পল্লবের পরীরা

বিপ্লব রহমান এর ছবি
লিখেছেন বিপ্লব রহমান (তারিখ: শনি, ১১/০৮/২০০৭ - ১২:২৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রিয় পল্লব, বছর তিনেক আগে দৈনিক যুগান্তর ছাড়ার পর আমার যুগান্তরের অনেক সহকর্মী দৈনিক সমকালে যোগ দেন। তাদেরই টানে আমি প্রথম আলো -- নিউ এজ বদলে সমকাল -- নিউ এজ পড়তে শুরু করি। কিন্তু মানসিক রোগিদের (মনে আছে নিশ্চয়ই, মিরপুরের কথিত সেই দুই সুপার জিনিয়াস রীতা -- মিতা কাহিনী) পুঁজি করে সমকাল সংবাদ বিক্রি করা শুরু করায় আমি আবার ফিরে যাই প্রথম আলোতে। সেই থেকে সমকাল আমার তেমন একটা পড়া হয় না। হয়তো অফিসে এসে হেডলাইনগুলোতে একটু চোখ বুলিয়ে গেলাম -- এরকম আরকি।

কিন্তু সেদিন রাতে একটা পার্টিতে সমকালের পুরনো একটা সাপ্লিমেন্টে আপনার লেখা দেখে আমি পত্রিকাটা টেনে নেই। এক টানে পড়ে ফেলি পুরো লেখা।

সমকালের বিভিন্ন পাতায় এর আগেও আপনার ভ্রমন কাহিনী পড়েছি। আপনার সাবলীল ভাষা, প্রকৃতি দেখার সহজাত চোখ ও পর্যটকের মন আমাকে টানে। কিন্তু (এই কিন্তুটা অনিবার্য; কোনো রকমেই কিন্তুটাকে এড়ানো গেলো না। অতএব কিন্তু) --

চিতমরমের পাহাড়ে মারমাদের বর্ষবরণ উতসব 'সাংগ্রাই' নিয়ে আপনার এবারের লেখাটি আমি কোনোভাবেই গ্রহণ করতে পারলাম না -- লেখাটির দিকদর্শনের কারণেই।

এর বিষয়বস্তু নয়, ভাষা নয়, এমন কী মূল রচনা সম্পর্কেও নয়, পাহাড়িদের দেখার যে লোভাতুর দৃষ্টি গত প্রায় ১০০ বছরে আমরা সংখ্যাগুরু বাঙালি জাতি তৈরী করেছি, সেই দৃষ্টিসুখের মোহ থেকে শেষ পর্যন্ত বন্ধুবরেষু পল্লবও বের হতে পারলেন না -- আমার আপত্তি এখানেই।

প্রিয় পল্লব, আদিবাসী পাহাড়িদের নিয়ে আমরা সমতলের বাঙালিরা সব সময়েই একটা রোমান্টিকতায় ভুগি; বিশেষ করে পাহাড়ি মেয়েদের নিয়ে। এর একটা কারণ বোধহয়, পাহাড়ি মেয়েরা প্রকৃতির মতো সরল ও সুন্দর (আপনার ভাষায় -- পরীর মতো)। যে কারণে পাহাড়ি মেয়েদের নষ্ট করার সুযোগও অনেক বেশী।

আপনি পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস পর্যলোচনা করলে দেখতে পাবেন --পাহাড়, অরণ্য, ঝর্ণা ধারায় নয়নাভিরাম পার্বত্যাঞ্চলের ইতিহাস, গণহত্যা, গণধর্ষণ, শোষণ আর বঞ্চনার ইতিহাস। কল্পনা চাকমাকে মনে পড়ে নিশ্চয়ই। নিখোঁজ নারী নেত্রীর শেষ পরিনতি কী -- আশা করি পল্লব, আপনি তা সহজেই অনুমান করতে পারেন।

যুদ্ধবিধ্বস্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সমতল কী পাহাড়ে -- আদিবাসী অধূ্যষিত অন্যান্য এলাকার চিত্রও কী প্রায় একই রকম নয়? জমি কেড়ে নিয়ে, ভাষা কেড়ে নিয়ে, ধর্ম নষ্ট করে, মেয়েদের নষ্ট করে, গলা টিপে ুদ্র জাতিসমূহকে ধ্বংস করার একটা নিরব সুদূর প্রসারী ষড়যন্ত্র কী সর্বত্রই চলছে না?

একটু খেয়াল করে ৬০দশক থেকে এ পর্যন্ত চলে আসা বাংলা -- হিন্দী সিনেমা, এমন কি টিভি নাটক খেয়াল করে দেখবেন, সেখানে কী ভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে আদিবাসীদের -- বিশেষ করে আদিবাসী মেয়েদের।

প্রচ্ছন্নভাবে ধারনা দেওয়া হচ্ছে, আদিবাসীরা জংলি, অসভ্য, এখনও ওরা নরমাংসভোজী।

আর সেইসব সিনেমা কী নাটকে দেখা যায়, শহর থেকে বাবুসাব গেছেন অরণ্যে বেড়াতে কী কর্মসূত্রে। ছমক ছমক নৃত্যগীতি -- ঢোল -- বর্শা -- মদ্যপানে প্রেম হলো তার জংলী রাণীর সঙ্গে। েেপ গেলো 'পরদেশী বাবুর' ওপর পুরো অরণ্যচারী জনপদ -- ইত্যাদি ইত্যাদি।

পল্লব, প্রিয় পল্লব, বছর চারেক আগে কুলাউড়ার খাসিয়া পাহাড় গর্জে উঠেছিলো ইকো -- টু্যরিজম, তথা ইকো -- পার্কের বিরুদ্ধে। আর এই সেদিন মধুপুরে আরেক ইকো -- পার্ক রুখতে গিয়ে প্রাণ দিলেন একজন গারো আদিবাসী তরুন।

সেই সময় বর্ষিয়ান খাসি নেতা অনিল ইয়াং ইউম আমাকে বলেছিলেন, যে পর্যটন আমার গ্রাম ধ্বংস করবে, নষ্ট করবে গাছবাঁশ, পানের বরজ, পাহাড়ি ছড়া, আর আমার মেয়েদের -- আমি নেতা হিসেবে নই, এই পাহাড়ের মানুষ হিসেবে আমি যে কোনো মূল্যে সেই পর্যটন রুখে দেবো। আমি শহর চাই না, দালান চাই না, রাস্তা চাই না, বিদু্যত, টিভি -- সিনেমা চাই না। আমার অরণ্যে আমি যুগ যুগ ধরে আমার মতো করেই স্বাধীনভাবে বাঁচতে চাই।

জানি না বিষয়টি আপনাকে কতোটা বোঝাতে পারলাম। আমার বোঝানোর মতাও তো সীমাবদ্ধ, তাই না?

তাই বলছিলাম, আপনার লেখা পড়ে সমতলবাসী+সুশিতি+প্রথম শ্রেণীর নাগরিক+সভ্য মানুষের মনে হতেই পারে, পাহাড় তাহলে প্রেমকাতর পরীতে ভরপুর! তারা নেচে নেচে সাংগ্রাই বারি বর্ষণ করবে -- তখন বলা যাবে, সাংগ্রাই ফানি ইজ সো ফানি।...ম্যামাচিং এর মতো সুন্দরীরা বলামাত্র মোবাইলে ফোন করবে, খুনসুটি করে পাল্টা প্রশ্ন করবে, কে রে?....

পল্লব, পাহাড়ে কর্মরত নিরাপত্তা বাহিনীর একাধিক তরুণ সদস্যর সঙ্গে আমি কথা বলে জেনেছি, ম্যালেরিয়া, জঙ্গল -- জলা, আর একাধিক সশস্ত্র গোষ্ঠির ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় পোস্টিং দেওয়ার জন্য তাদের ভাল বেতন আর 'সেক্সি চাকমা মেয়ে' অবাধে ভোগ করার লোভ দেখানো হয়।....

সব মিলিয়ে তাই আপনার এবারের লেখাটা কোনোভাবেই গ্রহণ করতে পারলাম না। এ জন্য বিশেষভাবে দুঃখিত।

শেষ করছি। ভাল থাকবেন। ভালবাসায় থাকবেন।।

(লেখাটি এর আগে সামহোারিনে প্রকাশিত)


মন্তব্য

অচেনা এর ছবি

সচলে স্বাগতম! হাততালি

বিপ্লব@বিপ্লব গড়াগড়ি দিয়া হাসি

-------------------------------------------------
আমি ভালবাসি বিজ্ঞান
আমি ঘৃণা করি জামাত॥

দিগন্ত এর ছবি

আপনি অনেকগুলো সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন। সেজন্য ধন্যবাদ। কিন্তু কোনো সমাধানসূত্র আছে কি এই সমস্যাগুলোর? একটা দিক থেকে ভাবা যেতে পারে যে মিডিয়া আরো সচেতনভাবে পাহাড়ীদের উপস্থাপন করা উচিত। তাতেও কি একদিনে সমাধানসূত্র আসবে? মানসিকতা পরিবর্তনে সময় লাগে, অনেকসময় কয়েক দশক, বা শতক।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

আরিফ জেবতিক এর ছবি

আপনাকে আমি ৫ দিলাম।

-----------------------------------
কিস্তিমাতের যুদ্ধ শেষে,সাদাকালো ঘুটিগুলো এক বাক্সেই ফেরত যাবে...

বিপ্লব রহমান এর ছবি

অচেনা, আপনাকে ধন্যবাদ। সচল হওয়ার জন্য সত্যই দীর্ঘ প্রতীক্ষা ছিলো।

দিগন্ত, আপনি ঠিকই বলেছেন। এর সমাধানসূত্র এতো সহজ নয়। মানসিকতার পরিবর্তন খুবই সময়সাপেক্ষ বিষয়। আর এ জন্য প্রধান ভূমিকা নিতে হবে শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রকেই।

আমাদের শাসকগোষ্ঠির মানসিকতার প্রয়োজন জরুরী।

পাঠ্যপুস্তকেও অহরহই আদিবাসীদের একইভাবে বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গীতে উপস্থাপন করা হচ্ছে। গণমাধ্যমের এ ক্ষেত্রে একটা দায় থেকেই যায়। কিন্তু এখনেও শর্ষের মধ্যে ভূত রয়েছে।

আমার বন্ধু মাহবুব আলম পল্লবের ওই লেখাটি কিন্তু প্রভাবশালী বাংলা দৈনিকেই প্রকাশিত হয়েছে। পল্লব পরে অবশ্য তার আরেক লেখায় স্বীকার করেছেন তার সীমাবদ্ধতার কথা।

কিন্তু যারা পাহাড়ের সাংবাদিক, ঘোষণা দিয়ে আদিবাসী নিয়ে লেখেন, প্রকৃতি নিয়ে কাজ করেন, তাদের অনেকের মধ্যেই আমি এই উদার মানসিকতা দেখিনি।

আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসেই আমার চেনা একজন পাহাড়ের সাংবাদিকের আদিবাসীদের উপস্থাপনার নমুনা দেখুন এখানে


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

হাসান মোরশেদ এর ছবি

বিপ্লবী স্বাগতম প্রিয় বিপ্লব রহমান ।

শুরুতেই একটা আব্দার । পুরনো প্রিয় লেখাগুলো তো অবশ্যই সচলয়াতন এ নিয়ে আসবেন । অনেক নতুন পাঠক আছেন । আমরা পুরনো পাঠকেরা ও ভালো লেখা গুলো আবার পড়ার সুযোগ পেলাম ।

আব্দার হলো,সচলায়তনের জন্য নিজস্ব কিছু এক্সক্লুসিভ লেখা তৈরী করুন না কেনো? যা হবে সচলায়তনের সমৃদ্ধির জন্য বিপ্লব রহমান বিপ্লবী অবদান হাসি

-----------------------------------
'আমি ও অনন্তকাল এইখানে পরস্পর বিস্ময়ে বিঁধে আছি'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

হিমু এর ছবি

স্বাগতম দাদা।


হাঁটুপানির জলদস্যু

দ্রোহী এর ছবি

ভালো আছেন বিপ্লবদা?


কি মাঝি? ডরাইলা?

জিকো এর ছবি

ভালো লেগেছে আপনার বক্তব্য।

সিনেমায় আদিবাসী এবং পাহাড়ি লোকদের যে ইমেজ তৈরি করেন সিনেমা নির্মাতারা, সে ব্যাপারে আরও সচেতনতা দরকার, তাও মাথায় থাকলো। অরণ্যের দিনরাত্রি(সত্যজিৎ রায়), আবার অরণ্যে(গৌতম ঘোষ), মহুলবনীর সেরেঙ (শেখর দাশ)-- এই মুহূর্তে এ কটি সিনেমার কথা মনে পড়ছে যেখানে এমন ইমেজ দেখানো হয়েছে।

আদিবাসী নিয়ে আলোচ্য লেখাটি কি অনলাইনে পাওয়া/পড়া যাবে?

মাহবুব আলম পল্লব আমার অগ্রজপ্রতিম বন্ধু, দীর্ঘদিনের সঙ্গী। অনেক মতের সঙ্গে মেলে না আমাদের, কিন্তু ভদ্রতা না করে সরাসরি বলেন তিনি, এই গুণ আমাকে বেশি মুগ্ধ করে।

সচলায়তনে স্বাগতম।
_____________________________
জিকোবাজি | ফটো গ্যালারি | ইমেইল

বিপ্লব রহমান এর ছবি

স্বাগতম জানানোর জন্য, পাঠের জন্য এবং মন্তব্যের জন্য সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ।

হাসান মোরশেদ,
অবশ্যই এই ব্লগে নতুন লেখা লিখবো। তবে নতুন পাঠকের জন্য সামহোরিনের পুরনো কিছু প্রিয় লেখা এই ব্লগেও দিতে চাই।
...লেখালেখিই আমার পেশা। আমি বোধহয়, সবচেয়ে খুশী হই, যখন লিখতে পারি। আগামীতেও সঙ্গে থাকার অনুরোধ।

জিকো,
পল্লব আমারো খুব ঘনিষ্ট। আর আমি তো ওর লেখার গুনমুগ্ধ পাঠক। প্রথম আলোতে ওর লেখা 'হাতি তুমি সখা হও' পড়ে আমি ওকে এসএমএস করি, যদি আপনার মতো লিখতে পারতাম!...এটি খুব আন্তরিকভাবেই ওকে বলা। ওর লেখার ক্ষমতা একেবারে সত্যি সত্যি বিস্ময়কর।
...দুঃখিত, সমকালের শৈলী'র যে লেখাটির (এবার চিৎমরমের পাহাড়ে ম্যামাচিঙের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো।)সমালোচনা করে এই লেখাটি আমি লিখেছি, সেটি অনলাইনে নেই। সেটি একটি দীর্ঘ ভ্রমন কাহিনী, নইলে পাঠের সুবিধার জন্য আমি নিজেই ওর লেখাটি টাইপ করে আমার লেখার সঙ্গে জুড়ে দিতাম। আগামীতেও সঙ্গে থাকবেন প্লিজ।


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

জুম্ম [অতিথি] এর ছবি

এই লেখাটি আগে পড়েছিলাম, আজকে আবার পড়লাম। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, অত্যন্ত সুন্দরভাবে উপস্থাপন করার জন্যে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।