প্রবাসের কথা…[০৫]

বিপ্রতীপ এর ছবি
লিখেছেন বিপ্রতীপ (তারিখ: শনি, ০৮/১১/২০০৮ - ২:০৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১।
হুট করে গত দুদিন ধরে বেশ ঠান্ডা পড়েছে। আগের দিনও প্রায় সারা রাত প্রায় ৯ ডিগ্রী সেলসিয়াস ছিল। পরের দিন থেকে -৫/৬। রাতে আরোও বেশি ঠান্ডা পড়ে। সেইটা অবশ্য খুব একটা ব্যাপার না। তবে সাথে বাতাস থাকলে খবর হয়ে যায়। পরশু রাতে আটটার দিকে ভার্সিটি থেকে ফেরার পথে দেখি প্রচন্ড বাতাস। এখানে নাকি উইন্টারে কিছুদিন -৫০ ডিগ্রী সেলসিয়াসও থাকে। তাই -৫/৬ এ ভয় পেলে আর এইখানে থাকা লাগবে না এই ভেবে উইন্টার জ্যাকেট না নিয়ে টি-শার্টের উপর লেদার জ্যাকেট চাপিয়েই বের হয়েছিলাম। এপার্টমেন্ট থেকে ভার্সিটি প্রায় দশ মিনিটের পথ। মাঝপথে ম্যাক্সে কফির দাম দিতে গিয়ে পকেটে হাত দিয়ে মনে পড়লো ভুলে চাবি আনা হয়নি। ভার্সিটিতে গেলে অবশ্য অফিসের চাবি মহিউদ্দিন ভাইয়ের কাছে পাওয়া যাবে। আবার সন্ধ্যার পর এপার্টমেন্টের মেইন গেইট অটোলক হয়ে যায়। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে মাঝরাস্তা থেকে আবার বাসায় রওয়ানা দিলাম। আসতে আসতে মনে হলো ঘড়িটাও আনা হয়নি। এইখানে মোবাইল নেই, তাই সময় দেখার জন্য হাতঘড়িটাই সম্বল। উইন্টারে সন্ধ্যার পর চাবি না থাকলে কপালে অনেক দুঃখ আছে।এই এপার্টমেন্টের সবচেয়ে আজীব ব্যাপার হলো কোন কলিং বেল নেই। ভাড়া একেবারে কম না। দুই রুমের এই এপার্টমেন্টের ভাড়া অন্য এলাকার তুলনায় প্রায় দ্বিগুন। কারন ভার্সিটির কাছাকাছি। আর এই এলাকার বেশির ভাগ এপার্টমেন্ট বোর্ডওয়াকের। তাই এই এলাকায় থাকতে চাইলে তাদের মনোপলি মেনে নিয়েই থাকা লাগবে।

২।
বয়স বাড়ছে, সাথে কমছে পড়াশুনার ধৈর্য্য। আধঘন্টা পড়লেই এখন বিশাল হাই তুলি, মনে হয় অনেক পড়লাম। টানা দু’তিন মগ ব্ল্যাক কফিতেও কাজ হয় না। সুপারভাইজারকে এখন পর্যন্ত চাপার উপর রেখেছিলাম। আগের দিন হাতের কাছে যা পাই তাই কয়েক ঘন্টায় গুছিয়ে গাছিয়ে জমা দিতাম সপ্তাহান্তের আপডেট হিসেবে। তবে বেশিদিন চালানো গেল না। সবাই শো-ডাউন চায়। এ যাত্রা পার পেলাম মহিউদ্দিন ভাইয়ের পরামর্শে। সে এক বিরাত ইতিহাস। যাই হোক, আজ কাজের আপডেট নিয়ে দেখা করার সময় হঠাৎ করেই সুপারভাইজার জিজ্ঞেস করলেন, তোমার না বিপ্র না বাইপ্রো?

আমার সুপারভাইজার এমনিতে বেশ বন্ধুসুলভ। মাঝে মধ্যে একসাথে কোথাও যাবার সময় তার পেছনে আমি থাকলে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন। এখানে পেছনে কেউ থাকলে দরজা ধরে দাড়িয়ে থাকাটা ভদ্রতা। অবশ্য সবাই এসবের ধার ধারে না। সপ্তাহে একদিন সুপারভাইজারের সাথে দেখার করার জন্য একটা নির্দিষ্ট সময় আছে। মাঝে মধ্যে কোন কারনে অফিসে আসতে দেরি করে আসলে কমপক্ষে ছয়-সাতবার ‘সরি’ বলেন। তখন বুয়েটের কথা মনে পড়ে যায়। বুয়েটের মাঝে মধ্যে কোন স্যার/ম্যাডামের সাথে দেখা করার জন্য টি-রুমের সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। তবে আমার সুপারভাইজার কাজ কিভাবে আদায় করে নিতে হয় তার তরিকা উনি ভালোই জানেন। সাপ্তাহিক আপডেটের পাশাপাশি রিসার্স টপিকের উপর এই সেমিস্টারে তিনটা রিপোর্ট আর তিনটা প্রেজেন্টেশন জমা দিতে হবে। একটি প্রেজেন্টেশন বাড়তেও পারে। এই প্রজেক্টে যারা স্পন্সর করছে তাদের সামনে। ভয়ে আছি…আমাদের ভয়াবহ আপডেট দেখে না আবার সেই কোম্পানি স্পন্সর বন্ধ করে দেয়।

৩।
এই রিসার্স গ্রুপটা দুইজনের-স্যার ইন্ডাস্ট্রিয়ালের আর ম্যাডাম এনভায়রমেন্টের। দুজনে স্বামী-স্ত্রী, দেশ থাইল্যান্ড। ওনার দু’জনের কাছে এই প্রজেক্টে আমরা মোট ছয়জন। দুজন বাংলাদেশী, দু’জন চ্যাংকু আর একজন থাই। এর মাঝে লি নামের এক চাংকু পিএইচডি করছে। তার দূর্বোধ্য ইংরেজি আমি একবর্ণও বুঝি না।‘ওয়াটার’ কে উচ্চারন করে ‘ওতার’। ধৈর্য্যে কুলায় না বলে তাকে দেখলে ইদানিং নিরাপদ দুরত্ব সরে যাই। ইন্ডিয়ানটার বাড়ি সাউথ ইন্ডিয়ায়, নাম রাঙ্গাকৃষ্ণা (আমার সুপারভাইজার অবশ্য ডাকেন 'লংকা')। দেশে চারমাস চাকুরির সুবাদে সাউথ ইন্ডিয়ানদের সাথে চলাফেরার অভিজ্ঞতা আগে থেকেই আছে। এরা শোডাউনে ব্যাপক ওস্তাদ। এই রাঙ্গা নামক কাবিলও ব্যাতিক্রম না।

এইখানে ল্যাবে কাজ করার আগে বেশ কয়েকটা ওয়ার্কশপ আর নামকা ওয়াস্তে তাৎক্ষনিক কিছু পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। এসব ওয়ার্কশপে ল্যাব সেফটির উপর সিডাকসিন মাখা গাদাখানেক স্লাইড দেখানো হয়।বুয়েটে কেমিস্ট্রির এক স্যার ছিলেন। তার ক্লাসে সবার কেন জানি ঘুম আসতো। স্যার ‘সিডাকসিন’ হিসেবেই বেশি পরিচিত ছিলেন। এক ওয়ার্কশপে গিয়ে এই কথাটা মনে পড়ে গেলো। অনেক কষ্টেও মনে করতে পারলাম না স্যারের আসল নাম। এক ওয়ার্কশপে সিট না পেয়ে গোলটেবিলের একেবারে মাথায় বুড়ি ইনস্ট্রাকটর ক্রিস্টিনের পাশে গিয়ে বসতে হলো। চোখ খুলে রাখতে পারি না। মাঝে মধ্যে অনিবাবু পাশ থেকে ঠেলে ঠুলে তুলে দেয়। টেবিলের ওপাশ থেকে মিসবাহ ভাই তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসেন।

ল্যাবের দেখাশোনার দায়িত্বে যিনি আছেন তার নাম রবিন। এক ওয়ার্কশপের আগে আমার সুপারভাইজার জানালেন রবিনের সাথে ওয়ার্কশপের ব্যাপারে আগে মেইলে যোগাযোগ করতে হবে। আমি ভাবলাম রবিন মনে হয় পুরুষের নামই হবে। মেইলে মিঃ হিসেবেই সম্বোধন করলাম। গিয়ে দেখি রবিন মৈনাক পর্বতসম একজন মহিলা। আমার পরিচয় দিতেই চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, ও হ্যাঁ…মনে পড়েছে…তোমার মেইল আমি পেয়েছি। সে একদিন ঘন্টাখানেক ঘুরিয়ে দেখালো পুরো ল্যাবের সেফটি ইকুইপমেন্ট কোথায় কি আছে, ক্যামনে কি। অবশ্য আমার মনে হয় এই ল্যাবে কাজ করা হবে না। সিমুলেশনের কাজ শেষ হতে হতে সুপারভাইজারের ল্যাব নিউ ল্যাব বিল্ডিংয়ে চলে যাবে।



auto


ছবিঃ ল্যাব [International Test Centre for CO2 Capture, সংক্ষেপে ITC হিসেবে পরিচত]


মন্তব্য

পরিবর্তনশীল এর ছবি

বয়স বাড়ছে, সাথে কমছে পড়াশুনার ধৈর্য্য।

ভাইজান, পড়াশোনা কী জীবনে শেষ হবে না। আমি আগে ভাবতাম বিএসসি শেষ করলেই সব শেষ। বিয়া করব। চোখ টিপি

আপনার প্রত্যেকটা পর্বে দেখি এক একজনের কথা থাকে। আজকে যেমন রবিন ম্যাডাম।
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

বিপ্রতীপ এর ছবি

বালক,
রবিন তোমার আমার মতো তিন চার জনরে একসাথে তুলে আছাড় দিতে পারবে বলে আমার ধারনা চোখ টিপি

এনকিদু এর ছবি

সিডাকসিনের নাম মনোয়ার স্যার । কেমিস্ট্রি ।

-----------------------------------------
অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

সবজান্তা ( আপাতত ক্লান্ত, বিরক্ত) এর ছবি

মনোয়ার স্যার। আহা... উনি বড়ই বিনোদনের খোরাক ছিলেন !

বিপ্রতীপ এর ছবি

হুম...উনি আসলেই বিশাল বিনোদনের খোরাক ছিলেন...তবে তার সাডেন ক্লাসটেস্টগুলো খুবই বিরক্তিকর ছিল। প্রতিটাতে বাঁশ খাইছি মন খারাপ
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
http://biprodhar.com

শামীম এর ছবি

ঐ মিয়া... তুমি এই কথা বললে কেমনে হবে। আরও পজিটিভ হও ... অন্যের শোডাউন নিয়ে চিন্তার দরকার নাই .... শেষপর্যন্ত ভালো কাজগুলোই টিকে থাকে।
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

বিপ্রতীপ এর ছবি

আপনার সাথে কথা কইলে কিছুটা সাহস পাই...মাঝে মধ্যে ভাবি আপনারে কল দেই। আবার ভাবি কখন ভাবি ধরেন...ভাবীর কন্ঠ শুনলে আমার ক্যান জানি একটু ভয় ভয় লাগে হাসি
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
http://biprodhar.com

শামীম এর ছবি

ভাবীর (আমার বউএর) কন্ঠ শুনে দুইজনেরই একই রকম অনুভুতি হয় কেন? চিন্তিত
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

বিপ্রতীপ এর ছবি

অতীব চিন্তার বিষয় ... হাসি
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
http://biprodhar.com

রেনেট এর ছবি

বয়স বাড়ছে, সাথে কমছে পড়াশুনার ধৈর্য্য।

এরচেয়ে বড় সত্য মনে হয় গত ছয়মাসে আবিস্কার করি নাই। এখন মাঝে মাঝে ভাবি, ভাগ্যিস ব্যাচেলর্স অন্তত আছে, নাইলে এই অবস্থায় এখন আবার ব্যাচেলর করতে দিলে gpaমাইনাসের ঘরে থাকত।
মানুষজন পিএইচডি করে কেম্নে ইয়ে, মানে...
পড়াশোনা আর করুম না ওঁয়া ওঁয়া
-----------------------------------------------------
We cannot change the cards we are dealt, just how we play the hand.

---------------------------------------------------------------------------
একা একা লাগে

আলমগীর এর ছবি

সাহস দেয়ার জন্য কই: আমি দুই বছর মাস্টার্স করে, এখন গত চার বছর পিএইডি নামক কর্মে লিপ্ত। কাজেই ক্ষান্ত দিও না বৎস।

বিপ্রতীপ এর ছবি

গুরু,
আপনাকে সালাম ...
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
http://biprodhar.com

শামীম এর ছবি

একটা জিনিষই সবসময় ভাবতাম .... আমার সিনিয়ররা তাদের সেই বয়সে পারলে আমি পারবোনা কেন? তাঁদের সবাই কি এক্সট্রা অর্ডিনারি নাকি আমি বাতিল মাল!
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

প্রকৃতিপ্রেমিক [অতিথি] এর ছবি

মাস্টার্স করাকে আমি মনে করি হানিমুনের মতো। তারপরে যদি পিএইচডি শুরু কর তাহলে বুঝবা আসল মজা। কম্প্রিহেনসিভ পাশ করার পরেই দেখবা সুপারভাইজারের আসল রূপ--একেবারে তোমার ঘাড়ের উপর চড়বে। আর এই বয়সেই যদি বলো বয়স বাড়তেছে তাইলে আর কী দেখছ... যায় দিন ভালো আসে দিন খারাপ।

সাহস রাখ বুকে, ওয়েদার এনজয় করো, মাইনাস ফিফটি নিশ্চয় ব্যাপক মজার! (আমি মাইনাস ৩৫ পর্যন্ত দেখছি) তবে তাপমাত্রা যেহেতু ইন্টারভাল স্কেলের বিষয় তাই মাইনাস ৩৫ আর ৫০ এর পার্থক্য ততটা হয়তো নয়.. গা খোলা থাকলে ফ্রস্টবাইট হবে-- এ-ই যা।

বিপ্রতীপ এর ছবি

এইটা যদি হানিমুন হয়, তাইলে লাইফে আর বিয়াই করুম না। হানিমুনের দরকার নাই... মন খারাপ
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
http://biprodhar.com

শামীম এর ছবি

কিছু পাইতে হলে তো কিছু ত্যাগ স্বীকার করতেই হবে। চোখ টিপি
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

আমিই ভালো... এইসবে নাই... লেখাপড়া নাই, পরীক্ষা নাই... আহা... কি আনন্দময় জীবন...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

বিপ্রতীপ এর ছবি

হিংসা হইতাছে নজু ভাই... মন খারাপ

jara এর ছবি

দাদাভাই সামনে আরো পথ তোমাকে ডাকছে

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।