৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি যেভাবে রেডিওতে প্রচারিত হলো...

বিপ্লব রহমান এর ছবি
লিখেছেন বিপ্লব রহমান (তারিখ: শুক্র, ২৮/০৩/২০০৮ - ৪:৪০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

.

১৯৭১ এর মার্চ মাসের সময়টা ছিলো ভয়ঙ্কর। তারপরও সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলোতে পাকিস্তান রেডিওর ঢাকা কেন্দ্রের কয়েক জন দুঃসাহসী কর্মকর্তা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক সে ভাষণ সম্প্রচার করেছিলেন।

পাকিস্তানি সামরিক জান্তার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় শেখ মুজিব যে ভাষণ দেন তা সম্প্রচারের জন্য দুঃসাহসী সেসব কর্মকর্তাদের কাছে জাতি চীর কৃতজ্ঞ।

অগ্নিঝরা সেই ভাষণের বিষয়বস্তু পৌঁছে গিয়েছিলো বাংলাদেশের প্রতিটি প্রান্তে। এ ভাষণের মধ্য দিয়েই বাঙালির নেতা পাকিস্তান সরকারের সাথে যাবতীয় সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা করেন। এ ভাষণের বাঙালির স্বাধিকারের আকাঙ্খাকে আরও উস্কে দিয়েছিলো। আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলো জনগণের মনে।

পাকিস্তান রেডিওর শাহবাগ কেন্দ্রে প্রবেশ করাটাও কর্মকর্তাদের জন্য ছিল কঠিন এক ব্যাপার। সম্প্রচারের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল সামরিক সরকার। এসব সামরিক নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহারের দাবিতে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদে রেডিওর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এক ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিলেন।

যে আট-দশজন বেতারকর্মী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে '৭১ এ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্র থেকে প্রচার করেন, তাদের একজন আশফাকুর রহমান খান। রেডিও পাকিস্তান ছেড়ে পরবর্তীতে তিনি যোগ দিয়েছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে।

বছর দুয়েক আগে আমি এই অকুতোভয় সৈনিক আশাফাকুর রহমানের সন্ধান পাই আমারই আরেক সহকর্মী নজরুল ইসলামের মাধ্যমে। তিনিও একসময় বাংলাদেশ বেতারে কাজ করার সময় এই ব্যক্তিত্ব সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন।

ধানমণ্ডির বাসায় আলাপকালে এই মুক্তিযোদ্ধা বারুদঝরা সেই দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করেন । তার কথোপকথন থেকে সে সময় আমি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম এর জন্য তৈরি করি একটি বিশেষ প্রতিবেদন।

সে সময় আশফাকুর রহমান খান বলেন, 'তখন আমার বয়স মাত্র ২৮। রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রে অনুষ্ঠান সংগঠক হিসেবে সদ্য যোগ দিয়েছি। মার্চের শুরুতেই পাকিস্তানের সেনা সদস্যরা সশস্ত্র অবস্থান নেয় শাহবাগের ওই বেতার কেন্দ্রে। কোন অনুষ্ঠান যাবে আর কোনটি যাবে না, সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার মেজর সিদ্দিক সালেক এটি নিয়মিত তদারকি করতেন । এরই মধ্যে আমরা আন্দোলন-সংগ্রামের খবর, শ্লোগান, গণসঙ্গীত, দেশাত্নকবোধক গান, নাটক -- ইত্যাদি অনুষ্ঠান প্রচার করতাম।'

'আমাদের নেতৃত্ব দিতেন রেডিওর আঞ্চলিক পরিচালক আশফাকুজ্জামান খান। তিনিই গোপনে আমাদের জানান, আমরা সেনা নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে রেডিওতে সরাসরি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার করবো। সে-কি উত্তেজনা আমাদের মধ্যে! ৬ মার্চ রাতেই রেডিওর প্রকৌশলীরা রমনা রেসকোর্স মাঠে যে মঞ্চ থেকে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেবেন, সেখানে টেলিফোনের তার ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি বসায়।'

আশফাকুর রহমান খান বলেন, '৭ মার্চ বেলা ২টায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ দেওয়ার কথা। বেলা ১২টা থেকে আমরা রেডিওতে কিছুক্ষণ পর পর ঘোষণা দিতে থাকি, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সরাসরি প্রচার করা কথা। বঙ্গবন্ধু একটু দেরিতে বেলা ২টা ২০মিনিটের দিকে মঞ্চে আসেন।

এদিকে একই সময় রেডিও অফিসে মেজর সিদ্দিক সালেক টেলিফোনে মেসেজ পাঠান: নাথিং অব শেখ মুজিবুর রহমান উইল গো অন দ্য এয়ার আনটিল ফারদার অর্ডার।...

এই মেসেজ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা প্রতিবাদ হিসেবে রেডিওর সমস্ত কাজকর্ম বন্ধ করে দিয়ে অফিস ছেড়ে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে চলে যাই। ওই দিন আমরা রেডিওর অনুষ্ঠান বয়কট করি। সাভারে একটি বিকল্প শক্তিশালী ট্রান্সমিটার ছিলো। সেখান থেকে যেনো আবার অনুষ্ঠান প্রচার করা না হয়, সে জন্য সেখানে ট্রাংকল করে খবর দেওয়া হয় সকল রেডিও কর্মীকে আত্নগোপন করার জন্য। ওইদিন রেডিওতে আর কোনো অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়নি ।'

তিনি স্মৃতি হাতড়ে বলে চলেন, 'ওই সন্ধ্যায় আমরা এলিফ্যান্ট রোডের এক বাসায় গোপন বৈঠকে বসি। রাতে আমাদের নেতা আঞ্চলিক পরিচালক আশফাকুজ্জামান খবর নিয়ে আসেন, সেনাবাহিনী রাজি হয়েছে রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার করতে। তবে শর্ত হচ্ছে, সবাইকে কাজে ফিরে যেতে হবে। পরদিন ৮ মার্চ সকাল ৭টায় আমরা আবার কাজে যোগ দেই। রেডিওতে প্রচার করা হয় রেকর্ড করা বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ, ...এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম!'...
---
ছবি: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
ইংরেজী প্রতিবেদনটির লিঙ্ক


মন্তব্য

মাহবুব লীলেন এর ছবি

সালাম
আবারো সালাম মুক্তিযুদ্ধের এইসব নেপথ্য কর্মীদের

০২

একটা আক্ষেপ:

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সারা বছরই কোথাও না কোথাও আলোচনা হয়
কিন্তু সেইসব আলোচনার বেশিরভাগই কেন্দ্রিভূত থাকে সরাসরি মুক্তিযোদ্ধা কিংবা রাজনৈতিক নতৃবৃন্দের উপর
কিন্তু আমাদের পুরো মুক্তিযুদ্ধ জুড়ে এমনকি যখন মুক্তিযুদ্ধের পট তৈরি হচ্ছিল তখনও অনেক অনেক নেপথ্য যোদ্ধার ছিল অতুলনীয় অবদান
আমরা খুব কমই সেই খবর রাখি কিংবা সেই খবরগুলোকে আলোচনায় আনতে আগ্রহী হই

০৩
ব্প্লিব রহমানকে ধন্যবাদ

তারেক এর ছবি

শ্রদ্ধা জানাই ওঁদের প্রতি!
ভাগ্যিস আমাদের একজন বিপ্লবদা আছেন ব্লগে। হাসি
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

মনে আছে, ৭ মার্চ আমরা সবাই রেডিওর পাশে জড়ো হয়েছি ভাষণ শোনার জন্যে। বগুড়া শহরে বাস, রেসকোর্সে উপস্থিত হওয়া সম্ভব নয়। রেডিও ছাড়া আর উপায় কী? অথচ নির্ধারিত সময়ে রেডিও থেকে একটা শব্দও আসে না। আকাশবাণী ধরে বোঝা গেলো রেডিওর দোষ নয়। তাহলে কী হলো? কী ঘটছে ঢাকায়? উদ্বেগ বাড়ে। কোনো খবর পাওয়া যায় না। তখন টেলিফোন সুলভ ছিলো না, আমাদের বাড়িতে তখনো টিভি আসেনি।

ভাষণটি পরদিন সকালে রেডিওতে শোনা হয়েছিলো। আজ এতো বছর পরেও ভাষণটি শুনলে সেই দিনের কথা মনে পড়ে, রোমকূপ শিহরিত হয় ঠিক সেই দিনের মতোই।

বন্দুকের মুখে নীরব প্রতিবাদ করার সাহসও তখন এইসব মানুষের ছিলো। তাঁদের জন্যে অভিবাদন।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

রায়হান আবীর এর ছবি

নেপথ্যের মানুষদের নিয়ে জানা হয়নি কিছুই...দেশ স্বাধীনে তাদের অবদান তো কোন অংশে কম নয়। সেই সব মানুষদের শ্রদ্ধা রইল...
আর তাদের এক অংশের কথা জানাবার জন্য (বিপ্লব)
---------------------------------
এভাবেই কেটে যাক কিছু সময়, যাক না!

জাহিদ হোসেন এর ছবি

সে এক আশ্চর্য্য সময় ছিল। আর ছিল সোনার মতো মানুষেরা। বহুদিন আগে শোনা একটি (বোধকরি সিনেমার) গান মনে পড়লো।
"মানুষ বানাইলি, খোদা তোর মানুষ গেল কই?"

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

সৌরভ এর ছবি

হ্যাঁ, যুদ্ধের শুরু এইসব জায়গা থেকেই।
দারুণ, বিপ্লব বস।


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

সুন্দর বর্ণনা। ইতিহাসটা এখান থেকেই জানলাম। (বিপ্লব)

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

থার্ড আই এর ছবি

বরাবরের মতোই চমক,সেই সাথে বর্ণনার ঢং ও প্রানবন্ত।
ধন্যবাদ আপনাকে।
---------------------------
স্বপ্নকে ছুঁতে চাই সৃষ্টির উল্লাসে

-------------------------------
স্বপ্নকে ছুঁতে চাই সৃষ্টির উল্লাসে

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

কী এক সময় ছিলো সেটা! ভাবতেই রোমাঞ্চ হয়।
ধন্যবাদ, বিপ্লব রহমান।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

বিপ্লব রহমান এর ছবি

সঙ্গে থাকার জন্য আপনাদেরও ধন্যবাদ।


আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

স্যালুট, জনাব আশফাকুর রহমান খান ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।