ঘড়ি নিয়ে একটি দীর্ঘতম অবসেশন আমৃত্যূ তোমাকে তাড়া করে ফিরবে নিশ্চিত।
সেই যে ছেলেবেলায় রোজ রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে তুমি মনছবিতে আঁকতে একটি বিশাল ডায়ালের গ্রান্ডস ফাদারস্ ক্লক। কাঁটা দুটি বনবন করে ঘুরতে ঘুরতে যখন উলম্ব আকারে সোজা হয়ে দাঁড়াতো, অর্থাৎ কী না ভোর ছয়টা, তুমি মনে মনে শুনতে পেতে ঢং...ঢং...ঢং...কলজে-কাঁপানো ছয়-ছয়টি ঘন্টাধ্বনি।
তুমি মনের ভেতরে এই ছবিটি বার বার মকশ করে, মোটা তুলিতে এঁকে ঘুমিয়ে পড়ার পর কী আশ্চর্য! পরদিন ঠিক ঠিক ভোর ছয়টায় ঘুম ভাঙতো তোমার। তারপর স্নান, দাঁত ব্রাশ, হাফ বয়েল্ড ডিম, পাউরুটি দু-এক পিস, হাফ গ্লাস ওভালটিন খেয়ে, চক দেওয়া সাদা কেডস, নীল হাফ প্যান্ট-সাদা হাফ শার্টের ইউনিফর্মে হ্যাভারশেক কাঁধে নিয়ে ছুট...সকাল সাতটায় তোমার স্কুল অ্যাসেম্বলি!
আর প্রতিভোরেই ওই মনছবির কর্তা, তোমার নকশালাইট বাবার ঘর থেকে ভেসে আসতো বিবিসি রেডিওতে উর্মি বসুর প্রভাতি সংলাপ।...
*
এখন অবশ্য অতিবড় বেলায় ওইসব মনছবি-টবি ধুয়ে-মুছে কোথায় যে গেছে! তুমি এখন সপ্তাহে চার-চারটি লেট নাইট ডিউটি সেরে প্রায় শেষ রাতে বিছানায় যাও। মাঝে মাঝে একেবারেই নির্ঘুম...তিন তলার ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে একের পর এক দামি সিগারেট ধ্বংস করো।
তোমার মুখোমুখি অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ড়্যাব-২ এর কালো রঙা বদ্ধ সদর দুয়ার। 'সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিবাজদের ধরিয়ে দিন। এরা আপনার, আমার, দেশের শত্রু। তথ্য দাতার নাম-পরিচয় গোপন রাখা হবে। ফোন'...অস্পষ্ট এবং অসংখ্য।
না হে, দেড় দশকেরও বেশি সময় কলম পিষে ও কম্পিউটার টিপে তোমার চোখ দুটি ক্ষয়ে গেছে দেখছি। মাইনাস-এইটের চশমাটি বদল করো না কতদিন খেয়াল আছে?
আচ্ছা, এই যে এই নিশুতি রাতে তুমি এইমাত্র দিনের ষাট কী উনষাটতম সিগারেটটি পুড়িয়ে ফেললে, একবারও কী ভাবো, এই টাকায় একটি দিনমজুর কতো কেজি চাল কিনতে পারে?
আর হুইস্কির পেছনে তুমি যে পরিমান টাকা ওড়াও...।
*
মনিং ডিউটির ভোরটি তোমার কাছে বরাবরই বিচ্ছিরি রকমের বিরক্তিকর। প্রথমে পিপ্ পিপ্ করে অ্যালার্ম দেবে ডিজিটাল হাত ঘড়ি (টিভি-নিউজে মিনিট-সেকেন্ডের সঙ্গে তোমার লড়াই, তাই অ্যানালগ বিদায় অনেকদিন), এর তিনি সেকেন্ড পর ক্রিং ক্রিং মোবাইল ফোন। তুমি ঘুমের ঘোরে যান্ত্রিকভাবে হাতঘড়ি, মোবাইল অ্যালার্ম বন্ধ করে টেবিলঘড়ির অ্যালার্মটিও বন্ধ করতে যাবে। অস্পষ্টভাবে মনের ভেতর কেউ বলবেন, দরকার নেই হে, ব্যাটারীর অভাবে ও শালা মরে আছে বছর খানেক।...এরপর অজান্তেই আবারো তুমি তলিয়ে যাবে গহিনতম ঘুমের অতলে।
মিনিট পনেরো কী আধ ঘন্টার ঘুম পর্বের ভেতরে তোমার জিওন-অ্যালার্ম বৃদ্ধ মা ডেকে বলবেন, বাবু, এই বাবু, জলদি ওঠ। তোর না আজ মনিং-অফিস!
তুমি ধড়মড় করে এইবার নির্ঘাত উঠবেই উঠবে...কাক-স্নান সেরে ফুটবাবু হয়ে তিনগুন ভাড়ায় একটি গ্যাস চালিত ত্রি-চক্রযান পাকড়ে পৌঁছে যাবে অফিসে। পথে দিবসের প্রথম সিগারেটটি ধরাতে গিয়ে তোমার পেটের ভেতরে পাঁক দিয়ে একটি চিনচিনে ব্যাথা জানান দেবে...প্রায় বারো ঘন্টা পেটে দানাপানি কিচ্ছু পড়েনি। সে যাক গে...আগে অফিসে তো যাও...তারপর না হয় একটা কিছু ব্রেকফাস্ট আনিয়ে নিলে হবে। তাছাড়া তোমার লকারে তো বিস্কুটের টিন থাকার কথা। সে দেখা যাবেক্ষণ।...
এই সব হ্যাপার পর ফিঙ্গার-প্রিন্ট দিয়ে সিকিউরড ও সেন্ট্রাল্ড এসির হিম শীতল অফিসটিতে ঢুকতে ঢুকতে তুমি দেয়াল ঘড়ির সঙ্গে কব্জি ঘড়ি মিলিয়ে দেখবে: এই রে, আজ সকালেও আধ ঘন্টা লেট!
তুমি অবশ্য চট করে বিলম্বজনিত ছোট্ট অপরাধ বোধটুকু ঝেড়ে ফেলবে। কারণ তুমি এ-ও জানো, অফিসের বসদের এই সব ছোট-খাটো লেট-লতিফপনা কী দারুনভাবে মানিয়ে যায়!
*
অবসেশনের বায়ুচড়া হলে কী মারাত্নক কাণ্ড-কারখানাই না ঘটে যায়। তার একেকটা এতোই দুঃখের...ওই যে সাহিত্য করে বলে না, দুঃখে একেবারে বুক ভেঙে যায়। আবার মাঝে মাঝে এত্তো মজার সব কাণ্ড হয়, তোমার ইচ্ছে করে সচল আইকনের মতো মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে একচোট হো হো করে হেসে নিতে।
তো সেদিন তুমি এক অবসরে পুরো ঘরখানা খুঁজে-পেতে, এমন কী লেট আহমেদ উল্লাহর আট নম্বর ট্রাঙ্ক ঘেঁটেও, বের করো নানান সাইজের নানান রকমের তেরো-তোরটি ঘড়ি। একটি দু-টি বাদে সবই বহু বছর ধরে বিকল। এমন কী বিশাল কালো ডায়ালের সত্যিকার ও মৃত গ্রান্ডস ফাদারস্ ক্লকটিও আছে।
আর মনছবি নেই বলে এতোক্ষণ তুমি যে চাপাবাজী করে আসছো, তা-ও মিথ্যে করে দেখো তুমি বেল্টবিহীন প্যারাসিটামল আকৃতির, সাদা ও ছোট্ট গোল ডায়ালের একটি লেডিস রিস্ট ওয়াচটিকে নিয়ে আনমনা হয়ে আছো কী অদ্ভুদ। হোয়াইট-ক্রস ব্র্যান্ডের সুইস ঘড়িটি মুঠো বন্দি করে তুমি ঝাড়া এক ঠায় বসে আছো নির্ঘাত এক-দেড় ঘন্টা!...সেলুলয়েডের মতো একের পর এক তোমার ভেতরে তৈরি হয় কতশত দৃষ্টিসুখ! আর না চাইতেই তারা আবার ভেঙেও যায় কতই না সহজে! প্রেম...হায় প্রেম!!
মন্তব্য
বার্গম্যানের ওয়াইল্ড স্ট্রবেরি-র সেই বৃদ্ধটির কথা মনে পড়ল। যে স্বপ্নের মাঝে ডায়াল ছাড়া একটা শাদা (সাদা-র চেয়ে শাদা নাকি বেশি সাদা,সে যাই হোক)ঘড়ি দেখে চমকে ওঠে। এর কয়েকটা শট পরেই মুখোমুখি-স্বীয় মৃতদেহের সঙ্গে। কফিন থেকে বেরিয়ে আসা হাতের ভীতিকর হাতছানি। এই মন্তাজ থেকে বুঝে নিই মানুষের মৃত্যু মানে সময়েরও মৃত্যু হয়। আসলেই ।
সময় বলতে আমরা কীই বা বুঝি। সময় আর সময়ের পরিমাপ তো আর এক জিনিস নয়। আমরা সারাজীবন সময় মেপেই গেলাম। কিন্তু সময় কী বস্তু (বা নির্বস্তু)তার বোধ হল না।
তবুও সময়ের পিছনে ধাওয়া করি। মানবীয় সীমাবদ্ধতা,আর ভুল বোঝাবুঝির কারণে,সময়কে ভেবে নিই আমারই মতো ছুটে চলা আরেকজন মানুষ। আমার প্রতিদ্বন্দ্বী। নিয়তি। সেই প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে অসম লড়াইয়ে দৌড়ে যাওয়া ভালো লাগে বলেই - ব্রডকাস্ট মিডিয়ায় কোনো একভাবে টিকে যাওয়া। সব অসঙ্গতির পর,এই একমাত্র সঙ্গতি। সময় গেলে যে সাধন হবে না!
ভালো লেখা।
যর্থার্থই বলেছেন ভ্রাতা!
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
নাহ্, ঘড়ি নিয়ে আমার কোনো অবসেশন নেই।
তবে ভোরের অ্যালার্ম খুব বিরক্তিকর আমার কাছেও। একবার উপেক্ষা করি, দুইবার, তিনবারে আর পারি না। ওঠা না-ওঠার সাথে যুক্ত তিন-তিনটা পেট আছে না!
মাঝে মাঝে ভাবি, একটা পুরো জীবন হাতঘড়ি না পরে কীভাবে পার করে দিলাম! কখনো ইচ্ছেই করে নি।
................................................................
তোমার হাতে রয়েছি যেটুকু আমি, আমার পকেটে আমি আছি যতটা, একদিন মনে হবে এটুকুই আমি, বাকি কিছু আমি নই আমার করুণ ছায়া
... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
কচুরিপানার নিচে জেগে থাকে ক্রন্দনশীলা সব নদী
সময়ের বন্ধনহীন মুক্ত-জীবনের সাধ বৃদ্ধ এক পোষা ময়না যেনো!
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
খুব মন খারাপ হয়ে গেল এতো সুন্দর লেখাটা পড়ে।
একটা কথা বলি। কিছু মনে করবেননা।
আপনার বাবা নিয়ে আপনার সম্মানজড়ানো কষ্ট,
কষ্ট লাগলেও ভালো লাগে।
কিন্তু সব লেখায় বাবার প্রায় প্রতিকথায় 'নকশালাইট' শব্দের ব্যাবহার অকারণ পুনরাবৃত্তি মনে হয়।
শুধুমাত্র লেখার দৃষ্টি থেকে বলছি। অন্য কিছু নয়
আপনার অনেক আবেগের জায়গা নিয়ে কথা বললাম।
অভদ্রতা হয়ে থাকলে ক্ষমা করবেন
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
ঠিক আছে। কিছু মনে করিনি।
তবে আপনি আমার লেখা মন দিয়ে পড়ছেন, অনুসরণ করছেন--এ জন্য বিশেষ ধন্যবাদ। আর একই কারণে 'নকশালাইট বাবা' কথাটি পুনরাবৃত্তি মনে হতে পারে। কিন্তু ধরুন অতিথি ব্লগার অনিন্দ্য রহমানের কথা। তিনি হয়তো এই প্রথম আমার লেখা পড়লেন, এবং মন্তব্য করলেন। তার কাছে কিন্তু 'নকশালাইট বাবা' কথাটিই নতুন।
এছাড়া একজন সৈনিক বা একজন গেরিলার কাছে (তিনি সাবেক হলেও) তার বন্দুক-জীবনই সারা জীবন, এটি আমি ছেলেবেলা থেকেই খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছি। আরো পরে সাংবাদিকতার পেশাগত জীবনে পাহাড়ি জনপদেও দেখেছি একই ঘটনা। ...তবে ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে।
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
হুইস্কি খাইয়েন না বস। ডাবের পানি খান।
"ডাবের পানি ঠান্ডা-
খেয়ে ভরে মন্টা।" - কোবি বলেছেন।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
মন্তব্যে (বিপ্লব)
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
লেখাটা দারুণ লাগল!
সবাইকে অনেক ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা।
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
নতুন মন্তব্য করুন