আমার এক গুরজন একদিন আচমকা একটা প্রশ্ন করলেন। তিনি প্রায়ই আচমকা প্রশ্ন করে আমাকে ভড়কে দেন। ভড়কে যাই, কারণ তার প্রশ্নগুলো একটু ভিন্ন ধাঁচের। তাই আপত দৃষ্টিতে প্রশ্ন সহজ মনে হলেও উত্তরটা তত সহজে দিলে চলে না। প্রশ্নের নিরীহ-দর্শনের আড়ালে গভীর কোনো তাৎপর্য লুকিয়ে থাকে, তেমনি উত্তরের ভেতরেও ওই তাৎপর্যের প্রতিফলন চান।
যাক, যে কথা বলছিলাম। তাঁর এদিনের প্রশ্নটা ছিল, ‘বলো তো দুনিয়ার সবচেয়ে হিংস্র প্রাণী কোনটা?’
এই প্রশ্নটা আমাকে বিব্রত করতে পারে নি। ভাবতে হয় নি এক মুহূর্তও। কারণ, তিনি যে উত্তর আশা করেন, তা আমিও বহুকাল থেকে নিজের ভেতরে পুষে রেখেছি। কী জানি, কবে আমার মনে প্রথম উদয় হয়েছিল মানুষই দুনিয়ার সবচেয়ে হিংস্র প্রাণী? অনেকের হয়তো দ্বিমত থাকতে পারে, তবু সবকিছুর বিচারের শেষ রায় কিন্তু মানুষের বিপক্ষেই যায়।
‘তোমাদের মনটা এখন কুমোরের চাকে ওপর বসানো একতাল নরম কাদার মতো। এখন তা দিয়ে তুমি যা বানাতে চাও তাই পারবে। হাঁড়ি চাইলে হাঁড়ি, কলস চাইলে কলস। কিন্তু এই কাদা যখন শুকিয়ে মাটি হয়ে যাবে কিংবা পোড়ালে বাসন-কোসন হবে তখন শত চেষ্টা করলেও তাকে একটুও এদিক-সেদিক করতে পারবে না।’ আমার এক পাইমারি শিক্ষকের বয়ান এটা।
সীমান্তরেখা-১
সীমান্তরেখা-২
তৃতীয় অধ্যয়
সবেদ আলির মনে বেশ ফুর্তি ফুর্তি ভাব। সেদিনের মেঘলায় পাঁচু মাঝি দুপুরে ঘুমের আলস্যে পরাজিত হয়ে বিছানায় এলিয়ে পড়লেও পরদিন রেহায় দেয়নি ব্লাক মার্কেটরা। শুধু ব্ল্যাক মার্কেটই বা কেন, মেঘের অবগুণ্ঠন সরানো সূর্যের সোনাঝরা রোদে ঝিলিক দিয়ে উঠেছিল সবেদ আলি-হাবুডাগাদের গোত্রীয় মাথামুটের অন্নাভাবে মলিন মুখগুলোও। সেই ঝিলিকের চিহ্ন এখনো লেগে আছে সবেদ আলির চেহারায়। কিন্তু বউটার মন খারাপ নাকি শরীর খারাপ সেটা ঠাহর করে ওঠা তার জন্য পর্বত-লঙ্ঘনের মতো দুরাতিক্রম্য চ্যালেঞ্জ। একবার ভাবে জিজ্ঞেস করবে, পরক্ষণে একপশলা অভিমান এসে ভর করে মনে। খুব যে নতুন তাও নয়, নয় নয় করে ছয় মাস পার হলো, এই বয়সী দম্পতিরা কত আমোদ-আহ্লাদ করে, কিন্তু হুরমতি সেসবের ধার ধারে না। অথচ মুখরা রমনী সে।
‘ছিঃ ছিঃ, আমার নাকের ডগা দিয়ে চুরি, বলিহারি সাহস তোর!’ বিল্টুর পিঠে শপাং শপাং কঞ্চির লাঠি চালাতে চালাতে বললেন
হেকমত স্যার। ‘লোকে কী বলবে? কী বলবে, বল্। আমরা স্কুলে চুরি শেখাই! চুপ করে আছিস কেন হারামখোর, উত্তর দে...’
টিফিনের ফাঁকে স্কুলের পাশে রায়বাবুদের আমবাগানে আম চুরি করতে গিয়ে হেকমত স্যারের হাতে ধরা পড়ে গেছে বিল্টু। হেকমত স্যারের নামটা যেমন, তেমনি দশাসই তাঁর চেহারা। মুশকো জোয়ান, শুধু পেছন দিকে অড়হর ক্ষেতের লাইনের মতো একসারি চুল ছাড়া মাথার বাকিটুকু চকচকে টাক। আর এই চেহারায় যখন অগ্নিমূর্তি ধারণ করেন তখন শুধু ছাত্র-ছাত্রীরা নয়, জুনিয়র শিক্ষকরা পর্যন্ত কেঁপে ওঠেন।
অনেক অনেক দিন কথা। চুয়াডাঙ্গার আপেলদ্দি ডাক্তারের তখন বেশ নামডাক। হাসপাতাল আর চেম্বারে তো রোগি দেখেনই, প্রয়োজনে মুমূর্ষূ রোগিকে বাঁচাতে ছুটে যান দূর-দূরান্তে। একদিন এমনই এক রোগির চিকিৎসা করতে গেলেন চুয়াডাঙ্গা থেকে বিশ মাইল দূরে জীবননগরে। রোগির অবস্থা তেমন সুবিধার নয়। তাই আপেলদ্দি ডাক্তার বেশ সময় নিয়ে রোগির চিকিৎসা করতে লাগলেন। কখন যে দুপুর গড়িয়ে গেছে ডাক্তার সাহেব তা খেয়ালই করেননি।
তখনকার দিনে এত ঝকঝকে রাস্তাঘাটও ছিল না, এত এত বাস-মোটর গাড়িও ছিল না। ওদিকে রোগির চিকিৎসা করতে গিয়ে ডাক্তার সাহেব চুয়াডাঙ্গাগামী শেষ বাসটাও মিস করলেন। অথচ যে করেই হোক সন্ধ্যার আগেই তাঁকে চুয়াডাঙ্গায় পৌঁছতে হবে- কে জানে কতজন রোগি তাঁর অপেক্ষায় প্রহর গুনছে!
তখন চুয়াডাঙ্গা আর জীবননগরের মাঝে শুধু বন আর বন। মাঝে মাঝে খাপছাড়া দু-একটা গ্রাম। কেন্দুয়া বাঘ, ভালুক, হায়েনা আর বুনো শুকরদের অবাধ বিচরণ সেই বনে। ডাক্তার সাহেব তো পড়লেন মহা মুসিবতে। এখন বাড়ি ফিরবেন কীভাবে? একট গরূ কিংবা ঘোড়ার গাড়ি টাড়িও চোখে পড়ছে না। ঠিক সেই সময় একজন লোক সেই পথ দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিল। রাস্তার পাশে ডাক্তার সাহেবকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লোকটা সাইকেল থামিয়ে বলল, ‘আরে ডাক্তার সাহেব! আপনি এখানে দাঁড়িয়ে কেন?’
হাড়িচাঁছা শিয়াল ভারী বুদ্ধিমান। শিয়ালরা এমনিতেই বুদ্ধিমান হয়। কিন্তু হাড়িচাঁছার বুদ্ধি সবার চেয়ে বেশি। তবে তার দুঃখও কম নয়। কারণ তাঁর নাম হাড়িচাঁছা কিনা। এই নাম তো তার বাবা-মা দেয়নি। দিয়েছে মাঠের দুষ্টু পশুরা। তাঁর গলায় যতদিন রসের হাড়ির কান্দাটা
দেড়েদের বটগাছে আবার ফকির বাবার আছর হয়েছে- সঙ্গে আছে কয়েকশ' জ্বীন। জ্বীনে কারো ঘাড় মটকায়নি। তবে মটকাতে কতক্ষণ! গাঁয়ের লোক তাই ভয়ে-আতঙ্কে তটস্থ। তাছাড়া ভয় পাওয়াটা আবহমান গ্রাম-বাংলার জীবনযাত্রারই অবিচ্ছেদ্য অংশ; মরণনেশা।
প্রথম অধ্যায়
যে সময়ের কথা বলছি তখন পণ্ডিত মশাইদের সে-কী হাঁক-ডাক!
বিজ্ঞানী বিষ্ণুপদ বাঁড়ুজ্জের সাথে পরিচয় আমার বিশ বছর আগে। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে। আমি তখন ছাত্র। তিনি কেবল জয়েন করেছেন সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিম্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন 'বিগব্যাং ও মহাবিশ্বের' প্রসারণ বিষয়ক এক সেমিনারে বক্তব্য দিতে। সেমিনারের আয়োজক আমরা, অর্থাৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ। তাঁর বক্তব্য আমার মনে এতোটাই দাগ কাটল, সেমিনার শেষে তাঁর সা