“শইদুল ভাই, ও শইদুল ভাই।“
ইসমাইলের ঠেলায় ঘুম ভাঙ্গে শহীদুলের। ভোর হয়ে গেছে এত জলদি? ধুর। পিঠের ব্যথাটা আরো পোক্ত হয়েছে মনে হচ্ছে, কাজ করতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু উঠতে হবে, খদ্দের চলে আসবে কিছু ক্ষনের মধ্যেই। মালিক উঠে তাড়া দিবে আরেকটু পর।
উঠে পিছনে গিয়ে সকালবেলার কাম সেরে দাঁতন দিয়ে দাঁত খিলাতে শুরু করে শহীদুল, ততক্ষনে ইসমাইল হাঁড়িকুড়ি নামিয়ে ফেলেছে। ওইগুলো সাফা করায় হাত লাগায় শহীদুল।
কোলকাতা আক্রান্ত। ফোর্ট উইলিয়াম দূর্গ ঘিরে মুহুর্মুহু কামান দাগছে নবাবফৌজ, চলছে তুমুল লড়াই। উমিচাঁদের বিশাল বাগানবাড়িতে বসে ছক কষছেন তরুণ নবাব সিরাজউদ্দৌলা। এইরকমটাই আমরা দেখেছিলাম গত পর্বে। আজ দেখব কোলকাতার পতন এবং অন্ধকূপ হত্যার বিবরণ।
ঢাকা শহরে হোটেলগুলি একটি অলিখিত রুটিন মাফিক চলে। ভোরবেলা পাঁচটার দিকে সবাই হঠাত ঝাঁপ খুলে রুটি বেলতে বসে যায়। হালকা সবজি রান্না চলে পিছনে, সামনে বিশাল ব্যাসের ফ্ল্যাট কড়াইতে পাশাপাশি ভাজা হয় পরোটা আর ডিম। বেশুমার পরোটা ভাজি ডিম সবজি আগের রাতের মাংসের তরকারি উড়ে যায় মিনিটে মিনিটে। দশটা বাজে। এইবার সকলে শুরু করে গণ সিঙ্গাড়া ভাজা। আচমকা দোকানের সামনে ঝুড়ি উপচে সঙ্গাড়া সমুচা হাজির হয়। রামপুরার আবুল হোটেল অথবা নীলক্ষেতের চিপা দোকান, সায়েদাবাদ অথবা মীরপুর যেখানেই থাকুন দুপুর এগারোটায় হোটেলে গেলেই দেখবেন ঝুড়িভর্তি সিঙ্গাড়া ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে আপনার দিকে। এই সিঙ্গাড়ারা সকাল দশটার আগে অনুপস্থিত। এদের জন্ম দশটায় মৃত্যু একটায়। স্বল্পস্থায়ী একটি অর্থপূর্ণ জীবন।
সুবা বাংলার সর্বশেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ ছিলেন একটি মহামূর্খ। দূরদর্শিতা ও বুদ্ধির অভাব এবং শরাবে ডাইলুটেড ঘিলু নিয়ে তিনি বেশিদূর এগোতে পারেননি। কিন্তু তার টার্গেট ছিল সঠিক, বেনিয়া ইংরেজ যে হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছিল তা তিনি নানা আলিবর্দির মতই ধরতে পেরেছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় সিরাজ আলিবর্দি ছিলেন না। ইংরেজকে টাইট দিতে গিয়ে নিজেরই হালুয়া টাইট হয়ে যায় তার। সেই পুরান পোকার খেলার নীতি, ইউ হ্যাভ টু নো ওয়েন টু হোল্ড ইয়োর কার্ড অ্যান্ড ওয়েন টু ফোল্ড। সিরাজ কখন কার্ড ফোল্ড করতে হয় জানতেন না, তিনি বেট মেরেই চলেছিলেন। নভিস খেলোয়াড়।
আজকের পর্ব দীর্ঘ পর্ব, পাঠক চা নিয়ে বসুন। গত পর্বে আমরা দেখেছি কাশিমবাজার কুঠি ঘেরাও হবার পথে। আজ দেখব নবাবের কাশিমবাজার দখল ও কোলকাতা দখলের উদ্দেশ্যে ফোর্ট উইলিয়াম আক্রমণ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু বিষয়ে আসুন আলোচনা সেরে নেই মূল অনুবাদ পড়ার আগে।
“সিরাজ উদ্দৌলা, সিংহাসনে অধিরুঢ় হইয়া, মাতা মহের পুরাণ কর্ম্মকারক ও সেনাপতিদিগকে পদচ্যুত করিলেন। কুপ্রবৃত্তির উত্তেজক কতিপয় অল্পবয়স্ক দুষ্ক্রিয়াসক্ত ব্যক্তি তাঁহার প্রিয়পাত্র ও বিশ্বাসভাজন হইয়া উঠিল। তাহারা প্রতিদিন তাঁহাকে কেবল অন্যায্য ও নিষ্ঠুর ব্যাপারের অনুষ্ঠানে পরামর্শ দিতে লাগিল। সেই সকল পরামর্শের এই ফল দর্শিয়াছিল, যে তৎকালে প্রায় কোন ব্যক্তির সম্পত্তি বা কোন স্ত্রীলোকের সতীত্ব রক্ষা পায় নাই।”
শ্রীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বাঙ্গালার ইতিহাস।
….....................
নবাব আলিবর্দি মারা যাবার পর তাকে গোর দেবার আগেই সিরাজউদ্দৌলা তখতে লাফ দিয়ে বসেন। বসেই তিনি প্রথম কলকাঠি নাড়া আরম্ভ করেন খালা ঘষেটি বেগমের ঘষটামি বন্ধ করার উদ্দেশ্যে। ঘষেটি তার অঢেল পয়সাকড়ি নিয়ে মতিঝিল প্রাসাদে থাকতেন। প্রাসাদের চতুর্দিকে পানি, শক্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। ভিতরে ঘষেটি বেগম তার লাভার নাজির আলি আর কয়টা সিপাই। কিন্তু ফাইট হলনা, আলিবর্দির বিধবা স্ত্রীর অনুরোধে ঘষেটি আত্মসমর্পণ করেন। নাজির আলিকে কানে ধরে দরবার থেকে বের করে দেয়া হয়, ঘষেটিকে চালান করা হয় হেরেমে আর তার পয়সাকড়ি চালান করা হয় কোষাগারে। এ সবই হয় আলিবর্দি দেহরক্ষার দশ দিনের মধ্যে। নবাব কিছুটা চিন্তামুক্ত এখন। তবে পুর্ণিয়ার নবাব, শওকত জং আর ইংরেজের সাথে বোঝাপড়া বাকি।
মারাঠা যন্ত্রণা কিছুটা কমে আসার পর আলিবর্দি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নানান ফ্যামেলি ঝামেলি নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তার অতি আদরের ধন সিরাজ গদি পাবার জন্য লাফঝাঁপ আরম্ভ করে দেয়, ১৭৫০ সালে সে বিদ্রোহও করে বসে। তরুণ গর্দভটিকে আলিবর্দি ক্ষমা করে দেন, বৃদ্ধ নবাবের এই নাতিটির প্রতি অসীম ভালবাসা ছিল। সেই ভালবাসার সুযোগ নিয়ে সিরাজ ইচ্ছেমত পাইকারি বজ্জাতি চালিয়ে যেতে থাকে। স্থানীয় ঐতিহাসিক গুলাম হুসেন খানের মতে,
“ভালমন্দের বাছবিচার না করে, আদব লেহাজের ধার না ধেরে তিনি যখন যা খুশী তাই করতেন। ছোট বড় মেয়ে মদ্দ কারুরই ছাড় ছিলনা তার সামনে। অতি অল্প সময়ে মিশরের ফারাও এর মতই তিনি ঘৃণ্য হয়ে উঠলেন, আর তাকে দেখা মাত্র লোকে মনে মনে ভাবত ও আল্লা বাঁচাও ডরাইসি!”
প্রথম পর্ব । দ্বিতীয় পর্ব । তৃতীয় পর্ব
মারাঠারা তাদের রীতি অনুযায়ী যুদ্ধে আগে বাড়ার আগে শত্রুপক্ষের সাপ্লাই লাইন কেটে দিতে মত্ত হল। আলিবর্দি তাদের ফাইট দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তার সাথের আফগানেরা বেঁকে বসে। তাঁবুর পেছন দিক দিয়ে দ্রুত এগিয়ে আসে মারাঠা ঘোড়ার দল, অগুণতি সিপাই ঘিরে ধরে ক্যাম্প। আলিবর্দি পড়লেন বাটে। তিনি দূত পাঠিয়ে বললেন আচ্ছা যাও যাও চৌথ বাবদ দশ লাখ রূপী চাইছিলে তা দিয়ে দিচ্ছি। মারাঠা জেনারেল তখন ফট করে দাম বাড়িয়ে দশ লাখ নয় এক কোটি রূপী চৌথ হেঁকে বসলেন।
সুজা খানের মৃত্যুর পরে পুত্র সরফরাজ খান বাংলা ও উড়িষ্যার মহান অধিপতি হিসেবে অটো প্রমোশন পান। তিনি পিতার মতই যুবতী ও বোতলের গোলাম ছিলেন, তবে বাপের তুলনায় অনেক মাথা গরম। তিন মন্ত্রি হাজি আহমেদ, আলম চান আর জগতশেঠকে তিনি ডিসমিস করে দিলেন না, চাকরি বহাল রইল। কিন্তু তাদের অবিশ্বাস্য অপমান করা হতে থাকল দিনের পর দিন।হাজিকে প্রকাশ্য দরবারে গালাগালি করা হতে থাকল।
চাটগাঁও জিলা কয়েকশো বছর ধরে বাংলার মুসলিম শাসক আর আরাকানের মঙ্গোল শাসকদের টানাটানির বস্তু ছিল। পঞ্চদশ শতাব্দীতে এক পলাতক আরাকানরাজ বাংলায় আশ্রয় পান, পরে ১৪৩০ সালে গৌড়ের মিলিটারির সাহায্যে তিনি গদি ফিরে পান। কৃতজ্ঞতাস্বরুপ তিনি হুকুম জারি করেন তার বংশের লোক বার্মিজ পালি নামের সাথে আলি খান, সিকান্দার শা বা সেলিম শা এইরকম মুসলিম টাইটেল যুক্ত করবেন। ঐ নামে কয়েনও ইস্যু করা হয়। কিন্তু পরের প্রজন্মের আরাকানেরা বাংলার সাথে ভাই বেরাদরি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয় আর ১৪৫৯ সালে পুরো চাটগাঁও জিলা বাংলার সুলতান বুরবক শা এর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়।
থার্ড ইয়ারে পড়ার সময় বান্দরবান গিয়েছিলাম। ট্রেকিং। রুমা বাজার থেকে কেওকারাডং তাজিনডং হয়ে থানচি। এরপরে থানচি থেকে চান্দের গাড়িতে বান্দরবান শহর। রুমা বাজারে আর্মি কমান্ডার ছিলেন সেকেন্ড লেফটেনান্ট ইফতিখার। আমাদের এক ব্যাচ সিনিয়ার, ফৌজদারহাট ক্যাডেটের। চিনতামনা কিন্তু গিয়ে কথা বলার পরে মেলা পরিচিত লোক পাওয়া গেল। তার সাথে ঝিরি দেখতে গেলাম, সে এক কান্ড। ওখানে আর্মি সোলজারের নিরস্ত্র ঘুরাফিরা নিষেধ, তাই তিনি আর এক সৈন্য নৌকায় উঠলেন একে ফর্টি সেভেন বা ওইরকম কিছু সহ। নৌকায় উঠেই কমান্ডার ঠ্যাং ছড়িয়ে ঘুম, পাশে আমি যেমন বই নিয়ে ঘুমাই সেইরকম তার পাশে অটোমেটিক অস্ত্র।