সেই কোন কালে ওস্তাদ মুজতবা আলী বইকেনা প্রবন্ধে লিখেছিলেন - বই কিনে কেউ কখনো দেউলিয়া হয়না। আলী সাহেবের সারাজীবনের কাজ পিডিএফ হিসেবে নামাতে সময় লাগে মিনিট খানেক। খরচ লাগে শূন্য টাকা। সুতরাং দেউলিয়া হবার প্রশ্নই আসে না। একথা জানার পর তিনি বেঁচে থাকলে আজ কি বলতেন জানিনা। তবে 'বই চুরি করে কেউ কখনো পাপী হয়না' এই কথা নিশ্চয়ই বলতেন না।
ঘটনা কি খুলে বলি। তার আগে একটু গান শুনে নেয়া যাক।
পারভেইচ্যারে বল খেলাডা তওবা কইরা ছাড়
অনেক কথা বলা যায়। সুন্দর করে, আবেগ দিয়ে, হিউমার দিয়ে, যুক্তি দিয়ে। আজ বরং তা বাদ দেই। সহজ কথা সহজে বলি। প্রথম আলোর সাজিদ হোসেন এর তোলা এই ছবিটি দেখেছেন সবাই আশা করি।
মে ১৫, ১৯৭১
যুদ্ধটা শেষ পর্যন্ত শুরু হয়েই গেল। সানাউল্লাহ ভাই কিছুদিন চারিদিকের ভাও বোঝার চেষ্টা করে শেষপর্যন্ত মিটিং ডেকেই ফেললেন। লোকজন নিতান্ত কম না। এলাকার মুরুব্বী, আধা মুরুব্বী, চ্যাংড়া, ছেলে ছোকরা, চার আনা, আটআনা, দশপাই, পাঁচপাই সব মিলিয়ে দুইশ এর মতো লোক। কমবেশি সবাই সানাউল্লাহ ভাইকে মানে। সানাউল্লাহ ভাই একটু গলা খাঁকারি দিয়ে শুরু করলেন,
- মেয়ে আমেরিকান
আম্মা শুনে চোখ কপালে তুলে বলে,
- সাদা চামড়া?
- নাহ
হাঁফ ছেড়ে বলে,
- তাহলে কি আমাদের দেশী? আমেরিকায় বড় হয়েছে?
আমি বলি,
- নাহ আফ্রিকান আমেরিকান।
আম্মা আবারও চোখ কপালে তুলেন। একটু হেঁচকি তুলে কান্নার ভঙ্গী করেন। কিন্তু কান্না আসে না। 'ও মতিনের বাপ, এদিকে আসো। আমি শেষ' বলে বিকট চিৎকার করার চেষ্টা করেন। কিন্তু গলার আওয়াজ বেশিদূর যায়না। আব্বা ঘটনাস্থলে পৌঁছে নাটুকে গলায় বলেন,
আমাদের পাড়ার পিছন পাগলের গল্পটা বলি।
ব্যাটা এমনিতে বেশ ভালো। সবার সাথে বিকেল বেলা আড্ডা দেয়, চা মুড়ি খায়, দেশের হাল হকিকত নিয়ে আলোচনা করে। খালি কেউ পিছন বললেই ক্ষেপে যায়। কারণটা আমরা ঠিক জানতাম না। পাগলের নিজ নাম পছন্দ না বলে পিছন বললে ক্ষেপে যায় নাকি পিছন বললে ক্ষেপে যায় বলেই তার নাম পিছন পাগল এটা আমাদের কাছে ডিম-মুরগির মতো একটা ধাঁধা ছিল।
কারো ফাঁসির খবরে আনন্দিত হবার কিছু নেই। মানুষের মৃত্যুতে আনন্দ করার কিছু নেই। মৃত্যু এক অমোঘ পরিণতি যা সব বর্ণের সব রকমের মানুষকে এক করে দেয়। যতবড় আসামীই তার অধিকার আছে ন্যায় বিচার পাওয়ার। যতবড় অপরাধীই হোক না কেন, তার অধিকার আছে সম্মানজনক একটা শাস্তি পাওয়ার। অনেক সভ্য দেশ থেকেই মৃত্যুদণ্ডের মতো অমানবিক বিধান বাতিল করা হয়েছে। সারাবিশ্বে মানবতা আজ হুমকির মুখে। ঘৃণা, হিংসা, প্রতিশোধ আকাঙ্ক্ষা, চোখের
মোমেনা বেগম একঘেয়ে স্বরে বলে যায়,
- আমার নাম মোমেনা বেগম, স্বামী হাবিবুর রহমান, আব্বা হযরত আলী লস্কর।
- সেইসময় আপনার বয়স কত ছিল?
- একাত্তরে আমার বয়স ছিল বার বা তের বছর। আমরা চার বোন, তিন ভাই। আমি সবার বড়। আমার মা ২৬ মার্চ, ১৯৭১ সালে গর্ভবতী ছিলেন।
- কি হয়েছিল সেইদিন?
- ২৬ মার্চ ১৯৭১ সন্ধ্যায় বেলা ডোবার আগেই ঘটনা। আব্বা দৌড়ায়ে ঘরে আসে এবং বলতে থাকে কাদের মোল্লা মেরে ফেলবে।
- কেন?
জনসেবার ভূত জীবনে কখনো মাথায় চাপেনি এইরকম লোক মনে হয় কমই আছে। সমস্যা হচ্ছে ভূতগুলা বেশীদিন মাথায় থাকেনা। সবাই মাদার তেরেসা না, এমনকি কেউ কেউ ও মাদার তেরেসা না, খুবই অল্প কেউও না, একেবারে পৃথিবীর বিলিয়নকে বিলিয়ন লোকের মধ্যে হাতে গোনা দুই একজন হয়তো। বাকিরা সবাই আমার মতোই। মাঝে মাঝে বাথরুম চাপার মতো জনসেবার তীব্র বেগ চাপে। আবার দ্রুত সেটা কমেও যায়। সেরকমই ভূত আমার মধ্যেও চেপেছিল একবার। খুলে বলি।
আমি মেধাবী সেটা আগেই জানতাম কিন্তু বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় চান্স পাবার পর সেটা বাকিরাও জানল। আম্মা এসে জড়ায়ে ধরে বলল, মানিক তুই বংশের মুখ উজ্জ্বল করলি। চাচা বললেন, গুড জব। এই বংশের ছেলেরা ডিপ্লোমা বিআইটি ইত্যাদি হাবিজাবিতে চান্স পাইলেও বুয়েটে এই প্রথম। পাড়া প্রতিবেশী সবাই হৈহল্লা করে দেখতে আসল পাড়ার মেধাবী ছেলেকে। কেউ গায়ে হাত বুলায়, কেউ মৃদু চিমটি কাটে, কেউবা ফিসফিস করে বলে, কি মেধাবী গো।