(আমার দেশচ্চান হীরে-মানিক/ সোনা রূপোয় ভরা/ আমার দেশচ্চান মুড়ো-মুড়ি/ গাঙে-ছড়ায় ভরা...চাকমা গান)
উন্নিশশ' ছিয়ানব্বই সালের জুনের পরে কোনো একটি সময়। পাহাড়ি নেত্রি কল্পনা চাকমা মাত্র অপহরণ হয়েছেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম তখন দারুন অশান্ত - বিক্ষুব্ধ; সেনা বাহিনীর সঙ্গে সাবেক গেরিলা গ্রুপ শান্তি বাহিনীর রক্তক্ষয়ী বন্দুক যুদ্ধ লেগেই আছে।
পাহাড়ি বিদ্রোহী গ্রুপ শান্তি বাহিনী দমনের নামে নিরাপত্তা বাহিনী লংগদু, লোগাং, নানিয়ারচর, বরকল, দীঘিনালা, পানছড়িসহ নানান এলাকায় একের পর এক গণহত্যা করেই চলেছে।
আর এই সব গণহত্যায় সরাসরি অংশ নিচ্ছে সমতল থেকে সেনা সহায়তায় পাহাড়ে পুনর্বাসিত (?) বাঙালিরা; পাহাড়ের চলতি ভাষায় এদের বলা হয় -- সেটেলার।
তো সেই সময় পেশাগত কারণে একাধিকবার ভারতের ত্রিপুরার একাধিক পাহাড়ি শরণার্থী আশ্রয় শিবিরে যাওয়া হয়। সাবরুম আশ্রয় শিবিরে পরিচয় হয় বর্ষিয়ান শরনার্থী নেতা প্রভাকুমার চাকমার সঙ্গে। তিনি ঘুরে ঘুরে দেখান, বস্তির চেয়েও ঘিঞ্জি আর নোংরা শিবিরটিকে।
আশ্রয় শিবিরে তখন প্রায় ৭০ হাজার শরণার্থী মানুষ মরছে ঝাঁকে ঝাঁকে; কিলবিলে পোকার মতো অপুষ্টি, কলেরা, ম্যালেরিয়া, আর নানান অসুখে তারা মরছে ধুঁকে ধুঁকে। এক মুঠো চালের চেয়েও তখন বুঝি সস্তা জীবনের দাম ।...
যাদের এক সময় ছবির চেয়েও সুন্দর ঘর - দুয়ার, জুমের ক্ষেত আর শাল কি সেগুন বাগান ছিলো, তারা গণহত্যার কবল থেকে জীবনটুকু বাঁচাতে পরিবার-পরিজন নিয়ে সীমানা পাড়ি দিয়ে আশ্রয় শিবিরে কাটাচ্ছেন শরণার্থীর গ্লানিময় জীবন। রিলিফের চাল-ডালের জন্য ভিখিরির মতো লাইনে দাঁড়াচ্ছেন শিশু সন্তানের মুখে দুটি অন্ন তুলে দেওয়ার জন্য!
সাবরুম আশ্রয় শিবির ঘুরে দেখার সময় এক ঝাঁক চাকমা শিশু ঘিরে ধরে এই প্রতিবেদককে। এই সব শিশুর জন্ম আশ্রয় শিবিরেই। তারা শুধু বড়দের কাছে শুনেছে, ওপারে বাংলাদেশে এক সময় তাদের আনন্দময় জীবনের স্বপ্নকথা। আর শুনেছে, দেশত্যাগের একটি অন্যতম কারণ গণহত্যা, সেটেলারদের জমিজমা দখলের নোংরা রাজনীতির টুকরো কথা।
শিশুর দল ঘিরে ধরে বাংলাদেশ থেকে আসা 'বাঙাল'কে। কিচির মিচির করে চিৎকার করতে থাকে: সেটেলার! সেটেলার! সেটেলার!...
প্রভাকর বাবু নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন তাদের। বলেন, আপনি কিছু মনে করবেন না যেনো আবার। ওরা আপনাকে চিনতে পারেনি।
কিছুই মনে করার ছিলো না কখনোই। কিন্তু কচিকন্ঠের সেই সব চিৎকার এখনো কেনো যেনো মাঝরাতে ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। মাথার মধ্যে আটকে যাওয়া ভাঙা রেকর্ডের মতো ঘুরতে থাকে সমবেত শিশু-শ্লোগান: সেটেলার! সেটেলার! সেটেলার!...
(এই লেখাটি এর আগে সামহোয়ারিনে প্রকাশিত।)
মন্তব্য
বিপ্লবের লেখায় বিপ্লব!
-------------------------------------
রামছাগলের সামনে, খচ্চরের পেছনে আর নির্বোধের ধারেকাছে না থাকাই শ্রেয়!
আপনি দারুণ একটা বিষয় নিয়ে কাজ করেন, ভাই!
ভাল লাগল লেখাটা।
লিখে যান, যদি কোনদিন বোধোদয় হয় কারো
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর
সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ। ....
কারো বোধোদয় হবে, সে আশাতেই লেখা। তবে তা না হলেও কিছু সচেতন পাঠক বিষয়টা জানলেন, এটিও তো কম নয়!
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
সেটলার তো নিজের উদ্যোগে সেটল করেনি, তাদের পিছনে ছিল খোদ রাষ্ট্রযন্ত্র। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের নানান বিষয়ে রাষ্ট্রীয় পলিসির নানান রকম বদল হয়েছে। বদল হয় নি শুধু পাহাড়িদের ক্ষেত্রেই। শেখ মুজিব থেকে, জিয়া, এরশাদ, খালেদা, হাসিনা, ফখরুদ্দীন..... সব রসুনের গোড়া এক জায়গাতেই ছিল, আছে, এবং সম্ভবত থাকবেও।
সুন্দর লেখা। সিরিজ করা যায় এই অভিজ্ঞতা নিয়ে?
...........................................................................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!
একমত।
বছর তিনেক আগে আমার সাবেক কর্মস্থল দৈনিক যুগান্তরে পাহাড়ের ওপর একটি সরেজমিন ধারাবাহিক প্রতিবেদনে সেটেলার সমস্যা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।...
তবে আমার অভিজ্ঞতা এমন কিছু বিস্তৃত নয় যে, এ বিষয়ে আবারো সচলায়তনে কোনো ধারাবাহিক লেখা তৈরি করা সম্ভব।
আবারো সবাইকে ধন্যবাদ।
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
বিপ্লবদা, আপনার পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে লেখাগুলো অসাধারণ। খুব সম্ভবতঃ এই লেখাটি পড়েই আপনাকে প্রিয় ব্লগারের তালিকায় অ্যাড করেছিলাম সেসময়।
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
অ্যাঁ!
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
বাংলাদেশ সরকার আদি বাসিদের সাথে মোটেও ঠিক আচরণ করেনি। জিয়াউর রহমানের আমলেই আদি বাসিদের সরিয়ে বিভিন্ন জেলা থেকে লোক বসিয়েছে। আমাদের স্বদিচ্ছা থাকলে এই সমস্যার সামাধান কোন কঠিন কাজ নয়।
যথার্থই বলেছেন। তবে সরকারি পর্যায়ে সদিচ্ছা থাকাটা খুব দরকার।
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
বিপ্লব রহমান কে যথারীতি বিপ্লব ।
হিল উইমেন্স স্টুডেন্ট ফেডারেশনের বর্তমান সভানেত্রী কি সোনালী চাকমা?
-----------------------------------
মানুষ এখনো বালক,এখনো কেবলি সম্ভাবনা
ফুরোয়নি তার আয়ু
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
সঙ্গে থাকার জন্য আবারো সবাইকে ধন্যবাদ।
হাসান ভাই,
হিল উইমেন্স ফেডারেশনের শান্তিচুক্তি সমর্থিত গ্রুপটির একাংশের সভানেত্রি সোনালী চাকমা ছিলেন। নতুন কমিটিতে কে এসেছেন, তা এখনই বলতে পারছি না।
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
হুম,আমাদের অনেক পুরনো বন্ধু
-----------------------------------
মানুষ এখনো বালক,এখনো কেবলি সম্ভাবনা
ফুরোয়নি তার আয়ু
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
বিপ্লব দা,
ইদানিং পাহাড়ে ভূমি বিরোধ আবার বেড়েছে..........
বিশেষ করে খাগড়াছড়িতে..........
সময় পেলে নিউজ করতে পারেন..........
আমরা তো পারিনা............
বোঝেন তো !!!
নতুন মন্তব্য করুন