পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের (১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর) প্রায় এক দশক পরেও পাহাড়ে এখনো অবরুদ্ধ সাংবাদিকের কলম। এখনো সেখানের সাংবাদিকতা একটি বিশেষ মহলের প্রভাবে প্রভাবান্বিত, উগ্র জাতীয়তাবাদী বোধে দুষ্ট এবং একপেশে। অপসাংবাদিকতার কবল থেকে যেনো কিছুতেই মুক্তি নেই! তবে এর ব্যতিক্রমও আছে।
শান্তিচুক্তির আগে অস্থির-অশান্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পাহাড়ের সাংবাদিকতা বরাবরই ছিলো অবরুদ্ধ। নিরাপত্তা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থেকে অনেক সত্যই সে সময় প্রকাশ পায়নি। প্রকাশ পায়নি লংগদু, বরকল, পানছড়ি, দীঘিনালা, মহাজনপাড়ার গণহত্যা-গণধর্ষণের কথা। গণমাধ্যমে আসেনি অনেক পাথর চাপা কান্নার ইতিহাস। মাইলের পর মাইল আদিবাসী পাহাড়ি গ্রাম উজার হওয়ার করুন গাঁথা। সীমান্তের ওপারে ভারতে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ৭০ হাজার শরনার্থীর গ্লানীময় জীবনের কথা।
সেখানে প্রায় দুই দশক বুটের নীচে চাপা পড়ে ছিলো সাংবাদিকের কলম। আর বরাবরই পাহাড়ের তথ্য সংবাদ নিয়ন্ত্রণ করতো নিরাপত্তা বাহিনী। রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান -- এই তিন পার্বত্য জেলার তিনটি প্রেসক্লাবের উদ্বোধন করেছেন তিনজন উচ্চ পদস্ত সেনা কর্মকর্তা। এ থেকেই কি সেখানের সাংবাদিকতার দর্শন ও গতিপ্রকৃতি পরিস্কার নয়?
শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের আগে সম্ভবত লোগাং গণহত্যা (১৯৯২ সালের ১০ এপ্রিল) এবং কল্পনা চাকমা অপরণের (১৯৯৬ সালের ১২ জুন)সংবাদ প্রথম ফাঁস করে দেয় বহু বছর ধরে পাহাড়ে চলে আসা মানবাধিকার লঙ্ঘনের নগ্ন সত্য! চমকে ওঠে পুরো বিশ্ব! কিন্তু যথারীতি উচ্ছিস্টভোগী কিছু সাংবাদিককে সে সময় দেখা গেছে, অপসাংবাদিকতায় প্রকৃত সত্য আড়াল করার চেষ্টা করতে।
চুক্তির আগে পাহাড়ি-বাঙালি জাতিগত যে বিদ্বেষ সৃষ্টি করা হয়েছিলো, পাহাড়ের সাংবাদিকরাও এই বিদ্বেষমুক্ত ছিলেন না। এতো বছর পর বলতে দ্বিধা নেই, এই বিদ্বেষ পাহাড়ের অনেক সাংবাদিকই এখনো ধারণ করে চলেছেন। আর বাঙালি সাংবাদিকরা বরাবরই পাহাড়ি সাংবাদিকদের এতোদিন বলে এসেছেন, শান্তি বাহিনীর দালাল। এখনও বলেন, সন্তু লারমার দালাল! আদিবাসীদের নিয়ে তথ্য সংবাদ তৈরি করতে গিয়ে গত প্রায় দুদশকে এই আখ্যা এই অধমকেও মাথা পেতে নিতে হয়েছে!... আর আদিবাসী পাহাড়িদের দেখার দৃষ্টিসুখের মোহ তো আছেই। এটি হচ্ছে, দৃষ্টিভঙ্গীর বিষয়। যেটি পরিবর্তন হতে কয়েক দশক তো বটেই, এমন কি কয়েক শতকও লেগে যেতো পারে।
তবে এখন চুক্তির পর আর কোনোভাবেই পাহাড়ে কোনো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া সম্ভব নয়। যেভাবেই হোক না কেনো তা জনসম্মুখে প্রকাশ পাবেই।
এই সেদিন, ইলেভেন ওয়ানের আগে গত ডিসেম্বরে বান্দরবানের টংকাবতীর পাহড়ে সেনা ক্যাম্প সম্প্রসারণের জন্য উচ্ছেদ করা হয় সাড়ে ৭০০ ম্রো আদিবাসী পরিবার। এই সংবাদ পাহাড়ের সাংবাদিকদের কাছে তেমন গুরুত্বই পায়নি। এক সপ্তাহ প্রচন্ড শীতের ভেতর উচ্ছেদ হওয়া আদিবাসী নারী-পুরুষ ও শিশু খোলা আকাশে জঙ্গলের ভেতর অনিশ্চিত জীবন কাটান। পরে এটি ঢাকার সাংবাদিকরা খোঁজ নিয়ে সংবাদ করলে প্রশাসনের টনক নড়ে। পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয় উচ্ছেদকৃতদের।
আবার বিপরীত চিত্রও আছে। ঢাকা থেকে হয়তো পাহাড়ে সংবাদ করতে গেছেন সাংবাদিক। পাহাড়ের ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি, জীবন -যাত্রা ইত্যাদি কিছু না বুঝেই উগ্র জাতিগত অহং থেকে হয়তো তৈরি করলেন একটি সংবাদ। আর পত্রিকাগুলোও সাংবাদিকতার সব ধরণের নীতিমালা ভঙ্গ করে ফলাও করে ছাপলো সে সব খবর।
এতো বছর পাহাড়ে, বনে-বাদাড়ে ঘুরে তথ্য সংবাদ করার পরেও, গণমাধ্যমের মূল স্রোত যখন বৈরি তখন আয়নায় নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করা হয়, ওহে সাংবাদিক, খুব কী এগুলো? ...
*পুনশ্চ:পাহাড়ের অপসাংবাদিকতার নমুনা দেখুন এখানে
মন্তব্য
খুবই সুন্দর লেখা।
আমাদের সারাদেশে এখন পুঁজি বিনিয়োগের জন্য আদিবাসী উতখাত করছে। আমার মনে হয় একদিন এই নীতি হিতে-বিপরীত হবে। মজার কথা হল যে সাধারণ চাষী জমি বিক্রি করে কোটিপতি হচ্ছে, কিন্তু আদিবাসীরা হচ্ছে না। কেন জানেন? ওরা তো জমির মালিক নয় !!!!
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
পত্রিকা মারফত (খুব সম্ভবত প্রথম আলোয়) এই খবরটা পেয়েছিলাম তখন কিন্তু তারপর কি হয়েছিলো সেটার খবর পাইনি। আপনার কাছ থেকে এখন জানলাম পুনর্বাসনের ব্যাপারটা।
রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।
বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।
বিডিনিউজে খবরটা পড়ে,সামহোয়ারে একটা পোষ্ট করেছিলাম ।
তখনো জানতামনা,রিপোর্টার আমাদের বিপ্লব রহমান ।
এই পোষ্টের জন্য আপনাকে আমি পাঁচ দিলাম ।
(আসলেই দিলাম কিন্তু )
-----------------------------------
'আমি ও অনন্তকাল এইখানে পরস্পর বিস্ময়ে বিঁধে আছি'
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
সঙ্গে থাকার জন্য সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ।
দিগন্ত,
আপনি ঠিকই বলেছেন, পাহাড় কি সমতলে আদিবাসীদের জমির কাগজপত্র তেমন নেই। কারণ জমির কাগজপত্র থাকতে হয়, এই ধারণা আমরা কথিত সংখ্যাগুরু সভ্য মানুষেরা আদিবাসীদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছি। আদিবাসীরা বরাবরই ঐতিহ্যগত রীতিনীতিতে বিশ্বাসী। এ কারণে কখনোই দেখা যাবে না, একজন আদিবাসী আরেকজন আদিবাসীর জমি দখল করেছে। আর জায়গা-জমির দলিল না থাকায় পাহাড় ও সমতলে আদিবাসীদের সঙ্গে বাঙালিদের ভূমির বিরোধ বাড়ছে।...এ ক্ষেত্রে প্রশাসনিক অজ্ঞতাও অনেকাংশে দায়ী। কয়জন সরকারি কর্মকর্তা জানেন, পাহাড়ের স্থায়ী বাসিন্দা না হলে সেখানের জমি কেনাবেচা বা বন্দোবস্ত নেওয়া যায় না? এটি ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি, শান্তিচুক্তি সম্পর্কিত আইনসহ বিভিন্ন আইন দ্বারাই স্বীকৃত। অথচ আপনি দেখবেন, এ সব আইনের ব্যপক লঙ্খন করে পার্বত্যাঞ্চলে দেদারছে জমি কেনাবেচা বা বেআইনী বন্দোবস্ত দেওয়া চলছে।...
ঝরাপাতা,
প্রথম আলো ও চট্টগ্রামের স্থানীয় দৈনিক পূর্বকোনে ভেতরের পাতায় ছোট্ট করে বান্দরবানের ম্রো জনগোষ্ঠির উচ্ছেদ হওয়ার আগাম আশঙ্কার খবর ছাপা হয়েছিলো। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ফলোআপ নিউজ হয়নি।...আদিবাসীরা উচ্ছেদ হওয়ার বেশ পরে যখন বান্দরবান প্রেসক্লাবের সামনে তারা প্রতিবাদ সভা করে, তখন সব কাগজই সেই খবর ছেপেছে। ...তবে দুঃখজনক উচ্ছেদকৃতদের স্থায়ী পুনর্বাসন এখনো হয়নি; অনেকেই ক্ষতিপূরণ পায়নি। জায়গা-জমি হারিয়ে অনেকেই এখন বাধ্য হয়ে আশেপাশের গ্রামে আত্নীয়-স্বজনদের বাসায় থাকছেন।
হাসান মোরশেদ,
আপনি ঠিকই বলেছেন, বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিনিধি হিসেবে ওই উচ্ছেদের বিস্তারিত সংবাদটি সে সময় আমিই করি। এটি দি নিউ এজসহ কয়েকটি জাতীয় ও চট্টগ্রামের স্থানীয় দৈনিকে সে সময় ফলাও করে ছাপা হয়। আর সেই উচ্ছেদ সংবাদ সাংবাদিককে পৌঁছে দেয়ার দায়ে বা উচ্ছেদের প্রতিবাদের বান্দরবানে সমাবেশ করার অপরাধে বা অন্য কি এক অপরাধে ম্রো নেতা রাংলাই কে যৌথবাহিনী কিছুদিন আগে গ্রেফতার করেছে। আদালত তাকে ১০ বছর কারাদন্ড দিয়েছে।...
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
কিছু বলব না...সেটা হবে বাহুল্যতা...
৫ দিলাম।
দৃশা
দৃশা,
আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ। আগামীতেও সঙ্গে থাকার অনুরোধ।
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
নতুন মন্তব্য করুন