প্রবাসের কথা…[০৪]

বিপ্রতীপ এর ছবি
লিখেছেন বিপ্রতীপ (তারিখ: রবি, ১৯/১০/২০০৮ - ৭:৫৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১।
গত কয়েকটা দিন খুব ঝামেলার মাঝে গেছে…প্রেজেন্টেশন, রিপোর্ট সব মিলে রীতিমতো চিড়ে চেপ্টা অবস্থা। বুয়েটের আন্ডারগ্র্যাড হলে এই রিপোর্টটা চোখ বুঁজে চোথা মেরে দেয়া যেতো মাত্র কয়েক ঘন্টায়। কারন, প্রথম দুই সেমিস্টারে রেজাল্ট ভালো না করার খেসারতটা বাকী তিন বছরেই সুদে আসলে আদায় করে নেয়া হয় বাঁশ দিয়ে।রিপোর্ট খেঁটে খুঁটে নিজে লিখলেও কোন লাভ হয় না বেশির ভাগ সময়। ডিপার্টমেন্ট ছোট হলে সেই যন্ত্রণার পরিমাণটা আরোও ভয়ংকর হয়ে দাঁড়ায়। যাই হোক, পড়াশুনার অভ্যাসটা ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় তাই লাঞ্চ আর নাস্তা একসাথে করে প্রতিদিন অফিসের (গ্র্যাজুয়েট স্টার্ডি রুম) দিকে ছুটি। সেখানে বাকীদের পড়াশুনা দেখে যদি ইচ্ছে হয় একটু পড়াশুনার সেই আশায়। লাভের লাভ কিছু হয় না।একটা পেপারের abstract পড়তেই কেমন ক্লান্ত লাগে, সেই ক্লান্তি কাটানোর জন্য ঘন্টাখানেক ফেসবুক, আমাদের প্রযুক্তি আর সচলায়তনে উঁকিঝুঁকি মারতে হয়…

২।
কানাডায় আসার পর অপেক্ষায় ছিলাম কবে তুষারপাত দেখা মেলে।গত সপ্তাহে সেটা দেখা হয়ে গেলো প্রথমবারের মতো।অবশ্য কয়েকদিন আগে থেকেই আবহাওয়া পূর্বাভাস বলছিলো এই সপ্তাহান্তেই তুষারের দেখা মিলবে। রুমে বসে থাকতে ভাল্লাগেনা…তবু সেদিন আর স্টার্ডি রুমে গেলাম না।সকাল থেকেই আকাশের মুখ গোমড়া।দুপুর পৌনে একটার মতো বাজে…ল্যাপটপ থেকে জানালায় চোখ সরাতেই দেখি… হাল্কা তুষারপাত শুরু হয়েছে।সময়ের সাথে বাড়তে লাগলো…তুলোর মতো তুষারে ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। ভারী জ্যাকেট চাপিয়ে বাইরে বের হলাম এপার্টমেন্টের তিনজন…উদ্দেশ্য ফটুসেশন।
auto
auto
auto


























রেজিনায় বাংলাদেশী কম বলে আশপাশ থেকে দাওয়াত তেমন একটা পাওয়া যায় না।দাওয়াত বলতে ঘুরেফিরে এক সুমন ভাই, এখানে পিএইচডি করছেন। মৌসুমের প্রথম তুষারপাত দর্শন উপলক্ষ্যে বিকেলে ভার্সিটির আরেক বাংলাদেশী তারেক ভাই চা-নাস্তার দাওয়াত দিলেন।আমাদের এপার্টমেন্ট থেকে দুই স্ট্রিট পার হলেই তারেক ভাইয়ের বাসা। গত কয়েক বছর ধরে সকালের নাস্তা বলতে ছিল রুটি কিংবা পরোটা। এখানে আসার পর রুটি খাওয়া হয়নি তেমন একটা শুধু রেজিনার ঈদ পুনর্মিলনীতে নান রুটি খাওয়া হয়েছিল। কানাডা আসার পর সেদিন প্রথম চালের রুটি দেখে রীতিমতো ঝাঁপিয়ে পড়লাম…

৩।
আমি একটু ঘরকুনো স্বভাবের। ঘুরাঘুরি তেমন একটা পছন্দ হয় না। রেজিনাও তেমন একটা ঘুরে দেখা হয়নি। আর্ট গ্যালারি, মিউজিয়াম আর ওয়াসকানা পার্ক ছাড়া এখানে অবশ্য দেখার মতো তেমন কিছু আছে বলে মনে হ্য় না। ওয়াসকানা লেকটা ক্যাম্পাস ঘেঁষেই, আর্চার লাইব্রেরীর পেছনে। যাবো যাবো করে যাওয়া হয়ে উঠছিলো না। সেদিন গেলাম।
ওয়াসকানা পার্ক নাকি নর্থ আমেরিকার বৃহত্তম শহুরে উদ্যানগুলোর একটি। বেশ কিছুক্ষণ লেকের পাড়ে হাঁটলাম…ভালোই লাগলো। লেকের পাড়ে একটা ভাস্কর্যও আছে। নামটা জানতাম না।বাসায় এসে ইন্টারনেটে সার্চ দিয়ে খুঁজলাম… ফেঞ্চ নামটা একটু দাঁতভাঙ্গা। ইংরেজি নামটাও পাওয়া গেলো Mind’s Garden (মনের বাগান)। নামটা বেশ মনে ধরলো । এই প্রদেশেরই এক বিখ্যাত ভাষ্কর্য জো ফাফার্দের নাকি বিখ্যাত সৃষ্টি এই ভাষ্কর্য। ১৯৯৪ সালে ইংল্যান্ডে এক প্রতিযোগিতায় পাঠানো হয়েছিল। সেখানে কোন পুরষ্কার না জিততে পারলেও এই কাজটিকে তার অন্যতম সেরা সৃষ্টি হিসেবে গণ্য করা হয়। ১৯৯৯ সালে ওয়াসকানা লেকের পাড়ে এই ভাস্কর্যটি স্থাপন করা হয়।

auto
auto
auto
auto

auto












































৪।
সপ্তাহের ঝামেলা শেষে শুক্রবারের রাত এসব একঘেঁয়েমি থেকে কিছুটা মুক্তি দেয়। এখানে আন্ডারগ্র্যাডের দু’একজন বাংলাদেশী আছে।এদের মাঝে মিনাম আর তন্ময়ের সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেছে, আমাদেরই সমবয়সী। দুজনই খুবই মিশুক। ক্যামনে কি,কোথায় কি পাওয়া যায় সেসব জানতে এরাই ভরসা বেশির ভাগ সময়।শুক্রবার বাংলাদেশী ছাত্ররা সবাই মিলে আড্ডা দেয় মিনামের বাসায়। আমার তাস পেটানো হয় না, তবু প্রতি শুক্রবার যাই। এক কোনায় বসে ল্যাপটপে হাতি ঘোড়া মারি। মাঝে মধ্যে ঝাঁকে মেশার আশায় সিগারেটে দু’একটা টান দেয়ার চেষ্টা করলে অনি’র ঝাড়ি খেতে হয় ‘যে জিনিস খাইতে পারো না সেইটা ক্যান যে খাইতে যাও, আবার তো ফিল্টারটা ভিজাইয়া দিলা?’

৫।
সম্প্রতি আবার ‘ভাল্লাগেনা’ রোগে ধরেছে। হাতে সময় থাকলেও ব্লগাতে ভাল্লাগেনা। চমৎকার কোন লেখা পড়লেও লগইন করে কমেন্ট করতে ইচ্ছে হয় না। মনে হয় ভালোলাগা-মন্দলাগা মনেই থাক। কি দরকার? সব অনুভূতি কি সব সময় আর প্রকাশ করা হয়…। হার্ডডিস্কে ডাউনলোড করা গাদাখানেক মুভি,নাটক জমা হয়েছে। ইদানিং বাংলা নাটকগুলোরও বেশিরভাগ ভাঁড়ামি কিংবা ন্যাকামিতে ভরপুর, দেখতে বিরক্ত লাগে। মাঝেমধ্যে পুরাতন পছন্দের মুভিগুলোর পছন্দের অংশগুলো ঘুরেফিরে দেখি। নতুন মুভি দেখতে বসে শেষ করা হয় না। নতুন কিছু আজকাল আর বেশিক্ষণ ভালো লাগে না…মনে হয় পুরনো সবকিছুই ভালো ছিল।


মন্তব্য

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

আপনি তাহলে বেশ আগেই বরফ দেখে ফেললেন। রেজিনাতে বলেই সম্ভব। আমার এখানে রাতে ফ্রস্ট ওয়ার্নিং দিয়েছে। যাহোক আপনার দিনলিপি পড়ছি আর নিজের স্মৃতি মনে করছি। অনেকটা আপনার মতই দিন কেটেছিল আমার।

মাঝে মাঝে এমন হয় যে কোনকিছুই ভালো লাগেনা। মনকে জোর করে কিছু না করানোই ভালো। তবে পড়ালেখাটা ঠিকমত চালিয়ে নিবেন। এটা ঠিক থাকলে দেখবেন সব ঠিক।

ছবিগুলা একটু বড় করে দিলে ভালো হতো। ফ্লিকারে তুলে কোড পেস্ট করে করতে পারেন।

বিপ্রতীপ এর ছবি

এমনিতে ইমেজশ্যাক থেকে দেই, আজ কেন যেন ঝামেলা করছিলো...তাই সরাসরি ফেসবুক থকে লিঙ্ক দিয়েছি। দেখি পরে ঠিক করে দেব।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
http://biprodhar.com

শামীম এর ছবি

মন খারাপ লাগাটা মনে হয় বাইরে যাওয়া সবার মধ্যেই কমন। কারণ, প্রথম প্রথম ওখানের জগৎটা অনেক সীমাবদ্ধ মনে হয়।
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

আলমগীর এর ছবি

তাস খেলতে পারে না, পোলাপাইন ডিগ্রি পায় কেমনে!

বিপ্রতীপ এর ছবি
শিক্ষানবিস এর ছবি

ছবিগুলো খুব সুন্দর, লেখাটাও।
প্রবাস থেকে সবাই দেখি কেবল দুঃখের কথা লিখছেন। গতকাল কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাইয়ের ব্লগেও সেই কষ্টের কথা। প্রবাসের সাধারণ দুঃখগুলো থেকে মুক্তির কোন উপায় বের করে ফেলেন। যেন ভবিষ্যতে নতুন জিনিস ভাল্লাগতে শুরু করে। পুরনোর চেয়ে নতুনকে ভাল লাগাটা বোধহয় বেশী জরুরী।

মুশফিকা মুমু এর ছবি

ছবিগুলো সুন্দর। আমারো ইদানিং কিছু ভাল লাগছেনা। মনেহয় ছেলে হলে খুব ভাল হত। মেয়ে হলে অনেক বেশি ঝামেলা, সবার অনেক বেশি চিন্তা, কিছু ভাল লাগেনা। আপনি ছেলে আছেন, অনেক ভাল আছেন।
------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

বিপ্রতীপ এর ছবি

নদীর এপাড় কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস, ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস... হাসি
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
http://biprodhar.com

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

হ...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

নীল রোদ্দুর এর ছবি

বীপ্রদা আরো অনেক কিছুই পারেনা... যেমন ধরেন কাউকে কঠিন স্বরে কিছু বলতে পারে না... হাসি

তবু বীপ্রদা শুধু ডিগ্রী না... তার চেয়েও অনেক মূল্যবান কিছু পাওয়ার মত মানুষ... ডিগ্রী সেসবের তুলনায় আসলেই কিছু না
--নীলকণ্ঠ

-----------------------------------------------------------------------------
বুকের ভেতর কিছু পাথর থাকা ভালো- ধ্বনি দিলে প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়

পরিবর্তনশীল এর ছবি

যে জিনিস খাইতে পারো না সেইটা ক্যান যে খাইতে যাও, আবার তো ফিল্টারটা ভিজাইয়া দিলা?’

এসব টুকরো কথা-ই মানুষ হিসেবে পাওয়া।

নতুন কিছু আজকাল আর বেশিক্ষণ ভালো লাগে না…মনে হয় পুরনো সবকিছুই ভালো ছিল।

আর এটাই মানুষ হওয়ার যন্ত্রণা।

---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

বিপ্রতীপ এর ছবি

আসলেই মানুষ হবার যন্ত্রনা অনেক...মাঝে মধ্যে বিষন্ন বালক সৌরভের 'আমি কখনো মানুষ হতে চাই নি' লেখাটার কথা মনে পড়ে...
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
http://biprodhar.com

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।