ছোট বেলায় দাদু বাড়ি বেড়াতে গেলে দাদিমা সকাল বেলায় খেতে দিতেন গরম গরম লাল চালের এক থালা বউখুদ, হাসের ডিম ভাজা, আর সামান্য মিষ্টি আচার।
আহ, শৈশবের দাদু বাড়ির সেই সব সোনালী দিন! ইছামতি নদীর পাড়ে অশ্বত্থ গাছের ছায়ায় বসে শুধু পাল তোলা নৌকার আনাগোনা দেখেই বুঝি কাটিয়ে দেওয়া যেতো একটি জীবন!
দাদিমা মারা গেছেন সেই স্কুলের নীচু ক্লাসে থাকতেই কোন বেলায়। লাল রঙা আলো চালও আর নেই। তাই বউখুদ নামের চালের ভগ্নাংশও আর নেই। সব চালই এখন কলের মেশিনে ভাঙা হয়। কলের মেশিনে আর যাই হোক খুদ - কুড়ো বা বউখুদ পাওয়া যায় না।
মেইলবোর্ন প্রবাসী আমার বড়দিদি তানিয়া এখন ঢাকায় বেড়াতে এসেছেন। সে আবার বড় হয়েছে সেই ইছামতির পাড়ে, দাদু বাড়িতে। শুনেছি, শৈশবে নাকি দুর্দান্ত ডানপিটে ছিলেন। দিদি অবশ্য বড় হয়ে গেলে বেশ শান্তশিষ্ট হয়ে উঠেন। দাদিমা তাকে হাতে ধরে নানান রকম রান্না - বান্নার গোপন কলা - কৌশল শেখান। সেই সঙ্গে হরেক রকম আচার বানানোর রেসিপি তো আছেই।
তো দিদি কয়েকদিনের জন্য আমাদের বাসায় এসে রান্না - বান্নার সমস্ত দায়িত্ব নিয়েছেন। তারই সুবাদে যে সব রান্না অনেকদিন আমাদের বাসায় হয় না, সেই সব সুস্বাদু সব খাবার - দাবারে সকাল - বিকাল ডাইনিং টেবিল ভরে উঠছে। সকালের নাস্তায় আবার ফিরে এসেছে আমার প্রিয় চিজ-নুডুল, ব্লাক কফি।
আজ সকালে কাজে বের হতে যাওয়ার আগে দেখি থালা ভর্তি ফ্রাইড রাইস, ছোট বাটিতে গরুর মাংস, সঙ্গে মিষ্টি বড়ইয়ের আচার। খেতে বসে ফ্রাইড রাইসটিকে আমার অচেনা মনে হয়। পরে মনে হয় এটি বোধহয় তেল, কাঁচা মরিচ- পেঁয়াজ দিয়ে বানানো ভাত-ভুনা। নাহ, তা - ও সন্দেহ যায় না।
দিদিকে ডেকে জিজ্ঞেস করতে তিনি হেসে বলেন, বাবু, তোর মনে নেই, সেই দাদিমার বাড়ি কথা? তুই ছোট বেলায় বউখুদ আর ডিম ভাজা খেতে খুব ভালোবাসতি! এখন বার্ডফ্লু'র জন্য তো ডিম খাবার যো নেই, তাই একটু গরুর মাংস করেছি।...
ঝাঁ করে আমি ফিরে যাই সেই ধুসর শৈশবে। ...দিগন্ত জোড়া শর্ষে ফুলের ক্ষেত, বাগান বিলাসে ছাওয়া ব্রিটিশ আমলের লাল রঙা একতলা বাড়ি। সিরাজগঞ্জের প্রত্যন্ত অজ পাড়া গাঁর দাদু বাড়ির নানা রকম আদুরে সব দৃশ্য সাদা - কালো সিনেমার স্লাইডের মতো একে একে আমার চোখের সামনে ভাসতে থাকে। ...
আমি জানতে চাই, কিন্তু তুমি বউখুদ পেলে কোথায়?
দিদি বলেন, এখন তো আর ঢেঁকির চাল নেই। তাই বউখুদ হয় না। আমি তোর জন্য ব্লেন্ডারে চাল ভেঙে খুদ তৈরি করেছি।
আমি মনে পড়ে যায়, এ যেনো সেই আদিবাসী কোচদের কৃত্রিম বরাহ শিকার উৎসব। ...
এক সময় মধুপুরের ভাওয়াল গড়ের অরণ্য ভেঙে নেমে আসতো বুনো বরাহের দল। কোচ শিকারীর লক্ষ্যভেদী বর্শার ফলা গেঁথে ফেলতো সবচেয়ে সুদর্শন বরাহটিকে। তারপর আগ্নিকুণ্ড ঘিরে সারা রাত ধরে চলতো পানাহার আর নাচ।
সেই অরণ্য গড় নেই বহু বছর। সেই বুনো বরাহের দলও হারিয়ে গেছে কোথায় কয়েক প্রজন্ম আগেই। উৎসবের সময় তারই অতীত স্মৃতি রোমন্থন করে এখন গৃহপালিত শুকরগুলোকে মদ খাইয়ে প্রথমে উন্মত্ত করে নেওয়া। তারপর এরই একটি - দুটিকে মরচে পড়া বর্শায় গেঁথে শিকারের উল্লাস!
এতো কিছুর পরেও আমি তৃপ্তি করে মাংসের ঝোল দিয়ে বউখুদ মেখে খেতে থাকি। দিদির রান্নার হাত সত্যিই খুব ভালো।
... সে সময় সকালের পত্রিকায় তাজা খবরগুলোতে চোখ বুলিয়ে নিতে নিতে আমার দৃষ্টি আটকে যায় দৈনিক যুগান্তরের শেষ পাতায় ছাপা হওয়া একেবারে শেষের দিকে একটি মফঃস্বল সংবাদে।
'রংপুরে চাল নিতে এসেই দিনমজুরের বেলা শেষ : মধ্যবিত্ত ওএমএস লাইনে' -- শিরোনামের খবরটি পড়তে পড়তে আমার গলায় ভাত আটকে যায়। আমি খাবার শেষ না করেই ঢক ঢক করে এক গ্লাস পানি খেয়ে উঠে পড়ি।
দিদি বোধহয় সামান্য আহত হন। বলেন, সে কি! খাবার শেষ করলি না?
আমি বলি, নাহ্। আর ভালো লাগছে না। আমার কাজে দেরী হয়ে যাচ্ছে।...
খবরের লিঙ্ক
মন্তব্য
নস্টালজিক সোনালী অতীত থেকে মন খারাপ করা বর্তমানে না আনলেই কি হতো না?
সাবলীল গদ্য। ভালো লেগেছে।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
ছোটবেলার সব ডানপিটে কেন যেন বড়বেলায় শান্তশিষ্ট হয়ে যায়!
শুরুটা পড়ার সময়ই শেষের খবরটা আন্দাজ করতে পারছিলাম। এ সময়ের সব গল্পই বোধহয় এরকম!
শালার...
স্মৃতিটাকেও জন্ডিস থেকে বাঁচানোর কোনো দাওয়াই নাই
সত্যিই তাই--
তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ,
আমি কি রকমভাবে বেঁচে আছি।...
আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
সুন্দর সাবলীল লেখা। আমি কিছুটা ভোজনরসিক হওয়ায খাবারে বর্ণনা-পরবর্তি পরিস্থিতিটা আমার জন্য বেশ কষ্টকর হয়ে পড়ল (জিভে জল এসে পড়েছে)। ফ্রীজে হামলা চালানোর আগে তাই ধন্যবাদ জানানোর কাজটা সেরে ফেললাম।
:ফেরারী প্রতীক্ষা:
অ্যাঁ!
আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
হুমম!
মনটা উদাস হইলো আহ্হারে!!
তারিক স্বপন
গতকাল প্রথম আলোতে চাল কেনার জন্যে মানুষের লাইন দেখে আচমকা আশংকা হচ্ছিলো, এরপরে হয়তো লঙ্গরখানার লাইন দেখতে হবে। পরিস্থিতি সেদিকেই যাচ্ছে বলে সন্দেহ হয়।
লাল চালের ক্ষুদ দিয়ে আমার নানী এক ধরনের রান্না করতেন, নওগাঁ-আত্রাই অঞ্চলে সেই খাদ্যের নাম ছিলো ক্ষুদবিরান (ক্ষুদ দিয়ে তৈরি বিরিয়ানি, যদিও তাতে মাংস নেই)। আশ্চর্য, মাত্র দু'দিন আগে অনেক চেষ্টা করেও এই খাবারের নাম মনে করতে পারছিলাম না। আপনার লেখা সেটা মনে পড়িয়ে দিলো।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
ক্ষুদবিরান -- কি চমৎকার নাম! @ মুহম্মদ জুবায়ের।
আজকে প্রথম আলোতে খুদ নিয়ে একটি ছোট্ট খবর আছে।
সবাইকে অনেক ধন্যবাদ।
আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
অতি সুন্দর চলছিলো স্মৃতি রোমন্থনের পর্বটা। আজকের বাংলাদেশই সব উলট-পালট করে দিল। দেশটা যে কবে ঠিক হবে!
— বিদ্যাকল্পদ্রুম
ছেঁড়া ঘুড়ি...রঙিন বল
এইটুকু সম্বল।
আর ছিল রোদ্দুরে পাওয়া বিকেল বেলা।
বাজে বকা...রাত্রিদিন
এস্টেরিক্স...টিনটিন
এলোমেলো...কথা উড়ে যেত...হাসির ঠেলায়।
সে হাসি ছুটে যেত... গোধূলি মিছিলে।
সবার অলক্ষ্যেতে তুমিও কী ছিলে
হাওয়ায়...হাওয়ায়।
.....................
.....................
ছেঁড়া ছবি...স্ফটিক জল
এইটুকুই সম্বল
আর আছে রোদ চলে যাওয়া বিকেল বেলা।
একঘেঁয়ে...ক্লান্তিহীন
ক্যাম্ফোস...এসপিরিন।
যানজটে দেরী হয়ে গেল... এ কালবেলায়।
মরা মাছের চোখ যায় যদ্দূরে
শুকনো জলছবি আজো রোদ্দুরে...
হাওয়ায়...হাওয়ায়।
আমার খুব প্রিয় একটা গানের কিছু অংশ।
আপনার লেখাটা পড়ে
লিখে দিতে ইচ্ছে হল।
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
কার গান এইটা? লিরিকটা সুন্দর ...
................................................................................
objects in the rear view mirror may appear closer than they are ...
চন্দ্রবিন্দু ব্যান্ডের।
ইস্নিপ্স এ 'বন্ধু তোমায়' লিখে সার্চ দিলেই পাবার কথা।
=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=
LoVe is like heaven but it hurts like HeLL
---------------------------------
বাঁইচ্যা আছি
নস্টালজিক !
আপনার দিদিকে খুব ভাল লেগে গেলো।
...........................
সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
আমারও ছোটবেলার কথা মনেপরে গেলো। দাদাবাড়ির পালা কবুতর গুলো, পুতুল বিয়ে খেলা, বৌচি খেলা, গ্রামে চাচাত ভাইদের সাথে মাছ ধরা দেখতে যাওয়া, আম্মুর কাছে লুকিয়ে দাদির কাছে শুপারি খাওয়া ..... কত কিছু
------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে
আবারও সবাইকে ধন্যবাদ।
আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
মাত্রই নানাবাড়ি থেকে ঘুরে এসে মন খারাপ।
এবার গিয়ে আমার হারানো ছেলেবেলার মত কিছু আর সেখানে অবশিষ্ট নেই এই ভেবে।
তারপরে এমন লেখা। খুব খারাপ
=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=
LoVe is like heaven but it hurts like HeLL
---------------------------------
বাঁইচ্যা আছি
সব দিন গুলো কোথায় হারালো??
--------------------------------------------------------
শেষ কথা যা হোলো না...বুঝে নিও নিছক কল্পনা...
---------------------------------------------------------------------------
কারও শেষ হয় নির্বাসনের জীবন । কারও হয় না । আমি কিন্তু পুষে রাখি দুঃসহ দেশহীনতা । মাঝে মাঝে শুধু কষ্টের কথা গুলো জড়ো করে কাউকে শোনাই, ভূমিকা ছাড়াই -- তসলিমা নাসরিন
- আপনার লেখা পড়ে সেই নাইনটিন ফোরটি ফোরের কথা মনে পড়ে গেলো।
আমার দাদীও আমাকে তখন লাল চালের ক্ষুদবউ করে বেড়ে খাওয়াচ্ছে। কিন্তু তখনও ঠিক আপনার মতোই খাওয়া ছেড়ে উঠে যেতে হয়েছিলো আমার। মোবাইলে একটা জরুরী কল এসেছিলো। বৃটিশরা নাকি চার বছরের মধ্যে চলে যাবে। গান্ধিজী'র ফোন ছিলো। মাওলানা সাহেব নাকি আমার জন্য অপেক্ষা করছেন।
তখন আমাদের লোকজনের কোনো অভাব ছিলো না। সবাই দেখি রাস্তায় লেক্সাসের ফোরটি মডেল হাঁকিয়ে চলেছে। এক ভিক্ষুককে দেখলাম কাঁধে ঝোলা নিয়ে ১২৫ সিসি মোটরবাইকে কিক মারতে!
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
হ!
আবার লিখবো হয়তো কোন দিন
হুম!
ওয়েবসাইট | ফেসবুক | ইমেইল
সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আর ধু. গো. মন্তব্যে (বিপ্লব)
আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
শৈশব ফেরানো লেখা।
(বিপ্লব)
সুন্দর স্মৃতিরোমন্থন।...তার মানে চালের গুঁড়োকে বউখুদ বলে?
নতুন মন্তব্য করুন