আজ থেকে চার বছরেরও কিছু বেশি সময় আগের ঘটনা। রাহেলা ধর্ষণ এবং হত্যা মামলার কথা বলছিলাম। যে নৃশংস ঘটনা আমাদের প্রচার মাধ্যমগুলোতেও তেমনভাবে সাড়া জাগাতে পারেনি, আজো বিচারের আশায় আদালতে লটকে আছে।
রাহেলার পুরো নাম ছিল রাহেলা আক্তার লিমা। ২০০৪ সালে তাকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মশাররফ হলের পেছনে ঝোপ এলাকায় তিন মানুষ নামের কলঙ্ক গণধর্ষণ শেষে হত্যা করার চেষ্টা করে রাহেলার গলায় ছুড়ি চালিয়ে। এরপর তার মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য মুখে এসিড ঢেলে দেওয়া হয়। ঘটনার তিনদিন পর রাহেলাকে উদ্ধার করা হয় ঝোপের মধ্যে থেকে, ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায় মৃতপ্রায়। বাইশ বছর বয়সী অসম্ভব প্রাণচাঞ্চল্যের অধিকারিনী এই তরুণী সেযাত্রা বেঁচে গেলেও শেষ রক্ষা করা যায়নি। তেত্রিশদিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন রাহেলা ২০০৪ সালের ২৪ আগস্ট।
এহেন ঘৃণ্য হত্যাকান্ডের আশু বিচারকার্য সম্পাদন এবং অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা প্রদান সবার কাম্য। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে রাহেলা হত্যা মামলার প্রতিটি পর্যায়েই দীর্ঘসূত্রিতা পরিলক্ষিত হয়। হত্যাকাণ্ড সংঘটনের পর প্রথমদিকে প্রচারমাধ্যমগুলোতে কিছুটা সাড়া জাগালেও এক সময় তা থেমে যায়। নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ ট্রাইবুনাল-১ এ বিচারাধীন এ মামলা আইন শালিশ কেন্দ্রের সহযোগিতায় ২০০৬ সালে সর্বপ্রথম শুনানীর জন্য উত্থাপিত হয়। তারপরই জানা যায় যে মামলা সংশ্লিষ্ট জরুরী নথিপত্র খোঁয়া গেছে। ইতোমধ্যে মামলার প্রধান আসামী বিদেশে পাড়ি জমায় এবং অন্যান্য আসামীরা সুকৌশলে জামিনে মুক্তি পেয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে রাহেলার মৃত্যুর পর তার কবরের জায়গাটুকুও স্বামী চান মিয়ার বাড়িতে হয়নি। রাহেলাকে তার গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরে দাফন করা হয়। রাহেলা মারা যাবার ছয় মাস পরেই চান মিয়া আবার বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। প্রায় দুই বছর অতিবাহিত হয়ে যায়, মামলাটি হয়তো মানুষের স্মৃতি থেকে হারিয়ে যেত যদি না কতিপয় নারী অধিকারকর্মী এবং বাংলা ব্লগাররা সোচ্চার হতেন। বিভিন্ন ব্লগ্লীয় প্লাটফর্মে মামলাটির গুরুত্ব নিয়ে লেখালেখি হতে থাকে, ধীরে ধীরে অনেকেই এর সাথে যোগ দেন। রাহেলার জন্য দ্রুত ন্যায় বিচারের ধ্বনি চারদিকে উচ্চারিত হতে থাকে। বাংলা ব্লগ, সংবাদপত্র, ফেসবুকগ্রুপ এবং আই-পিটিশন ইত্যাদির মাধ্যমে অনলাইনে একটা বেশ বড় প্রচারাভিযান সংঘটিত হতে থাকে। অফলাইনে এ বিষয়ে জনগণের সচেতনতা জাগ্রত করার জন্য প্রতিবাদ বিক্ষোভ এবং মানব-বন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। মামলাটিকে সামনে এগিয়ে নিতে আদালতের উপরে চাপ প্রয়োগ করার জন্য বাংলা ব্লগারদের এই চলমান প্রচেষ্টা প্রচার মাধ্যমের নজর কাড়ে এবং ক্রমশ: প্রতিবেদন এবং টিভি রিপোর্ট প্রচার হতে থাকে। শেষপর্যন্ত ২০০৮ এর জানুয়ারী মাসে মামলাটি পুনরায় চালু হয় এবং এপ্রিল মাসে হারিয়ে যাওয়া নথিপত্র আশ্চর্য্যজনকভাবে খুঁজে পাওয়া যায়। তদন্তকারী কর্মকর্তারা পরবর্তীতে দাবী করেছেন যে নথিপত্র ‘সবসময় সেখানে ছিল'। বলার অপেক্ষা রাখে না যে বিচারের জন্য যুদ্ধ এখনও একটা দীর্ঘমেয়াদী সংগ্রাম। ইতোমধ্যেই এই মামলা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এবং মুখ্য প্রত্যক্ষদর্শীরা অসহযোগিতা শুরু করছে। কিন্তু ব্লগাররা ছেড়ে দিচ্ছেন না। মানুষের স্মৃতিতে রাহেলাকে সজীব রাখার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে, যেন অন্যায়কারীকে আইন ও বিচারের সম্মুখীন করা যায়; যদিও দেরী হয়ে গেছে, কিন্তু রাহেলা আখতার লিমাকে বঞ্চিত করা হয় নাই। সাম্প্রতিক সময়ে এক টিভি সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের একজন সম্মানিত শিক্ষাবিদ ও লেখক প্রফেসর মুহাম্মদ জাফর ইকবাল রাহেলার ন্যায় বিচারের বিষয়টির বারবার উল্লেখ করেন।
এ বছরের এপ্রিল মাসে সরকারের দায়িত্বশীল বিভাগ মামলাটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ‘চাঞ্চল্যকর মামলা মনিটরিং সেলে’ অন্তর্ভূক্ত করা হয় এবং দ্রুত বিচার আইনে সম্পন্ন করার নির্দেশ প্রদান করা হয়। বিচারের জন্য বেঁধে দেয়া সময় ছিল অক্টোবর পর্যন্ত এবং বিশেষ প্রয়োজনে ডিসেম্বরের ১৫ তারিখ পর্যন্ত বাড়তি সময় প্রদান করা হয়। রাহেলার চিকিৎসক শহীদুল ইসলাম এবং তদন্ত কর্মকর্তার গড়িমসির কারণে সাক্ষ্য গ্রহণের সময় বাড়তে বাড়তে নভেম্বরের শেষ দিকে সকল সাক্ষ্য গ্রহণের কাজ শেষ হয়। মামলার পরবর্তী তারিখ ধার্য্য করা হয়েছে ৬ জানুয়ারি। এদিন মামলার আসামী সনাক্তকরণ হবে তিনশত বিয়াল্লিশ ধারায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, মামলার প্রধান আসামী এখনো পলাতক এবং বাকিরা আজো জামিনে মুক্ত।
সচলায়তনের সকলের পক্ষ থেকে আমরাও চাই এই মামলার আশু নিষ্পত্তি। গত চার বছরে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর গড়িমসির কারণে অনেক জল ঘোলা হয়েছে, রাহেলা হত্যা মামলা ন্যায় বিচারের আশায় এখনো আদালতে ধুঁকছে। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান এবং রোমহর্ষক এই হত্যাকাণ্ডের ন্যায় বিচারকার্যের আশু সম্পাদনাই হোক নতুন বছরের ঊষালগ্নে আমাদের দৃঢ় প্রত্যয়।
মন্তব্য
আর দীর্ঘসূত্রীতা না করে রাহেলা হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার দাবী করছি।
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
সহমত জানাই।
--------------------------------------------------------
কী বীভত্.স-ই না ছিল ঐ ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টা !
অই পিশাচদের অবিলম্বে খুঁজে বের করে টেনে-হিঁচড়ে (তাদের সবরকম পিশাচাধিকার লঙ্ঘন করে) ফাঁসিতে ঝোলানো হোক।
বিচারবিভাগের উন্নতিসাধনের অনেক গালভরা গপ্পো শুনি, কিন্তু এসব পৈশাচিক মামলার খবর শুনলে খুব হতাশ হয়ে পড়ি।
--------------------------------------------------------
এই ঘটনার বিচার চাই, অবিলম্বে !
অলমিতি বিস্তারেণ
অলমিতি বিস্তারেণ
সহমত
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
সহমত।
তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে
*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়
সবজান্তা, নজুভাই এবং তানবীরা আপুকে ধন্যবাদ জানাই কষ্ট করে পড়ে মন্তব্য করার জন্য।
--------------------------------------------------------
বিচার চাই।
হুমম্।
--------------------------------------------------------
বৃথা এ হা-হুতাশ, ভাই! দেশের বিচারবিভাগের ওপরে আস্থা রাখতে পারি না...
আমার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত হোক।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
একলা পথে চলা আমার করবো রমণীয়...
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
আস্থা তো আমার যে আছে সেটা বলছিনা কিন্তু প্রতিবাদ তো জানাতে পারি তাই আরকি এইসব হাউকাউ।
--------------------------------------------------------
সন্ন্যাসী'জী-র মত আমি নিজেও দেশের বিচারবিভাগের ওপর আস্থা রাখতে পারি না। এরকম কতই না বীভৎস, চাঞ্চল্যকর ঘটনার বিচার এখনো ঝুলে আছে!
তবুও আশা করি, সুবিচার হবে।
A question that sometimes drives me hazy: am I or are the others crazy?
ঠিকই বলেছেন কতই তো রাহেলারা মারা যাচ্ছে যাদের খবর আলোতে পৌছার আগেই অতলে হারিয়ে যায়। তবুও আশাটুকু ধরে রাখতে চাই শেষ সময়টা পর্যন্ত। দেখা যাক কি হয়।
--------------------------------------------------------
বাংলাদেশে এইসব ঘটনা এখন পত্রিকা খুললেই আমাদের চোখে পড়ে, এমন কত বিচারের ফাইল ধামাচাপা পরে আছে আর দোষী ব্যক্তিরা ঘুড়ে বেড়ায় আমাদেরই চারপাশে। তবুও আমরা সবাই এর সুষ্ঠু বিচার চাই।
ধন্যবাদ তোকে এমন একটি লেখার জন্য।
পড়েছ জেনে ভাল লাগল।
--------------------------------------------------------
সহমত। বিচার চাই!
হুমম, দেখা যাক কি হয় !
-------------------------
--------------------------------------------------------
ঘটনাটা পড়ে মনটা খুব খারাপ হল.মানুষ কত পিশাচ. বিচার চাই.
ঠিকই বলেছেন দিদি। কিছু মানুষ আসলেই পিশাচদের মতন জঘন্য কাজ করে আর তাদের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়াবার কেউ নেই ! বড়ই লজ্জাকর ব্যাপার।
------------------------------------
--------------------------------------------------------
নতুন মন্তব্য করুন