পানি থেকে উঠবার সময় পেলাম মহামূল্যবান এক জিনিসের দেখা। শামুকের ডিম। দুর্লভ হয়তো নয়। কিন্তু বহুদিন এ জিনিস আমি দেখিনি। তাই ক্যামেরা হাতে থাকা অবস্থায় এমন কিছু পেয়ে যাওয়া সৌভাগ্যের বিষয় বৈকি।
ধুতরাকে গাঁয়ের মানুষে ভয় পায়। কারণ এর ফুল বড্ড বিষাক্ত। আমরাও ভয় পেতাম। কিন্তু মাঝে-মাঝেই ভুলে যেতাম ভয়ের কথা, ধুতরার বিষের কথা। মা-দাদীরা বলতেন, ধুতরোর ফুল নাকে শুঁকলে মানুষ পাগল হয়ে যায়। কথাটা কতটা সত্যি জানতাম না। তবে ধুতরোর ফুল নিয়ে খেলা করলেও নাকে শুঁকতাম না কখনও।
পেয়েছি! আর কিছু চায় না। এ যে বিভূতিভূষণের ময়নাকাঁটা। কত বন-বাঁদাড়ে এর খান তল্লাস করেছি, পায়নি। চিনিই না তো পাব কীভাবে? যারা দেখেছেন, চেনেন, তাঁদের মুখে বর্ণনা শুনে খোঁজার চেষ্টা করেছি। তবুও দেখা মেলেনি। আজ এভাবে অপ্রত্যাশিত দর্শনের কথা ভাবিইনি। ময়নাকাটা বাংলাদেশের সবজায়গায় ছিল কিনা জানা নেই। তবে আমাদের এলাকায় যে এর প্রাচুর্য ছিল তার সাক্ষ্য বিভূতিভূষণই দিয়েছেন।
যেহেতু অনেক পাঠক এই পোস্ট নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তথ্যসূত্র চেয়েছেন, পর্যাপ্ত তথ্যসূত্র আমার হাতে নেই, তাই পোস্ট থেকে লেখাগুলো সরিয়ে ফেললাম। যারা আমার কথায় আঘাত পেয়েছেন, তাদেরকে আঘাত দেয়ার জন্য আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।
মাঠে মাঠে ঘোরা আমার ছেলেবেলার অভ্যাস। আমাদের একটা বাগান ছিল। একপাশে বাঁশবন আরেক পাশে দেশি আমের সারি। ঠিক দুপুরের বাগানে বসে আপন মনে খেলতে ভালবাসি। ঠিক খেলা নয়, ছেলেমানুষী। বুনো লতা পাতার গায়ে হাত বোলানো, কোন গাছে কটা ফল ধরেছে তা গুণে দেখা, শুভ্রপালক শাহ বুলবুল পাখির পেছনে বাগানময় ঘোরা--ছেলে মানুষী ছাড়া কী! নিরিবিলি খেলতে ভালবাসতাম, তেমনি ভয়ও পেতাম খুব। বেঁশেভূতের ভয়। মধ্যদুপুরেই তাদের যত বাহাদুরি।
শরতের তাল পাকা গরম। ভ্যাপসা, অস্বস্তিকর। তবে তা শুধু বড়দের জন্য। আমাদের বয়েই গেছে শরৎকে কেয়ার করতে। ঘরকুনো হয়ে বসে থাকার দিব্যি তো কেউ দেয়নি! বিশেষ করে নানা বাড়িতে। মা-বাবার বারণ নেই, চাচার রক্তচক্ষু নেই, তাই অস্বস্তি¡র দুপুরে-ঘুমও নেই। নানা বাড়ির সাথেই বিশাল বাগান। আম, জাম, কাঁঠালের। বাগানের ঠিক মধ্যিখানে এক বিরাট তাল গাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে আছে। সব গাছ ছাড়িয়ে আকাশে উঁকি মেরে। ধপাস করে একটা তার পড়ে। আমরা ছুটে যাই। কিন্তু কোথায় তাল! কে যেন কুড়িয়ে নিয়ে গেছে। ফিরে এসেছি। আবারও ধপাস! এবার ছুটে গিয়ে দেখি, তাল মুখে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছেন শিয়াল মামা।
গরু আর কুকুরের উদাহরণ দেয়া হয় বারবার। গাঁয়ের গোরস্থানে কুকুর আর গরুদের অস্থির আচরণই মানুযকে ভয় পাইয়ে দেয়, ভুল বিশ্বাসের ভিত্তি মজবুদ করে। শুধু শোনা কথা নয়, কিছু ব্যাপার নিজেও দেখেছি। ছোটকালে মাঝে মাঝে গরু চরতাম আমি। কুকুর নিয়ে শিয়ালের পেছনে ধাওয়া করার অভিজ্ঞতাও আমার কম নয়। এই দুই প্রাণীকে দেখেছি, গোরস্থানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কেমন যেন অস্থির হয়ে যায়। ছোটাছুটি করে। দড়ি ছিঁড়ে পালিয়ে যেতে চায় গরু। ফোঁস ফোঁস করে গর্জায় কখনও কখনও। শুধু তা-ই নয়, দেখা যায় একটা গোরস্থানে শত শত কবর থাকে কিন্তু তার ভেতরে নির্দিষ্ট একটা কবরের দিকে তেড়ে যায়। শিং দিয়ে গুঁতিয়ে কবরের মাটি আলগা করে ফেলে প্রবল আক্রোশে। যদি কবর রেলিং দিয়ে ঘেরা থাকে, তবে প্রবল বিক্রমে সেই বেড়া ছিন্ন ভিন্ন করতে পিছ পা হয় না নীরিহ গরু। লোকে তখন ভাবে, কবরের ভেতরে যে মানুষটি শুয়ে আছেন, তিনি বড্ড পাপি ছিলেন, ভয়াবহ আজাব হচ্ছে তাঁর।
বৈশাখ মানেই সূর্যের বাহাদুরী। ধানকাটা সারা। খালি মাঠে খাঁ খাঁ রৌদ্রের দোর্দণ্ড প্রতাপ। কৃষকের ব্যস্ততা নাইকো আর। বাগানজুড়ে শুকনো পাতার আস্তর। তপ্ত মরুর নির্জনতা ভর করে মাঠজুড়ে। বাঁশঝাড়ের কঞ্চি-পাতার জটলা থেকে নেমে আসা শ্যামা পাখির সন্তর্পণ পদচারণা। প্রাণহীন দুপরে খসখসে মৃদু ভৌতিক আওয়াজ। নির্জনতার বুক চিরে হঠাৎ ছাতারে দলের তীক্ষ্ণ চিৎকার। শিমুল গাছের মগডালে বাজপাখির জাজ্বল্যমান শ্যেন দৃষ্টি। হঠাৎ রকেটের গতি ভর করে তার ডানায়। ছাতারে দলের পাখায় পিস্টনের উল্লাস। ভীত প্রস্থান। জেট বিমানের মত ডাইভ দেয় বাজপাখি, ছোঁ মারে। বাজের নখরে আটকে থাকা ইঁদুর পুর্ণ আত্মসমর্পণে পৃথিবীকে বিদায় জানায় বৈশাখী হাওয়ায় ভেসে। সেকি জানে এই মৃত্যুই তাঁকে আকাশজয়ী করেছে। করেছে অনন্য। দোপেয়ের লাঠির আঘাতে, গর্তে ধুঁকে ধুঁকে, ড্রেনে পচে কিংবা শ্বাপদের নখরে ছিন্নভিন্ন হওয়ার চেয়ে আকাশজয়ী হয়ে মরা কি শ্রেয় নয়? বাজপাখি উড়ে যায় গ্রীষ্মের লেলিহান শিখার দিকে। বৈশাখের টকটকে বহ্নিশিখা যেন দাউ দাউ করে জ্বলছে কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে। বাজপাখি সেই আগুনে আত্মাহুতি দেয়; মরণের জন্য নয়, রাজসিক ভোজন পর্বটা মহিমান্বিত করতে।
জিম করবেট হলেন জঙ্গলের বিজ্ঞানী। জঙ্গলের প্রতি পরতে পরতে লুকিয়ে থাকে মৃত্যু, জিাঘংসা, কূটিলতা। সে সব শুধু সুনিপূণ ভাবে আবিষ্কারই করেনি করবেট, রীতিমত জঙ্গলের আইন তৈরি করে উত্তরসুরিদের জন্য একটা সুনির্দিষ্টি পথনির্দেশনা রেখে গেছেন। জঙ্গল আজ বিলুপ্তির মুখে, তাই করবেটের ‘‘জাঙাল লোর’’ কতদিন কাজে লাগবে তা নিয়ে সন্দিহান আমরা। কিন্তু অ্যাডভেঞ্চার যাদের রক্তে মিশে আছে, তারা কী থেমে যাবেন। না, তাই কি হয়! শিকারের নেশা মানুষ কমাতে বাধ্য হয়েছে, কিন্তু দিন দিন বেড়ে চলে পর্বতের হাতছানি। এক হিমালয়ই ভুলিয়ে ভালিয়ে তার বুকে ডেকে নিয়ে শত শত পর্বতারোহীর প্রাণ কেড়ে নেয়। হিমালয় যেন মায়াবী ঘাতক--সে এভারেস্টই হোক আর কাঞ্চনজঙ্ঘা কিংবা অন্নপূর্ণা। কিন্তু এর মায়ডাকও তো উপেক্ষা করার মত নয়। তাই পদে পদে মৃত্যুর হাতছানি উপেক্ষা করে, তুষারের বুকে অগ্নির উপাখ্যান রচনা করতে নিশিতে পাওয়া মানুষের মতো চূড়ার দিকে অগ্রসর হন অদম্য প্রাণ অভিযাত্রীকেরা।
কৃষ্ণপক্ষের কালিগোলা অন্ধকার রাত। গা ছমছমে একটা ডাক ভেসে আসে সজনে গাছের জমে থাকা অন্ধকারের আড়াল থেকে। বড্ড ভয়ংকর সেই ডাক। গাঁয়ের লোকেরা বলে জমকুলি ডাকে। রক্ত হীম করা করুণ সুরে। কু-উ-উ কু-উ-উ রবে। এই জমকুলি আদৌ কী, তা বলতে পারে না কেউ, শুধু ভয় পেতেই জানে। লাইট জ্বালিয়ে সজনে গাছের মাথটা একবার দেখে আসে সে সাহসও নেই কারও।