অকস্মাৎ দেয়াল থেকে খসে পড়লো ছবি
ফ্রেম ভেঙে চারদিকে ছিটকে গেলো
টুকরো টুকরো কাঁচ এলোমেলো গন্তব্যে।
বর্শার ফলার মতো ইতস্তত:
আটকে থাকা কাঁচের বাঁধা পেরিয়ে,
সন্তর্পণে কিছু শো’পিসের চোখ এড়িয়ে
নামলো তিন যন্ত্রী―
একজন চিত্রকর আর দুজন কবি।
অবশ্য কিছুক্ষণ তাঁরা বিস্ময়ে নিঃশব্দ
জেল-মুক্ত কয়েদির মতো বুক ভরে
মুক্ত বাতাসের ঘ্রাণ শুষে নিলো
অনেক দিনের পরে!
নিপুণ বাদন ছেড়ে সোফায় এলিয়ে দেহ
ঘর্মাক্ত দিনের শেষে গোলাপি বরণ বিকেল।
কোথাও বাতাস নেই, সূর্য ছিটোচ্ছে বিস্তর
ঝাঁঝালো রোদের থুতু―
ভেবেছি সেদিন, বড় বেশি দুখী আমি―
তুমি বলেছিলে, “এই শেষবার দেখা!”
তোমার দু’চোখে ছিল যতটুকু নীল
ছড়িয়ে দিয়েছি সুকেশী আঁধারে একা।
তোমার জন্যে আকুলতা একবুক
চোখের কিনারে বিধবা ব্যথার ছোপ
যতনে ভেবেছি এই বুঝি সব পাওয়া
মুক্তোর মতো বড় জ্বালাময়ী সুখ।
তোমার মুখোশে স্নিগ্ধতা সন্ধান―
করোটির রোদে ঘুঘু ডাকা নীরবতা
ধূসর মলিন মৃত তারাদের গান―
শব্দের স্নানে ভেসে যাওয়া খেরো খাতা।
উৎসর্গ :
“এমন এক কবি যিনি সর্বোতভাবে কবি হ’তে চেয়েছিলেন। প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে কবি। দৈনন্দিন জীবনের অর্থহীনতম মুহূর্তেও। ভ্রমণে ও মননে, বাক্যে, ব্যবহারে, পত্ররচনায়। যখন কবিতা লিখছেন না বা লিখতে পারছেন না তখনও। যখন তিনি অসুস্থ, বা হতাশ, বা মনঃক্ষুণ্ণ, তখনও।”
এইখানে। শেষাবধি পেলাম ওটাকে। দৃষ্টি এড়ানোর ফন্দি আঁটতে আঁটতে হয়তো ওটার কেটে গেছে কয়েকটি দীর্ঘ সপ্তাহ। কত ছল-চাতুরী করতে হয়েছে, কতই না খেলতে হয়েছে লুকোচুরি। দুই ট্রাঙ্কের মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া ইস্পাতের দেয়াল ঘেরা সরু গলি, পলিথিন দিয়ে মুড়িয়ে রাখা অব্যবহৃত লেপ-তোষকের আঁধার ঘুঁজি, পরিত্যক্ত আসবাবের দাঁতে শিরশির তোলা অমসৃণ ফোঁকর, পাট পাট করে বিছানো দৈনিক পত্রিকার স্তূপ, ষ্টোর রুমে রাখা সুগন্ধি চালের বস্তা
অন্যান্য আরো অনেকেরই মতো জীবনানন্দকে ঠিকমত বুঝে উঠবার আগেই ‘বনলতা সেন’-এর সাথে আমার পরিচয়। সেই পরিচয়ে তারুণ্যের মুগ্ধতাই ছিল বেশী। সে বয়সের মুগ্ধতার একটা আলাদা চরিত্র আছে। সেই চরিত্রগুণে সহজেই ‘বনলতা সেন’ ‘জীবনানন্দ’কে ছাপিয়ে যান। আমার প্রথম সেই পাঠ ছিল নিতান্তই অর্বাচীন পাঠকের পাঠ। তাই কবিতাটির প্রথম চরণেই খটকা লেগেছিল। ‘হাঁটিতেছি’, একি বিশ্রী গুরুচণ্ডালী। পাড়াগাঁর কবি, হয়তো
আমার বয়স হয়েছে। একটা বয়স ছিলো, সেই বয়সটার চরিত্রই হয়তো বন্য ষাঁড়ের মতো। ক্ষেপে ফুঁসে উঠার গুণে অমিত তেজোদৃপ্ত। সে বয়স আমারও ছিল, এখন নেই। রক্তে তেজ নেই, গতিতে জড়তা থিতু হবার অপেক্ষায়। এখন অসঙ্গতি দেখলে প্রতিবাদী হই না, ব্যথা পাই। যা কিছু অশোভন মনে হয় নিজের কাছে, তা আর আমাকে ক্ষুব্ধ করে না, আহত কিম্বা বেদনার্ত করে।
মায়ের স্নেহার্দ্র হাত যেমন করে কোলের সন্তানকে জড়িয়ে থাকে ঠিক তেমনি করে সবুজ পাহাড়ের পাচিল ঘেরা বিপুলা কর্ণফুলী বড়হরিণার তিনদিক জড়িয়ে। চৈত্রের নিদাঘ সময়ে চাষির দল সেই পাহাড়ের বুকে আগুন লাগিয়ে জুমচাষের জন্য উপযোগী করে তোলে। মাঝে মাঝে দাবানল হয়ে আগুন ছড়িয়ে পড়ে দিগ্বিদিক। পুড়ে যায় কতকিছু! এই বড়হরিণাতেই কেটেছে আমার একাকীত্বের কিছু দিন। তবুও সেগুলি ছিল রঙের। গোলাপি না হলেও ধুসর তো!
সাফাই :
নতুন বাসায় উঠেছি। ট্রাঙ্ক থেকে বইপত্র গুছিয়ে গুছিয়ে আলমারিতে তুলছি। হঠাৎ দেখি ট্রাঙ্কের একপাশে দীর্ঘদিনের অবহেলায় পড়ে আছে আমার তরুণ বয়সের একটি ডায়েরি। একটু মমতা হয়। আজ দিনের শেষে, সকল কাজের শেষে, ওর সাথে কথা হয়। দিনপঞ্জি নয় বরং এলোমেলো কিছু লেখা দিয়ে ঠাসা। তখন কতই বা আমার বয়স। বাইশ কিম্বা তেইশ। এই রচনাগুলো কতটুকু সম্পন্ন হয়েছে সে বিবেচনার চাইতে বোধকরি সে বয়সের আবেগের প্রাবল্য আমাকে বেশী আলোড়িত করে। প্রকাশযোগ্য কিনা জানি না। তবে প্রকাশিত হলে পাঠক সহৃদয় হয়ে আমার সে বয়সটিকে বিবেচনায় নেবেন আশাকরি। কাপ্তাই লেকের দূরবর্তী প্রান্তে যেখানে কর্ণফুলির উদর সন্তানসম্ভাবা নারীর ফুলে উঠা তলপেটের মতো অসামান্য মমতায় ও আশ্রয়ের আশ্বাসে গোল হয়ে বিপুলা হয়েছে সেখানেই বড়হরিণা। তাহলে শুরু হোক 'বড়হরিণার দিনলিপি'।