গভীর রাতে আচমকা ঘুম ভেঙে গেল। কোনো কারণ নাই, তবুও ঘুম ভেঙে গেল। শব্দ বলতে আছে শুধু বাতাসের সর সর শব্দ, আলো বলতে আছে শুধু ডুবে যাওয়া চঁদের রেখে যাওয়া প্রায়ান্ধকার আলো, তারপরও ঘুম ভেঙে গেল।
নাজনীন এমনভাবে চোখ মেলে যেন সে এতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলো না, কোনো কিছুর অপেক্ষায় চোখ বন্ধ করে ছিলো শুধু। ডান কাতে শুয়ে ছিলো সে। ডানদিকেই দরজা। খোলা। চাপা, ঝিম ধরানো আলো। বারান্দায় এসে পড়া গাছের বড় ডালটা দুলছে বাতাসে, নড়ছে তার ছায়া, কীসের যেন ইশারা, রহস্যময়। ডানদিকেই মোবাইল ফোনটা। ক’টা বাজে দেখতে গিয়ে নাজনীন দেখতে পায় একটা মেসেজ এসেছে - ’ঘুমাও আমার পরী’। ছোট্ট মেসেজ। শিহাবের পাঠানো। আর এক সপ্তাহ পর ওদের বিয়ে।
গায়ে ওড়না জড়িয়ে মেঝেতে পা রাখতেই নাজনীন থমকে যায় একটু - ঠান্ডায়। চকচকে শীতল মেঝে। পাযে পায়ে বারান্দায়। গ্রিল লাগানো বারান্দা। হালকা শীত শীত বাতাস এসে আলতো করে শরীর ছুঁয়ে যায়। দেয়ালের আর গ্রিলের বাধায় পুরো শরীর না ছুঁতে পেরে যেন অসহিষ্ণু বাতাস। তারপর আরেকটু সাহসী। জোরালো ঝটকায় উড়িয়ে দেয় নাজনীনের কাঁধের নিচে নেমে আসা এলোমেলো লালচে কালো চুল। ওড়না ওড়ে পাগলের মতো। নেশা ধরানো নিভু আলো, আকাশ, বাতাস। নিস্তদ্ধ, ঘুমন্ত চরাচর। সুখী, অথবা অসুখী পৃথিবী। বহু অর্থে পূর্ণ অথবা অর্থহীন জীবন। একা নাজনীন খোলা বারান্দায়। যতদূর চোখ যায় - পড়ে থাকা অপার শূন্যতা হাহাকার করে ডাকে - আয় আয়। কীসের তীব্র আকাংক্ষায় রাতের বাতাস কেঁপে কেঁপে বারবার ছুঁয়ে দিয়ে যায়।
নাজনীন পেছন ফেরে তবুও। ছোট ছোট, কিছুটা এলোমেলো পায়ে নিজের ঘর পেরিয়ে বের হতেই সামনে বড় ডাইনিং টেবিল। বাবা মার ঘর। সামান্য খোলা। ভাইয়া ভাবীর ঘর। বন্ধ। বসার ঘর। সোফা। ছোট টেবিল। টিভি। পর্দা। জিরো পাওয়ারের লাইটের হালকা নীল আলো। পায়ে পায়ে এগিয়ে রান্নাঘর। অন্ধকারে সয়ে গেছে চোখ। যদিও সে চোখে যেন শূন্যতা । মাথা ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকাতেই আবছা অবয়ব। দেয়ালে ঝোলানো চাবি। ছাদের ডুপ্লিকেট চাবি। চাবিটা হাতে নিয়ে এর শীতলতা অনুভব করে নাজনীন। মুঠিতে চেপে রাখে।
দরজার লক খুলে যায় খুট্ শব্দ করে। সিঁড়িতে আলো নাই। অন্ধকারে পা টেনে টেনে কেমন জড় পদার্থের মতো সিঁড়ি ভাঙে নাজনীন - ভাবলেশহীন। উঠতে উঠতে অবশেষে ছাদের বন্ধ দরজার সামনে। দরজায় তালা আটকানো। হাতের মুঠিতে ধরে রাখা চাবিটা একবার চোখের সামনে ধরে নাজনীন - অযথাই। তালা খুলে দিতেই হা হা করে হিমেল বাতাস এসে জাপটে ধরে - যেন আর অপেক্ষা সইছিল না। খসখসে ছাদের মাঝে। তবে পরিষ্কার। নিয়মিত ঝাঁট দেওয়া। সারি সারি টব। রকমারি ফুল আর পাতা। ওদের মাঝ দিয়ে নাজনীন হেঁটে যায়। ওরা ডাকে বারবার আকুল সুরে - যেও না মেয়ে, আমাদের ফেলে যেওনা। নির্বিকার নাজনীন। নেশাগ্রস্ত নাজনীন, অথবা স্বাভাবিক নাজনীন। হেঁটে হেঁটে অবশেষে ছাদের কিনারায়।
কী বিশাল আকাশ। নাজনীন চেয়ে থাকে নির্ণিমেষ। যেন এই আকাশ আর সে কখনো দেখেনি । কী ভাবে নাজনীন ! কোনো দুঃখের কথা ? কোনো হতাশার কথা ? কোনো আনন্দের কথা ? অথবা কোনো কিছু ভাবে কী ! বাতাস এসে লুটোপুটি খায় নাজনীনের গায়ে। তবে পায়ের অংশটুকু অধরাই রয়ে যায় ইঁট সিমেন্টের বাধায় । বুঝিবা সে কারণেই নাজনীন উঠে দাঁড়ায় ওপরে। এবার প্রবল উল্লাসে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাতাস। চুল ওড়ে। ওড়না ওড়ে। নাজনীন দাঁড়িয়ে থাকে স্থির - যেনবা সম্মোহিত। সময় বয়ে যায়। আর আচমকা এক ঝটকায় খসে যায় ওড়না। উড়ে উড়ে যেন হারিয়ে যেতে চায় দূরে কোথাও। নাজনীন এসব দেখে। আর ওড়নাকে ধরতেই কী, না কী বিশাল কালো আকাশের সম্মোহনে, না কী কালো পিচের রাস্তার অবিরাম ডাকে সাড়া দিতে, না কী বাতাসের কাছে নিজেকে পুরোপুরি সমর্পিত করতেই হাওয়ায় গা ভাসিযে দেয় নাজনীন। কালো রাস্তা হা করে থাকে অজগরের মতো। চুম্বকের মতো টেনে নিতে থাকে নাজনীনের হালকা শরীরটাকে। আর যেন বা সান্ত্বণা দিতেই পরম আদরে ওকে জড়িয়ে রাখে রেশমী বাতাস। চেয়ে চেয়ে দেখে নড়েচড়ে ওঠা সচকিত গাছের পাতারা, রাতজাগা পাখিরা। স্তব্ধ অপেক্ষায় চাপা আলো-আঁধার মাখা আকাশ।
মন্তব্য
বইখাতাপু, আবারো দুর্দান্ত একটা লেখা দিলেন, তবে ছাদের চাবি নিতে শুনেই কেমোন সন্দেহ হয়েছিল। শেষটা খুব চমৎকার হয়েছে, পুরো ঘটনাটা যেন স্লোমোশনে দেখতে পেলাম।
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদ্বপি গরীয়সী
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী
সত্যি কী তেমন ভালো হয়েছে ! জানিনা।
কিছুটা বিক্ষিপ্ত মনে খুব অল্প সময়ে এক টানে যা মনে আসে লিখে গেছি দ্রুত। সহৃদয় প্রশংসা করলেন, কৃতজ্ঞতা।
ধন্যবাদ আপনাকে। ভালো থাকবেন।
এখনতো দেখতেসি কারোই কিছু ভালো লাগতাসে না। সবারই সুইসাইড খাইবার মনচায়...
---- মনজুর এলাহী ----
হুম ! আজব না !
আহ্ একদম ডায়ালগ ছাড়া নাটক
.........................................
I think what I think because that's how I am. You think what you think because that's how you are.
...........................
Every Picture Tells a Story
ধন্যবাদ আপনাকে।
গল্পটা ভালো লাগছে, খুব।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
এখনও বড় হননি তাহলে !
গল্প ভালো লাগছে জেনে আমারও ভালো লাগলো। ধন্যবাদ আপনাকে।
চমৎকার!
-------------------------------------------------------------
স্বপ্ন দিয়ে জীবন গড়া, কেড়ে নিলে যাব মারা!
-------------------------------------------------------------
জীবন অর্থহীন, শোন হে অর্বাচীন...
ধন্যবাদ ।
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
ধন্যবাদ নিবিড়।
চমত্---- কার!!!!!!!1
*তিথীডোর
ধন্যবাদ ।
ভীষণ ভীষণ ভালো লাগলো।
গল্পটার সাথে শিরোনামটা খুবই চমৎকার লাগছে।
...........................
কেউ আমাকে সরল পেয়ে বানিয়ে গেছে জটিল মানুষ
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
অনেকদিন পর দেখলাম আপনাকে সচলায়তনে। আপনার লেখা মিস্ করেছি।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
... তয় ডিটেকটিভ গল্পের ভাষায় কইলে "মোটিভ" পরিষ্কার হৈলো না।
_________________________________________
সেরিওজা
ধন্যবাদ সুহান।
আসলে মোটিভ আমিও পরিষ্কার জানিনা ! তাই লিখতে পারলাম না।
বাহ্, ভালো লাগলো খুব! কত্তরকম কিছু ভেবে নেয়ার সুযোগ রয়ে গেলো পাঠকের জন্য!
[অন্য প্রসঙ্গঃ আপনার নিকটা আমার দারুণ লাগে ]
কতশত কারণেই তো চলে যেতে ইচ্ছা করে। তাই যারা এই লেখা পড়বেন, তাদের কাছেই পছন্দসই কারণ বেছে নেবার ভার দিয়েছি।
[অন্যপ্রসঙ্গে: তাই ! জেনে ভালো লাগলো খুব। :)]
বইখাতা, খুব ভালো লাগলো। রেশমী বাতাসের নেশা লেগে গেল।
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
অদ্ভুত ভাল৷ নেশা ধরানো ভাল৷
এর আগে লগিন না করা অবস্থায় আপনার দুইখান লেখা পড়েছিলাম, মন্তব্য করা হয় নি৷ সেগুলোও খুব ভাল লেগেছিল৷ সত্যি বলতে কি প্রথম পাতায় আপনার ব্লগ দেখলেই ঝাঁপিয়ে ঢুকে পড়ে ফেলি৷
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
তাই ! জেনে অবাক হয়েছি এবং খুব আনন্দিতও হয়েছি।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
খুব ভাল হয়েছে। শিরোনামটা দারুণ লেগেছে।
ধন্যবাদ আপনাকে ।
লেখাটা ভাল লাগলো, কিন্তু গল্পটা নিয়ে ভাবছিলাম। একটা প্রশ্ন ঘুরছে মাথায়- কেন?
-----------------------------------
আমার জানলা দিয়ে একটু খানি আকাশ দেখা যায়-
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
ধন্যবাদ আপনাকে। এই 'কেন'-র উত্তর আসলে কয়েকটা হতে পারে। কিন্তু কোনো একটা নির্দিষ্ট উত্তর বেছে নিতে বা সবগুলি উত্তর এই লেখায় আমার বলতে ইচ্ছা করেনি - যখন লিখেছিলাম। তাই গল্পে কোনো উত্তর নাই।
কেন?
কেন নয়?
"অর্থ নয়, কীর্তি নয়, আরও এক বিপন্ন বিষ্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে
আমাদের ক্লান্ত করে, ক্লান্ত - ক্লান্ত করে।"
=======================
যদি আমি চলে যাই নক্ষত্রের পারে —
জানি আমি, তুমি আর আসিবে না খুঁজিতে আমারে!
=======================
কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার;
আহা, পঞ্চমীর জোৎস্নায় নাজনীনও বুঝি ভূত দেখেছিল; যে জীবন দোয়েলের, যে জীবন ফড়িঙ্গের, তাই কি সে পেতে চেয়েছিল? তবে বিয়ের মাত্র এক সপ্তাহ আগে ও ছাদ থেকে একেবারে লাফিয়ে পড়ল! শিহাব বেচারার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি না, জীবনানন্দ বাবুর কবিতা কি তাকে সান্তনা দিতে পারবে?
--চিরায়ত পাঠক
মনে হয় না।
মানুষের মন বড় জটিল জিনিস।
নতুন মন্তব্য করুন