আমার বন্ধু বুদ্ধজ্যোতি চাকমা বলেছিলো, এবার ঈদে যেনো বান্দরবানের দূর পাহাড়ে যাই। ও হচ্ছে প্রথম আলোর বান্দরবান জেলা প্রতিনিধি, পাহাড়ের চারণ সাংবাদিক বলতে যা বোঝায়, ঠিক তাই। পেশাগত কারণে গত প্রায় দেড় দশকে পাহাড়ে, বনে, বাদাড়ে কম ঘোরা হয়নি। বুদ্ধর সঙ্গেও পাহাড় ভাঙা হয়েছে অনেক।
তো আমি সাত দিন ছুটি নিয়ে ছুটে যাই দূর পাহাড়ের আমন্ত্রণে। বান্দরবান সদরের অস্থায়ী আবাস হয় বুদ্ধর বাড়িতেই। বুদ্ধ আমাকে বলে, আমাদের সামনে বেড়াতে যাওয়ার তিনটি অপশন আছে: এক. কেওক্রাডং এ দুজনে বেড়াতে যাওয়া, দুই. নেভি মারমা দার সঙ্গে রাজস্থলির পাহাড়ে যাওয়া এবং তিন চন্দ্রঘোনায় আমাদের বন্ধু উচি মং মারমার বিয়েতে অংশ নেওয়া। আমি প্রথম অপশনটিকেই সমর্থন করি। কারণ সেটাই সবচেয়ে দুর্গম যাত্রা। আর তাছাড়া সেখানে গেলে একই সঙ্গে ইদুঁর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ জুম চাষীদের বর্তমান অবস্থার ওপর সরেজমিন ফলোআপ নিউজও সংগ্রহ করা যাবে।
পত্রিকায় জেনেছি, এবার বহুবছর পর পাহাড়ের প্রান্তিক চাষী জুমিয়াদের লাখ লাখ একর জুমের ফসল বন্যার পানির মতো ধেয়ে আসা ঝাঁক ঝাঁক ধেড়ে ইঁদুর খেয়ে নষ্ট করেছে। চাকমা ভাষায়, এটি ইঁদুর বন্যা। আর বম ভাষায়, মাওথাম।
*
পরদিন খুব ভোরে ঘন কুয়াশা আর ডিসেম্বরের হাড় কাঁপানো শীতের সকালে দুজনে ব্যাগ গুছিয়ে বের হই। অভিজ্ঞতা থেকে জানি, ব্যাগ ভাড়ি হলে পাহাড় ভাঙতে খুব কষ্ট। তাই দুজনের ব্যাগে একপ্রস্থ শার্ট - প্যান্ট আর টুকিটাকি ছাড়া বিশেষ কিছু নেই। বুদ্ধর একরত্তি ছেলে দেবংশি আমাদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য বায়না ধরে। স্কুল শিক্ষক বুজিকে (বৌদি) শিশুটিকে সান্তনা দিতে হিমশিম খেতে হয়। 'কাক্কা' হিসেবে আমি তাকে চাকমা ভাষায় প্রবোধ দেই, তোর জন্যি জুমের বিন্নি চাল, মারফা (শশা), মিষ্টি কুমড়ো আনি দেম। ও লক্ষ্মি বাপ্পো, ও সিজি, ন' কাঁন্দিস।...
তো শিশুকন্ঠের আর্তচিৎকার পেছনে ফেলে আমরা বাসস্ট্যান্ড থেকে রুমা যাওয়ার লক্কড় - ঝক্কড় ভাড়ার জিপ (স্থানীয় চাঁদের গাড়ি) ধরি। চাঁদের গাড়ির ছাদে শহর থেকে বেড়াতে আসা একদল ট্যুরিস্টকে দেখা যায়। বুদ্ধর ভাষায়, ওরা হচ্ছে ঠোঙ্গা পার্টি! দুষ্টুমি করে ও অবশ্য খুব একটা ভুল বলেনি। কি বিচিত্র সব সাজ পোশাক একেকজনের। এই শীতেও একেকজন হাফ হাতা গেঞ্জির ওপর হাফহাতা জ্যাকেট, হাফপ্যান্ট, উঁচু হাইকিং বুট আর বিশাল বিশাল হ্যাভারশেক নিয়ে চলেছে কেওক্রাডং। গলায় ঝুলছে দামি বাইনোকুলার কি ক্যামেরা। দু - একজন তো আবার টুপির ওপর কি মাথায় বাঁধা রঙিন রুমালের ওপর তুলে দিয়েছে সানগ্লাস।
বুদ্ধর রাগ যায় না। গজগজ করে ও, হুম। জিম করবেট একেক জন! শহর থেকে সাহেব এসেছেন জঙ্গলে বাঘ শিকার করতে!...
ও ভুলে যায়, আরেক ঠোঙ্গা ওর পাশেই বসে আছে; সে ও বেড়াতে এসেছে ওরই আমন্ত্রণে!
তো ঠোঙ্গা পার্টি রুমা ঘাটে সেনা ছাউনিতে হাজিরা দেয়। আমরা চাঁদের গাড়ি থেকে নড়ি না (এই নিয়ে পরে ধকল পোহাতে হয়)।
লম্বা একটি ট্রলারের ভেতর আর ছাদে গাঁদাগাঁদি করে বসি। শীতে শুকিয়ে আসা শঙ্খ নদী বেয়ে ট্রলার চলে। সেখানে মারমা এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়। তিনি জানান, মারমা ভাষায়, 'রুম্মা ছড়া' নামক নদী থেকেই 'রুমা' থানার নাম। আর 'কেওক্রাতং' থেকে ইংরেজিতে 'কেওক্রাডং'। 'কেওক্রাতং' শব্দের অর্থ হচ্ছে শিলাপাহাড়।
নদীর দুপাশে পালং শাকের মতো ছোট ছোট জুমচাষ দেখে বুদ্ধকে জিগেষ করে জানতে পাই, এগুলো হচ্ছে, তামাক পাতা। ব্রিটিশ - আমেরিকান ট্যোবাকো কোম্পানী বান্দরবানে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করছে তামাক চাষের জন্য।
জুম চাষিরা দেখলেন, ধান চাষের চেয়ে তামাক পাতা চাষ অনেক লাভজনক। আর এগুলোর ক্রেতাও ওই কোম্পানী। এতে অনেক জুমিয়া পরিবারে আর্থিক সাচ্ছন্দ এসেছে ঠিকই। কিন্তু পরিবেশের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে মারাত্নক।
তামাক পাতা পাহাড়ি ঝর্না বা নদীতে ধোয়ার ফলে মাইলের পর মাইল পানি দূষিত হয়ে পড়ছে। মারা যাচ্ছে মাছ, কাঁকড়া, ব্যাঙ, কচ্ছপ, শামুক - ঝিনুকসহ নানা জীব - বৈচিত্র। এমন কি তামাক চাষীদের অনেকের যক্ষা রোগ ধরা পড়ছে। অনেকের হাত - পায়ের নখ খসে যাচ্ছে!...
*
রুমা বাজারে ট্রলার ভীড়লে সেখানে আমাদের স্বাগত জানায় চেওহ্লা চিং মারমা। সে প্রথম আলোর রুমা থানা প্রতিনিধি। ও আমাদের একজন বম গাইড ঠিক করে দেয়। চারজনে একটি রেঁস্তোরায় মুরগি দিয়ে দুপুরের খাবার সেরে নেই। বেলা দুটার দিকে চাঁদের গাড়িতে করে রওনা দেই বগালেক। কিন্তু যাত্রা পথে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও সেই গাইডের সন্ধান পাওয়া যায় না। আর ঠোঙ্গা পার্টিকে গরীব পাহাড়ি থানা শহরে কেনাকাটায় ব্যস্ত দেখা যায়। তারাও বগালেক যাত্রা থেকে বাদ পড়ে।
চাঁদের গাড়ির ড্রাইভারের নাম শুক্কুর। সে বান্দরবানের স্থায়ী বাসিন্দা। যাত্রা পথে টুকরো আলাপে তার ক্ষোভ ঝরে পড়ে পাহাড়িদের ওপর। অনর্গল চট্টগ্রামের আঞ্চলিক উচ্চারণে মারমা আর বমদের গালিগালি করতে থাকে সে। তাদের ব্যবহার খারাপ, ঠিকমতো ভাড়া দিতে চায় না, একটু এদিক সেদিক হলে ড্রাইভার আর হেল্পারদের ধরে মারপিট করে -- এই সব।
আমি মনে মনে বলি, ভাগ্যিষ, এখানে চাকমাদের বাস নেই। নইলে শুক্কুর ড্রাইভার হয়তো বুদ্ধর চৌদ্দপুরুষের গুষ্ঠি উদ্ধার করে ছাড়তো!
মাটির কাঁচা আর উঁচু - নীচু এবড়ো - থেবড়ো পাহাড়ি পথে আলাপ খুব বেশীদূর এগোয় না। ঝুঁকি পূর্ণ পাহাড়ি পথের একপাশের খাদে কাত হয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায় আরেকটি চাঁদের গাড়িকে। শুক্কুর ড্রাইভার জানায়, বিস্ময়করভাবে ওই গাড়ির সব যাত্রী অক্ষত রয়েছেন। শুধু একজনে হাত ভেঙেছে। আর গাড়িটিও অক্ষত আছে। রুমা - বগালেকের কাঁচা রাস্তাটি বর্ষাকালে হয়ে ওঠে ভয়ংকর। তখন গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকে। কাদা, জোঁক আর সাপের উৎপাতে পায়ে হেঁটে চলাও বিপদজনক।
বিকাল নাগাদ আমরা পৌঁছাই বগালেক। সেখানে সেনা ছাউনি এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। উঁচু টিলার ওপর ছাউনির সৈনিকদের কাছে কৈফিয়ত দিতে দিতে আমাদের অবস্থা জেরবার।
কেনো আমরা রুমা ঘাট আর রুমা বাজারের সেনা ছাউনিতে রিপোর্ট করে আসিনি, এখানে আমাদের 'কিছু হলে' তার দায় - দায়িত্ব কে নেবে, আমাদের সঙ্গে গাইড নেই কেনো, আমি মুসলমান হয়ে কেনো ঈদের দিনে বাড়িতে না কাটিয়ে এখানে এসেছি (পরদিনই কোরবানী ঈদ), বুদ্ধর সঙ্গে কি ভাবে আমার পরিচয় -- ইত্যাদি ইত্যাদি।
এর আগে পাহাড়ে কি সমতলে একাধিকবার সেনা, বিডিআর, র্যাব, পুলিশ, আনসার, ভিডিপি, সামরিক - বেসামরিক গোয়েন্দা মোকাবিলা করতে হয়েছে। এ সব ক্ষেত্রে আমি বরাবরই আমার নকশালাইট বাবা আজিজ মেহেরের সূত্র অনুসরণ করি: কখনো নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে তর্ক করতে হয় না। যে কোনো বিষয়ে ওদের সঙ্গে ভদ্রভাবে সায় দিয়ে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
ওই সূত্রায়নে নিস্তার পাওয়া যায় অবশেষে। বার বার হলফ করতে হয়, কিছুতেই আমরা ক্রেওক্রাডং এর পর গহিন পাহাড়ে যাবো না।...
সেখানেই চোখে পড়ে একাধিক সেনা ও আনসার সদস্যর এন্টেনা নিয়ে মোবাইল টেলিফোন নেটওয়ার্ক পাওয়ার নিরন্তর কসরত। গ্রামীণ ফোনের নেটওয়ার্ক দুর্বল; সিটি সেলের নেটওয়ার্ক আসে আর যায়।
এক সেনা সদস্যকে দেখা গেলো বাঁশের একটি খুঁটির সঙ্গে মোবাইল সেট বেঁধে লাউড স্পিকারে চিৎকার করে গ্রামের বাড়ির খোঁজ খবর নিতে, মা কেমন আছেন? গরু কেনা হইছে? আমি ভাল আছি। কোনো চিন্তা করবেন না। ...
তার পেছনে কথা বলার জন্য অন্য সেনা সদস্যদের লাইন।
৯০ দশকের শুরুতে সারা দেশে মোবাইল ফোন চালু হলেও নিরাপত্তার অজুহাতে দেড় দশকেও রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান -- এই তিন পার্বত্য জেলায় এখনো মোবাইল ফোন চালু হয়নি। অথচ শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে একদশক আগে।
অন্যদিকে 'ইনসার্জেন্ট এরিয়া' খ্যাত ভারতের সেভেন সিস্টার রাজ্যগুলোতে মোবাইল ফোন চালু হয়েছে অনেক আগেই।
কবে যে আমাদের কর্তাদের বোধোদয় হবে!
তো চট্টগ্রাম জোনের নেটওয়ার্ক পার্বত্যাঞ্চলের কোনো কোনো উঁচু পাহাড়ে পাওয়া যায়। সেটুকুই ভরসা বিচ্ছিন্নভাবে পাহাড়ের সঙ্গে চলছে সমতলের মোবাইলে কথোপকথন।
*
বগালেক ঘিরে ছোট্ট একটি বম পাড়া। গ্রামটি এরই মধ্যে ছোট - খাটো পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। গড়ে উঠেছে দুটি সরকারি, আর একটি বেসরকারি রেস্ট হাউজ। কুয়াশায় পুরো লেকটি ভাল করে চোখে পড়ে না। তবু চারিদিক সবুজ পাহাড় ঘেরা শান্ত প্রাকৃতিক হৃদটির রূপ টের পাই। ঝুপ করে রাত নামে শিলা পাহাড়ের দেশে।...
আমরা একটি বম দোকানে চা - বিস্কুট খেয়ে নেই। দোকানী এক কিশোরী ময় বম। তাদেরই পারিবারিক রেস্ট হাউজে থাকার ব্যবস্থা হয়। মাথাপিছু সিট ভাড়া মাত্র ষাট টাকা। ময় মহাজনের দোকানেই তিন বেলা ভাতের ব্যবস্থা আছে। আমি 'ময়' শব্দের অর্থ জানতে চাই। চটপটে কিশোরী এবার লাজুক হয়। তার চতুর জবাব, যখন ক্রেওক্রাডং পাহাড়ের চূড়ায় উঠবেন, তখনই জানবেন, এই কথার অর্থ! পরে জেনেছি, বম ভাষায় 'ময়' কথার অর্থ হচ্ছে, সুন্দরী।
পাশের একটি মারমা গ্রাম থেকে এক বোতল 'প্রাইং' সংগ্রহ করে দুজনে রেস্ট হাউজে গল্পে মাতি। সারাদিনের কান্তি দূর করতে ভাতের রস থেকে তৈরি প্রাইং মদের জুড়ি নেই। এটি চাকমাদের 'দো-চোয়ানি'র চেয়েও কড়া। অনেকরই ধারণা, প্রাইং এর ৭৫ থেকে ৮০ ভাগই হচ্ছে অ্যালকোহল। এর রঙ একেবারে পানির মতো স্বচ্ছ; বোতল ঝাঁকালে পুরো মদটিতে দেখা যায় ফেনার বুদবুদ। আর বোতাল খুলে নাকে কাছে ধরলে সহজেই টের পাওয়া যায় এর ঝাঁজ।
আধ বোতল প্রাইং শেষ করে আমরা ময় মহাজনের রান্না করা ডিমের ঝোল তরকারি আর দুতিন রকম জুমের সব্জি দিয়ে রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ি।
মাঝ রাতে শীতের চোটে আমার ঘুম ভেঙে যায়। বেড়ার রেস্ট হাইজের ফাঁক গলে হু হু করে আসছে হিমেল হাওয়া। চারদিকে শুনশান নিরবতার ভেতর শুধু ঝিঁ ঝিঁ পোকা আর পেঁচার ভৌতিক কনসার্ট। দুটি পাতলা কম্বল আর একটি বম তাঁতের কম্বলেও শীত মানে না। শেষে চামড়ার জ্যাকেটটি ওপর ওই তিন কম্বল জোড়া দিয়ে শীত কাবু করে ঘুমিয়ে পড়ি।
*
পরদিন সকাল সাতটার দিকে ফ্রেস হয়ে ময় মহাজানের দোকানে ভাত আর চা খেয়ে আমরা রওনা দেই কেওক্রাডং এর উদ্দেশ্যে। আমাদের গাইড হন সাংলিয়ান কার্বারী (গ্রাম প্রধান)। বয়স তার বছর পঞ্চাশ। হ্যাভারশেক না থাকায় উচুঁ পাহাড় ভাঙতে খুব একটা কষ্ট হয় না। তবে টেরপাই, ২০ বছর ধরে নিয়মিত ধূমপানের ফলে ফুসফুসে দম কমে গেছে। মাঝে মাঝে হাপরের মতো বুক ওঠানামা করে। বাঙাল বিপ্লবের কাহিল দশা দেখে দুই পাহাড়ি দাঁত বের করে হাসেন। মাঝে মাঝে অল্প কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার খাড়া পাহাড় বেয়ে উঠে যাওয়া।
আমি সাংলিয়ান কার্বারীর কাছে জানতে চাই বগালেকের ইতিহাস। পোড়খাওয়া মানুষটি ভাঙা ভাঙা বাংলায় আমাকে যা বলেন, সংক্ষেপে তা অনেকটা এ রকম:
বম ভাষায় বগা লেক হচ্ছে 'বগা রেলি'। 'বগা' মানে অজগর, আর 'রেলি' হচ্ছে লেক। লেকের উত্তরে বাস ছিলো এক ম্রো পাড়ার। সেটি ব্রিটিশ আমলেরও আগের কথা। একবার ম্রো'রা বিশাল এক অজগর সাপ জ্যান্ত ধরে আনেন। পাড়ার সবচেয়ে বুড়ো লোকটি অনুরোধ জানান সাপটিকে যেনো আবার ছেড়ে দেওয়া হয়। কারণ এটি হচ্ছে পাহাড় দেবতা। বুড়োর কথায় কেউ কান দেয়নি।
সবাই মিলে রাতের বেলা সাপটি আগুনে পুড়িয়ে মদ দিয়ে খায়। কিন্তু বুড়ো লোকটি সাপের মাংস ছুঁয়েও দেখেন না।
ওই রাতে পাহাড়ি ঢল নেমে পুরো ম্রো পাড়াটি ভাসিয়ে নিয়ে যায়। পানির স্রোতে মারা পড়েন সবাই। বেঁচে যান একমাত্র সেই বুড়ো। সেই থেকে লেকটির সৃষ্টি।
এখনো নাকি ওই ম্রো বুড়োর ভিটে আর অজগরটির গুহা আছে।...
সাংলিয়ান দা'র কাছে আমি জানতে চাই একাত্তরের কথা। উনি বলেন, যুদ্ধ শুরু হলে একাত্তর সালে প্রায় ৫০০ জন বাঙালি নারী - পুরুষ, বৃদ্ধ - বৃদ্ধা আমাদের গ্রামগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের সঙ্গে ১০ জন অস্ত্র ধারী মুক্তিবাহিনী ছিলো। দুয়েকদিন পর পাকিস্তান আর্মি রুমা বাজার থেকে এগিয়ে আসতে থাকলে আমরা বাঙালিদের পথ দেখিয়ে ওপারে মিজোরামে পৌঁছে দেই। পরে আর পাকিস্তানি আর্মি এদিকে আসেনি। যুদ্ধের বাজারে তখন চালের সের পৌঁছেছিলো এক লাফে ৫০ টাকায়। অনেক অভাব আর দুঃখ - কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে আমাদের!
আমি জানতে চাই, আচ্ছা কার্বারী দা, আপনাদের এখানে শান্তিবাহিনী ছিলো? আপনি কখনো দেখেছেন তাদের?
উনি বলেন, শান্তি বাহিনী কখনো আমাদের এখানে স্থায়ীভাবে ছিলো না। শুধু একবার আমি জুম চাষ করতে গিয়ে ১০ - ১৫ জনের একটি দলকে পাহাড়ি পথ অতিক্রম করতে দেখেছি। সবার পরনে পাতা রঙের সবুজ পোশাক। আর ভাড়ি ভাড়ি হাতিয়ার। তবে আমাদের এখানে অনেক বছর ছিলো মিজো বাহিনী (মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট, এমএনএফ)। কেওক্রাডং এর এই পথটি ধরেই মিজো নেতা লাল ডেঙা চলাচল করতেন।
এবার আমি ও বুদ্ধ দুজনেরই কৌতুহল, কেমন দেখতে উনি?
কার্বারী দা বলে চলেন, লাল ডেঙা খুব লম্বা - চওড়া বলশালী মানুষ। বয়স প্রায় ৬০ বছর। পরনে সাদা শাট আর নীল প্যান্ট। সব সময় ওনার নিরাপত্তায় থাকতো ৫০ - ৬০ জনের একটি বাহিনী। ওদের পরনেও ছিলো পাতা - সবুজ পোষাক। অস্ত্র - শস্ত্র সবার হাতে হাতে। মিজো দলে অনেক মহিলা যোদ্ধাও ছিলো। কিন্তু মিজো বাহিনী খুব খারাপ।...
কেনো?
তার উত্তর, ১৯৬৫ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত মিজো বাহিনী আমাদের এখানে ছিলো। তারা দিনের পর দিন আমাদের গ্রামে আস্তানা গেড়ে বাস করতো। আমরা তাদের খাওয়াতাম, আবার চাঁদার টাকাও দিতাম। তাদের ছাগল, মুরগী, শুকর কেটে ভাত দিতে হতো। আমাদের কোনো মেয়েকে তাদের পছন্দ হলে জোর করে ওরা বিয়ে করতো। আমাদের দিয়ে ওরা এক ক্যাম্প থেকে আরেক ক্যাম্পে বিনে পয়সায় বোঝা টানাতো।
একবার আমাদের গ্রামের একজন বম মেয়েকে মিজো বাহিনী বিয়ে করে ওপারে মিজোরামে নিয়ে যেতে চায়। আমি বাধা দিলে ওরা আমাদের তিনজনকে গুলি করে মারার জন্য এক সারিতে দাঁড় করিয়েছিলো। পাহাড় - জঙ্গল ভেঙে আমরা দৌড়ে পালিয়ে সেবার বাঁচি।
সাংলিয়ান কার্বারী বার বার আক্ষেপ করে বলেন, আমি শুনেছি, মিজোরাম দেশটি নাকি খুব সুন্দর। মিজো বাহিনী জয়লাভের পর ওখানে নাকি এখন খুব শান্তি। জিনিষপত্রের দাম খুব শস্তা, জুম করা যায়, ঘন বনে শিকারও মেলে প্রচুর। কিন্তু আমি কখনো মিজেরামে যাবো না। মিজো বাহিনী খুব খারাপ।...
আমরা জানতে চাই, পাকিস্তান কি বাংলাদেশ সেনা বাহিনীর সঙ্গে মিজো বাহিনীর কখনো বন্দুক যুদ্ধ হয়নি?
কার্বারী দা বলেন, আরে না। পাকিস্তান আর্মি আর বাংলাদেশ আর্মিই তো মিজো বাহিনীকে এপাড়ে আশ্রয় দিয়েছে। ওরা মিলেমিশে থাকতো। কেউ কাউকে ঘাঁটাতো না। মাঝে মাঝে এ - ওর ক্যাম্পে বসে চা - বিস্কুটও খোতো!
পথে পথে আমরা কথা বলি বম, মারমা আর ত্রিপুরা জুমিয়াদের সঙ্গে। ইঁদুর বন্যায় সবাই সর্বস্বান্ত হয়েছেন। এখন অন্যের জুমে দিন মজুরীই ভরসা। অনেকে দিন মজুরীর কাজ খুঁজতে দূর - দূরান্ত থেকে রুমা বাজারে রওনা হয়েছেন। আদা কিংবা শীতের সব্জি চাষ করে ক্ষতি পুষিয়ে নেবেন, এমন সঙ্গতিও অধিকাংশের নেই। ফসলের বীজও খেয়ে ফেলেছে ইঁদুর। ঘরে ঘরে হাহাকার।...সামনের বর্ষায় দুর্ভিক্ষ দেওয়ার আতঙ্ক সবার চোখে -- মুখে। প্রশাসন থেকে কেউ কোনো খবর নেয়নি এইসব অসহায় মানুষের।...
*
ঘন্টা তিনেক পাহাড় ভাঙার পর আমরা ছবির মতো সুন্দর একটি বম গ্রামে পৌঁছাই। নাম দার্জিলিং পাড়া। সেখানে যুবক - যুবতি প্রায় কেউই গ্রামে নেই। ইঁদুর বন্যার পর সবাই দলে দলে এদিক সেদিক কাজ খুঁজতে গেছেন। আমাদের স্বাগত জানায় ছোট্ট বম দোকানী সাহিত। সে রুমা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। বড়দিনের ছুটিতে বাড়িতে এসেছে (বমদের অধিকাংশই ছয় দশক আগে প্রোটেস্টাইন খ্রিষ্টান হয়েছেন।)।
সাহিত বমের দোকানে চা - বিস্কুট- কলা খেয়ে আমরা আবার রওনা দেই কেওক্রাডং এর পথে। আধঘন্টা হাঁটার পরে ভর দুপুরে পৌঁছাই দেশের সবচেয়ে উঁচু পর্বত শিখরে। সেখানে বম ছাত্র - ছাত্রীরা বড়দিন উপলক্ষে পথচারীদের জন্য বিনে পয়সায় বাঁশের চোঙায় করে রং চা খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। পাশাপাশি চলছে গিটার বাজিয়ে বম ভাষায় গানের রিহার্সেল।
আমরা চা খেয়ে কেওক্রাডং এর চূড়ায় ফটো সেশন করি। বগালেক থেকে ১০ কিলোমিটার খাড়া পাহাড় ভেঙে মনে হয়, আরে! এই পাহাড় বিজয় তো মোটেই এতো দূর্গম আর এতো কষ্টকর নয়!...
ছবি: লেখক
মন্তব্য
অ্যাঁ!
আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
আহা দাদা . পুরোনো কথা মনে করে দিলেন?? ২০০১ এবং ২০০৩ সনে দুই দফায় ১১ দিন পাহাড়ে রাত যাপনের স্মৃতি আজও ভুলতে পারছিনা। বগালেক, কেওকারাডাং, তেজিংঢং.... তবে পাহাড়ীদের আতিথেয়তা অসাধারন। বিশেষ করে বগালেকের লারামের কথা মনে আছে. দুই বারই লারাম আমাদের কেওকারাডং পর্যন্ত নিয়ে গেছে। ওর বাবা ছিলো বগা লেকের কার্বারী , এখন নিশ্চই লারাম কার্বারী হয়েছে। আমার সেই পুরোনো লিখাটা (দ্যা ডেইলি স্টার ) মন্তব্যে জুড়ে দিলাম।
---------------------------
স্বপ্নকে ছুঁতে চাই সৃষ্টির উল্লাসে
-------------------------------
স্বপ্নকে ছুঁতে চাই সৃষ্টির উল্লাসে
বাহ, আপনার লেখাটি তো খুব সুন্দর! ছবিগুলো আপনি তুলেছিলেন?
কিন্তু ওই লেখায় Bom শব্দের বানান Bawm হবে।
যাই হোক। বগালেকে লারামের সঙ্গেও আলাপ হয়েছে। ওর বাবাই সাংলিয়ান কার্বারী, আমাদের গাইড। পাশের মারমা পাড়া থেকে লারামই আমাদের প্রাইং যোগাড় করে দেয় । অনেক ধন্যবাদ।
আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
কি আশ্চর্য - ওলন্দাজ ভাষায় ও mooi (ময়) মানে সুন্দর।
উরে সের'ম হইছে। চরম এবং ব্যাপক
তোর জন্য আকাশ থেকে পেজা
এক টুকরো মেঘ এনেছি ভেজা
বৃষ্টি করে এক্ষুনি দে তুই
বৃষ্টি দিয়ে ছাদ বানিয়ে শুই
তোর জন্য আকাশ থেকে পেজা
এক টুকরো মেঘ এনেছি ভেজা
বৃষ্টি করে এক্ষুনি দে তুই
বৃষ্টি দিয়ে ছাদ বানিয়ে শুই
দুর্দান্ত লেখা। (বিপ্লব)
কি মাঝি? ডরাইলা?
(বিপ্লব) দেয়ার জন্যই এত রাতে লগাইলাম
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ।
ছবির রেজ্যুলেশন কমিয়ে লেখাটিতে আরো ছয়টি নতুন ছবি যোগ করা হলো।
'নিরাপত্তার কারণে' দুর্গম পাহাড়ে পর্যটকদের ভ্রমনের অনুমতি মিলছে না। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে সরেজমিন প্রতিবেদনটি পড়ুন এখানে ।
আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
আপনাকে বিপ্লব
ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ
অজ্ঞাতবাস
অসাধারণ এক পোস্টের জন্য আপনাকে আন্তরিক অভিবাদন।
আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
নতুন মন্তব্য করুন