একাকী পাপাড়ু গিয়ে হাসানাবাদ পৌঁছালেন, যে গ্রাম তার নিজেরই পত্তন করা। সেখানে এক তাড়ির দোকানে জুত করে বসে তিনি বললেন, “এই আমায় ভালো তাড়ি দে”। পলাতক পাপাড়ুর ছদ্মবেশ ছাপিয়ে সেই গম্ভীর কন্ঠ তাড়িওলার কানে ঠং করে গিয়ে বাজল। চোখ তুলে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করল সে খদ্দেরের মুখ। হ্যাঁ, এই লোক অবশ্যই পাপাড়ু!
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি স্মার্টফোন লাল রঙে ভয় দেখাচ্ছে, “ফগ অ্যালার্ট”, “চান্স অফ রেইন/ড্রিজল”, “স্টে অ্যালার্ট অন দ্যা রোড” আরো কি কি হাবিজাবি। বারান্দায় গিয়ে দেখি চমৎকার সকাল, অল্প কুয়াশা। রেলিং ভেজা। অন্ধকার পুরো কাটেনি। একেবারে আমার মতই শহর মাত্র ঘুম থেকে উঠেছে, দেখতে ভালোই লাগে। কোন রামছাগলে অ্যাপ বানিয়েছে আল্লায় জানে। কোথায় সে একটা স্লো মিউজিক ছেড়ে কইবে “ওগো শুনছ, বাইরে গিয়ে দেখো সে কী সুন্দর কুয়াশা আর হাল্কা হিম...জ্যাকেটটা পরে বাইরে পিচ্চিকে নিয়ে হেঁটে এসো।” তা নয়, অ্যালার্ট অ্যালার্ট। ফগ অ্যালার্ট। রেইন ওয়ার্নিং। রেড অ্যালার্ট। দ্য জার্মান ইজ কামিং। অ্যালার্ট।
যন্ত্রণা।
বারো বছর বয়েসী রাজা জগৎ সিং আমার দিকে তাকিয়ে বড়দের মত গম্ভীর গলায় বললেন, নাম কবুতর ফারুক ঠিক আছে। কোন অসুবিধা নাই। তবে নামটা তোর তেলাপোকা ফারুক হলে আজই তোর গর্দান নিতাম।
বুড়া শকুন মারা গেছে।
এই বুড়া গোলাম আজম পাকিস্তান আদর্শ রক্ষা তহবিলে চাঁদা উঠিয়েছিল। এই যে কি চমৎকার রশিদ দেখা গেলঃ
চাঁদার টাকা দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদ্যয় ঠেকানোর মতলব ছিল চান্দুর। আহারে বুড়া কদু, সেই বাংলাদেশের যে শুধু অভ্যুদয় হবে তাই না... মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নামে হাসপাতালে যে তোকে পটল তুলতে হবে এইটা কি আর জানতি রে ময়না? জীবন চোষে বটে।
এক দেশে থাকত এক রাজপুত্র আর এক কোটালপুত্র। দুইজনে ছিল বিরাট দোস্ত। তারা একত্রে থাকত, খেত, ঘুরত ফিরত। একদিন কোটালপুত্র এসে রাজপুত্রকে বলল, হে পিয়ারা ভাই আমার। এক কাজ করি চল। আমাদের নিজ নিজ শ্বশুরবাড়ি একটা ঘুরান দিয়ে আসা যাক। প্রথমে আমার শ্বশুর বাড়ি চল, আমি আমার শ্বশুরের সাথে তোমার পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি। পরে তুমিও না হয় তাই করলে তোমার শ্বশুরবাড়িতে।
রাজপুত্র ভারি খুশি হয়ে বলল, উত্তম প্রস্তাব! কেন নয়?
ভারত সাগর, ১৬০৭। মাঝারি আকারের চৈনিক জাহাজ হায় ছাঙ এর ডেক। ভোর।
জাহাজের সর্বময় কর্ত্রী পী না’র কপালে গভীর ভাঁজ। গুমোট জাহাজের পরিবেশ গতকাল থেকে। গতকালের ঝড়ে বেঁচে বের হওয়া যাবে এইটা অনেকেই বিশ্বাস করেনি, এরকম পাহাড়ের সমান উঁচা ঢেউ দেখে কলজের জোর ধরে রাখা শক্ত। সেইটা থেকে বাঁচা গেছে সত্য, কিন্তু আরেক কঠিন সমস্যা তৈরি হয়েছে। খাবার নেই।
বোম্বাই, ১৬০৭। ইংরেজ সওদাগর র্যালফ অ্যান্ডারসনের বাসভবন।
অ্যান্ডারসনের হিন্দুস্তানি বাবুর্চি আদম বেগ আজ দম-পোখত বলে এক ডিশ রেঁধেছে। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অফিসার ক্যাপ্টেন ব্রুকস সেই সকালে মর্নিং ওয়াকে যাবার সময় খেয়াল করেছিলেন পাকশালায় আদম বেগ তার দুই সহকারীকে নিয়ে মহা ব্যস্ত হয়ে কীসব কাটাকাটি করছে। এইসব নেটিভগুলো ঘুমায় দশঘন্টা আর রান্না করতে তাদের আরো দশঘন্টা। তারপরে বাকি চারঘন্টা খায় আর পান চাবায়। অলস জাত আর কাকে বলে!
মধ্য দুপুরের ভয়ংকর রোদ। ঘোড়াটা থেমে থেমে চিঁহি আওয়াজ করছে। তেষ্টা পেয়েছে মনে হয়।
মুকুন্দরাম হাতের তালুর উলটা পিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছে নিলেন। মুখটা তেতো হয়ে আছে, সকাল থেকে কিছু পেটে পড়েনি। সেই গত সন্ধ্যায় একটা পাখি ঝলসে খেয়েছিলেন চান্দার ঝিলের ধারে, এরপরে একটানা পথচলা। এলাকা সুবিধার না, আরো কিছুদূর যেতে হবে তবেই নিরাপদ জায়গা শুরু। থামা চলবে না, সে যতই তেষ্টা পাক।
তবে প্রস্রাবের বেগ ধরেছে, কোথাও থেমে নেয়া জরুরী। খামোকা চুড়িদার ভিজানোর মানে হয়না।
ভেনিশিয়ান পর্যটক নিকোলাই মানুচ্চি আমাদের ইন্টারেস্টিং একটা গল্প বলে গেছেন। ১৬৬০ সালের কথা, আওরঙ্গজেব তখন সদ্য গদিতে। পিতা শাজাহান জেলের পুলাউ খাচ্ছেন শুকনা মুখে। পূর্বপুরুষ আকবর বাদশা একটা অলিখিত নিয়ম করে গিয়েছিলেন যে পারস্য থেকে বিপদে পড়ে কেউ দিল্লীতে আসলে তাকে তাড়িয়ে দেয়া চলবে না, আদর করে মনসবদার টাইটেল দেওয়া হবে আর কাশ্মীরে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। তার পিতা হুমায়ূন ভারত থেকে শের শা এর লাথি খেয়ে পারস্যে পালিয়ে কিছু আদর সোহাগ পেয়েছিলেন বলে সম্ভবত পুত্র আকবরের এই পাল্টি ব্যবস্থা।
আওরঙ্গজেব গদিতে আসতে আসতে কাশ্মীরে এইসব মনসবদারের বাজার বসে গিয়েছে। চতুর্দিকে রেফ্যুজি মনসবদার। নিজেদের কেউ অক্কা পেলে বাকী সকলে নাকি তার পয়সা মেরে খেত। সরকারকা মাল টাইপ ব্যাপার। এই সব দেখে আওরঙ্গজেব হাত তুলে কইলেন, ওকে অডিট টাইম। কাশ্মীরে কে কে আছ মনসবদার আমার দরবারে এসে চেহারা দেখাও, নইলে মনসবদারী খুদাপেজ।
তাগড়া মধ্যবয়েসি নেতাগোছের লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় জিজ্ঞাসা করল, তর নাম কবুতর ফারুক?
কানে বিরাশী সিক্কার থাপ্পড় দিয়ে ঘুম থেকে উঠিয়েছে এইমাত্র, কান এখনো ভোঁ ভোঁ করছে। আমি কষ্টে মাথা হেলিয়ে বললাম, জ্বী।
চিন্তিত মুখে পাশে দাঁড়ানো দুইজনের দিকে তাকিয়ে সে বলল, বন্দুকচির নাম কবুতর হয় জিন্দেগীতে শুনছস?