আজ ২৬ ফেব্রুয়ারি। একটা দুঃস্বপ্ন তাড়া করে ফিরেছে একটা বছর। অনেক লেখা হয়েছে তাঁকে নিয়ে। অনেক টকশোর বকবকানি শুনেছি। শুনেছি পুলিশের আশাবাদ। ফল কিন্তু শূন্যই রয়ে গেছে। অভিজিৎদা হত্যার বিচার হবে কি হবে না, সে বিষয় নিয়ে লেখার উদ্দেশ্য নয়; সেটা বোধহয় সবাই অনুমান করতে পারছেন। আমি শুধু একবছর আগের সেই দিনের স্মৃতিচারণ করতে চাই।
শীতের সকালের জমাট কুয়াশা ভেদ করে রোদ ঝলমল করতে দশটা বেজে যায়। সুতরাং আমাদেরও বেরুতে হলো বেশ বেলা করেই। ইছামতীর আঁকাবাঁকা গতিপথকে অনুসরণ করে বয়ে গেছে প্রশস্ত মেঠোপথ। খালাতো ভাইকে সাথে নিয়ে চলেছি মাঠপানে, পাখির খোঁজে। মাঝপথে এক চাষি ভাই শামখোলের খবর দিলেন। শামুকভাঙার দলটি নাকি আস্তানা গেঁড়েছে ইছামতীর তীরে। আমাদের এলাকায় শামখোলকে মানুষ শামুকভাঙা বলে। ছোটবেলায় দূর আকাশে উড়ন্ত শামুকভাঙা দেখেছি বহুবার। গ্রামের বিলে নাকি শামুকভাঙা থাকে। অতদূরের রাস্তা ভেঙে দেখতে যাওয়া আর হয়ে ওঠেনি। তাই সামন-সামনি দেখার সুযোগ পাইনি। এতদিনে পেলাম।। এসময় ইছামতীর পানি হাঁটুর নিচে নেমে যায়। তাই ওদের পর্যপ্ত খাবার মিলবে।
পাট দেখেননি কিংবা পাটগাছ চেনেন না এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। পাটের ফল দেখেছেন, এমন মানুষের সংখ্যা শতকরা ১০ ভাগেরও কম। আর পাটের ফুল দেখেছেন কিনা, এ প্রশ্ন করলে সংখ্যা নির্ঘাত আরও কমবে।
এবার ভাগ্যক্রমে পাটের ফুল ও ফল পেয়ে গেলাম। বহুদিন এ দুটো জিনিস দেখা হয় না। আসলে মৌসুমে যে পাটের চাষ করা হয়, সেই পাট অনেক বড় হয়্। ৮-১০ ফুটের মতো। কিন্তু আঁশের মৌসুমে পাটের ফুল-ফল হয় না। কেন হয় না তা জানা নেই। তাহলে পাটের বীজ আসে কোথা থেকে?
ঝকঝকে রোদে হেসে উঠল নাটোরের জলজ মাঠ। সবুজের উজ্জ্বলতা বাড়ল। আকাশে নীল-সাদার এক অপুর্ব সম্মিলন। নাটোরের মেঠোপথে অন্য এক অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল তনুমনে। চারপাশে ইতিউতি করে পাখি খুঁজে চলেছি। কিন্তু আকাশে ঝাঁক ঝাঁক শামুকখোল ছাড়া অন্যপাখি তেমন চোখে পড়ল না। অবশ্য দোয়েল আর শালিকের অভাব নেই। আমাদের এলাকায় এই বর্ষাতেও হরেকরকম পাখির দেখা মেলে। এদিকে নেই, তার কারণ বোধহয় জলবদ্ধতা। ভূচর পাখিদের খাবারের অভাব। বলতে আপত্তি নেই আরও একটা জিনিস খুঁজে চলেছি-- পাখির নীড়ের মতো দুটি চোখ।
ফুলটা, গাছটা ছোট বেলায় হঠাৎ হঠাৎ দেখেছি পতিত ঘেসো জমিতে। তবে খুব বেশি দেখিনি। যেখানে সেখানে এখন আর দেখা মেলে না। খুব ভালো করে দেখার সুযোগ পেলাম ২০১৪ সালে । জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রজাপতি আর পাখির পেছনে ছুটতে ছুটতে পুকুর পাড়ে পেয়ে গেলাম তেজপাতার মতো দেখতে এই উদ্ভিদকে। পটাপট বেশকিছু ছবিও তুলে নিলাম।
তারপর আবার প্রজাপতি-ফড়িংয়ের পেছনে ছোটা। হঠাৎ দেখতে পেলাম ত্যাজপাতার মতো পাতাওয়ালা ওই ছোট ছোট গাছগুলোতে দারুণ সুন্দর একটা ফুল। এত সুন্দর ফুল বনে-জঙ্গলে বাসই দেখা যায়। সুতরাং আবারও ক্যামেরা তাক করতে হলো দাঁতরাঙ্গা নামের এই বুনোফুলের দিকে। দাঁতরাঙ্গা নামটা জানলাম বৃক্ষকথা গ্রুপে ফুলের একটা ছবি পোস্ট করে। পরে অবশ্য নওয়াজেশ আহমদ-এর ‘বাংলার বনফুল’ নামের বইটিতেও পেলাম ফুলটির বর্ণনা।
গ্রামেই আমাদের অনেক আত্মীয়-স্বজন। আমার এক চাচার বাড়ি বড় একটা শিমুল গাছ ছিল। এখন সেটা আছে কিনা ঠিক জানি না। বসন্তকালে শিমুল গাছে ফুল ফোটে। লাল লাল বড় পুরু ফুল। ফুলের কুড়ি ঠিক কুড়ির মতো নয়। বসন্তে পাখিরা শিমুল গাছে ভিড় করে। কেউ শিমুলের ফুলের মধু চুষতে আসে। কেউবা আসে পোকার লোভে। মধুপায়ী পোকাদের আনাগোনা কম নয় শিমুল গাছে। কিছু পাখি আসে স্রেফ ভালোবাসার টানে। তবে ভালোবাসাটা তাদের শিমুলের প্রতি নয়। সঙ্গিনীর টানে আসে ওইসব পাখিরা। চোখগেল, বসন্তবৌরি, বেনেবউ পাখিগুলো কিছুটা লাজুক প্রকৃতির। বছরের অন্যসময় লোকালয়ের ধারেকাছে এদের খুঁজে পাওয়া কঠিন। কিন্তু বসন্তকালে ওরা মরীয়া। তাছাড়া পুরুষপাখিগুলো সঙ্গিনীকে ডাকার সময় এলাকা ভাগ করে নেয়। পারতপক্ষে একজনের এলাকায় আরেকজন পা দেয়। যদিবা দেয় যুদ্ধের জন্য আটঘাট বেঁধেই দেয়। যেসব পাখি মাঠে সুবিধা করতে পারে না, তারা সঙ্গিনীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য বেছে নেয় লোকালয়। মানুষকে এড়িয়ে চলা পাখি। যে-সে গাছে বসলে মানুষের সান্নিধ্যে চলে আসার আশঙ্কা আছে। তাই বেছে নেয় শিমুলের মতো উঁচু গাছ। চোখগেল আর বসন্তবৌরি শিমুলের মগডালে বসে তারস্বরে চিৎকার করে। তবে ওদের কণ্ঠ মধুমাখা। আর বেনেবউ, যাকে আমরা হলদে পাখি বলি--ওদের গলায় অত জোর নেই। তাই সবসময় এক জায়গায় বসে ডাকে না। এ গাছে, সে গাছে ঘুরে ঘুরে ‘খোকা হও... খোকা হও’ স্বরে ডেকে বেড়ায়। আমার ওই চাচার বাড়ি প্রায়ই একটা বেনেবউ ডেকে বেড়াচ্ছে। শুধু সে বাড়িই নয়, আশপাশের সব বাড়িরই মেহমান সে।
এমনিতে ওদের ওই ডাকে কেউ পাত্তা দিত না। কিন্তু যে বাড়ি নতুন বউ আছে, সে বাড়িতে খুশির রোল পড়ে যেত। সবাই ধরেই নিত নতুন বউয়ের গর্ভে একটা পুত্র সন্তান আসছে। পরে নতুন বউয়ের মেয়ে সন্তান জন্মালে বেনেবউয়ের কথা কেউ মনে রাখত না। তবে ছেলে হলে বলত--‘ওই দেখো, এ বাড়িতে ‘খোকা হও’ পাখি ডেকেছিল, খোকা না হয়ে যাবে কোথায়। এ বিশ্বাস আদ্যকালের। যুগ যুগ ধরে বাংলার ঘরে ঘরে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সংক্রিমত হয়ে হয়েছে বিশ্বাসের ভিত। এই ডিজিটাল যুগে এসেও সে বিশ্বাস কিছুটা হয়তো নড়চড় হয়েছে, তবে একেবারে ধুয়েমুছে যায়নি।
আষাড়ে ঝমঝম বৃষ্টি নামে। মাঝে মাঝে মেঘের পর্দা সরিয়ে উঁকি মারার চেষ্টা করে সূয্যিমামা। কখনও চেষ্টা ব্যর্থ, কখনওবা সফল। টানা বৃষ্টিতে মজাই লাগত আমাদের। স্কুল কামাই করার জন্য বৃষ্টি বিশাল এক ছুতো। কিন্তু প্রকৃতিও বোধহয় মা-বাবার পক্ষে থাকত। ঠিক দশটা বাজার আগে থেমে যেত বৃষ্টি। ছাতা হাতে ধরিয়ে স্কুলে ঠেলে পাঠাতেন মা। বৃষ্টিকে গালিগালাজ করতে করতে পথে জমা পানিতে পা ডুবিয়ে স্কুলে যেতাম। স্কুলের খেলার মাঠে পা দেওয়ার সাথে সাথে বৃষ্টির প্রতি সেই ক্ষোভ অভিমান কোথায় ধুয়ে মুছে যেত! আমাদের মতো শিক্ষকেদেরও তো আলস্য আছে। তাছাড়া বেশিরভাগ শিক্ষকই ভিনগাঁয়ের। তাঁদের আসতে দেরি হত। হয়তো বা সেদিন আর আসতেনই না। আমরা তখন ফুটবল নিয়ে নেমে পড়তাম মাঠে। বৃষ্টিধোয়া মাঠে তখন চোরকাঁটার বান ডেকেছে। গোটা মাঠটাই ভরে উঠেছে গ্রামীণ এই ঘাসফুলের গালিচায়।
ঘাসফুল নিয়ে মানুষের মাতামাতি কম। তবে কিছু কিছু ফুল সত্যিই দেখার মতো। আর কিছু ঘাসফুল মানুষের দৃষ্টিই কাড়তে পারে না। তবে কিছু ঘাসফুল আবার একেবারেই আলাদা। চেহারা দিয়ে নয়, গুণ দিয়ে মানুষের দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয়। কেশড়ের ফুলের আলাদা সৌন্দর্য নেই। আবার একেবারে অবহেলিত সে নয়। সব মানুষ তাকে চেনে তার গুণের জন্য। অবশ্য সেই গুণ এখন আর তেমন কাজে লাগায় না। ছোটবেলায় রোদে ঘোরাঘুরি করতাম খুব। চুল লাল হয়ে যেত রোদে পুড়ে। সবাই বলে, চুলকটা হয়ে গেছে। শুধু আমার নয় বন্ধুদেরও একই অবস্থা।
কাঁচা ঝাল হিসেবে একটা জিনিসই ব্যবহার করতাম পটপটির ফল। যার ভালো নাম রুয়েলিয়া। রুয়েলিয়ার ফল নিয়ে ছিল বিরাট আগ্রহ। কাঁচা পাকা দুই রকম ফলেই আমাদের আগ্রহ। কাঁচা ফল দিয়ে বানাতাম কাঁচা মরিচ। তবে বলে রাখি, রুয়েলিয়র ফল কিন্তু মোটেও ঝাল নয়। তবু কল্পনার রঙে তাকে ঝাল বানাতে আপত্তি কোথায়!
রুয়েলিয়া বুনো গুল্ম, একেবারে দুষ্প্রাপ্য নয়। কিন্তু তবুও এর ফল সহজে পাওয়া যেত না। কারণ ওগুলো সাবাড় করার জন্য আমাদের মতো ছেলেমেয়ের অভাব ছিল না। ফল আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকলেও ফুল নয়। ফুল দেখতে সাদামাটা। অবশ্য সেটা কিশোর চোখে। আজ চোখ বদলেছে। তাই রূপ বদলেছে রুয়েলিয়ার ফুলেরও। রীতিমতো মুগ্ধ করার মতো এক ফুল।
বর্ষায় বান ডাকে প্রকৃতিতে। ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ শব্দের সাথে তাল মিলিয়ে অঝরে ঝরে বৃষ্টি। সবুজে সবুজে ছেয়ে যায় প্রকৃতি। ভাঁট-আশশ্যাওড়ার দাপট পথের দুধারে। আকন্দ তো সারা বছরই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে বেগুনি সাদা ফুলের গয়নায় সেজে। বনওকড়ার চারা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে সবুজের মিছিলে। কিন্তু কিছু উদ্ভিদ একেবারে নীরবে-নিভৃতে চুপটি করে মাথা তুলে দাঁড়ায় সবুজের কোন্ গহীন কোণে। অনাদর অবহেলায় কখন বেড়ে ওঠে তার হদিস রাখে না কেউ। কিন্তু প্রয়োজন হলেই খোঁজ পড়ে। ওষুধ বানাতে হবে না! এখন তো ওদের বড্ড কদর।