অনেকদিন ধরে বই পড়ার সময় পাই না। দু’এক পাতা পড়ার পর আর পড়া হয়ে উঠে না। সম্প্রতি হুমায়ুন আহমেদের ‘মধ্যাহ্ন’ বইটি পড়লাম। লেখাটি শুরু করার আগে বলে নেয়া প্রয়োজন আমি সাহিত্যের নাড়ি নক্ষত্র খুব কমই বুঝি। এছাড়া এখানে নিয়মিত যারা লিখেন তাদের সবার লেখাই অত্যন্ত উচ্চমার্গীয়। তাই দয়া করে কেউ লেখাটিকে সাহিত্য সমালোচনা ভেবে ভুল করবেন না। লেখাটি একদমই একজন সাধারন পাঠক হিসেবে আমার নিজস্ব মতামত।
কদিন আগের ঘটনা...নীলক্ষেতে বই কিনতে গেছি। কারন অনেকদিন ধরে বই কেনা হয় না, আগে প্রতি মাসে দু’একটা বই কেনা হতো। ফুটপাতে সারি সারি বইয়ের মাঝে ক্যাটকেটে হলুদ বর্ণের ‘মধ্যাহ্ন’ চোখে পড়লো। দাম জিজ্ঞেস করতেই দোকানি উত্তর দিলো, তিনশ ...টুয়েন্টি পারসেন্ট কমিশন দিয়া দুইশ ষাইট ট্যাকা। ভাবলাম কিনলে পুরো টাকাটাই জলে যাবে। হুমায়ুন আহমেদের বই আশেপাশের কারো কাছ থেকে ধার করে পড়তে হয়, কিনে পড়ার কোন দরকার নেই।
কদিন পরের ঘটনা...আমার আতেঁল বন্ধু তপু সেই ‘মধ্যাহ্ন’র প্রশংসায় পঞ্চমুখ (পঞ্চমুখ বললেও বোধ করি ভূল বলা হবে) করছিল। স্বভাবতই আমি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলাম। হুমায়ুন আহমেদের সাম্প্রতিক প্রকাশিত কিছু বই পড়ে আমি কিছুটা বিরক্ত। শুধু বই কেন...তার চলচ্চিত্র, নাটক সবখানেই একই ধরনের কিছু তৃতীয় শ্রেণীর রসিকতায় ভরপুর। একঘেঁয়ে গন্ডির ভেতর থেকে যেন বের হতে পারছেন না। তবু তপুর অনুরোধে শেষ পর্যন্ত ধার করে এক মধ্যাহ্নে বইটি পড়া শুরু করলাম।
কাহিনী শুরু ১৯০৫ সাল থেকে। পঞ্চাশ বছর বয়স্ক হরিচরণের পুকুর ঘাটে বসে আছেন... এমন একটি দৃশ্য দিয়ে উপন্যাসের শুরু। আর মৃত্যুরোগ থেকে মুক্তি পেতে নগ্ন শশাংক পাল একটি গাছকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। এমন একটি দৃশ্য দিয়ে প্রথম খন্ডের সমাপ্তি। উপন্যাস জুড়ে হুমায়ুন আহমেদের নিজস্ব এবং গতানুগতিক কিছু বিষয়ের ছাপ আছে। যেমনঃ কোন কোন চরিত্র মৃত মানুষ দেখতে পায়।
উপন্যাসে সাধারন চরিত্রের পাশাপাশি কিছু বিখ্যাত মানুষের কথাও স্বপ্ল পরিসরে উঠে এসেছে, যার একজন উকিল মুনসি। যিনি সাম্প্রতিক কালে জনপ্রিয় হওয়া ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়’ গানের স্রষ্টা। উপন্যাসের প্রতিটি অধ্যায়ের শেষেও সেই সময়ের ইতিহাসটুকু উঠে এসেছে, যা উপন্যাসের কাহিনীর সাথে একেবারেই বিচ্ছিন্ন মনে হয়নি। বরং মিশে একাকার হয়ে গেছে। আসলে সবকিছুকে ছাপিয়ে এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র সময়। তাই কোন কোন পাঠক আপাত দৃষ্টিতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘প্রথম আলো’ কিংবা ‘সেই সময়’ এর ছাপ পেলেও পেতে পারেন।
একজন লেখক বা সাহিত্যিকের দায়িত্ব একজন সাধারন মানুষের চেয়ে অনেক বেশি। এই অনেকগুলো দায়িত্বের মাঝে একটি হলো ধর্মান্ধতা এবং মৌলবাদের বিরুদ্ধে কথা বলা। একটি প্রবন্ধে লেখক সরাসরি সেই কথা বলতে পারেন, কিন্তু উপন্যাসে পারেন না। উপন্যাসের সেই কথা বলে চরিত্রগুলো। হুমায়ুন আহমেদ সেই গুরুদায়িত্বটি এই উপন্যাসে বেশ ভালোভাবেই পালন করেছেন, যা খুব সম্ভবত আগের কোন উপন্যাসে সেইভাবে করেননি। সমগ্র উপন্যাস জুড়ে এই বিষয়টিই বেশি ভালো লেগেছে । দু’টি লাইন না বলে পারছি না ... ‘ভারতীয় এক বিজ্ঞানী সমুদ্রের পানির রঙ নীল দেখায় কেন তা বের করে ফেলেছেন, এটা কোন বিষয় নয়! ঈশ্বর ঠিক করে রেখেছেন সমুদ্রের পানির রঙ নীল দেখাবে,এটা কি যথেষ্ট নয়’।
বইয়ের শেষ কিছু লাইন ...
‘মানবজাতি অপেক্ষা পছন্দ করে না। তারপরেও তাকে সবসময় অপেক্ষা করতে হয়। ভালোবাসার জন্য অপেক্ষা, ঘৃণার জন্য অপেক্ষা, মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা, আবার মুক্তির জন্য অপেক্ষা।
শশাংক পাল যেমন গাছ ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন, ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে ফাঁসির দড়ির দিকে তাকিয়ে বিপ্লবীরাও অপেক্ষা করেন। অপেক্ষাই মানবজাতির নিয়তি’।
হুমায়ুন আহমেদের প্রধান পেশা লেখালেখি। কদিন আগে এক অনুষ্ঠানে কথাশিল্পী নাসরিন জাহান বলছিলেন, ‘একজন প্রকাশক হুমায়ুন আহমদের একটি বই বের করলে রাহাত খানের দশটি বই বের করতে পারেন’। আসলে তিনি এমন এক জায়গায় পৌছে গেছেন, যে লেখালেখি করেই তাকে বাঁচতে হবে না। তিনি ইচ্ছে করলেই ‘আজ হিমুর বিয়ে’ এর মতো কিছু গতানুগতিক উপন্যাসের পাশাপাশি একটি ‘মধ্যাহ্ন’ লিখতে পারেন, যার জন্য বইমেলায় ঘটা করে হিমুর বিয়ে দিতে হবে না। আমরা আশা করি, হুমায়ুন আহমদ গোলক ধাঁধা থেকে বের হয়ে আবার ফিরে আসবেন তার নন্দিত নরকে। কারন আমরা একটি সস্তা প্রেমের উপন্যাসের পাশাপাশি একটি ভালো উপন্যাস পড়ার অপেক্ষায় থাকি সবসময়...
মন্তব্য
ধন্যবাদ রিভিউর জন্যে। বইটি পড়ার আগ্রহ সৃষ্টি হলো। সাম্প্রতিক সময়ে হুমায়ুন আহমেদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে লোকের বেশী আগ্রহ দেখতে পেয়েছি (যেটা আমার কাছে কিছুটা বিরক্তিকর লেগেছে)। হয়ত মানুষ যাদের পছন্দ করে নিজেদের মতন করেই তাকে পেতে চায় বলে এমন হয়।
××××××××××××××××××××××××××××××××××××××
পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?
পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?
রেজওয়ান ভাই,
সহমত...ব্যাক্তিগত হুমায়ুন আহমদ কে নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি অনুচিত...
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
ব্যাক্তিগত ব্লগ | আমার ছবিঘর
রিভিউটা ভাল লাগল। পড়ার আগ্রহও সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু বিদেশী টাকা দিয়ে হুমায়ূনের বই পড়ব বলে মনে হয়না। হাত বদলে কাছে এলে পড়ে দেখতাম।
আপনার লেখা ভাল হয়েছে। ধন্যবাদ। আরো লিখবেন আশা করি।
প্রকৃতিপ্রেমিক ভাই,
হাতে এলে পড়ে দেখতে পারেন।আশা করি মন্দ লাগবে না।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
ব্যাক্তিগত ব্লগ | আমার ছবিঘর
নতুন মন্তব্য করুন