরণে এদেশীয় চলচ্চিত্র সহিংসতা ও অশ্লীলতাকে পুঁজি করে বাধাহীন প্রক্রিয়ায় জনসাধারণের সাংস্কৃতিক রুচি তৈরি ও বিকাশের পথ রুদ্ধ করে দিচ্ছে, ভারি করে তুলছে প্রযোজক ও পরিচালকের পকেট। তবে এর ব্যতিক্রমও রয়েছে। ইদানিংকালে সামাজিক ও প্রেমনির্ভর কয়েকটি চলচ্চিত্রের ব্যবসায়ীক সাফল্য অন্ধকার সময় থেকে আলোতে প্রত্যাবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। তবে তা যথেষ্ট নয়।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, একটি চলচ্চিত্রে সহিংসতার স্থান কোথায়? চলচ্চিত্রে কি তাহলে সহিংসতা থাকবে না? এর পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা হচ্ছে, চলচ্চিত্রে সহিংসতা থাকতেই পারে। তবে তা হতে হবে কাহিনীর প্রয়োজনে। যুক্ত হতে হবে যৌক্তিক পারম্পর্যে, ল্ক্ষ্য রাখতে হবে পরিচালক সহিংসতার মাধ্যমে যে চিত্র আঁকতে চেয়েছেন আদৌ তা চিত্রিত হয়েছে কি না? যদি তা ব্যর্থ হয় তবে ধরে নিতে হবে সেসব সহিংসতাপূর্ণ দৃশ্যগুলোর সংযোজন প্রয়োজন ছিল না কিংবা এর নেপথ্যে কাজ করেছে পরিচালকের ব্যবসায়ীসুলভ মনোভাব, যিনি যেন তেন ভাবে লগ্নিকৃত অর্থের মুনাফা করতেই অধিক আগ্রহ বোধ করেন, চলচ্চিত্র তার ব্যবসায় মুনাফার হাতিয়ার মাত্র।

এ প্রসঙ্গে আমরা কয়েকটি উদাহরণ দেখতে পারি। আমরা যদি স্টিফেন স্পিলবার্গ পরিচালিত 'সেভিং প্রাইভেট রায়ান' চলচ্চিত্রটি দেখি তবে দেখবো তা সহিংসতায় ভরপুর। ডি ডে'র প্রায় সত্য ঘটনাবলীই চিত্রায়ন করেছেন স্পিলবার্গ। যে কোনো দর্শক এ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বুঝতে পারবেন কেন মার্কিন বাহিনী সেখানে গিয়েছিল। এখানে সহিংসতা মানুষের রুচিকে উপজীব্য করেই সংযোজিত হয়েছে। এখানে সহিংসতা মানুষের হৃদয়কে নাড়া দিয়েছে, সত্যকে উপলব্ধি করার লক্ষে রচিত হয়েছে। কিংবা আমরা যদি সায়েন্স ফিকশন চলচ্চিত্র 'ইনডিপেন্ডেনস ডে'র কথা বিবেচনা করি তবে দেখবো, পৃথিবী আক্রান্ত হয়েছে এলিয়েনদের দ্বারা। সেই প্রবল আক্রমণেও যারা টিকে যায় তারা যৌথভাবে এলিয়েনদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালায় এবং পৃথিবীকে রা করে। এ চলচ্চিত্রেও সহিংসতার ব্যাপক ছড়াছড়ি ল্ক্ষ্য করা যায়। কিন্তু চলচ্চিত্রগুলোর বিষয় নিরিখে তার প্রয়োগ বাড়াবাড়ি মনে হয় না। মনে হয় না অযাচিত আরোপ।

কেউ কেউ সহিংসতাকে সনাক্ত করেন নাটকীয় উপাদান বলে। চিত্রনাট্যকার কাহিনীর প্রয়োজনে তা ব্যবহার করেন। এর মাধ্যমেই গল্পের ক্যাথারসিস ঘটে। কেউ কেউ বিষয়টিকে 'ফ্রিডম অব স্পিচ' এর আওতাধীন বলে ধরে নিতে এবং মেনে নিতে পারেন এবং বলতে পারেন এ সম্পর্কিত কোনো নির্দেশনার প্রয়োজন নেই আর তা উচিতও হবে না। কিন্তু কীভাবে একজন নিশ্চিত হবে এ ধরনের কোনোকিছু থাকা বা না থাকা উচিত? এ ব্যাপারে শুধু এটুকুই বলা যেতে পারে যে, পরিচালক যদি দায়িত্ববান ও রুচিবান হন, তিনি যদি শিল্প এবং ব্যবসার সমন্বয় করতে পারেন তবে চলচ্চিত্রে অযাচিত সহিংসতার ব্যবহার থেকে বিরত থাকবেন। অবশ্য এ বিষয়টিতে কেউ কেউ দর্শকদের আগ্রহের ওপরও দায় চাপান। এ প্রসঙ্গে সহিংসতা ও যৌনতা নির্ভর চলচ্চিত্রগুলোর ব্যবসায়িক সাফল্যের উদাহরণও টানা যেতে পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে দর্শকের চাহিদা একদিনে তৈরি হয়নি। দর্শকের রুচি এ পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে পরিচালক ও অর্থলগ্নীকারী প্রতিষ্ঠান। কেননা চলচ্চিত্র মাধ্যমটি দর্শকের নিয়ন্ত্রণে নয়। পরিচালক যা দেখাতে চান দর্শক তাই দেখেন। সুতরাং দর্শকের রুচিকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করালে তা ধোপে টিকছে না। ইতিবাচক চলচ্চিত্রের অব্যাহত যোগান থাকলে দর্শকের রুচিও ইতিবাচকতার দিকেই ধাবিত হবে। ব্যবসাসফল ইতিবাচক কিংবা রুচিশীল চলচ্চিত্রের উদাহরণ তো কম নয়। এ থেকে পরিচালকগণ উৎসাহ নিতে পারেন। কেননা এখনো পর্যন্ত চলচ্চিত্রই সবচেয়ে জোড়ালো গণমাধ্যম যা একই সঙ্গে অনেক বেশি মানুষের কাছাকাছি পৌঁছতে পারে। তাই এর যথাযথ পরিচর্যা এবং এর অন্তর্নিহিত স্পিরিটকে নষ্ট হতে দেওয়া ঠিক নয়।
শুধু চলচ্চিত্রেই নয়। বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে সহিংসতাকে দৃশ্যনির্ভর অন্যান্য মাধ্যমেও ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন ভিডিও গেমস এর দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা দেখবো, জনপ্রিয়তা কিংবা চাহিদার দিক থেকে সহিংসতাযুক্ত গেমসগুলোই শীর্ষে। পাশাপাশি বুদ্ধিদীপ্ত অথবা সহিংসতাহীন গেমসগুলো বর্তমানে হুমকির সম্মুখীন। ২০০২ সালের সেপ্টেম্বরে মুক্তি পাওয়া 'গ্রান্ড থিফ অটো থ্রি' গেমসটি বিশ্বে দ্বিতীয় জনপ্রিয় গেমস এ পরিণত হয়। গেমসটি সহিংসতায় পূর্ণ বলে অস্ট্রেলিয়ায় নিষিদ্ধ করা হলেও ২০০২ সাল শেষে এটি আয় করে ৩০ কোটি মার্কিন ডলার।

ঘরে বসে টেলিভিশনে বিশ্বের বিভিন্ন চ্যানেল দেখার সুযোগ হওয়ার কারণে 'রেসলিং' এখন সারা বিশ্বেই ভীষণ জনপ্রিয়। শিশু কিশোরদের প্রিয় হিরো এখন রক, থ্রিপল এক্স কিংবা খালি'র মতো রেসলাররা। এতে দু'কিংবা ততোধিক মাসলম্যান পরস্পরের বিরুদ্ধে সহিংস লড়াইয়ে নামে। লড়াইয়ে একজন বিজয়ী হন। সেই প্রদর্শনীগুলোয় আরও ব্যবহার করা হয় স্বল্প বসনা নারীদের। অর্থাত যৌনতার ইঙ্গিতবাহী বিষয়ের অযাচিত ব্যবহার। নারীদের রেসলিংও রয়েছে। যদিও 'রেসলিং' শুরুর আগেই দেওয়া হয় বিজ্ঞাপন, যেন এ বিষয়টি বাড়িতে প্র্যাকটিস করা না হয়। যদিও আমরা অনেকেই জানি পুরো বিষয়টিই সাজানো। কিন্তু রেসলারদের নৈপুণ্যে বোঝার উপায় নেই যে তারা অভিনয় করছেন। ফলে পুরো সময় জুড়েই থাকে টান টান উত্তেজনা।

১৯৯৮ সালে ২৩টি দেশের ওপর পরিচালিত ইউনেস্কো'র এক জরিপে দেখা গেছে ৯১ শতাংশ শিশু ও কিশোর ঘরে বসে টেলিভিশন দেখার সুযোগ পায়। এসব শিশু ও কিশোরেরা সহিংসতাপূর্ণ মুভি এবং রেসলিং উপভোগ করে। এসব দেখে অনুকরণ করতে গিয়ে মৃত্যুও বরণ করেছে অনেক শিশু কিশোর। শুধু চলচ্চিত্র, কম্পিউটার গেমস কিংবা রেসলিং'র কথা বাদ দিলেও আমরা যদি প্রতিদিনকার খবরের কাগজের পাতা উল্টাই তবে দেখবো, সহিংসতাপূর্ণ কিংবা সহিংসতার ইঙ্গিতবাহী খবরগুলোই বেশি পরিমাণে ছাপা হচ্ছে। যুদ্ধ, মারামারি অথবা বিপর্যয়ের সম্ভাবনাবাহী এসব খবর পরিবেশনে বিশ্বের সংবাদমাধ্যমগুলো যতটা উৎসাহী, সুকুমার চর্চার সংবাদ ছাপাতে ততটা নয়।

সম্প্রতি 'নিউ সাইনটিস্ট' একটি জরিপ প্রকাশ করে, যাতে দেখা যায়, শুধুমাত্র আমেরিকাতেই শিশুরা প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে ৮ হাজার হত্যা এবং ১০ হাজার সহিংসতাপূর্ণ দৃশ্য দেখে ফেলে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এসব হত্যা এবং সহিংসতাপূর্ণ দৃশ্য তাদের আচরণে কোনো প্রভাব ফেলে কিনা? গবেষণায় দেখা যাচ্ছে যেসমস্ত শিশু এসব দৃশ্য শৈশবে দেখেছে পরবর্তীতে তাদের বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। প্রাপ্তবয়স্ক ৩২৯ জনের ওপর ‘নিউ সাইনটিস্ট’ জরিপ চালিয়ে দেখেছে, শৈশবে সহিংসতাপূর্ণ চলচ্চিত্র কিংবা দৃশ্য বেশি মাত্রায় দেখেছে যে সমস্ত মেয়েরা, তারা ক্ষেপে গেলে তাদের স্বামীর দিকে বিভিন্ন জিনিসপত্র ছুঁড়ে মারে। আর ছেলেরা তাদের স্ত্রীদের সঙ্গে সহিংস আচরণ করে। চলচ্চিত্রে সহিংসতার এই দানবীয় উত্থাণ সেই সঙ্গে সমাজে এর প্রভাব সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক ডেভিড পুটন্যাম বলেন, 'আমি দিব্যি দেখতে পাচ্ছি, আমরা আমাদের ধ্বংস করছি।'

চলচ্চিত্র বা মুভি, কম্পিউটার গেমস কিংবা রেসলিং এসব বিনোদন ভোক্তাদের একটি বড় অংশ হচ্ছে মূলত শিশু কিশোর এবং তরুণ সম্প্রদায়। বিনোদনের নামে এতোসব সহিংসতা দেখতে দেখতে তারাও যে অনেকটাই সহিংসপ্রবণ হয়ে ওঠে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তাদের অরতি মনোজগতে সহিংসতা এক ধরনের হিরোইজম তৈরি করে, যা দৃশ্যমাধ্যমের সহিংসতার নামান্তর। পরবর্তীকালে এইসব সহিংস দৃশ্যকল্প নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে তাদের জীবন-যাপনে। বিষয়টি সমগ্র বিশ্বের জন্যে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে উঠতে পারে। তাই বিনোদনে অযাচিত সহিংসতা ব্যবহারের যৌক্তিকতা নিয়ে আমাদের এখনই সচেতন হওয়া প্রয়োজন।


মন্তব্য

হিমু এর ছবি

বর্ণদূত ভাই, প্রতি প্যারার পর একবার এন্টারে চাপ দিয়ে সেকশন ব্রেক করে নিয়েন। তা না হলে ব্রাউজার দেখাতে পারবে না লেখাটা।


হাঁটুপানির জলদস্যু

অবনীল [অতিথি] এর ছবি

ধন্যবাদ বর্নদূত ভাই সুন্দর আর তথ্যনির্ভর এই প্রবন্ধ টা উপস্থানের জন্য। নতুন কিছু চিন্তার খোরাক পেলাম।

নির্বাক এর ছবি

সঠিক সময়ে সঠিক কথা বলার জন্য ধন্যবাদ!

_________________________________________
তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ
আমি আজ চোর বটে!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।