বর্ষকালের দিনটা একটু বড়ই হয়। বিশেষ করে যে দিন বিকেল নাগাদ একটা ঝুম বৃষ্টি হয়ে যায়। কয়েক ঘন্টার ঝরঝরানি। আকাশ কালো করা মেঘ বিকেল না পেরুতেই রাত নামিয়ে দেয়। ঘড়ি ধরে গৃহস্থের দিন চলে না। বরং আকাশের গায়ে শম্বুকগতিতে গড়িয়ে চলা সূর্যের রকমফের বুঝিয়ে দেয় কখন কী করতে হবে। তবে বর্ষার দিনে তেমনটা হবার জো নেই। একটানা বৃষ্টি হলে যদিও ঘড়ি দেখে বেলা আন্দাজ করে নিতে হয়। কিন্তু যখন ‘খেকশিয়ালের বিয়ে’ টাইপের বৃষ্টি হয় তখন সময়ের মর্জি বোঝা বড় দায়। মুষল ধারের বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যায় হয়তো গৃহিনীরা রাতের ভাত চড়িয়ে বসে আছে, গৃহকর্তার মুখে হাসি, যাক বাঁচা গেল, আজ আর বাজারে বেরুনো যাবে না, জন-মায়েন্দারের পাওনাটা অন্তত আরো একদিন টেনে নিতে পারবে, পাওনাদার মুনিষ-চাষাদের চোখে যখন অন্ধকার ঘিরে ধরেছে, আজ রাতেও উপোষ থাকতে হবে, হাঁস-মুরগী আর গৃহপালিত পশুগুলো যখন প্রস্তুতি নিচ্ছে ঘরে ওঠার, তখনই হয়তো গৃহস্থের হাসি মুখে ঝামা ঘষে, চাষা-ভূসাদের অবয়ব উজ্জ্বল করে শেষ বিকেলের সোনারোদ ছড়িয়ে পড়ে ভেজা উঠনে, বৃষ্টিধোয়া মাঠের বুকে, ভূখা চাষিদের ভাঙা চালের ভাঙা বেড়ার ফাঁক গলিয়ে। শিমুল তুলোর মতো বাতাসে উড়ে বেড়ানো ছেঁড়া ছেঁড়া শুভ্র কিছু মেঘ ছাড়া গোটা মহাকাশে নীলের হরষ। জন-মায়েন্দাররা বেরিয়ে পড়ে পাওনা আদায়ে, গৃহস্থ কাঁথার তলায় দেহটা সেধিয়ে জর-সর্দির দোহায় দিয়ে হাট কামাইয়ের অজুহাত খোঁজে, গৃহপালিতারা ছুটে বেরিয়ে পড়ে অলিতে গলিতে।
গল্পটা রহস্য পত্রিকা’র অক্টোবর-২০১০ সংখ্যায় প্রকাশ হয়।
আমি আনারুল। মা বলতেন ‘আনারুল হক’। বাবা ডাকতেন আনু নামে। গাঁয়ের লোকেরা বলত আনারুল পাগলা। ভাঙাচোরা অবয়ব। পাখির নীড়ের মত উষ্কখুষ্ক কেশশ্রী, সাপের খোলসের মত খসখসে ত্বক, অস্পষ্ট বাচনভঙ্গি, বোকাবোকা চাহনি আর বুদ্ধির ঘটে আমড়া কাঠের ঢেঁকি; সবমিলিয়ে গ্রামবাসীদের দেয়া পদবীটা ধারণ করার মত যথেষ্ট যোগ্যতা আমার ছিল। তাই আজও এই গাঁয়ে পাগল ও আনারুল সমার্থক দুটি শব্দ।
হাঁসুলী বাঁকে বাঁশবনের তলায় পৃথিবীর আদিম কালের অন্ধকার বাসা বেঁধে থাকে। সুযোগ পেলেই দ্রুত গতিতে ধেয়ে ঘনিয়ে আসে সে অন্ধকার বাঁশবন থেকে বসতির মধ্যে।
...হাঁসুলী বাঁকের উপকথা, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
তারপর সে ভয়ে ভয়ে বনের মধ্যকার সুঁড়িপথ দিয়ে বিছুটি লতার কর্কশ স্পর্শ গায়ে মেখে, সেঁয়াকুল কাঁটায় শাড়ির প্রান্ত ছিঁড়ে অতিকষ্টে এসে গ্রাম-প্রান্তের কাওয়ার পাড়ায় পা দিলে।
—ইছামতী, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
কী শোভা, কী ছায়া গো, কী স্নেহ কী মায়া গো—
কী আঁচল বিছায়েছ, বটের মূলে নদীর কূলে।
‘একদিন সকালে একমনে খবরের কাগজ পড়ছি, বলাই আমাকে ব্যস্ত করে ধরে নিয়ে গেল বাগানে। এক জায়গায় একটা চারা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কাকা এ গাছটা কী।”
দেখলুম একটা শিমুল চারা বাগানের খোওয়া দেয়া রাস্তার মাঝখানে উঠেছে।’