১.
অফিস থেকে বের হতে আজ দেরী হয়ে গেলো। তানিম ভাইয়ের জন্য। চলে আসবো এমন সময় একটা কাজ ধরিয়ে দিলেন। আমি অবশ্য এড়িয়ে যেতে পারতাম - সে সুযোগ ছিলো। কিন্তু ইচ্ছা করেই এড়ালাম না। কারণ তানিম ভাইকে আমি পছন্দ করি। মানুষটা ভালো। সুবিধা-অসুকিধা বোঝেন। তাই করে দিলাম কাজটা।
রাস্তায় বের হয়ে খুব ক্লান্ত বোধ করলাম। আজকে বৃহস্পতিবার। আরেকটা সপ্তাহ শেষ হতে যাচ্ছে। আমি লক্ষ্য করেছি, বৃহস্পতিবার অফিষ শেষে বের হলেই আমার খুব ক্লান্ত লাগে। যেন পুরো সপ্তাহের ক্লান্তি একবারে অনুভব করি।
সাত মসজিদ রোড ধরে ফিরছি। নন্দন এ যাবো। তারপর সোজা বের হয়ে যাবো মিরপুর রোডে। রাস্তায় বৃহস্পতিবারের নিয়মিত ভয়াবহ ট্রাফিক জ্যাম। রাস্তার ধারের কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া ফুলগুলিকে কালচে দেখাচ্ছে। রাতের আঁধার ওদের লাল/কমলা রং যেন শুষে নিয়েছে।
আমি বামে তাকাতে চাইলাম না। তারপরও অবধারিতভাবে আমার চোখ চলে গেল বামে। তৌহিদ ভাইয়ের অফিস। তৌহিদ ভাই এতক্ষণে নিশ্চয়ই বাসায় পৌঁছে গেছেন বা আমার মতোই রাস্তায়। বাসায় পৌঁছে গেলে হয়তো ’রি’ - র সাথে গল্প করছেন। বলছেন সারাদিন কী কী হলো। দিয়া হয়তো তার বাবার আশে পাশে ঘুরছে, বাবার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছে। ’রি’ হয়তো বিরক্ত হয়ে মেয়েকে একটা বকাই দিয়ে বসলো, ’নিজের রুমে যাও দিয়া। পড়তে বসো।’ ’রি’ কী এখন রান্নাঘরে? চা বানাচ্ছে ? অথবা তৌহিদ ভাই হয়তো এখনো ফেরেননি। ’রি’ হয়তো ফোন করেছে, ”কোথায় তুমি ? দেরী হবে ?” তৌহিদ ভাই হয়তো বলছেন যে রাস্তায় অনেক জ্যাম। ফিরতে দেরী হবে।
কত কিছু ভেবে ফেললাম এক মুহূর্তে। ইচ্ছা না করলেও ভাবনাগুলি চলে আসে মাথায়। কী করবো আমি ! আমার কী দোষ ! কেন তৌহিদ ভাইয়ের অফিস এই রাস্তাতেই হতে হবে ! আর ’রি’ কেই বা কেন আমাদের বাসা থেকে পাঁচ মিনিট দূরের ফ্ল্যাটে বাসা নিতে হবে ! ঢাকা শহরে কী থাকার জন্য ওরা আর কোন ফল্যাট পেল না !
’রি’ কে আমি কোনদিনই নাম ধরে ডাকতে পারলাম না। এমনকি মনে মনেও না। সংস্কার কী ! বয়সে বড়দেরকে শুধু নাম ধরে ডাকতে হয় না, আপা/আপু বলে ডাকতে হয়, ছোটবেলা থেকে শিখে আসছি। মেনেও আসছি। শুধু ’রি’ এর বেলাতেই সব এলোমেলো হয়ে গেল। এইসব ভাবতে চাই না আমি। কিন্তু ভাবনাগুলো তো আমাকে ছাড়ে না। কতদিন, আর কতদিন লাগবে আমার এই অনুভূতিগুলো মেরে ফেলতে ? আদৌ কী পারবো !
২.
মফস্বল শহরটাতে তখনো একটা গ্রাম-গ্রাম ভাব ছিলো। আবাসিক এলাকাটা ঘেরা ছিল ইঁট-সিমেন্টের বড় দেয়াল দিয়ে। বড় একটা বাউন্ডারি। ৪/৫ টা গেট আছে বাইরে বের হবার। এর একটা গেট পার হয়ে কিছুদূর হাঁটলেই একটা ছোট খাল। খাল পার হলেই দুই তিনটা বিল্ডিঙ। অপেক্ষাকৃত নতুন। আর একটা গেট দিয়ে বাইরে বের হয়ে বড় রাস্তা। বড় বড় বাস যায়। রাস্তার অপর পাশে কয়েকটা দোকান। মুদি দোকান, চায়ের দোকান, এইরকম আরো কিছু দোকান। এই রাস্তার ধারে, গেটের সামনে একদিন বড় একটা বাস থামে। ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা বাস। বাস থেকে নামে রাজিব আর রিতা। ওদের বাবা বদলি হয়ে এসেছেন এখানে কয়েক মাস হলো। ওরা এলো আজকে। এতোদিন আসা হয়নি, বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি ছিলো না তাই। নেমেই জায়গাটা পছন্দ হয়ে যায় দুইজনেরই। কেমন নির্জন, শান্ত একটা জায়গা। অনেক সবুজ এখানে। গাছগাছালিতে ঘেরা একটা ছোট আবাসিক এলাকা।
রিতাদের বাসাটা তিনতলা বিল্ডিঙের দোতলায়। রিতা-রাজিব দুইজনেই খুব মিশুক প্রকৃতির হওয়ায়, তিনতলার সমবয়সী আশফাক, সামনের দুইটা বিল্ডিঙের ওদের চেয়ে ২/৩ বছরের ছোট সায়মা, জাকির, জাহিদ, এমনকি ওদের নিচতলার ৫/৬ বছরের ছোট রাশেদ, মিনা আর রোশনি আর এরকম আরো কয়েকজনের সাথে ভাব হতে সময় লাগলো মাত্র এক দিন আর আরেকটা বিকাল। এই বন্ধুত্ব গাঢ় হতেও সময় নিলোনা। কয়েকটা মাস গেলো। রিতা-রাজিব ২/৩ দিনের ছুটি পেলেও চলে আসতে শুরু করলো ঢাকা থেকে। ১৫/১৬ থেকে ২১/২২ বছর বয়সীদের দলটা এখন আরো জমজমাট - সারাদিন হই-হুল্লোড় - কলোনি থেকে একটু দূরে বাঁধানো পুকুরঘাট সংলগ্ন পেয়ারা বাগানে নিজেরা নিজেরা পিকনিক - বিকালে - সন্ধ্যায় ছোট মাঠটায় নেট টানিয়ে ব্যাডমিন্টন - পিচের রাস্তায় সাতচারা খেলা - স্কুলঘরের পেছনে মজা দীঘি আর তারপরের বেগুন, টমেটো, পেঁয়াজ, রসুনের ক্ষেতটা পার হয়ে পুরোনো, নির্জন, ঝোপঝাড়ে ঢাকা পরিত্যাক্ত রাজবাড়িটায় অভিযান - কোনোকিছুতেই উৎসাহের কমতি নাই।
এর মাঝে মাঝে ঘটে আনুষাঙ্গিক আরো কিছু - ছোট খালটায় একসাথে সবার যখন একনৌকায় নৌকাভ্রমণ - তখন নৌকায় কৌশলে আশফাক রিতার পাশে- রোশনির বিশেষ দৃষ্টিনিক্ষেপ রাশেদের দিকে - নৌকা উল্টে গেলে রাজিবের হাত বাড়িয়ে দেয়া মিনার দিকে - এইরকম আরো কিছু । আর এইসব ঘটনায় বেদম মজা পেয়ে সায়মা, জাকিররা করে অযথায় চিৎকার-চ্যাঁচামেচি।
আধা গ্রাম - আধা শহরের ছোট একটা কলোনির আকাশ -বাতাস - সকাল - দুপুর - সন্ধ্যা মাতিয়ে রাখছে একদল কিশোর-তরুণ।
৩.
’তোমার কী আজকে কোনো কারণে মন খারাপ ছিলো ?’
’নাতো ! কেন ?’
’দেখে মনে হচ্ছিলো, কী হয়েছে তোমার বলোতো ?’
’ নাহ্ ! কিছু হয়নি। আমি একদম ঠিক আছি ।’
’ মিথ্যা বলছ কেন রাশেদ ? আমি তো তোমাকে চিনি। কী হয়েছে সেটা না বলো, অন্তত স্বীকার করো যে কিছু একটা হয়েছে।’
কন্ঠে অভিমানের সুর। এইবার খারাপ লাগলো আমার। কিন্তু কী করে ওকে আমি বলি কেন আমার মন খারাপ ছিল ! কেন মাঝেমাঝে আমি চেষ্টা করেও হাসতে পারিনা !
ফোনে কথা বলছিলাম সারার সাথে। আমরা ক্লাসমেট ছিলাম। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, একই অফিসে জয়েন করার আগে আমাদের মধ্যে তেমন কোন কথাই হয়নি ! চাকরি করতে এসে আমাদের যেন আবার নতুন করে পরিচয় হয়েছে। ভাল একটা বন্ধুত্বও হয়েছে। ও যে আমাকে বেশ পছন্দ করে এটাও টের পাই। জানিনা কেন সারা এখনও বিয়ে করেনি। আমি অবশ্য এ নিয়ে ওকে কখনও কোন প্রশ্ন করিনি। হয়তো আছে কোনও লুকানো কারণ - আমার মতোই।
অফিস থেকে ফিরছি। ভালো লাগছে না। সারার আচরণে আমি দিন দিন বিভ্রান্ত হয়ে যাচ্ছি। ওর সাথে কী আমার প্রেম বা বিয়ে এই জাতীয় কোন সম্পর্ক হবে ! বোধহয না। মন থেকে তো সেরকম কোন সাড়া পাই না। কথায় কথায় বলেছিলাম একদিন কলাপাতা সবুজ রঙটা আমার খুব পছন্দের। ও বোধহয় সেই কথাটা মনে রেখেই আজকে কলাপাতা সবুজ একটা শাড়ি পরে এসেছিলো। আমার সাথে বসে গল্পও করেছে কিছুক্ষণ, একফাঁকে। আগা - মাথা নাই এইরকম কিছু কথা বললাম দুইজনে। কিছু একটা কী বোঝাতে চাইছিল ও ! তাই তো মনে হয় ! কিন্তু বুঝেও কেন আমি আজকে খুশি হতে পারলাম না ! ’রি’ - র চেহারা আর স্বভাবের একেবারে বিপরীত বলেই কী ? সারাকে তো আমি পছন্দই করি। ওর সাথে সময় কাটাতে পারলেও খুশি হই। মানে এতদিন তো তাই ভাবতাম। কখনো ভাবিনি নিজের অজান্তেই ওকে আমি মনে মনে ’রি’ - র সাথে তুলনা করতে শুরু করবো।
কখনোই ভাবতে পারিনা। কিন্তু অনিবার্যভাবেই যেকোনো মেয়ের কাছাকাছি গেলেই আমি তাকে ’রি’ - র সাথে তুলনা করতে শুরু করি। এই অসুখ আমি আর কতদিন বয়ে বেড়াবো ! কেন আমার এমন হলো ! জানি আজকেও বাসায় গেলেই আম্মা বিয়ের কথা নিয়ে ঘ্যানঘ্যান শুরু করবে। কী যে এক যন্ত্রণা আমার। আমিও বুঝি আমার বিয়ে করা উচিত। আসলে অনেক আগেই করে ফেলা উচিত ছিল। বাসায় আমরা তিনজন মোটে মানুষ, তার মধ্যে আজকাল আম্মার সাথে তো আমার কথাই হয়না এক বাসায় থেকেও ! দিন দিন কী রকম যেন হয়ে যাচ্ছি আমি ! আম্মার নিশ্চয়ই খুব একা একা লাগে ! কিন্তু কী করে আমি আম্মাকে বুঝাই যে কেন আমি সাহস করে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারিনা। এই সবকিছু তো তোমার জন্যই ’রি’। শুধু তোমার জন্যই। কিন্তু তুমি কী অদ্ভুত ভাল আছো সবকিছু ভুলে গিয়ে !
জ্যামে আটকে আছি। বিরক্ত লাগছে। ’রি’ র বলয় থেকে কী আমি কোনদিনই বের হতে পারবো না !
৪.
আনমনা বিকালে বা সন্ধ্যার কনে দেখা আলোয় যখন ছোট দলটা গোল হয়ে বা এলোমেলো ভাবে ছোট মাঠটায় বা পুকুরঘাটে বা অন্য কোথাও বসে আড্ডা দেয় বা গানের কলি খেলে, তখন ইথারে ভেসে বেড়ায় গোপন অনুভূতির রেণু। আর তা হয় প্রায় নিত্যদিনই।
রাশেদ রোশনির ক্ষণে ক্ষণে চকিত দৃষ্টিনিক্ষেপকে পাত্তা না দিলেও, রিতা আশফাকের বেশি বেশি মনোযোগকে উপেক্ষা করলেও, মিনা কিন্তু ঠিকই রাজিবের রহস্যময় হাসির প্রতুত্তরে একইরকম রহস্যময় হাসিই ছুঁড়ে দিল। ফলাফলস্বরূপ দীর্ঘ তিন বছর পর রাজিব ঘোষণা দিল যে সে বিয়ে করলে মিনাকেই করবে নাহলে আর কাউকেই না। এতে অবশ্য কারো কোন আপত্তি দেখা গেল না। কারণ পাত্র হিসাবে রাজিব আর পাত্রী হিসাবে মিনা দুইজনেই অত্যন্ত সুযোগ্য। কিন্তু রাজিবের বাবা যখন মনস্থ করলেন যে মেয়ের বিয়ে দিয়ে তবেই তিনি ছেলের বিয়ে দেবেন আর তারই পরিপ্রেক্ষিতে যখন রিতার জন্য পাত্র খোঁজা শুরু হলো, তখনই প্রকাশ পেল সেই অত্যাশ্চর্য, অবিশ্বাস্য আর সৃষ্টিছাড়া ব্যাপারটা।
৫.
খুব ভালো লাগছে আমার। আজকের পেপারটা নিয়ে যদিও বসে আছি, পড়তে ইচ্ছা করছে না মোটেও। এর চেয়ে ডাইনিং টেবিলে বসা আম্মার সাথে দিয়ার গল্প শুনতেই বেশি ভালো লাগছে। আমাদের দোতলায় দিয়ার বয়সী একটা মেয়ে আছে, ওর কাছে আসলে দিয়া আমাদের বাসাতেও আসে। আমার সাথেও গল্প করে অনেকক্ষণ ধরে। সারাদিন অফিসে কী করি, কোথায় খেতে যাই, আমার বন্ধু-বান্ধবরা কে কী বললো এইসব গল্প শোনে মেয়েটা পাকা বুড়ির মতো। আমার সাথে গল্প করতে ও খুব পছন্দ করে বুঝি। আমিও খুব আনন্দ পাই ওর সাথে গল্প করতে পারলে। দিয়ার জন্য গভীর মায়া বোধ করি আমি। ’রি’ কী এটা বোঝে ! জানিনা। তবে দিয়ার প্রতি আমার এই অপরিসীম মায়া আর আমার প্রতি দিয়ার এই ভালবাসা ’রি’ কে খুব খুশি করে এটা বুঝে আশ্চর্য লাগে আমার। আমাকে কি তাহলে এখনও ও অনুভব করে ! দিয়াকে নাচের স্কুলে আমিই ভর্তি করে দিয়ে এলাম সেদিন ’রি’ - র অনুরোধেই । আমার ওপর ’রি’ - র এই নির্ভরতায় অনুভব করি - আমি যেন কৃতার্থ হয়ে যাই। শুধু এইটুকুই তো আছে আমার !
দিয়া ধেখতে হয়েছে অনেকটা ওর মার মতো। এই বয়সেই অনেকটা লম্বা হয়ে গেছে। মুখের গড়নটা ’রি’ র মতোই।’রি’ র মতোই রেশমী ঘন কালো চুল। তবে দিয়ার চুল কাঁধ পর্যন্তই। এইটুকুই পার্থক্য। ক্লাস ফাইভ শেষ করলো এবার। দেখতে দেখতে বড় হয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। সেদিন কী সব বললো। ওর বন্ধুদের নাকি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে, বিদেশী ছেলে-বন্ধু আছে...এইসব কী কী যেন। আমি এত মনোযোগ দিয়ে শুনিনি। তবে একটু একটু টেনশন হচ্ছে এখন। এই বয়েসেই এইরকম হলে তো সমস্যা। ’রি’ কী এসব জানে ! আমি তো শুনেছি মেয়েকে ’রি যথেষ্ট কড়া শাসনে রাখে। সমবয়সী ছেলেদের সাথেও খুব একটা মিশতে দেয় না। দিয়ার জন্য ভয হয় আমার। কোনোরকম ভুল করে মেয়েটা যেন কষ্ট না পায়, আমার মতো - হয়তো ওর মার মতোও।
৬.
বিনা মেঘে বজ্রপাত হবার মতো একটা অনুভূতি যদি হয় রিতা আর রাশেদের বাবা-মার তাহলে তাদেরকে দোষ দেয়া যাবেনা কারণ, রিতা আর রাশেদের মধ্যে যে ভাই-বোন জাতীয় সম্পর্ক ছাড়া আর কোন সম্পর্ক হতে পারে এটা না ভাবাটাই স্বাভাবিক। রিতা আর রাজিবের মধ্যে অবশ্য সত্যি কোন বাড়াবাড়ি রকমের ভাল সম্পর্কের প্রমাণ পাওয়া গেল না; তবে রিতাকে কোনভাবেই বিয়েতে রাজি করানো গেল না আর রাশেদ সবার সাথেই কথা বলা প্রায় একদম ছেড়ে দিল। লজ্জায় নাকি হতাশায় নাকি দুইরকম অনুভুতিতেই সেটা অবশ্য বোঝা গেল না। এদিকে রিতাকে রাজিব আর তাদের বাবা-মা মিলে বিস্তর ধমকাধমকি করলেও কাজের কাজ কিছুই হলো না। মাঝখান থেকে রিতার সারাদিনব্যাপী কান্নাকাটিতে প্রতিবেশীরা নানান রকম সন্দেহ করে এর ওর সাথে ফিসফিসিযে আলাপ আলোচনা করতে শুরু করলো। আসল ব্যাপার অবশ্য কেউই আঁচ করতে পারলো না। এইরকম একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার কেই বা ভাবতে পারে ! একটা মেয়ের সাথে ৬ বছরের ছোট একটা ছেলের প্রেম ! এও কী হয় নাকি ! এইরকম একটা শান্ত, ভদ্র শহরে ! আর সত্যি কী প্রেম - ভালবাসা ছিল নাকি ওদের মধ্যে ! কী যে ছিল সেটাই তো ঠিকমত জানতে পারে না কেউ। রিতার বাবা-মা-ভাই অথবা রাশেদের বাবা-মা -বোন, কেউই না।
তবে শেষ পর্যন্ত যা ঘটলো সেটাই সবাই আশা করছিলো। এতে অবশ্য প্রতিবেশীদের আশাভঙ্গঁ ঘটলো - কেননা মশলাদার কোন ঘটনা নিয়ে কয়েকদিনব্যাপী জাবর কাটা গেলনা।
মিনার সাথে ধুমধাম করে রাজিবের বিয়ে হয়ে গেল। আর অবশ্যই এর আগে রিতার বিয়ে হয়ে গেল এক ঢাকাবাসী চাকরিজীবির সাথে। রিতা আর রাজিবের মধ্যে যে সবার-কাছে-অস্পষ্ট সম্পর্ক ছিলো সেটা একদম হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।
সবকিছু সুসম্পন্ন হওয়ার হওয়ার কয়েক মাস পরে যখন রাশেদ বুয়েট, মেডিকেল আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে একটাতেও উত্তীর্ণ হতে পারলো না তখন রাশেদের বাবা এর কারণ জানতে চাইলে রাশেদ শুধু ম্লান চোখ মেলে তাকিয়ে রইলো তাঁর দিকে, কোন উত্তর দিতে পারলো না। শেষ হলো রাশেদের জীবনের একটা ছোট অধ্যায়। তখন অবশ্য রাশেদ জানতো না যে এই অধ্যায় আসলে শেষ হয়েও হলো না শেষ।
৭.
বসে আছি দিয়া আর ওর বান্ধবীর সাথে, দিয়ার রুমে, গল্প করলাম ওদের সাথে। আজকে দিয়ার জন্মদিন। ’রি’ আর বিশেষ করে তৌহিদ ভাইকে এড়াতেই আসতে চাইনি। কিন্তু দিয়ার জন্য না এসে পারলাম না। গিফ্ট দিয়ে চলে যাবো ভাবছিলাম, তৌহিদ ভাই যেতে দিলেন না। থেকে যাবার আরো একটা কারণ অবশ্য আছে। মিনা আর রাজিব ভাইও আসবে আজ - একই শহরে থেকেও বোনটার সাথে দেখা হয়না অনেকদিন।
ওরা অবশ্য এখনও এসে পৌঁছেনি। দিয়ার রুমে ওর বন্ধু-বান্ধবদের সাথে এতক্ষণ জমিয়ে আড্ডা দিলাম বাচ্চাদের মতোই। এই কাজটা আমি খুব ভালো পারি। আর এ জন্য বাচ্চারাও বোধহয় সহজেই আমার ভক্ত হয়ে পড়ে। দিয়া অবশ্য ওর বন্ধুদের সাথে আমার এত খাতির পছন্দ করছে না বুঝতে পারছি - মেয়েটা ওর মার মতই হিংসুটে হয়েছে দেখছি। এই মিলটা দেখে হাসি পায আমার।
’রি’ আমার সাথে কথা বলার সুযোগ খুঁজছে, বুঝতে পারছি। এই সুযোগটা আমি ওকে দিতে চাই না। খুব অভিমান হয় আমার। কিন্তু ওরই বা কী দোষ ছিল ! কীই বা করতে পারতাম আমি অথবা ’রি’। ওর কী কখনো মনে পড়ে অনেক অনেক বছর আগের সেই দিনের কথা ! আমাদের নিজস্ব গোপন দুপুর, বিকালের কথা ! মনে তো হয় না ! সব ভুলে কী সুন্দর সংসার করছে !
কীসব ভাবছি আমি। ’রি’ ভাল থাকবে, সুখে থাকবে এটাই তো সবসময় চাই আমি। আমার শুধু একটাই আশংকা - দিয়া যদি কখনো বুঝতে পারে কিছু !
আর কোন জটিলতায় জড়াতে চাই না আমি। সেদিন ’রি’ ফোনে জানতে চাইছিল আমি ওকে একটু সময় দিতে পারবো কিনা। কেন তা জানতে না চেয়েই বলে দিলাম আমার সময় নেই। আমি আর কখনোই পুরোনো সেই দিনগুলিতে ফিরে যেতে চাই না।
৮.
ঈদের রাত। রাত দশটা। রাশেদ ওর ঘরে। দিয়া সমানে কথা বলে যাচ্ছে। রাশেদের এদিকে কোন মনোযোগ নেই। সে বুঝতে পারছে না রিতা কেন এখনো ওর বাসায় ফিরে যাচ্ছেনা। রিতার উপস্থিতিতে যেকোনো কাজ পুরোপুরি নির্বিকার, স্বাভাবিকভাবে করা ওর জন্য কষ্টকর। কী এত গল্প করছে রিতা ওর মার সাথে - ভাবে রাশেদ। সে কান পেতে শোনার আর বোঝার চেষ্টা করে।
’রাশেদ মামা, তোমার কী গার্লফ্রেন্ড আছে ?’
’আছে না ! আমার ক্লাসে কত মেয়ে ছিল !’
’না না , ওইরকম ফ্রেন্ড না তো! আমাদের ক্লাসের মিতি আর নাফিজের যেরকম ...তোমাকে বললাম না একবার ...সেরকম !’
’সেটা আবার কী রকম বন্ধুত্ব !’
’আহ্ রাশেদমামা ! তুমি বুঝেও না বুঝার ভান করো কেন! বলো না ! আছে তোমার সেরকম কেউ !’
হঠাৎ করেই রাশেদ বুঝতে পারে না কেন ও অস্বস্তিবোধ করে ! দিয়ার কথা বলার ভঙ্গি বা সুরের মধ্যে কিছু একটা ছিল কী ! রাশেদ ভাল করে তাকায় - দিয়ার চোখে, মুখে কিছু একটা খোঁজে - ভয় নিয়ে, শঙকা নিয়ে। কিছু একটা কী অনুভব করে ! হঠাৎ যেন কিছু একটা বুঝতে পারে সে ! আবার বুঝতে পারেও না ! একটু বিভ্রান্ত চোখে তাকায় সে দিয়ার চোখের দিকে। দিয়ার দৃষ্টিটা কী একটু অন্যরকম ! তা কী করে হয় ! এ তো অসম্ভব ! কিন্তু ওইরকম দৃষ্টি সে কবে কোথায় যেন দেখেছে ?! কী করে এমন হলো ! কবে এমন হলো ! সে কী চোখ বন্ধ করে ছিল এতদিন ! দিয়া কী এতোটা বড় হয়েছে ! সে কী কোন ভুল করেছে কখনো ! নিশ্চয়ই এটা ওর মনের ভুল। ’নাহ্ ! মাথাটা গেছে একেবারে’। ব্যপারটা ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করতে গিয়ে দিয়াকে মৃদু বকা দেয় রাশেদ।
’এইখান থেকে যা তো এখন। নাহলে মাইর খাবি !’
’যাবনা। কী করবা তুমি !’
’দিয়া ! সত্যি সত্যি মারবো কিন্তু। মেজাজ খারাপ করে দিস না।’
মুহূর্তে দিয়া একটু দূরে সরে যায়, যেমন করে সবসময়, দুষ্টামি করে......
’ইশ ! আমাকে ধরতে পারবা তুমি !’
এইবার রাশেদের একটু স্বস্তি পায়। এইতো তার পরিচিত দিয়া !
’তোকে ধরা কোন ব্যাপার !’
রাশেদ হাত বাড়িয়ে দিয়াকে ধরতে যায় । আর কী আশ্চর্য ! এই প্রথম দিয়া নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা তো করেই না বরং যেন নিজে থেকেই জড়িযে যায় রাশেদের হাতে। আর কী হয় কে জানে, বিদ্যুৎ¯পৃষ্টের মত উঠে দাঁড়ায় রাশেদ। পেছনে মা বা রিতা.কে কী বললো ঠিকমত না শুনেই বেরিয়ে যায় বাসা থেকে। মাথার মধ্যেটা একেবারে ফাঁকা। উদভ্রান্তের মত হাঁটে রাশেদ। পথচারী একজন, দুইজনের গায়ে ধাক্কা লাগে, ঠিক সামনে একটা মিনিবাস থামে, গালি দিয়ে ওঠে ড্রাইভার। কোনো কিছুই কানে যায় না। রাশেদ হাঁটে, অন্ধের মতো।
পৃথিবীটা নাকি রঙ্গমঞ্চ। মানুষের জীবন নাকি বড়মাপের নাটক। আর মানুষগুলো নাকি সব অভিনেতা-অভিনেত্রী। তাহলে রঙ্গমঞ্চ থেকে কী কোনোভাবে বের হওয়া যায় না ! নিজের চরিত্র বদলে নিয়ে কী অন্য চরিত্রে অভিনয় করা যায় না ! অথবা কাহিনী পছন্দ না হলে কী কাহিনী বদলে দেয়া যায় না ! যেমনটা হয় টেলিভিশনের নাটকে ! রাশেদ ভেবে ভেবে আকুল হয় !
হাঁটতে হাঁটতে অনেকদূর চলে আসে রাশেদ। অনেক রাত হয়ে যায়। রাতের রাস্তায় রাশেদ হাঁটে। হাঁটতে থাকে। হাঁটতেই থাকে।
২৩/০৭/০৯
মন্তব্য
আরো একটি দারুণ গল্প...।
যদিও কোনো নিককে আসল নাম জিজ্ঞেস করা নেটিকেটের সঙ্গে যায় না, তবুও জিজ্ঞেস করি, আপনি কি আগে কোথাও লিখতেন? অন্য কোনো নামে?
কিছু টাইপো আছে লেখায়, হয়তো তাড়াহুড়ার জন্য...
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
নাহ্ আমি আর কোথাও গল্প বা ফিচার বা এই জাতীয় কিছু লিখিনি। তবে অন্য একটা ফোরামে খুব অল্প কিছু সাধারণ মন্তব্য করেছিলাম বেশ আগে। গল্প লেখার চেষ্টা সচলায়তনেই প্রথম।
হ্যাঁ আমি লিখতে বসলে খুব তাড়াহুড়া করে লিখে ফেলি। এটা একটা সমস্যা আমার। এইজন্য কিছু ভুল হয়। আর বানান ভুল নিয়েও আমি খুব বিব্রত থাকি। অনেক শব্দেরই সঠিক বানান কী হবে বুঝতে পারিনা।
ভাল লাগল।
ধন্যবাদ আপনাকে।
চমৎকার লাগলো, আরো লিখুন।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
গল্পের ঢং-টা বেশ গুছানো। বড় হলেও একটানে পড়া গেছে। ভালো লেগেছে।
---------------------------------------------------------------------------
- আমি ভালোবাসি মেঘ। যে মেঘেরা উড়ে যায় এই ওখানে- ওই সেখানে।সত্যি, কী বিস্ময়কর ওই মেঘদল !!!
ধন্যবাদ আপনাকে।
আপনি তো দেখছি পাকা গল্পলেখক! ভালো লাগলো, খুব!
অনেক ধন্যবাদ....বিশেষ করে এইরকম একটা সহৃদয় প্রশংসার (যার যোগ্য আমি না মোটেও) জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
খুব সাবলীল লেখা, এক টানে পড়লাম, সব যেন চোখের সামনে দেখতে পেলাম, খুব ভালো লাগলো, তা ভাইজান, এভাবে শীত নিদ্রায় যান কেন? আরেকটু ঘন ঘন লেখলে পারেন। আপনার মত লেখকের লেখা পড়ার জন্যে হা করে বসে থাকি। আশা করি শীঘ্রই লেখা দিবেন আবার
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী
ভাই সাইফ তাহসিন, আপনার মতো একজন সহজ, স্বচ্ছন্দ, সাবলীল লেখনীর লেখক যখন এভাবে প্রশংসা করেন, লজ্জা পেয়ে যাই ! আমি তো খুব একটা ভালো লিখতে পারিনা। অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনার সহৃদয় মন্তব্যের জন্য।
আসলে লিখতে ইচ্ছা করলেও প্রতিদিন কীসব কাজে আর ঝামেলায় দিন কেটে যায় টের পাই না।
আর.....ইয়ে...মানে...আমি কিন্তু ’ভাইজান’ না...’আপু’....মানে আপা বা আপু বলতে পারেন আর কী...! অবশ্য ’ভাইজান’ বললেই বা কী ! সম্বোধনে কী আসে যায় !
বড়ই লজ্জিত আপু, আপনে কিন্তু সদস্য পরিচয়ে কিছুই দেননি, একটু কষ্ট করে কিছু তথ্য দিলে এমন ভুল হতো না , নিজের দোষ পরের ঘাড়ে চাপালাম , মাইন্ড খাইয়েন না আপু। অবশ্য পরিচয় দিতে না চাওয়াটাও আপনার একান্ত ব্যাক্তিগত ব্যাপার লেখার মান অনুযায়ী প্রশংসা, এটা আপনার ৩য় লেখা না?
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী
আরে না না ! মাইন্ড খাবো কেন ! এইটা কোনো ব্যাপারই না রে ভাই ! আমার তো বরং মজাই লাগসে ’ভাইজান’ দেখে !
হুম, সদস্য পরিচয়ে কিছু লেখা হয়নি তবে এর আগের স্মৃতিচারণটায় (’একটা সাধারণ স্মৃতি’) কিছু কথা বলা হয়ে গেছে অবশ্য।
হ্যাঁ, এটা আমার তৃতীয় গল্প ও চতুর্থ লেখা। লেখার মান বোধহয় তাহলে একটু বাড়াতে পারা গেছে ! অনেক ধন্যবাদ।
একেবারে মুগ্ধ করে দিলেন!
চমৎকার লাগল আপনার লেখা----
শুভকামনা রইল!!
অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
খুব ভাল লেগেছে!
----------------------------
হতাশাবাদীর হতাশাব্যঞ্জক হতশ্বাস!
-------------------------------------------------------------
জীবন অর্থহীন, শোন হে অর্বাচীন...
অনেক ধন্যবাদ ।
ভালো লাগলো।
ধন্যবাদ আপনাকে।
সুন্দর গল্প/
--------------------------------------------
"নিভন্ত এই চুল্লিতে মা
একটু আগুন দে
আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি
বাঁচার আনন্দে৷'
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
খুব সুন্দর... বড় হলেও পড়তে সমস্যা হলনা... আরও অনেক লিখুন।
--------------------------------
কাঠবেড়ালি! তুমি মর! তুমি কচু খাও!!
**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।
মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
আপনার গল্পগুলো আমার কেন যেন সত্যি সত্যি মনে হয়।
এটার প্রথম দিকেও তাই মনে হচ্ছিলো।
ভালো লেগেছে অনেক।
...........................
সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
তাই !
অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
দারুন সাবলীল আপনার লেখার ভংগী। আর সেই সাথে দারুন গুছানো গল্পের প্লট
আমি দেখি আপনার নিয়মিত পাঠক হয়ে যাচ্ছি
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
নিবিড়, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
উফ! মিরপুর রোড। জ্যামের ভয়ে ওই রোডে আর যাই না।
গল্পটা দারুণ। আমি এখন থেকে আপনাকে নিয়মিত ফলো করবো।
দুঃখিত, নিজের লেখার মন্তব্যে অনেকদিন ফেরত আসা হয়নি, তাই জবাবও দেয়া হয়নি। লেখা পড়ার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।
দিদির লেখাগুলো খুব বাস্তব মনে হয়। খুবই বাস্তব।
যেন নিজের সাথে ঘটে গেছে!!
দিদি কি হারিয়ে গেলেন? আর লেখা দেখি না যে???
-বৃদ্ধ কিশোর
নতুন মন্তব্য করুন