শ্রদ্ধেয় এমএন লারমা ,
আপনি জানেন, অতিকায় হস্তি বা তেলাপোকার কোনো তুলনামূলক বিচার ছাড়াই প্রায় দুদশক ধরে সাংবাদিকতার কষ্টকর পেশাটিকে ভালবেসে এখনো টিকে আছি। তারুণ্যের বন্ধুরা আদিবাসী পাহাড়ি হওয়ার সুবাদে দুর্গম পাহাড়ের আনাচে - কানাচে, বনে - বাদাড়ে ঘোরা হয়েছে তারও অনেক আগে থেকে।
পাহাড়ের পর পাহাড় উজাড় করে সবুজ মরুভূমিতে পরিনত করা, অথবা ছবির চেয়েও সুন্দর স্বাপ্নিক ঘরবাড়িগুলোকে শ্মশান বানানো, গণহত্যার পর গণহত্যার শুকনো কালচে রক্ত, কি ধর্ষিত নারীর আর্তনাদ, আর দেশান্তরী হওয়া মানুষের চাপা কান্না কখন যে একের পর এক সংবাদের অক্ষর হতে থাকে!
সেই শুরু থেকে কোনো প্রাপ্তির আশা ছিলো না, ছিলো শুধু লেখার আনন্দ; সত্য প্রকাশের অদম্য আকাঙ্খা। বহু বছর ছোট্ট চেনা গণ্ডির বাইরে ‘সাংবাদিক’ হিসেবে কেউ চেনেও নি; একের পর এক সাপ্তাহিকে কলম ঘষে ঘষে অনেকখানি জীবন ক্ষয়ের পর ১৯৯৪ সালে যখন তিন হাজার দুশ টাকার অনিয়মিত বেতনে চাকরি পাই ‘আজকের কাগজে’, তখন পত্রিকাটির সম্পাদক কাজী শাহেদ আহমেদের নানান ভণ্ডামী - ধান্দাবাজীর জন্য কম গাল খেতে হয়নি, এই সেদিনের পুঁচকে সাংবাদিককে।
প্রিয় পাহাড়ি নেতা,
শান্তিবাহিনীর সঙ্গে সেনা বাহিনীর ভয়ংকর রকম সশস্ত্র যুদ্ধের ভেতর গেরিলা নেতা সন্তু লারমার হাইড আউটে গিয়ে তার প্রথম একটি সাক্ষাতকার করার সুবাদে সেই সময় ‘সাংবাদিক’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করা হয়। অনেক বড় বড় কাগজ আর সংস্থার নামকরা সাংবাদিকরা একটু - আধটু চিনতে শুরু করেন। পাহাড়ি বন্ধুদের সুবাদে সমতলে থেকেই অনেক পাহড়ের খবর আসতে থাকে একের পর এক।
মানবাধিকার লংঘনের খবরের সন্ধানে গারো পাহাড়, খাসিয়া পাহাড়, দিনাজপুরের সাঁওতাল পল্লী, কি টেকনাফের রাখাইন পাড়ায় যাতায়ত বাড়তে থাকে। এমনকি ঢাকার কাছেই গাজিপুরের বর্মন - কোঁচ পাড়ায়, মধুপুরের মান্দি গ্রামেও। সবই করা হয়েছে, পেশাগত কারণে, সত্যের সন্ধানে।
লারমা বাবু,
এই করে করে কাগজ বদল করতে করতে একদিন অবাক হয়ে দেখি এখন আমি ‘সিনিয়র’ হয়ে গেছি। আমার পরেও আরো তিন - চার প্রজন্ম এখন একই পেশায়; বানান ভুল ধরিয়ে দিয়ে ওরা এখনো আমাকে শেখায়। আমি অবাক বিস্ময়ে দেখি ওদের প্রযুক্তিগত ধ্যান, ভনিতাহীন তথ্য - সংবাদ প্রয়োগ কৌশল! আমি প্রতিনিয়তই সহকর্মি শিশু - সাংবাদিকদের ছাত্র হই, শিখি, শিখে চলি।...এছাড়া অন্য কোনো প্রাপ্তির আশা কখনো ছিলো না, এখনো নেই।
চারপাশে দেখি, সাংবাদিকতার নানান পুরস্কার। ক্রেস্ট, পদক হাতে, কি মেডেল গলায় সাংবাদিকের বিকশিতদন্তসহ ছবি পত্রিকায় ছাপা হয়। আমার চেনা, সামান্য চেনা, এমন কি একেবারে অচেনারাও প্রশিক্ষণ, কর্মশালা, সেমিনারে যোগ দিতে কতো যে দেশ - বিদেশে উড়াল দেয়! সেই কবে ১৯৯৮ সালে অনুসন্ধানী রিপোর্টের জন্য আধখানা ‘ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির’ পদক -- পুরস্কার বলতে এই। আর বিদেশ সফর? পেশাগত কারণে দুদফায় কোলকাতা, একাধিকবার আগরতলা মাত্র। ভেবেছি, বড় হলে দেখিস একদিন আমরাও!...
শ্রদ্ধেয় এমএন লারমা,
পার্বত্য শান্তিচুক্তি সাক্ষরের পর (১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর) নব্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এনজিওগুলো উন্নয়নের নামে, ‘আদিমবাসী’ গবেষণা নামে, আরো নানা নামে দেদারছে ডলার, পাউন্ড, ইউরো ওড়ানো শুরু করে। দেখি ভূঁইফোড় অনেক নতুন মুখ, ঝাঁ চকচকে অনেক নতুন নতুন দোকান।
জুম্ম (পাহাড়ি) ব্যাপারীরা আমাকে সকাল - বিকাল নিয়ম করে সালাম-আদাব-নমস্কার দিতে থাকে। ফোন -ফ্যাক্স- ইমেইলে উত্তক্ত করে এটাসেটা অনুষ্ঠানের খবর ছাপার জন্য। ‘জানেন, আমরা আধুনিক উপায়ে জুম চাষের জন্য একটা গবেষণা করছি আলুটিলায়। ঢাকা থেকে প্লেনে চট্টগ্রাম, সেখানে থেকে এসি মাইক্রোতে খাগড়াছড়ির আলুটিলা। আলুটিলার পাহাড়ে জুম চাষী উপজাতীয় মেয়েরা একটা সম্বর্ধনা দেবে সাংবাদিকদের। চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ির ভিআইপি রেস্ট হাউজ বুকিং দেওয়া আছে। ফেরা হবে আবারও প্লেনে!’
পাহাড় সম্পর্কে, আদিবাসী সম্পর্কে, সাংবাদিক সম্পর্কেও এই সব ব্যাপারীদের ধারণা দেখে মনে মনে আমি চমকাই। লজ্জায় আমার মাথা কাটা যায়।
...আমার শিক্ষক আতাউস সামাদ বলেছিলেন, কখনো ‘সোর্সের’ সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হয় না। তো এই শিক্ষা থেকে সরাসরি কোনো কটু কথা বলতে পারি না। বিভিন্ন অজুহাতে শুধু এড়িয়ে যাই।
লারমা বাবু,
আবার সেদিন আরেক জুম্ম ব্যাপারী মেসবাহ কামালের সকাল সকাল ফোন, ‘বিপ্লব, আমরা বিশ্ব আদিবাসী দিবস উপলক্ষে (৯ আগস্ট) অনেক বছর ধরে যারা আদিবাসী নিয়ে কাজ করছেন, এমন কয়েকজন সাংবাদিকদের সম্বর্ধনার আয়োজন করেছি। আদিবাসী অধিকার আন্দোলন এই সম্বর্ধনার আয়োজন করেছে। সব টিভি চ্যানেল আর পত্রিকায় কাভারেজের ব্যবস্থা করেছি। আপনি কিন্তু অবশ্যই আসবেন।’
জানা গেলো, অধ্যাপক মেসবাহ কামালের নেতৃত্বাধীন বাঙালিদের ওই সংস্থাটি ‘অনেক বছর ধরে আদিবাসী নিয়ে কাজ’ করার জন্য এই অধমসহ আরও যাদের সম্বর্ধিত করতে চান, তারা হচ্ছেন: হরিকিশোর চাকমা (প্রথম আলো), গোলাম মর্তুজা (সাপ্তাহিক ২০০০), ফারজানা রূপা (এটিএন বাংলা) এবং নজরুল কবির (ইটিভি)। বিনীত ভাবে বলা হলো, ওই দিন পেশাগত কারণে ঢাকার বাইরে অবস্থান করতে হবে বলে অনুষ্ঠানে আসা সম্ভব নয়!
ওইদিনই রাতে শ্রদ্ধেয় হরিদার টেলিফোন পাই, ‘বিপ্লব, তুমি অনুষ্ঠানে আসো নি কেনো? আমি কিন্তু তোমাকে খুব আশা করেছিলাম!’
আমি সরাসরি সত্য কথাটিই হরিদাকে বলি, ‘হরিদা, ওরা সম্বর্ধনা দিয়ে আমার কলম বন্ধ করতে চায়। আগে সম্বর্ধনা নেওয়ার মতো বয়স হোক; তারপর সম্বর্ধনা নেবো। আর তাছাড়া আদিবাসী নিয়ে কাজ করার জন্য বাঙালিদের একটি সংগঠন বাঙালি সাংবাদিককে সম্বর্ধনা দিচ্ছে; এটি কেমন কথা!’
‘এ কারণেই ওই অনুষ্ঠানটিকে আমি নিরবে বর্জন করেছি। এইসব পদক - টদক নিলে আমি আমার নেতা এমএন লারমার কাছে মনে মনে ছোট হয়ে যেতাম!’ যোগ করি আমি।
আমার কথা শুনে পাহাড়ের চারণ সাংবাদিক হরিকিশোর চাকমা বোধহয় একটু থমকে যান। বলেন, ‘বিপ্লব, এ ভাবে চিন্তা করিনি তো! তুমি সম্বর্ধনা না নিয়ে ভালই করছো। আগে জানলে আমিও অনুষ্ঠানে আসতাম না!’
প্রিয় নেতা,
আপনি বলেছিলেন, নেতৃত্বের মৃত্যূ আছে, আদর্শের মৃত্যূ নেই। -- এই বিশ্বাস নিয়ে যেনো সব ধরণের লোভ আর মোহের উর্দ্ধে কলমকে শানিত করে চলতে পারি, আপনি সেই আশির্বাদই আমাকে করবেন।
আপনাকে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন; লাল সালাম।।
মন্তব্য
মন্তব্য নেই ।
পড়ে গেলাম
----------------------------------------------
আমাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে একটা নদী-
সাথে নিয়ে একটা পাহাড় আর একটা নিঃসঙ্গ মেঘ।
আরও চাই
====
এম. এম. আর. জালাল
"ফিরে দেখুন একাত্তর ঘুরে দাঁড়াক বাংলাদেশ।"
এম. এম. আর. জালাল
"ফিরে দেখুন একাত্তর ঘুরে দাঁড়াক বাংলাদেশ।"
বিপ্লব ভাই, এই লেখাটি আপনার জন্য।
নীরবে পড়ে গেলাম।
আপনার কলম সচল থাকুক।
আমি ও আমার স্বপ্নেরা লুকোচুরি খেলি
আবার লিখবো হয়তো কোন দিন
বিপ্লবের জন্য বিপ্লব ।
-----------------------------------
মানুষ এখনো বালক,এখনো কেবলি সম্ভাবনা
ফুরোয়নি তার আয়ু
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
সঙ্গে থাকার জন্য সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা।
আরিফ ভাই,
আলাদা করে আপনাকে আর কী বলবো?
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
নতুন মন্তব্য করুন