অস্ত্র কোনো নির্ধারক শক্তি নয়; নির্ধারক শক্তি হচ্ছে মানুষ। সংগঠিত জনগণ অ্যাটম বোমার চেয়েও শক্তিশালী। - মাওসেতুং।
এক.১৯৯৪ সালের ৫ মে। পার্বত্য চট্টগ্রাম তখন দারুন বিক্ষুব্ধ। সেনা বাহিনীর সঙ্গে পাহাড়ি বিদ্রোহী গ্রুপ শান্তিবাহিনীর রক্তক্ষয়ী বন্দুকযুদ্ধ লেগেই আছে। তো চারদিন খাগড়াছড়ির পাহাড়ি গ্রাম প্যারাছাড়ায় আত্নগোপন করার পর 'ক্লিয়ারেন্স' পাওয়া যায়। ভোর বেলা লক্কর -- ঝক্কর ভাড়ার জিপ চাঁদের গাড়িতে করে রওনা হওয়া গেলো পানছড়ির উদ্দেশে। পানছড়ি কলেজের ছাত্ররা পায়ে হাঁটা পথে কিছুদূর এগিয়ে দেওয়ার পর একজন ত্রিপুরা ভাষী যুবক গাইড হলেন।
তারপর ছাতা মাথায় মাইলের পর মাইল পাহাড়ি রাস্তা ধরে দ্রুত বেগে অবিরাম পথ চলা। কষ্টকর যাত্রার পুরো সময়টা ছাতা দিয়ে মাথা ঢেকে ক্যামোফ্লাজ করতে হয়; যেনো পাহাড়ের ওপর বসানো সেনা বাহিনী আর বিডিআর এর ওয়াচ পোস্ট থেকে দূরবীনে এই সাংবাদিক ধরা না পড়ে।
দুই.পথে এক পাহাড়ির বাড়িতে সামান্য সময়ের জন্য বিশ্রাম। কথা হয় ত্রিপুরা গাইডের সঙ্গে। মন পরীক্ষা জন্য প্রশ্ন করা হয়, আচ্ছা, আপনারা জুম্মল্যান্ড (পাহাড় আঞ্চলিক সায়ত্ত্বশাসন) প্রতিষ্ঠা করবেন কবে? জবাবে তিনি মুচকি হেসে বলেন, মাওসেতুং তো গেরিলা যুদ্ধের মহানায়ক, তাই না? তিনি কিন্তু কখনোই বলেননি, অমুক বছর চীনে রাষ্ট্র বিপ্লব হবে। রাজনীতিতে এ রকম দিনক্ষণ বলা যায় না।
গ্রামের স্বল্প শিতি সাধারণ এক গেরিলা যোদ্ধার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দেখে চমকিত হতে হয়।
এরপর আবারো হন্টন।...পার হতে হয় লোগাং, পুচগাঙসহ নানা নাম না জানা পাহাড়ি জনপদ। মাঝে মাঝে পথের ধারে অপেক্ষমান সাদা পোষাকে শান্তি বাহিনীর সদস্যরা গাইডকে 'কিয়ারেন্স' দেন।
তিন.হাঁটতে হাঁটতে পথে পড়ে এক গহিন খাদ। খাদ পার হওয়ার জন্য এ পার -- ওপার একটি গাছের গুড়ি ফেলা। তা ও আবার কাদায় মাখামাখি হয়ে পিচ্ছিল। শহুরে সাংবাদিকের আশঙ্কা হয়, হয়তো পা পিছলে গহিন খাদে মৃত্যূ আসন্ন প্রায়। ইতস্ততা দেখে কিছু বোঝার আগেই গাইড যুবক এক ঝটকায় এই অধমকে তুলে নেন কাঁধে। অবলীলায় পার হয়ে যান খাদ।
তিনি বলেন, আমাদের সব ধরণের ট্রেনিং আছে। দয়া করে একটু জলদি হাঁটুন। সন্ধ্যার আগেই ক্যাম্পে পৌঁছাতে হবে। সন্ধ্যা হলে আর পথ দেখা যাবে না। টর্চ জ্বালানোও ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা বিডিআর জানে শান্তিবাহিনীর গতিপথ কোনগুলো। টর্চের আলো দেখলে দ্বিধা ছাড়াই ওরা গুলি করতে শুরু করবে।
আরো কিছুটা এগিয়ে সন্ধ্যার আগে আগে পৌঁছে যাওয়া গেলো ভারত সীমান্তে শান্তিবাহিনীর সদর দফতর দুদুকছড়ায়। বনের ভেতর পাহাড়ি টিলায় অসংখ্য জলপাই রঙের তাঁবু ফেলে তৈরি হয়েছে গেরিলা ছাউনি। একে -- ৪৭, জি থ্রি আর নানান রকম সয়ংক্রিয় বন্দুকে বিভিন্ন গাছের আড়ালে সতর্ক প্রহরায় রয়েছে জলপাই পোষকে শান্তি বাহিনীর সদস্যরা।
চার.সাদা পোষাকে শান্তি বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড সুধা সিন্ধু খীসা এগিয়ে এসে স্বাগত জানান। হ্যারিকেনের আলোয় হাতমুখ ধুয়ে একটি ছোট্ট তাঁবুর ভেতর বসা গেলো। ফাক্স খুলে খেতে দেওয়া হলো কফি। সঙ্গে বিস্কুট আর গোল্ড লিফ সিগারেট।
সুধা সিন্ধু বললেন, শুনেছি, আপনার চা -- কফির খুব নেশা। আর আপনি গোল্ডলিফ সিগারেট খান। তাই জঙ্গলের ভেতর অনেক কষ্ট করে এসব যোগাড় করতে হয়েছে!
পাঁচ.একটু পরে একজন শান্তিবাহিনীর সৈনিক এসে সেলুট করে সুধা সিন্ধুকে চাকমা ভাষায় বলেন, 'স্যার' আসছেন।
বলা ভাল, এই 'স্যার' হচ্ছেন শান্তি বাহিনী প্রধান (ফিল্ড কমান্ডার) জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমা। শান্তি বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা, প্রয়াত নেতা এমএন লারমা, সন্তু লারমা, সুধা সিন্ধু খীসাসহ শীর্ষ নেতারা সকলেই ছিলেন স্কুল শিক্ষক। এ কারণেই শান্তিবাহিনীর গেরিলা যুদ্ধকে বলা হয়, মাস্টার্স রেভ্যুলেশন। আর সেই থেকে শীর্ষ নেতাদের অনুসারীরা 'স্যার' সম্বোধন করেন। তবে সাধারণ অর্থে 'স্যার' বলতে সন্তু লারমাকেই বোঝায়।
খুবই সাদাসিদা পোষাকে বয়স্ক মতোন শুকনো গোছের একজন মানুষ আট -- দশজন গেরিলা যোদ্ধা পরিবেষ্টিত হয়ে কাছে এগিয়ে আসেন। হাত বাড়িয়ে বললেন, আমিই সন্তু লারমা!...
ছয়....সেদিন দূর্গম দুদুকছড়ার হাইড আউটে শান্তিবাহিনী প্রধান সন্তু লারমার সঙ্গে তেমন কথা হয়নি। লিডার বললেন, আপনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এতো কষ্ট করে আমাদের ক্যাম্পে এসেছেন, আমি খুব খুশী হয়েছি। আপনার সঙ্গে কথা হবে কাল সকালে।
রাতে সামান্য ভাত -- মুরগির মাংস খেয়ে শুয়ে পড়া গেলো। রাত্রিবাসের তাঁবুটিকে পাহারা দিচ্ছিলো শান্তিবাহীর সশস্ত্র যোদ্ধারা। পথকান্তিতে ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসে দ্রুত।...একজন গেরিলা কমান্ডার এসে ফিসফিস করে বলেন, সেনা বাহিনী বা বিডিআর ক্যাম্প আক্রমন করলে আপনি ভয় পাবেন না। গোলাগুলি শুরু হলে আপনি শুধু মাটিতে শুয়ে থাকবেন। আমরা আপনাকে জীবন দিয়ে রা করবো।...
পরদিন খুব ভোরে চা -- নাস্তা খেতে খেতে কথোপকথন হয় সন্তু লারমার সঙ্গে। দীর্ঘ সাক্ষাতকারটি লিখে নেওয়া হচ্ছিলো। লিডার রেকর্ড ব্যবহার করার অনুমতি দিলেন না। আর তাকে সহায়তা করছিলেন শান্তিবাহিনীর শীর্ষ নেতা রূপায়ন দেওয়ান; শান্তিবাহিনীতে যিনি মেজর রিপ নামে পরিচিত।
সাত.কথোপকথনে সন্তু লারমা যা বললেন, তা অনেকটা এরকম: কথায় কথায় আমাদের বলা হয়, আমরা বিচ্ছিন্নতাবাদী, বিভেদপন্থী, রাষ্ট্রদ্রোহী -- ইত্যাদি। কিন্তু আমরা তা নই। আমরা এদেশের অখণ্ডতায় বিশ্বাসী। তাছাড়া আমাদের প্রতিষ্ঠিত স্কুল -- কলেজগুলোতে নিয়মিত জাতীয় পতাকা উড়ানো হয়। গাওয়া হয় জাতীয় সংগীত। আমাদের স্কুল -- কলেজেও একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস পালিত হয়। আর আমরা কোনোভাবেই ভারতের মদদপুষ্টও নই। আমার যুদ্ধ পরিচালনা করছি, এ দেশের সাধারণ পাহাড়ি মানুষের জন সমর্থন নিয়েই। তারাই আমাদের যুদ্ধের মূল শক্তি।
সন্তু লারমা জোর দিয়ে বলেন, আপনি গেরিলা যুদ্ধের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখবেন, এ রকম কোনো যুদ্ধই কোনো একটি দেশের ওপর নির্ভর করে বা জনসমর্থন ছাড়া টিকে থাকতে পারে না। আর আমরা সশস্ত্র সংগ্রাম করছি প্রায় দুই দশক! এটি খুব সাধারণ ব্যাপার নয়।
কিন্তু বলা হয়, আপনারা ভারতীয় সীমান্ত অবাধে ব্যবহার করছেন।... এ কথার জবাবে গেরিলা নেতা বলেন, সারা বিশ্বেই গেরিলারা কোনো না কোনো সীমান্ত ব্যবহার করেছে। ১৯৭১ সালেও মুক্তি বাহিনীর গেরিলারা ভারত সীমান্ত ব্যবহার করেছে। সেভেন সিস্টার খ্যাত অঞ্চলেও তাই হচ্ছে। তাই আমরা তা করলে দোষ হবে কেনো?
তাহলে পরিস্থিতি এখন ১৯৭১ সালের মতোই? সন্তু লারমা বলেন, অনেকটা তাই। আর দেখুন জঙ্গল জীবন অনেক কঠিন। আমরা তো আর শখ করে অস্ত্র হাতে তুলে নেইনি। এখানে রোমান্টিকতার কোনো প্রশ্নই নেই। এই যুদ্ধ আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের সমস্ত পথই বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমরা অনিয়মতান্ত্রিক পন্থায় সশস্ত্র গেরিলা যুদ্ধের রণনীতি বেছে নিয়েছি। আমরা শান্তিকামী বলেই সরকারের সঙ্গে আলোচনার পথও খোলা রেখেছি। আর ১৯৭১ সালের সঙ্গে এই যুদ্ধের পার্থক্য হচ্ছে, তখন পাকিস্তান এদেশের সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেছে। কিন্তু এখন এদেশের সেনা বাহিনী এদেশেরই পাহাড়ি জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাচ্ছে। এটি হচ্ছে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠিকে বুলেটে উড়িয়ে দেওয়ার জন্য সেনা অপারেশন। আত্নরক্ষার অধিকার তো সকলেরই আছে তাই না? আর আমরা লড়ছি পাহাড়ে আঞ্চলিক সায়ত্ত্বশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য। তবে সাধারণ বাঙালিদের সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ নেই।
আট.সন্তু লারমার এটিই ছিলো এদেশের কোনো গণমাধ্যমকে দেওয়া প্রথম সাক্ষাতকার। সাক্ষাতকারটিকে বিশ্বাসযোগ্য করতে লিডারের সঙ্গে গেরিলা পরিবেষ্টিত হয়ে এই আলোকচিত্রটি তোলা হয়। ছবি তোলেন রূপায়ন দেওয়ান।
দুপুরে ভাত খেয়ে আবারো পানছড়ি হয়ে খাগড়াছড়ির উদ্দেশে যাত্রা। সন্তু লারমা কিছুটা পথ এগিয়ে দেন। বিদায় বেলায় বলেন, পারলে আমাদের কথা লিখবেন। কেউ আমাদের কথা বলে না!
নয়.সে সময় দৈনিক আজকের কাগজে ছবিসহ সাক্ষাতকারটি হুবহু প্রকাশিত হয়। ভারতীয় ইংরেজী সাপ্তাহিক 'ইন্ডিয়া টুডে' একই সাক্ষাতকারটি ছবিসহ ফলাও করে প্রকাশ করে। সাপ্তাহিক খবরের কাগজে দুই পর্বে ছাপা হয় সন্তু লারমার প্রথম সাক্ষাতকারের ইতিবৃত্ত। ফরাসী বার্তা সংস্থা এএফপি'র তৎকালীন বিশেষ সংবাদদাতা নাদিম কাদের সংস্থার পক্ষে সন্তু লারমার দুটি আলোকচিত্র চড়া দামে কিনে নেন।।
*লেখাটি এর আগে সামহোয়ারিনে প্রকাশিত।
মন্তব্য
বিল্পব ভাই
লেখাটি বেশ বড়। দুর্দান্ত এবং রোমাঞ্চকর। একজন গণমাধ্যমকর্মী এ ধরনের সাক্ষাতকার ও অভিজ্ঞতার জন্যই অপেক্ষা করে বলে আমি মনে করি। যদিও অনেক বিষয়রে সঙ্গে আমি একমত নই। লেখাটি রহস্যপত্রিকার পাঠকদের জন্য দেওয়া যেতে পারে। এটি ছাপা হলে অনেক অজানা ঘটনা মানুষ জানতে পারবে।
প্রিয় অতিথি,
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। লেখার অনেক বিষয়ের সঙ্গে আপনার দ্বিমত থাকতেই পারে, কিন্তু তাই বলে এটি রহস্য পত্রিকার উপযোগি লেখা!!...সত্যিই এভাবে ভাবিনি কিন্তু।...
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
খুব ভাল্লাগলো!
একটা কথা মাঝে মাঝে জানতে ইচ্ছে করে - শান্তিচুক্তির পর পাহাড়ীরা এখন কেমন আছেন?
যায় ভেসে যায় স্বপ্ন বোঝাই, নৌকা আমার কাগজের...
সুপ্রিয়,
আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।
সংক্ষেপে বলছি, শান্তিচুক্তির প্রায় এক দশক পরেও পার্বত্য ভূমি কমিশনসহ চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়িত না হওয়ায় পাহাড়িদের জীবন এখন অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশী সমস্যা সংকুল হয়ে পড়েছে। ...
সন্তু লারমার ভাষায়, চুক্তির পর পাহাড়ে কোনো মৌলিক পরিবর্তন হয়নি। বরং যথাযথভাবে চুক্তি বাস্তবায়নের অভাবে এটি এখন পরিনত হয়েছে কাগুজে চুক্তিতে। 'অপারেশন উত্তরণের' নামে পাহাড়ে চলছে সেনা শাসন, সেনা কর্তৃত্ব।...
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
নতুন মন্তব্য করুন