গারো পাহাড়ে হিংস্র শ্বাপদের সঙ্গে যার নিত্য বসবাস, এই পাথুরে শহরে এসে অবশেষে জেনেছে সে, সবচেয়ে হিংস্র পশুর নাম মানুষ!...
প্রিয় স্মৃতি রিছিল,
তুমি হয়তো এখন আমাকে আর চিনবে না। না চেনাটাই অবশ্য খুবই স্বাভাবিক। তবে স্মরণ করিয়ে দেই, ১৯৯৫ সালে সাবেক কর্মস্থল দৈনিক আজকের কাগজে তোমাকে নিয়ে যে প্রতিবেদন লিখেছিলাম, তার সূচনা বক্তব্য ছিলো অনেকটা ওই রকম।
তুমি তখন গণধর্ষণের শিকার হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছিলে। তখন তোমাকে ঘিরে ছিলো কয়েকজন মহিলা পুলিশ। গারো নেতা সঞ্জিব দ্রং আমাকে নিয়ে হাসপাতালে যখন পৌঁছান, তখন আমি তোমার যন্ত্রণাবিদ্ধ মায়াবি কিশোরী মুখখানিতে যেনো ওই লেখাগুলোই পড়েছিলাম।...
সঞ্জিব দা মান্দি ভাষায় তোমাকে অভয় দিয়ে কিছু বলেছিলেন। ধারণা করি, সেটা হয়তো এ রকম: তুমি সব কথা এই সাংবাদিক দাদাকে খুলে বলো। সে পত্রিকায় নিউজ করলে পুলিশ দোষিদের গ্রেপ্তার করবে। তারা শাস্তি পাবে। আমরা কাউকে ছাড়বো না -- ইত্যাদি।
আমি হাসতাপাতালের বেডের একপাশে বসে তোমার হাত ধরে বলি, দিদি, তোমার জীবনে যা ঘটে গেছে, তা নিয়ে দুঃখ করো না। মানুষের জীবনে অনেক দুর্ঘটনা ঘটে। ধরে নাও এটি সে রকমই একটি দুর্ঘটনা। আমাকে সব কথা খুলে বলো।...
তুমি নীচু গলায় বলতে শুরু করো:
ঢাকায় এসে গুলশানের একটি গার্মেন্টসে আমার এক দাদার সঙ্গে কাজ নেই। বস্তির একটি ঘরে ওই দাদার সঙ্গে থাকতাম। গার্মেন্টেসে যাওয়া আসার পথে কয়েকটি বখাটে ছেলে আমাকে উত্যাক্ত করতো।
দাদা আমাকে পই পই করে বলে দিয়েছিলো, দেখো স্মৃতি, ওরা সব খারাপ ছেলে। খবরদার তুমি ওদের সঙ্গে কথা বলবে না। ওরা যা-ই বলুক, কোনো কথার জবাব দেবে না।...
একরাতে বখাটে যুবকরা দরজা ভেঙে বস্তি ঘরের ভেতরে ঢোকে। ওরা মদ খেয়ে মাতাল হয়ে এসেছিলো। কয়েকজনের হাতে লম্বা ধারালো ছুরি। আরো কয়েক জন বাইরে পাহারায় থাকে। ঘরে ঢুকেই ওরা আমার গলায় ছুরি চেপে ধরে। দাদার হাত - পা - মুখ বেঁধে ফেলে। আমারও মুখ বাঁধে গামছা দিয়ে। ওরা আমাকে ওদের সঙ্গে 'কাজ' করতে বলে। আমি রাজি না হলে একে একে শুরু করে ধর্ষণ।...
প্রিয় স্মৃতি,
এরপর তুমি নির্বাক হয়ে যাও। তোমার দৃষ্টিশুন্য চোখের কোনা দিয়ে গড়িয়ে পড়ে বেদনার লোনা জল। ...
আমি সঞ্জিব দাকে অনুরোধ করি, গারো ভাষায় যেনো তোমাকে প্রশ্ন করেন, ওরা কতোজন এসেছিলো, আর তুমি কাউকে চিনতে পেরেছিলে কি না।
তোমার সঙ্গে আলাপ করে সঞ্জিব দা আমাকে জানান, যুবকদের সংখ্যা সাত থেকে আটজন বা তারও বেশী হতে পারে। ধর্ষণ শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই তুমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলো। তবে চারজনকে তোমার স্পষ্ট মনে আছে। গুলশান থানায় দেওয়া মামলার এজাহারে তুমি ওই চার ধর্ষকের নাম বলেছো।
এরপর আমি হাসপাতালের বিছানায় স্যালাইন লাগানো অবস্থায় তোমার একটি ছবি তুলি প্রতিবেদন তৈরি করি।
এই ফাঁকে তোমাকে বলি, তখন সংবাদপত্রে অবলীলায় কোনো রকম বাছবিচার ছাড়াই ধর্ষিতার ছবি ও নামধাম ছেপে দেওয়া চলতো। পরে অবশ্য নারী সংগঠনগুলো সংবাদপত্রের সম্পাদকদের সঙ্গে একাধিক মতবিনিময়ের আয়োজন করলে এই রীতি বাদ দেওয়া হয়।
তো আজকের কাগজ কর্তৃপক্ষ প্রথমে তোমার কথা আদিবাসী সংবাদ হিসেবে না দেখে এটিকে আর পাঁচ - দশটি ধর্ষণ সংবাদের কাতারে ফেলতে চেয়েছিলো। আমরা সাংবাদিকরা হেলা করে যাকে বলি: সতেরোর পাতায় দুই ইঞ্চি! অর্থাৎ একেবারে ভেতরে ১৭ নম্বর পৃষ্ঠায় এক কলাম দুই ইঞ্চি আকারে সংবাদটি প্রকাশ পাবে।
সঞ্জিব দাই বার্তা সম্পাদককে টেলিফোনে অনুরোধ জানান, তোমার খবর যেনো প্রথম পাতায় গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ হয়। এই অনুরোধে কাজ হয়। সচিত্র স্মৃতি রিছিল সংবাদ প্রথম পাতায় গুরুত্বসহ ছাপা হয়।
পরদিন তোমার ধর্ষকরা এখনো গ্রেপ্তার হয়নি; ঘুরে বেড়াচ্ছে পুলিশের চৌহদ্দির মধ্যেই -- এমন আরেকটি ফলো আপ প্রতিবেদনও করি।
অন্যান্য দৈনিকগুলোও শুরু করে তোমাকে নিয়ে মানবিক সব প্রতিবেদন। নারী সংগঠনগুলোও সোচ্চার হয়। শুরু হয় সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল, সংবাদ সম্মেলন।
নড়েচড়ে বসে পুলিশ কর্তারা। গ্রেপ্তার হয় ধর্ষক পালের গোদারা। গুলশান থানার ওসি আওরঙ্গজেব অবশ্য পরে নিজেই চাকরিচ্যূত হন একজন ব্রিটিশ মহিলাকে থানার ভেতর করার ধর্ষণ দায়ে। সে আরেক অন্য ইতিহাস।...
প্রিয় স্মৃতি রিছিল,
এরপর আর কখনো তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। আমি শুনেছি, বাঙালি সমাজের মতোই গারো সমাজ ধর্ষিত নারী, তোমাকে গ্রহণ করেনি। জীবন বাঁচাতে তুমি এক মিশনারী আশ্রমে আশ্রয় নিয়ে নামধাম বদলে সন্নাস জীবন বেঁছে নিয়েছো। জানি না, এখন তুমি কোথায় আছো, কেমন আছো।...
আমিও হয়তো তোমাকে ভুলেই যেতাম। যদি না এর পর পাহাড়ের একাধিক ধর্ষিতা নারীর সংবাদ আমাকে না করতে হতো। যখনই আদালত পাড়ায় ধর্ষিতা কিশোরী তানিয়া বা আরেক ধর্ষিতা রাহেলার সংবাদ লিখতে থাকি...অথবা অনলাইনে পড়ি মুখতারমাই এর মতো কোনো দুঃখী নারীর কথা, এই প্রায় একযুগ পরেও তোমার সেই বেদানার্থ মুখখানি মনে পড়ে। অস্ফুট স্বরে তুমি জানতে চেয়েছিলে, ও দাদা, আমার অপরাধ কি বলো? কেনো আমার জীবনে এমনটি হবে?...
ছবি: জুমঘর, ফিলিপ গাইন, সেড।
মন্তব্য
অদ্ভূত সমাজ! নির্যাতিনের শিকার নারীকে নাম পাল্টে সন্নাস জীবন বেছে নিতে হয়।
অদ্ভূত রাষ্ট্র! যেখানে নিরাপত্তা প্রহরীরা মালিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।
অদ্ভূত আইন ! যা অপরাধীদেরই স্বার্থ সংরক্ষন করে।
অদ্ভূত বিচারব্যবস্থা ! যেখানে সর্বোচ্চ বিচারালয় রায় দিয়ে বলে জরুরী আইনের অধীনে মামলা হলেই আটককৃত ব্যক্তি জামিন পাবেনা.. তিনি প্রকৃত অর্থে অপরাধী হোন আর না হোন।
অদ্ভূত গণমাধ্যম ! নির্বাচিত সরকারকে তুলোধুনো করতে পারে অথচ অনির্বাচিত (কারো কারো মতে অবৈধ) সরকারের ভুলগুলো বলার সাহস পায়না।
অদ্ভূত আমরা...........এতো কিছুর মধ্যেও বেঁচে আছি...হাসি .. খেলি.......
বলার মত কিছু থাকেনা। কেমন একটা কাঁপন লাগে শরিরে
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
(দীর্ঘশ্বাস)
(মন খারাপ)
---------------------------------
এসো খেলি নতুন এক খেলা
দু'দলের হেরে যাবার প্রতিযোগিতা...
কিছুই বলতে ইচ্ছা করছে না
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
চারপায়ের জানোয়ারদের চেনা যায়, সমস্যা দুপায়ের জানোয়ারদের নিয়েই।
---ইবা
সত্যি কিচ্ছু বলার নেই। আপনাকে বিপ্লব আরেকটা বিপ্লবের জন্যে।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
সত্যিই অদ্ভূত! ধর্ষণের মত একটি জঘন্য অপরাধের শাস্তি চাপিয়ে দেয়া হয় ধর্ষণের শিকারের উপর।
১.
বিপ্লবদা, আমাকে ক্ষমা করবেন।
আমি একজন পুরুষ, যার মতো পুরুষেরা স্মৃতি রিছিলের অপমানের জন্যে দায়ী।
২.
আমরা যে বর্তমান বাংলাদেশে জন্মেছি, তাতে আমার মাঝে মাঝে ঘেন্না হয়। অপমানের পর নাম না বদলিয়ে এই মেয়েটা বাঁচবে, এই সমাজে? আমরাই হয়তো, আমাদের কর্মক্ষেত্রে এইরকম একজন মেয়ে সহকর্মী থাকলে আড়ালে আবডালে ফিসফিস করবো, জানেন, "আমাদের অফিসের মিজ স্মিতি আসলে ওই খবরের মিজ স্মৃতি.. "
আমাদের মানসিকতা এখনও এতোটা পূর্ণ হয়ে ওঠেনি যে, ধর্ষিতা স্মৃতি রিছিল কে সহকর্মী স্মৃতি রিছিল কিংবা প্রেমিকা স্মৃতি রিছিল হিসেবে আমরা গ্রহণ করবো।
৩.
রাহেলা মরে গেলে, আমরা ব্লগে আর অনলাইন কম্যুনিটিতে চিতকার করবো, কারণ, ভার্চুয়াল ব্যাপারগুলোতো দায়-দায়িত্ব প্রায় শূন্য। আর রাহেলার প্রায় অশিক্ষিত স্বামীপ্রবরটি পুরো ব্যাপারটিকে ভুলে গিয়ে আরেকটি মেয়েকে বিয়ে করবেন।
আমি বাজি রাখতে পারি, আমি-আপনি, যারা সুশিক্ষিত এবং স্বশিক্ষিত, রাহেলার স্বামীর জায়গায় থাকলে একই কাজ করতাম হয়তোবা।
৪.
এই সমাজে মেয়েরা কোন একটা পুরুষের নির্ভরতা ছাড়া একা হাঁটতেও পারে না। আমি আমার চেয়ে সামান্য বড় সহোদরার সাথে অনেকটা সময় সঙ্গ দিয়েছি, একা কোচিং বা বাজারে যেতো যখন, আমি পিচ্চি মানুষটা সাথে থাকতাম। নির্ভরতার জন্য, নিরাপত্তার জন্যে। মা যখন সাথে যেতে বলতো, খুব ছোটবেলায় বিরক্ত লাগতো। যখন বুঝতে শিখেছি, তখন নিজেই জোর করে যেতাম।
সাথে দ্বিতীয় একজন ছাড়া একজন মেয়ের বাজারে কেনাকাটায় নিরাপত্তা দেবার মতোন পরিস্থিতি আমরা এখনো তৈরি করতে পারিনি।
৫.
মাঝেমধ্যে মনে হয় এই পুরো সমাজের মুখের উপরে, সমাজের সব অলীক ভিত্তির উপরে জিপার খুলে জলত্যাগ করি।
-
আরণ্যক সৌরভ
সবাইকে অনেক ধন্যবাদ।
পুরোপুরি একমত @ আরণ্যক সৌরভ।
আপনার ওই সব অনুভূতি আমারও।।
আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
- জুমঘর দারুণ পছন্দ হয়েছে।
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
পড়ে খুব কষ্ট লাগলো.. দু:খ পেলাম..
মানুষকে আজকাল পশু বলে ডাকলেও মানুষ লজ্জাবোধ করে না ! হয়তো পশুদের সমাজে মানুষ শব্দটাই জঘন্যতম গালি হিসেবে প্রচলিত হয়ে গেছে !
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
নতুন মন্তব্য করুন