১
কানের ভেতরটা পুড়ে গেল তাহমিনার। বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে হাসান। সে এই তিক্ত কণ্ঠ শুনতে পায়নি। হাসানের বাবার পায়ের থেকে হাত গুটিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায় তাহমিনা। চাপদাড়িঅলা বিশাল শরীরের প্রৌঢ় মানুষটার চোখ তীব্র লাল। রক্ত ছুটে বেরিয়ে আসবে যেন। ক্রোধ, হতাশা আর তিক্ত ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে হাসানের দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি।
মনোরম একটি সন্ধ্যা। অভিজাত এলাকার বিস্তৃত মসৃণ সড়ক। দু' একটি ছিমছাম বহুতল বাড়ি। গোছানো মানানসই পরিপাটি ঘাস ও গাছ। বহুতল আবাসগুলোর পাশে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে কিছু সুদর্শন দোকানপাট, চীনা রেস্তোরা, অভিজাত স্কুল, আত্মসম্মানবোধে দৃঢ় বইয়ের দোকান, অত্যাধুনিক ও স্মার্ট যন্ত্রাদির স্টোর। সড়কে সাঁই সাঁই করে ছুটে চলছে চকচকে গাড়ি, রাগী বড়সড় বাস, ক্বচিৎ ক্ষ্যাপা হলুদ-সবুজ ট্রাক। এদের পাশ দিয়ে চিপা চাপায় মিশে গিয়ে
মেরীকে আমার মনে পড়ে। হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে। নিরুত্তাপ সকালে সদ্য-জেগে-ওঠা রাস্তায় পা রাখার পর, অথবা অফিসে এক সেকেন্ডও বিশ্রাম না নিয়ে একটানা ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করে যাওয়ার সময়গুলিতে, অথবা সন্ধ্যায় চায়ের পানি যখন টগবগ করে ফুটতে থাকে গ্যাসের চুলায় আর আমি চা-পাতা হাতে প্রস্তুত যখন - সেই সময়ে, অথবা রাতে ঘুমানোর আগে যখন লাইট নিবিয়ে দেবো ঠিক সেই মুহূর্তে কোনও পূর্বাপর কারণ ছাড়াই মেরীকে আমার মনে পড়ে।
মাথার ভেতরে গল্পেরা অবিরাম ধাক্কাধাক্কি করে যায়। এ ওকে ধাক্কা দেয় তো ও একে মারে ঠেলা। কার আগে কে বেরিয়ে আসবে এই নিয়ে ঝগড়া, মারামারি, গালিগালাজ, ঠেলাঠেলি। ...কেননা ঘুম এখনও গাঢ় হয়নি। কিছুটা সময় পাওয়া যেতে পারে - এটুকুই আশা। স্বপ্নেরা এখনও হানা দেয়নি একযোগে। মাথার ভেতরটা এ মুহূর্তেও যথেষ্ট পরিষ্কার। তবে কিনা এই সুযোগ চলে যাবে যেকোনো মুহূর্তে। লাল, নীল, বেগুনি, হলুদ, কমলা, কালো, ধূসর স্বপ্নেরা ঝেঁটিয়
মৌমি আমার সহপাঠি ছিল। মৌমি আমার বন্ধু ছিল। মৌমি আমার বোন ছিল। মৌমির সাথে একদিন দেখা না হলে সেই দিনটা আমার অসমাপ্ত মনে হতো। দিনের মধ্যে অন্তত একটাবার আমি মৌমির কাছে যেতাম। অথবা মৌমি আমার কাছে আসতো। আমরা একসাথে কোথাও বসতাম। আমাদের ছাদে চেয়ার পেতে। কিংবা মৌমির বারান্দায়। আমি হয়তো বলতাম, “মৌমি, আজকে আমার মনটা খুব খারাপ। বাসায় যাবোনা।” মৌমি বড় বাটিভর্তি মুড়িমাখা নিয়ে আসতো। আমরা একটু একটু করে খেতাম আর মৌমির পায়রাগুলোকে খাওয়াতাম। আমাদের সামনে রেখে একসময় সূর্য অস্ত যেতো। পায়রাগুলোর ডানা নানা রঙে রঙিন হয়ে যেতো।
সময়টা প্রায় দুপুর। অর্পিতা হাফ ইয়ার্লির খাতা নিয়ে বসেছে। হাতে একটা হলুদ কলম যার কালি লাল। ডান গালে একটা লাল রেখা। তর্জনীতে লেপটানো লাল কালি। ছুটির আর মাত্র দিন তিনেক আছে অবশিষ্ট। এর মধ্যে শেষ করতে হবে এত এত খাতা। কাগজের খস খস গা শিউরানো কর্কশ শব্দ ছাড়া এ ঘরে আর কোনো শব্দ নেই।
এটা ছোট্ট গোল কাচের টেবিল, নিচু, গাঢ় রঙের। খাতাগুলো ছড়ানো টেবিলে। অর্পিতার বাদামী-খয়েরী মগ এক পেট চা নিয় ...
ভ্যাপসা গরম রাত। এইরকম রাতে রাস্তাঘাটে, অলিতে গলিতে বাজে গন্ধ পাওয়া যায়। মানুষের গায়ের ঘামের গন্ধ, তরকারি পচা গন্ধ, মাছ পচা গন্ধ সব মিলেমিশে একটা বোটকা গন্ধ ছড়ায়। সেইরকম একটা রাত। গিজ গিজ করছে মানুষ। কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছে না। অথচ নির্বিবাদে ধাক্কা খাচ্ছে, ধাক্কা দিচ্ছে একে অন্যের কাঁধে, পিঠে, হাতে, পায়ে। এলোমেলো রিকশার ঝাঁক। রাস্তার এখানে সেখানে গর্ত। দুইপাশে সারি সারি দোকান। ...
এই সময়টাতে আমি একটু জিরোবার ফুরসত পাই, এই রাত একটায়। জাহিদ ঘুমিয়ে পড়ে, পাশের ঘরে ঘুমান আমার শাশুড়ী। না ঘুমালেও আমাকে আর ডাকাডাকি করেন না, কাশির শব্দে বুঝতে পারি তিনি জেগে আছেন। জাহিদের লতায় পাতায় জড়ানো আত্মীয়সম্পর্কের বোন রিনি কোনো কোনো রাতে জেগে থাকে, টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে বই টই পড়ে। সেই সব রাতে দরজার ফাঁক গলে আলো এসে পড়ে ভেতরের বারান্দায়। আমি কখনো কখনো সেই আলো দেখি ছোট কাঠের ট ...